এ এইচ মোফাজ্জল করিম ১৯৬৬ সালে তৎকালীন পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসের কর্মকর্তা হিসেবে সরকারি প্রশাসনে চাকরিজীবন শুরু করে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে দায়িত্ব পালন করেন। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ এবং নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিব ছিলেন। তিনি ইংল্যান্ডে বাংলাদেশের হাইকমিশনার হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ– অবচেতনে রাজাধিরাজ, মুমূর্ষু বিকেল, জীবন মৃত্যু পায়ের ভৃত্য ইত্যাদি। আলাওল সাহিত্য পুরস্কারসহ বেশ কিছু সাহিত্য পুরস্কারে ভূষিত এ এইচ মোফাজ্জল করিম মৌলভীবাজারের কুলাউড়ার ভাটেরা ইউনিয়নের বেড়কুঁড়ী গ্রামে ১৯৪১ সালে জন্মগ্রহণ করেন। সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছেন সমকালের সহকারী সম্পাদক সাইফুর রহমান তপন।
সমকাল: সরকারি কর্মকর্তাদের অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে যে ব্যাপক আলোচনা চলছে, সে বিষয়ে আপনার প্রাথমিক পর্যবেক্ষণ কী?
মোফাজ্জল করিম: আমি দীর্ঘদিন সরকারি চাকরি করেছি। ১৯৬৩ সালে আমি একজন তরুণ প্রভাষক হিসেবে সরকারি মুরারিচাঁদ (এমসি) কলেজে যোগদান করি। তার তিন বছর পর তৎকালীন পাকিস্তানে সিএসপি অফিসার হিসেবে যোগদান করি। সব মিলিয়ে প্রায় ৪০ বছর সরকারি চাকরি করেছি। এই দীর্ঘ অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, দেশের প্রশাসনে এত দুরবস্থা আগে কখনও আমার চোখে পড়েনি। অনেকেই সুশাসনের কথা বলেন। তার আগে গুরুত্বপূর্ণ হলো প্রশাসনকে ঠিকঠাক গড়ে তোলা। বর্তমানে সবাই যেমন খুশি তেমন চলছে। তবে প্রশাসনের এই অবস্থা এক-দুই দিনে হয়নি। দুর্নীতি একসময় চারাগাছ হিসেবে ছিল; সেটা এখন মহিরুহে রূপ নিয়েছে। প্রশাসনের সব জায়গা এখন দূষিত। দুর্নীতি সব সময় কম-বেশি সবখানে ছিল। কিন্তু সেটা ছিল এক আনা কিংবা দুই আনা। বর্তমানে ষোলো আনাই দুর্নীতি ঢুকে গেছে।
সমকাল: আপনার মতে, দুর্নীতি অতীতে কম ছিল?
মোফাজ্জল করিম: আগে বলা হতো, শতকরা ১০ জন দুর্নীতিবাজ, বাকি ৯০ জন সৎ। বর্তমানে আমরা সমাজে ঠিক উল্টো চিত্রই দেখছি। শতকরা ৯০ জনই এখন দুর্নীতিবাজ এবং বাকি ১০ জন হয়তো সৎ। যখন এই সমস্যা অঙ্কুরাবস্থায় ছিল, তখন তা উপেক্ষা করা হয়েছে। আস্তে আস্তে তা বাড়তে থাকে। এখন তা সর্বস্তরে ছড়িয়ে পড়েছে। এ পরিস্থিতিতেও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। বুঝে কিংবা না বুঝে আমরা বলি, দু্র্নীতির প্রতি জিরো টলারেন্স। তবে আমি আশা করি, যারা এ কথা বলেন, তারা এর মর্মার্থ বুঝেই বলেন।
সমকাল: সরকার দাবি করছে, তারা দুর্নীতিতে জড়িত কাউকে ছাড় দিচ্ছে না। আপনার কী মত?
মোফাজ্জল করিম: প্রশাসনের সব স্তর এখন দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। দু-এক দিন পত্র-পত্রিকায় কিছু লেখালেখি হয়, তারপর সবকিছু মুছে যায়। অথচ প্রাথমিক পর্যায়ে বড় বড় প্রশাসন, ব্যাংক খাত ও ব্যবসায় ক্ষেত্রে দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হলে বর্তমানে এমন পরিস্থিতি দাঁড়াত না। বেনজীর আহমেদ বা মতিউর যে ধরনের দুর্নীতি করেছেন, পৃথিবীর ইতিহাসে এ ধরনের নজির আছে কিনা, আমার সন্দেহ। এ ব্যাপারেও সরকারের তৎপরতা দু’দিন পরে হাওয়া হয়ে যেতে পারে। ১৫ লাখ টাকা দিয়ে ছাগল কিনলে কিংবা কোটি কোটি টাকা দিয়ে গুলশান-বনানীতে ফ্ল্যাট কিনলে তা কারও চোখে না পড়ার কথা নয়। এ রকম কাণ্ডে বিভাগীয় তদন্ত করব বলে পাঁচ-সাত বছর কাটিয়ে দেব; এরই মধ্যে লোকজন ঘটনা ভুলে যাবে– এর কোনো মানে নেই। আপনারা দুদককে আগামী এত দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলুন। দোষীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিয়ে শিগগির শাস্তি দিন। এতে দেশের লাখ লাখ বাকি সরকারি ছোট, বড়, মধ্যম কর্মকর্তা কিছুটা হলেও শঙ্কিত ও সংযত হবেন। আশ্চর্য হলো, পরিস্থিতি এখন প্রশ্রয়ের পর্যায়ে চলে গেছে।
সমকাল: মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেছেন, তারা অনিয়মে জড়িত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় পদক্ষেপ নেন। প্রশাসনে কাজ করার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা থেকে আপনি কী বলবেন এ বিষয়ে?
মোফাজ্জল করিম: মন্ত্রিপরিষদ সচিবের এ কথায় দেশের মানুষের আশ্বস্ত হওয়ার সুযোগ নেই। মন্ত্রণালয়ের বিভাগীয় পদক্ষেপ এতই দীর্ঘ একটি প্রক্রিয়া, তাতে ফল তেমন মেলে না। আমার কথা হলো, বিভাগীয় পদক্ষেপ নিন। তবে যখনই একজন অভিযুক্ত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে চার্জশিট দেওয়া হবে, তখনই অবিলম্বে তাঁকে চাকরিচ্যুত করুন। আদালতের বিচার প্রক্রিয়ায় সহযোগিতা করুন।
সমকাল: একটি নির্দিষ্ট সময় পরপর সরকারি কর্মকর্তাদের সম্পদের হিসাব দিতে বলা হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে এ নিয়ম প্রশাসনের চাপে শিথিল করা হচ্ছে বলে জানা গেছে।
মোফাজ্জল করিম: সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে যাদের কোটি কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে, প্রতিবছর বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদনের সঙ্গে তাদের বার্ষিক আয়-ব্যয়ের হিসাবটাও দিতে হবে। প্রতিবেদনে তাদের অর্জিত সম্পদের পরিমাণ নিয়মিত অবহিত করতে হবে। বর্তমানে প্রশাসনে অপেশাদারিত্ব দেখার কেউ নেই। দেশে এমন একটি সংস্থা থাকবে, যা সরকারি কর্মকর্তাদের পেছনে লেগে থাকবে, যাতে তারা কোনোভাবে দুর্নীতি করার প্রশ্রয় না পান। এতদিন বেনজীর, মতিউর গং এত কিছু করল, অবশেষে সেটা সাংবাদিকদের খুঁজে বের করতে হলো কেন? প্রশাসনিক স্বচ্ছতা থাকলে এ পরিস্থিতি তৈরি হতো না। একজন সাংবাদিক জীবনের ঝুঁকি নিয়ে একজন ১০০ কোটি টাকার মালিকের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান চালিয়ে প্রতিবেদন ছাপান। এই ঝুঁকি কেন তাঁকে নিতে হবে? আপনারা যে হাজার কোটি টাকা খরচ করে নানা তদন্ত সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেছেন, এগুলোর কাজ কী? এসব প্রতিষ্ঠান থেকেই তো প্রতিবেদন আসা উচিত ছিল।
সমকাল: সরকারি কর্মকর্তারা বলেন, প্রতিবছর আমরা আয়কর রিটার্নে সম্পদের হিসাব দিয়ে থাকি। নতুন করে আবার সম্পদের হিসাব দিতে হবে কেন?
মোফাজ্জল করিম: আমাদের লক্ষ্য করতে হবে, বেনজীর করের হিসাব দেন মতিউরের কাছে। সুতরাং পরিস্থিতি কী দাঁড়াবে, তা সহজেই বুঝতে পারছেন। সে জন্যই একটা তৃতীয় পক্ষ দরকার, যারা বিষয়গুলো যথাযথভাবে তদারক করবে। আর সেই সরিষার মধ্যেই যদি ভূত ঢুকে থাকে, তাহলে কী করার আছে! তবুও ব্যবস্থাটি চালু করার দরকার।
সমকাল: অধস্তন কর্মকর্তাদের দুর্নীতি কি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নজরে পড়ে না?
মোফাজ্জল করিম: বড় বড় দুর্নীতি একে অপরের সঙ্গে হাত মিলিয়ে সংঘটিত হয়। সচিব ও তাঁর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা মন্ত্রী যদি দুর্নীতিমুক্ত থাকেন, তাহলে ওই অফিসের ৯০ শতাংশ লোক সৎ থাকবেন। এ রকম অবস্থায় অফিসের সর্বস্তরের কর্মকর্তার কাছে এই বার্তা যায়– তাদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা অত্যন্ত সৎ ও কড়া লোক। তিনি কাউকে ছাড় দেন না। আমরা যখন সরকারি কর্মকর্তা ছিলাম তখন বেশির ভাগ লোক সুনামের সঙ্গেই অবসরে যেতেন। কথায় আছে– মাথায় পচন ধরলে শরীরের সব জায়গায় পচন ধরে। আমার এখন ভয় হয়, সমাজের শীর্ষস্তরে কি পচন ধরেছে?
সমকাল: বলা হয়ে থাকে, রাজনীতিবিদরা সচিবদের কাছে মন্ত্রণালয়ের সব ক্ষমতা ছেড়ে দেন বলেই আমলারা দুর্নীতিতে এমনভাবে জড়িয়ে পড়ছেন। এ ব্যাপারে আপনার অভিজ্ঞতা কেমন?
মোফাজ্জল করিম: সচিব তাঁর প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করবেন। অন্যদিকে রাজনৈতিক আদর্শ ও নৈতিক জায়গা থেকে মন্ত্রী তাঁর দায়িত্ব পালন করবেন। উভয়ে নিজেদের দায়িত্ব সৎভাবে সম্পন্ন করবেন। কিন্তু এখানে ব্যক্তিগত সততা না থাকাই সবচেয়ে বড় ভয়।
সমকাল: অনেকে বলছেন, দুর্নীতি দমন কমিশন ঠিকঠাক কাজ করছে না বলেই এত দুর্নীতি হচ্ছে।
মোফাজ্জল করিম: দুর্নীতি দমনের জন্য আমরা শুধু দুদককে দায়িত্ব দিয়ে দিলাম। তারা তদন্ত শেষ করে একটি রিপোর্ট জমা দেয়। এরপর ঘটনাটি হাওয়া হয়ে যায়। অনুল্লেখযোগ্য দু-একজনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নজির আছে বটে, কিন্তু যারা পুরো প্রশাসনকে নষ্ট করছে, কলুষিত করছে, সেসব রাঘববোয়ালের বিরুদ্ধে কি ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে? আমি বলব, বছরে অন্তত দু-চারটা রাঘববোয়ালকে শাস্তির কাঠগড়ায় নিয়ে আসুন। তাতে প্রশাসনে কিছুটা হলেও পরিবর্তন দেখা দিতে পারে।
সমকাল: দুদক নিজেই অসহায়ত্ব প্রকাশ করছে। এ ক্ষেত্রে আপনার মতামত কী?
মোফাজ্জল করিম: দুদক অসহায়ত্ব প্রকাশ করলে চলবে না। কারণ এটি একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান, যা কারও অধীনে নয়। এটি আলাদা একটি কমিশন; কোনো বিভাগও নয়। যদি তারা কাজ করতে গিয়ে বাধাগ্রস্ত হয় কিংবা হুমকি-ধমকি পায়, সেটা আপনারা পত্র-পত্রিকায় তুলে ধরুন। আর তারাও আপনাদের কাছে বিষয়গুলো জানিয়ে দিক। তাহলে পরিস্থিতি সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষের কাছে ন্যস্ত হবে। তারপরও যদি কোনো ব্যবস্থা গৃহীত না হয়, তাহলে এটা আমাদের দুর্ভাগ্য এবং এর ফয়সালা রাজনৈতিকভাবেই হবে বলে মনে করি।
সমকাল: এ পরিস্থিতিতে আপনার পরামর্শ কী?
মোফাজ্জল করিম: আজ পর্যন্ত সরকার দুর্নীতিবিরোধী যেসব কর্মকাণ্ড করেছে, তার সবই চমক সৃষ্টি করার লক্ষ্যে ছিল বলে আমার মনে হয়েছে। ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানের সময়ও আমরা তাই দেখেছি। আমার আহ্বান, এগুলো না করে স্থায়ী ব্যবস্থা নিন। শুধু তদন্ত নয়, এর বাস্তবায়নও জরুরি। বার্ষিকভাবে দুদকের অর্জনগুলোর হিসাব দেখা দরকার। জনগণকে এ ব্যাপারে আরও বেশি সোচ্চার হওয়া উচিত এবং কোনো কর্মকর্তা তাদের কাছে ঘুষ চাইলে তারা যেন সমঝোতায় না গিয়ে এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন। তাহলেও দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে প্রবল চাপ সৃষ্টি হবে।
সমকাল: আপনাকে ধন্যবাদ।
মোফাজ্জল করিম: সমকালকেও ধন্যবাদ।
সমকাল
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন