স্থপতি ইকবাল হাবিব। রাজধানীর হাতিরঝিল, ধানমণ্ডি লেক, কৃষিবিদ ইনস্টিটিউটসহ অসংখ্য দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্যের ডিজাইনার। সক্রিয়ভাবে যুক্ত পরিবেশ ও সামাজিক আন্দোলনের সঙ্গে। বর্তমানে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সহ-সভাপতি। ঢাকায় একের পর এক অগ্নিকাণ্ডে হতাহতের ঘটনা নিয়ে সম্প্রতি কথা বলেছেন মানবজমিন’র সঙ্গে। জানিয়েছেন নগর ব্যবস্থাপনায় আমাদের ত্রুটি ও সম্ভাবনার কথা। বলেন, অর্থলিপ্সু মালিক আর সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নেক্সাস তৈরি করে ফেলায় ঢাকা মৃত্যুকূপে পরিণত হয়েছে। দুর্নীতির এ দুষ্টচক্র রাষ্ট্রের সক্ষমতাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাচ্ছে। সরকার তলায় তলায় কম্প্রোমাইজ করা কর্মকর্তা-কর্মচারী তৈরি করায় পুরো ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের উপায় নিয়ে ইকবাল হাবিব বলেন, যেভাবে রানা প্লাজার পর বস্ত্রশিল্পে বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে পেরেছি, প্রতিমাসে অজস্র মৃত্যুর বান আমরা রোধ করতে পেরেছি ঠিক সেইভাবে সরকার সংবিধিবদ্ধ নিয়মকানুন যা রয়েছে সেটাকে সমন্বিত করে ৬টি গুরুত্বপূর্ণ অংশীজন বা মন্ত্রণালয়কে সঙ্গে নিয়ে টাস্কফোর্স গঠন করে ৩ থেকে ৬ মাসের মধ্যে ঘুরে দাঁড়ানোর প্রক্রিয়া শুরু করলে এ ভবনগুলোকে পরিশীলিত, পরিমার্জিত এবং কনপ্লাইন্ড করার মধ্যদিয়ে এ অবস্থা থেকে উত্তরণ করা সম্ভব।
তিনি বলেন, গৃহয়াণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ রাজউকের মাধ্যমে প্রায় ৮৮ শতাংশ অবৈধ ও বিপজ্জজনক ভবনকে নিয়ম-শৃঙ্খলার মধ্যে এনে পরিমার্জিত পরিশিলিত এবং রেক্টফিকেশন করে যথাযথ করণের একটি নীতিমালা ড্যাপের অধীনে তৈরি করা হয়েছে। সেটি দ্রুত কার্যকরের মধ্যদিয়ে আগামী দুই থেকে তিন বছরের মধ্যে একটি নিরাপদ, নিয়মতান্ত্রিক ও অনুমোদিত কার্যক্রমভিত্তিক ভবনের শহর তৈরি করতে পারবো। একই সঙ্গে বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোডের অধীন বিল্ডিং রেগুলেটরি অথরিটি (বিআরএ) দ্রুত তৈরি করে সারা বাংলাদেশে একই ধরনের নিরাপত্তা বলয় আমরা গড়ে তুলতে পারবো। মনে রাখা দরকার নগর নিরাপদ হলেই কেবল একটি দেশ তার উন্নতর জায়গায় যেতে পারে, অন্যথায় নয়।
এ নগরপরিকল্পনাবিদ বলেন, আমরা নগরীকে কেন্দ্রীভূত করেছি। নগরীকে একটি পুঞ্জিভূত কার্যক্রমের মধ্যে নিয়ে এসেছি। কিন্তু আইনগুলোকে করে রেখেছি বিচ্ছুরিত। হওয়ার কথা ছিল নগরী হবে বিচ্ছুরিত আর আইনগুলো হবে কেন্দ্রীভূত-পুঞ্জিভূত। এর ফলে বিচ্ছুরিত আইনের কোনোটাই এককভাবে কার্যকর করা যাচ্ছে না, শৃঙ্খলা এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারছে না। এ বিশৃঙ্খল অবস্থাকে একটা ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় পুঞ্জিভূত বা সমন্বিত জায়গায় আনতে হবে। সেই জায়গাটির কারণে আমরা বাস্তব রচিত উত্তরণ দেখছি না। অর্থাৎ ফায়ার ব্রিগেড সিভিল ডিফেন্সকে কিছু আইন দিয়েছে কিন্তু তার নীতিমালা-২০১৬ সাল থেকে স্থগিত করে বসে আছে। আজকের ঘটনায় তাদের বিচারের আওতায় আনতে পারবো না। তাহলে এ ক্ষতি যারা করেছেন তাদের দ্বার তারা কীভাবে উন্মোচন করতে পারেন। একই সঙ্গে ম্যাজিস্ট্রেট না থাকায় তারা শুধু নোটিশ দিতে পারে, সিলগালা করার ক্ষমতা নেই। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ অনুমোদন দেন, কিন্তু অনুমোদনের পর ব্যবহার পরিবর্তন করায় যে ঘটনাগুলো ঘটছে সেটা তারা তোয়াক্কা করার ক্ষমতা রাখেন না। ক্ষমতা রাখলেও সেটিতে তাদের যে তথ্য রয়েছে সে তথ্য শেয়ার না করায় অন্যান্য যারা সিটি করপোরেশনের লাইসেন্স দিচ্ছেন তারা এটার ব্যবহার কী ছিল সেটা জানেন না। না জেনে তারা আবাসিক ভবনে কমার্শিয়াল দিচ্ছেন, কমার্শিয়াল ভবনে রেস্টুরেন্ট দিচ্ছেন এবং এ লাইসেন্স দিয়ে দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছেন। পারস্পরিক তথ্যের আদান-প্রদান সেটা আমরা নিশ্চিত করতে পারছি না। সবকিছু মিলে একটি অশুভ চক্র জন্মদানের সব কর্মকাণ্ড আমরা করেছি। এ ফাঁক-ফোকরের কারণে অর্থলিপ্সু মালিক এবং সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা একটা নেক্সাস তৈরি করে ফেলেছে। সেই নেক্সাসের কারণে তৈরি হচ্ছে মৃত্যুকূপ। আর আমাদের অসচেতনতা এ মৃত্যুকূপে প্রবেশের সমস্ত পথ সুগম করেছে। আমিতো দেখি না আগুন লাগলে আমার বাচ্চা নিয়ে বের হতে পারবো কিনা। আমিতো দেখি না রেস্টুরেন্টে স্প্রিঙ্কলার সিস্টেম। আবদ্ধ দোকনে আগুন ধরলে যাবো কোথায়? পালানোর কোনো পথ নেই। তাই ব্যক্তি সচেতনতাও এর জন্য দায়ী। সব মিলিয়ে দেখলে ব্যক্তি থেকে প্রতিষ্ঠান, রাষ্ট্র, প্রশাসন সবার একটা অবহেলাজনিত হত্যাকাণ্ডের শিকার ছিল সেদিনের ৪৬ জন।
স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, সরকারি সংস্থার সক্ষমতার অভাবের সঙ্গে দুর্নীতিও শতভাগ জড়িত। দুর্নীতির নেক্সাস সক্ষমতাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাচ্ছে। শুধু ফায়ার ফাইটিংয়ের সক্ষমতা দেখলে হবে না। সিভিল ডিফেন্সটা কোথায়? ফায়ার ফাইটিং আর সিভিল ডিফেন্স এক না। কেন আমরা প্রত্যেক বিপনীবিতান, রেস্টুরেন্ট, কারখানা, জনসমাগমের জায়গায় ফায়ার ফাইটিং এন্ড সিভিল ডিফেন্সের সিভিল ডিফেন্স অন্তর্ভুক্ত অবস্থায় রাখতে পারবো না। আমাদের শিল্প মন্ত্রণালয়ের সরাসরি নির্দেশনা রয়েছে যে ১৮ শতাংশ মানুষ এ বিষয়ে প্রস্তুত বা প্রশিক্ষিত থাকবে। সেটার বাধ্যবাধকতা করছে না কেন। সেই বাধ্যবাধকতা থাকলেতো আজকে এ রেস্টুরেন্টে ৩-৪ জন লোক পাইতেন। সেদিন আমার বন্ধু ১৫ মিনিট পর টের পেলেন যে আগুন লেগেছে। কেন ভবনটিকে এলার্ম সিস্টেম করতে পারলাম না।
বেইলি রোডের অগ্নিকাণ্ডের পর সরকারি সংস্থাগুলোর চলমান অভিযান প্রসঙ্গে তিনি বলেন, চলমান অভিযানগুলো মানুষের সঙ্গে হটকারিতা এবং প্রবঞ্চনা। আমরা নগর উন্নয়ন কমিটির মিটিং-এ পরিষ্কারভাবে বলেছি যে প্রটোকল ছাড়া অর্থাৎ যারা আইনি সিদ্ধতায় লাইসেন্সগুলোর অনুমোদন ও দেখভাল করে তারা যৌথভাবে প্রটোকল তৈরি করে চেকলিস্টের মাধ্যমে সঠিক ও সুনির্ধারিতভাবে অভিযান পরিচালনা করবে। সেই সঙ্গে বিপজ্জনকতার মাত্রা অনুযায়ী প্রতিবিধান দিয়ে সময় নির্ভর উত্তরণের পথ দেখাবেন। এ অভিযান ছাড়া অন্য যেকোনো অভিযান মানুষের সঙ্গে হটকারিতা এবং প্রবঞ্চনা। কারণ এ শহরে মানুষের জন্য উন্মুক্ত জায়গা, খেলার মাঠ এবং বিনোদনের স্থান নেই। রেস্টুরেন্টগুলোই বিনোদনের একমাত্র জায়গা। তা কেড়ে নেয়ার অধিকার কারও নেই। কারণ বিচ্ছিন্নভাবে কাজ করার মধ্যদিয়ে যে প্রহসন এবং অত্যাচার হবে সেটি ঘুষ বাণিজ্যের চক্রকে বৃদ্ধি করার সুযোগ তৈরি করবে।
এ নগর পরিকল্পনাবিদ বলেন, ঢাকা শহরের নগর পরিকল্পনার বর্তমান যে অবস্থা তাতে রাতারাতি বসবাসযোগ্যতায় নিয়ে যাওয়া অসম্ভব। সম্ভব হচ্ছে- ব্যবস্থাপনার মধ্যদিয়ে ক্রমাগত উত্তরণের পথ তৈরি করা, সচেতন মানুষ তৈরি করা। নগর পরিকল্পনায় ক্ষমতার দাপট প্রশ্নে তিনি বলেন, সরকার ও জনগণের আইনের বিপরীতে ক্ষমতার দাপট যে দেখাচ্ছে তার বৃদ্ধাঙ্গুলি ভাঙতেই হবে। এতে কোনো সংশয় রাখার দরকার নেই। তলায় তলায় কম্প্রোমাইজ করার কর্মকর্তা-কর্মচারী সরকার তৈরি করায় পুরো ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। কার্পেটের তলায় আর এ ময়লা ঢেকে রাখা উচিত না। স্পষ্ট করা উচিত কেন সরকারের আইন-নীতিমালা রাজনৈতিক ঘোষণা থাকা সত্ত্বেও আমরা পারছি না। বিচার বিভাগীয় অথবা প্রশাসনিক ব্যবস্থায় তাদের জবাবদিহিতার মধ্যে আনতে হবে। এ অবহেলাজনিত হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে মামলা অথবা উপযুক্ত আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হোক। তিনি আরও বলেন, সকলের অংশগ্রহণে ঘুরে দাঁড়াতে অসংখ্য কাল সাপের মাথা কেটে কার্পেটের তলা উল্টিয়ে সমস্ত জঞ্জাল পরিষ্কার করার উদ্যোগ গ্রহণের মধ্যদিয়ে বদলে যাওয়া ঢাকা দেখি। যে বদলে যাওয়ার অসংখ্য উদাহরণ আমাদের রয়েছে। ঘুরে দাঁড়ানোর ভীত তৈরি হোক। তবেই আমরা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য নিরাপদ ও সাচ্ছন্দ্যের একটি বাসযোগ্য নগরায়ণ করতে পারবো।
মানবজমিন
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন