ইহুদি ইতিহাসবিদ আভি শ্লেইমের সাক্ষাৎকার
যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ইমেরিটাস অধ্যাপক আভি শ্লেইম। তিনি একজন ইরাকি ইহুদি, যিনি ছয় বছর বয়সে ১৯৫১ সালে সপরিবার ইসরায়েলে অভিবাসী হন। ছাত্রাবস্থায় ইসরায়েলি সেনাবাহিনীতে কিছুদিন যুক্ত ছিলেন। পরে বিলেতের রিডিং বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করেন। তাঁর রচিত বইগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো দ্য আয়রন ওয়াল: ইসরায়েল অ্যান্ড দ্য আরব ওয়ার্ল্ড, থ্রি ওয়ার্ল্ড: মেমোরিজ অব অ্যান আরব জু। তাঁকে ইসরায়েলের অন্যতম ‘রিভিশনিস্ট’ ইতিহাসবিদ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয় এ জন্য যে তিনি ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ইতিহাসসহ পরবর্তী ঘটনাক্রমকে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ব্যাখ্যা করেছেন, জায়নবাদের মিথ্যা ভাষণকে চিহ্নিত করেছেন। ফিলিস্তিনের নাকবার ৭৬ বছর উপলক্ষে ই-মেইলে তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সাংবাদিক ও লেখক আসজাদুল কিবরিয়া।
আপডেট: ১৫ মে ২০২৪, ০৯: ২১
প্রশ্ন: সাত মাসের কিছু আগে ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ফিলিস্তিনি হামাস ইসরায়েলের অভ্যন্তরে আক্রমণ চালায়। এর প্রত্যুত্তরে ইসরায়েল গাজায় সাত মাসের বেশি সময় ধরে নৃশংস যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। এতে প্রায় ৩৫ হাজার মানুষ নিহত হয়েছেন, যাঁদের প্রায় ১৩ হাজার শিশু। গাজার ৭০ শতাংশ ঘরবাড়ি ধ্বংস বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ওখানকার মানুষজন অনাহার ও অপুষ্টিতে ভুগছেন। এ অবস্থায় ফিলিস্তিনের নাকবার ও ইসরায়েলের স্বাধীনতার ৭৬ বছর উদ্যাপিত হচ্ছে। আপনি গোটা পরিস্থিতিটা কীভাবে দেখছেন?
আভি শ্লেইম: গাজার তথা ফিলিস্তিনের আজকের পরিস্থিতি বৃহত্তর ঐতিহাসিক পটভূমিতে অনুধাবন করা জরুরি।
যে যা-ই বলুক না কেন, ১৯৪৮ সালের ১৪ মে আনুষ্ঠানিকভাবে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সঙ্গে জড়িয়ে আছে ফিলিস্তিনিদের প্রতি করা বিশাল এক অবিচার। ১০ লাখ ফিলিস্তিনির মধ্যে তিন-চতুর্থাংশই শরণার্থী হয়ে পড়ে, মানচিত্র থেকে ফিলিস্তিনের নাম মুছে দেওয়া হয়। ইসরায়েলিরা একে বলে ‘স্বাধীনতাযুদ্ধ’, ফিলিস্তিনিরা বলে ‘নাকবা’ বা মহাবিপর্যয়।
ইহুদিদের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহতম ঘটনা হলো হলোকাস্ট। আর ফিলিস্তিনি জনগণেরটা হলো নাকবা। আর এই নাকবা শুধু একটি ঘটনা নয়, বরং তা হলো আজ পর্যন্ত ফিলিস্তিনিদের নিজভূমি থেকে ক্রমাগত বিতাড়ন ও অপসারণ করার নির্মম চলমান প্রক্রিয়া।
(১৯৪৮ সালের ১৪ মে ঐতিহাসিক ফিলিস্তিনের ভূমিতে জোর করে ইসরায়েল রাষ্ট্র স্থাপনের ঘোষণা দেওয়া হয়। তবে দিনটি ইহুদি ইসরায়েলিরা প্রতিবছর হিব্রু বর্ষপঞ্জি অনুসারে উদ্যাপন করে, যাকে হিব্রুতে বলে ইয়োম হা-য়াতযামুত। তাই দিনটি আন্তর্জাতিক বর্ষপঞ্জির ১৪ মে তারিখের সঙ্গে কখনো মেলে, কখনো মেলে না। কাকতালীয়ভাবে এ বছরের ১৪ মে হিব্রু বর্ষপঞ্জির অষ্টম মাস আইয়ারের ৫ তারিখের সঙ্গে মিলে গেছে। এর বিপরীতে নিজভূমি থেকে বিতাড়িত ও নিজ ভূমিতে পরাধীন ফিলিস্তিনিরা ১৫ মে তারিখে পালন করে নাকবা বা বিপর্যয়ের দিবস। আর গত বছর থেকে জাতিসংঘেও দিবসটি আনুষ্ঠানিকভাবে পালন করা হচ্ছে।)
মনে রাখতে হবে ইসরায়েল নামক ইহুদি রাষ্ট্রটির মূল পৃষ্ঠপোষক ছিল যুক্তরাজ্য। ১৯১৭ সালে ব্যালফোর ঘোষণার মাধ্যমে যার সূত্রপাত। তবে ১৯৪৮ সাল থেকে যুক্তরাজ্যকে সরিয়ে যুক্তরাষ্ট্র হয়ে ওঠে রাষ্ট্রটির প্রধান মদদদাতা।
ব্রিটিশ কর্মকর্তারা সদ্য স্বাধীন ইসরায়েলের পক্ষ নেওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের ওপর ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন বটে, তবে তাঁরাই আসলে ফিলিস্তিনকে দখলে নেওয়ার জন্য জায়নবাদীদের শক্তি ও সামর্থ্য জুগিয়েছিলেন। তারপরও আজ পর্যন্ত কোনো ব্রিটিশ সরকার কখনোই এটা স্বীকার করেনি যে তাদের কারণে ফিলিস্তিনিদের ওপর এই ভয়াবহ দুর্দশা নেমে এসেছে।
১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা এবং প্রথম আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যের আধুনিক ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ বাঁকবদল ঘটায়। কিন্তু আমি মনে করি, এই আরব-ইসরায়েল নিরন্তর সংঘাতের সূত্রপাত ঘটানো হয়েছে ১৯১৭ সালে।
ওই বছর ব্যালফোর ঘোষণার মাধ্যমে ব্রিটেন ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে ইহুদিদের জাতীয় আবাস গড়ে তোলার প্রতি সমর্থন জানায়, ফিলিস্তিনে ইহুদিদের রাজনৈতিক অধিকারকে স্বীকৃতি দেয় এবং আরবদের অধিকারকে অস্বীকার করে। ব্যালফোর ঘোষণা তো একটি ধ্রুপদি ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক দলিল। ব্রিটেনের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আর্থার জেমস ব্যালফোর তাঁদের ঔপনিবেশিক মানসিকতাকে পরিষ্কারভাবে এতে ফুটিয়ে তুলেছেন, যেখানে ওই ভূমির অধিবাসীদের ন্যূনতম স্বার্থটুকু তাঁর বিবেচনায় ছিল না।
১৯১৭ সালে তৎকালীন ফিলিস্তিন ভূখণ্ডের মোট জনগোষ্ঠীর মাত্র ১০ শতাংশ ছিল ইহুদি আর ৯০ শতাংশ আরব। মাত্র ২ শতাংশ ভূমির মালিকানা ছিল ইহুদিদের। ব্রিটেনের নেপথ্য মদদেই জায়নবাদীরা পরিকল্পিতভাবে ফিলিস্তিনের ভূমি দখল করে নিতে অগ্রসর হয় ও সফল হয়। এখন পর্যন্ত এই দখলদারি বজায় আছে। মূলত ১৯২২ থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত ফিলিস্তিন ব্রিটিশ ম্যানডেটে বা শাসনাধীনে থাকাকালেই জায়নবাদীদের জন্য সুযোগ তৈরি হয় এখানে ইহুদি রাষ্ট্র স্থাপনের। (প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষ দিকে উসমানীয় বা অটোমান সাম্রাজ্যের কাছ থেকে ফিলিস্তিন ভূখণ্ড ব্রিটিশদের অধীনে চলে যায়।)
প্রশ্ন: আপনি আপনার বিভিন্ন রচনায় ও সাক্ষাৎকারে বারবারই বলেছেন যে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডের ওপর জায়নবাদীদের দাবি নিতান্তই দুর্বল ভিত্তি এবং ১৯ শতকের বাস্তবতার অপব্যাখ্যার ওপর দাঁড়িয়ে রয়েছে। কেন?
আভি শ্লেইম: জায়নবাদীদের খুব প্রিয় বয়ান হলো—‘ভূমিহীন এক জনগোষ্ঠীর জন্য জনমানবহীন এক ভূমি’। এ দিয়ে বোঝানো হয়, ইহুদিরা হলো ভূমিহীন জনগোষ্ঠী এবং একসময় তারা তা-ই ছিলও বটে।
একই সঙ্গে এ দাবিও করা হয়, ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে কোনো মানুষ ছিল না, কোনো বসতি ছিল না, যা অসত্য। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ফিলিস্তিনের ভূমিতে একটি সুগঠিত আরব সমাজ ছিল। এ ছাড়া জায়নবাদী আন্দোলন একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক আন্দোলন। অথচ জায়নবাদীরা ধর্মভিত্তিক ঐশ্বরিক প্রতিশ্রুতিকে সামনে নিয়ে আসে—ইহুদিদের জন্য প্রতিশ্রুত ভূমি হলো ফিলিস্তিন।
একদিকে জায়নবাদীরা ঈশ্বর বিশ্বাস করে না, অন্যদিকে তারাই আবার ঈশ্বরকে বানিয়ে তুলল ভূসম্পত্তির তত্ত্বাবধায়ক, যিনি তাঁদের নির্দিষ্ট ভূমির মালিকানা প্রদানে প্রতিশ্রুতবদ্ধ হয়েছেন।
অস্ট্রিয়ান ইহুদি লেখক-সাংবাদিক থিওডোর হারজেল ছিলেন ইহুদি রাষ্ট্রের স্বপ্নদ্রষ্টা, যিনি ফিলিস্তিনের ভূমিতে এই রাষ্ট্র গঠনের জন্য তাঁর পরিকল্পনা লিখিতভাবে তুলে ধরেছিলেন। সে সময় তিনি দুজন র্যাবাই বা ইহুদি পুরোহিতকে ফিলিস্তিনে পাঠিয়েছিলেন সরেজমিন দেখে আসতে। তাঁরা ওখান থেকে টেলিগ্রাম করে হারজেলকে বলেছিলেন, ‘পাত্রী তো সুন্দরী, তবে তার যে অন্যত্র বিয়ে হয়ে গেছে!’ এই বিখ্যাত তারবার্তার মানে ছিল ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে তো অন্য লোকেরা বসবাস করছে।
প্রশ্ন: কিন্তু হিব্রু জনগোষ্ঠী বা ইহুদিদের সঙ্গে ফিলিস্তিন ভূখণ্ডের এক ঐতিহাসিক ও আবেগময় সম্পৃক্ততা রয়েছে। হিব্রু বাইবেলের ভাষ্য অনুসারে, এটা তো সেই কেনান ভূমি, যেখানে ইহুদিধর্মের সূচনা। আর তাই এ ভূমি তাদের স্বভূমি বলে ইহুদিরা দাবি করে আসছে।
আভি শ্লেইম: এ ধরনের দাবি আধুনিককালে মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়। এ কালে আন্তর্জাতিক আইন ও সংস্থা আছে, আছে বিভিন্ন রাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক সীমানা। তাই দুই হাজার বছর আগের কোনো রাষ্ট্রসীমানার বা ভূখণ্ডের দাবি তুলে তাকে কার্যকর করতে চাওয়া দুর্বল দাবি, যা অগ্রহণযোগ্যও বটে। অন্য যেকোনো সম্প্রদায়ের মানুষও তো এভাবে দুই-তিন হাজার বছর আগের ভূমির দাবি তুলতে পারে। এভাবে সবাই দাবি তোলা শুরু করলে তো দুনিয়ায় এক অনিঃশেষ সংঘাত দেখা দেবে।
না, আমি জায়নভূমির সঙ্গে ইহুদিদের জোরালো আবেগময় ও ঐতিহাসিক সম্পৃক্ততা অস্বীকার করতে পারি না, করছিও না। জেরুজালেমের আরেক নাম জায়ন। আর জেরুজালেম তো ইহুদিদের জন্য ধর্মীয়ভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ইহুদিরা দুনিয়ার যেখানেই প্রার্থনা করুক, তারা জেরুজালেমের কাছে ফিরে যায়। হাজার হাজার বছর ধরে তারা জেরুজালেমেই ফিরতে চেয়েছে। তবে তাদের এই ফিরতে চাওয়ার আকুতি এই ভূমির ওপর তাদের কোনো রাজনৈতিক বা আইনি অধিকার দেয় না।
আমাদের এটাও মনে রাখতে হবে যে ইসরায়েলের গোড়াপত্তনের আগপর্যন্ত জায়নবাদ আসলে ছিল একটি বসতি-উপনিবেশ গড়ে তোলার আন্দোলন। এর মূল লক্ষ্য ছিল ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে যত বেশি সম্ভব জমি-ভূমি দখল করে এমন একটি স্বাধীন ইহুদি রাষ্ট্র গড়ে তোলা, যার সীমানার ভেতরে যত কম সম্ভব আরববাসী থাকবে।
জায়নবাদী নেতারা তখন বারবার বলার চেষ্টা করেছে যে নতুন দেশটিতে দুই সম্প্রদায়ের—ইহুদি ও আরব—মানুষই উপকারভোগী হবে। আসলে ওসব ছিল ফাঁকা বুলি। আসল মতলব ছিল ওখানকার অধিবাসীদের তাড়িয়ে দিয়ে যত বেশি সম্ভব জমি দখল করা এবং দেশটি দখলে নেওয়া। জায়নবাদ যেহেতু বসতি-উপনিবেশে বিশ্বাসী, তার রাজনৈতিক ফসল হিসেবে উদ্ভূত ইসরায়েল রাষ্ট্রও তাই।
১৯৪৮ সালে আরবরা জাতিসংঘের পরিকল্পনা প্রত্যাখ্যান করে সামরিক আক্রমণ চালালে জায়নবাদীরা সুচতুরভাবে এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে জাতিসংঘের ঠিক করে দেওয়া সীমানার বাইরে রাষ্ট্র সম্প্রসারণ এবং ফিলিস্তিনিদের জাতিগতভাবে নিধন শুরু করে।
(১৯৪৫ সালে জার্মানি-জাপান অক্ষশক্তির পরাজয়ের মধ্য দিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়। ইউরোপে ইহুদি নিধনের বিভীষিকার তরতাজা স্মৃতি সারা বিশ্বের সমবেদনা কেড়ে নেয়। ১৯৪৭ সালের ২৯ নভেম্বর ব্রিটিশ ম্যানডেটে শাসিত ফিলিস্তিন ভূখণ্ডের ৫৬ শতাংশ ইহুদি ও ৪৩ শতাংশ ফিলিস্তিনি আরবদের মধ্যে ভাগ করে দেওয়ার পরিকল্পনা জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে গৃহীত হয় ৩৩-১৩ ভোটে। অথচ ফিলিস্তিনিরাই ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ। এতে জেরুজালেমকে আন্তর্জাতিক নগরের মর্যাদা দেওয়া হয়। ইহুদিরা এটা মেনে নিলেও আরবরা আপত্তি জানায়। ইসরায়েলের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ডেভিড বেন গুরিয়ানের নেতৃত্বে প্ল্যান দালেত বা প্ল্যান ডি নামে যে ছক কাটা হয়, তা ছিল ছিল হত্যা-ধর্ষণ-লুটতরাজ-সন্ত্রাসের মাধ্যমে ফিলিস্তিনি আরবদের নিজ ভূমি থেকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার মহাপরিকল্পনা। ১৯৪৮ সালের ১০ মার্চ এ পরিকল্পনা চূড়ান্ত হলে ইসরায়েলি সন্ত্রাসবাদী সংগঠন স্টার্নগ্যাং ও হাগানাহ তা বাস্তবায়নে পুরোদমে নেমে যায়।)
প্রশ্ন: ৭৬ বছর ধরে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নানা প্রচেষ্টা সত্ত্বেও ফিলিস্তিন-ইসরায়েলের নিরন্তর সংঘাত ও রক্তপাতের অবসান ঘটানো যায়নি, শান্তি প্রতিষ্ঠা করা যায়নি। বরং ফিলিস্তিনিরা ক্রমাগতভাবে কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। এর জন্য প্রধানত দায়ী কে বা কারা?
আভি শ্লেইম: ইসরায়েলই সবচেয়ে বেশি দায়ী ফিলিস্তিনি জনগণকে ক্রমাগত বিতাড়ন-নির্যাতন করে চলার জন্য। ইসরায়েল যে ফিলিস্তিনের ভূখণ্ড দখল করে রেখেছে, তা হাল জমানার সবচেয়ে দীর্ঘ ও নৃশংস সামরিক দখলদারত্ব।
ইসরায়েলকে নিঃশর্তভাবে সমর্থন দিয়ে যাওয়ার জন্য পশ্চিমা বিশ্বও দায় এড়াতে পারে না। পশ্চিমা দেশগুলো, বিশেষত যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন বারবার জাতিসংঘরে নিরাপত্তা পরিষদে আনীত বিভিন্ন প্রস্তাবে ভেটো প্রদান করে ইসরায়েলের পাশে দাঁড়িয়েছে।
মনে রাখতে হবে, ১৯৬৭ সালের পর থেকে ইসরায়েলের কাছে প্রতিবেশীদের সঙ্গে ‘হয় ভূমি, নয় শান্তি’ বেছে নেওয়ার আর কোনো বিকল্প নেই। ফিলিস্তিনিদের ক্ষেত্রে ইসরায়েল শান্তি বর্জন করে ভূমিকেই বেছে নিয়েছে। ফলে সেই ১৯৬৭ সাল থেকে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ইসরায়েলি দখলদারত্ব চলে আসছে।
(১৯৬৭ সালে ছয় দিনের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে মিসর, সিরিয়া এবং জর্ডানের সেনাবাহিনী ইসরায়েলের কাছে পরাস্ত হয়। ইসরায়েল গাজা উপত্যকা, মিসরের সিনাই মরুভূমি, সিরিয়ার গোলান মালভূমি এবং জর্ডানের কাছ থেকে পশ্চিম তীর এবং পূর্ব জেরুজালেম দখল করে। এ প্রথমবারের মতো ইহুদিদের জন্য পবিত্র জেরুজালেম ইসরায়েলের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আসে। সেখান থেকে বহু ফিলিস্তিনিকে বিতাড়িত করা হয়। জায়নবাদী ভাষ্যে অবশ্য এই দখলদারত্ব হলো হিব্রু বাইবেলে বর্ণিত ‘জুদিয়া, সামারিয়া’ ও গোলান উপত্যকার মুক্তি।)
২০০৫ সালে ইসরায়েল গাজা থেকে একতরফাভাবে সেনা প্রত্যাহার করলেও অল্প পরেই এই উপত্যকার ওপর জলে-স্থলে-অন্তরিক্ষে অবৈধভাবে অবরোধ আরোপ করে গাজাবাসীকে সমষ্টিগতভাবে অন্যায় শাস্তি দিয়ে আসছে। আর ৭ অক্টোবরের পর থেকে এই অবরোধ আরও জোরালো করেছে; গাজাবাসীর পানি, খাবার, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও চিকিৎসাসামগ্রী সরবরাহ আটকে দিয়ে যুদ্ধ অপরাধ করে চলেছে। অনেকে যেটা ভুলে গেছেন বা ভুলে যেতে চান, তা হলো সংঘাতটা তো ৭ অক্টোবর শুরু হয়নি।
সবচেয়ে বড় কথা, এ সংঘাত হামাসের হামলা হওয়া থেকে হয়নি। এর পেছনে রয়েছে ৫৭ বছরের ইসরায়েলি দখলদারত্ব—পশ্চিম তীর ও গাজার অধিবাসীদের ওপর প্রতিদিন সহিংসতা ও প্রতিদিন তাদের মৌলিক মানবাধিকারের লঙ্ঘন ঘটানো।
ইসরায়েল তো সুপরিকল্পিতভাবে ফিলিস্তিনিদের ওপর দুর্বৃত্তের তকমা লাগিয়ে দিয়েছে, সব ফিলিস্তিনিকে সন্ত্রাসী হিসেবে আখ্যায়িত করে চলেছে। একটি গোটা জনগোষ্ঠীকে বিমানবকিকীরণ (ডিহিউম্যানাইজেশন) করার বিপদটা হলো এটা তাদের জাতিগতভাবে নিধনের জন্য গণহত্যার পথ খুলে দেয়। আমরা আজকে গাজায় যা দেখছি এবং এত দিন ধরে যা দেখে এসেছি, তাতে এটা স্পষ্ট যে গাজায় ইসরায়েল ক্রমাগতভাবে সেদিকেই এগিয়ে গেছে।
প্রশ্ন: আপনি বলছেন, হামাস যে হামলা চালিয়েছিল, তা হওয়া থেকে এ সংঘাত হয়নি। আপনি এর ব্যাখ্যাও দিয়েছেন। হামাস এতটা শক্তি ও সাহস কীভাবে অর্জন করল?
আভি শ্লেইম: হামাস যে কাজ করেছে, তা ইসরায়েলি দখলদারত্বের বিরুদ্ধে একটি প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ হিসেবে দেখতে হবে। এর ইতিহাস তো আমি সংক্ষেপে তুলে ধরেছি। এই ইতিহাস হামাসের হামলাকে বৈধতা না দিলেও আমাদের গোটা বিষয়টা বুঝতে সাহায্য করে।
ইসরায়েলের অভ্যন্তরে বেসামরিক ও সাধারণ নাগরিকদের ওপর হামাসের হামলার আমি নিন্দা জানিয়েছি। এটা ছিল বর্বরোচিত হামলা।
তবে ইসরায়েল ও তার পশ্চিমা মিত্ররা যেভাবে দাবি করে থাকে, হামাস সেভাবে কোনো সন্ত্রাসী সংগঠন নয়। এটা একটা রাজনৈতিক দল, যার সামরিক শাখা বেসামরিক নাগরিকদের হামলা করেছে, যা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড।
হামাস আসলে রাজনৈতিক সংগঠনের চেয়ে বেশি কিছু—একটা গণসামাজিক আন্দোলন, ফিলিস্তিনি সমাজের বুননের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যেখানে প্রতিফলিত হয় তাদের স্বাধীনতা ও মুক্তির স্পৃহা। স্বাধীনতা অর্জন ও রাষ্ট্র গঠনে ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের ব্যর্থতা হামাসের বিকাশ ও প্রভাব অনেকটা ব্যাখ্যা করে।
যে বিষয়টি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য তা হলো, ২০০৬ সালে ফিলিস্তিনিদের একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে হামাস জয়ী হলে পশ্চিমারা তা মেনে নিতে না পেরে দলটিকে একঘরে করে দেয়। তা না হলে সে সময় হয়তো হামাসের রাজনৈতিক নেতারা ১৯৬৭ সালের যুদ্ধের আগের ভূসীমানায় স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র মেনে নিয়ে একটায় সমঝোতায় আসত।
(গাজা, পশ্চিম তীর এবং অধিকৃত পূর্ব জেরুজালেমে ফিলিস্তিনিরা ২০০৬ সালের ২৫ জানুয়ারি ভোট দেয় কয়েক দশকের মধ্যে অনুষ্ঠিত প্রথম সংসদীয় নির্বাচনে। সেবারই প্রথমবারের মতো ফিলিস্তিনি গোষ্ঠী হামাস ফিলিস্তিনের কোনো সংসদীয় নির্বাচনে অংশ নেয় এবং ১৩২টি আসনের মধ্যে ৭৪টি আসন পায়। ইয়াসির আরাফাতের হাতে গড়ে ওঠা তখনকার ক্ষমতাসীন ফাতাহ পার্টি পায় মাত্র ৪৫টি আসন।)
কিন্তু আজ হামাসের নেতারা অত্যন্ত সহিংস ও আপসহীন। দলটির অভ্যন্তরে চিন্তাশীল ও উদার রাজনৈতিক নেতাদের হাত থেকে ক্ষমতা সামরিক নেতাদের হাতে চলে গেছে। হামাসের রাজনৈতিক নেতারা কূটনৈতিকভাবে ও আলোচনার মাধ্যমে কোনো কূলকিনারা করতে না পারায় সামরিক নেতারা বলেছে যে তোমরা ইসরায়েলের সঙ্গে কোনো সমঝোতা করতে পারবে না, বরং ইসরায়েলকে আঘাত করতে হবে। তারা হিজবুল্লাহর উদাহরণও সামনে এনে বলেছে যে দক্ষিণ লেবানন থেকে ইসরায়েল ১৫ বছরের দখলদারি ছেড়ে সরে এসেছিল হিজবুল্লাহর কারণে।
প্রশ্ন: আপনাকে বলা হয় ‘সংশোধনবাদী’ (রিভিশনিস্ট) ইতিহাসবিদ, কখনোবা নয়া ইতিহাসবিদ (নিওহিস্টোরিয়ান)। ফিলিস্তিনিদের পক্ষে অবস্থান নেওয়ার জন্য আপনি বহু ইসরায়েলির সমালোচনা ও আক্রমণের সম্মুখীন হয়েছেন। ইসরায়েল রাষ্ট্রের বিষয়ে আপনার অবস্থানটা কী?
আভি শ্লেইম: প্রথম বা প্রকৃত ভৌগোলিক সীমারেখার মধ্যকার ইসরায়েল রাষ্ট্রের বৈধতা নিয়ে আমি কখনো প্রশ্ন তুলিনি। ১৯৪৯ সালে যুদ্ধ থেমে অস্ত্রবিরতির পর ইসরায়েল ও তার প্রতিবেশী আরব দেশগুলো এই সীমারেখা মেনে নিয়েছিল। আর এটাই এখন পর্যন্ত ইসরায়েলের একমাত্র ভূসীমা, যা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। আমিও সেটাকেই বৈধ বলে মনে করি।
ষাটের দশকের মাঝামাঝিতে আমি গর্বের সঙ্গে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনীতে (ইসরায়েলি ডিফেন্স ফোর্স বা আইডিএফ) যুক্ত ছিলাম। সে সময় আমি অনুভব করেছিলাম, এটা সত্যিই একটা প্রতিরক্ষা বাহিনী। কিন্তু ১৯৬৭ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের পর থেকে এ বাহিনীর চরিত্র বদলে যেতে থাকে। কালক্রমে এটা হয়ে ওঠে একটি নৃশংস ঔপনিবেশিক শক্তির দমন-পীড়নকারী বাহিনী।
সে যা-ই হোক, ইসরায়েলের সাবেক এক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এব্বা ইবান একবার বলেছিলেন, কোনো জাতি বা দেশ যখন তার হাতে থাকা সব কটি বিকল্প হাতিয়ারের ব্যবহার শেষ করে ফেলে, তখন থেকে তারা যৌক্তিক আচরণ করতে সামর্থ্যবান হয়। আমি এখনো আশাবাদী যে যাবতীয় সামরিক বিকল্পগুলো শেষ হওয়ার পর ইসরায়েল যৌক্তিক আচরণ শুরু করবে।
প্রথম বন্ধনীর ভেতরকার অংশগুলো সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীর ব্যাখ্যামূলক সংযোজন।
প্রথমআলো
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন