২৮ অক্টোবর বিএনপির মহাসমাবেশ ও আওয়ামী লীগের শান্তি সমাবেশ সামনে রেখে আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও অর্থনীতিবিদ মাহবুবউল্লাহর সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। তিনি বলেছিলেন কোনো অঘটন চাই না। শেষ পর্যন্ত সংঘাতই দেখা গেল সেদিন। বিএনপির পক্ষেও মহাসমাবেশ শেষ করা সম্ভব হয়নি। এই প্রেক্ষাপটে প্রথম আলো আবারও কথা বলেছে মাহবুবউল্লাহর সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন রাফসান গালিব
প্রথম আলো: আপনি আশা প্রকাশ করেছিলেন ২৮ অক্টোবরের পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি স্বস্তিদায়ক ও শান্তিপূর্ণভাবে শেষ হবে। তেমনটি তো ঘটল না।
মাহবুবউল্লাহ: যেভাবে ২৮ অক্টোবর অতিক্রান্ত হলো, তাতে অনেক মানুষ হতাশ হয়েছেন, দুঃখ পেয়েছেন এবং বিমূঢ় হয়েছেন। সেদিন এমন পরিস্থিতি কাম্য ছিল না। সংঘর্ষ এড়ানোর চেষ্টা সেদিন অনুপস্থিত ছিল। কেউ যাতে উসকানি দিতে না পারে বা অসৎ উদ্দেশ্য পূরণ করতে না পারে, এ বিষয়ে সতর্ক করেছিলাম। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, সেগুলোই ক্রিয়াশীল হয়েছে। এ কারণে ২৮ অক্টোবরের কর্মসূচি নিয়ে যে আশাবাদী অবস্থানে ছিলাম, সেটি আর সে জায়গায় থাকল না।
প্রথম আলো: বিএনপি কি তাদের মহাসমাবেশকে ঘিরে সরকারের পরিকল্পনা ও কৌশল বুঝতে পারেনি মনে করেন?
মাহবুবউল্লাহ: রাজনৈতিক দলগুলো যখন সমাবেশ ঘোষণা করে, তখন তারা জানে যে সেখানে যেকোনো কিছু ঘটতে পারে বা যেকোনো বাধা আসতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্র যেহেতু গোটা বিষয়ের দিকে মনোযোগ রাখছে, বিএনপি হয়তো মনে করেছিল সরকার সংযত থাকবে এবং দিনটা ভালোয় ভালোয় কেটে যাবে। কিন্তু তেমনটি হয়নি।
কিন্তু ক্ষমতাসীনদের কৌশল হিসেবে আমরা দেখতে পেলাম, শক্তি দিয়ে হোক বা সত্য-মিথ্যার মিশ্রণ করে হোক বা অন্য কোনো উপায়ে হোক, গোটা পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণ নেওয়া। এমনকি পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো যে আহ্বান করে আসছে তা উপেক্ষা করে বা বিবেচনা না রেখে সে কৌশল বাস্তবায়ন করে এগিয়ে যাওয়া।
এদিক দিয়ে বিএনপির পক্ষ থেকে হয়তো সরকারের কৌশল অতটা বোঝা সম্ভব হয়নি অথবা বুঝতে পারলেও নানা পরিস্থিতির চাপে সেভাবে তারা তাদের পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেনি।
প্রথম আলো: ২৮ অক্টোবর পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকাকে কীভাবে দেখছেন?
মাহবুবউল্লাহ: এ সরকার রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন যন্ত্রের ওপরে নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে, সেটি এত দিন পরে আর কাউকে বলে বোঝাতে হবে না। অনেক দেশেই এমনটি দেখা যায়, বিশেষ করে যেখানে একটি সরকার দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকে। তবে আমাদের দেশের ক্ষেত্রে বাড়তি অভিযোগ হচ্ছে, দলীয়করণ। দীর্ঘ ১৪-১৫ বছর ক্ষমতায় থাকা সরকার দলমনস্ক কর্মকর্তাদের দিয়ে রাষ্ট্রযন্ত্রগুলো সাজিয়েছে এবং তার সুবিধা সরকার পাচ্ছে।
প্রথম আলো: আওয়ামী লীগ কি এখন সুবিধাজনক অবস্থায় আছে বলে মনে করেন?
মাহবুবউল্লাহ: ব্যক্তিগতভাবে আমি ন্যায়বাদী। নিয়মবহির্ভূতভাবে রাজনৈতিক সুবিধা গ্রহণ করা আমি পছন্দ করি না। ২৮ অক্টোবরের ঘটনায় সরকারি দলের দায় কতটুকু, সেটি আগে বিশ্লেষণ করতে হবে। শাসনক্ষমতায় থাকার ফলে আওয়ামী লীগ অবশ্যই বাড়তি সুবিধাজনক অবস্থায় ছিল। এ জন্য বাড়তি অভিযোগের দায়ও তাদের বহন করতে হবে।
এখন বিএনপি আরও মামলা ও গ্রেপ্তারের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এগুলোকে রাষ্ট্রশাসনের কৌশল হিসেবে সরকার সব সময় ব্যবহার করে আসছে। এখন জনমতের কথা ভাবলে বলতে হয়, ২৮ অক্টোবর যা ঘটেছে, তা তারা ভালোভাবে নেয়নি। তারা সরকারের কাছে আশা করেছিল দিনটি সুন্দরমতোই অতিক্রান্ত হবে। সেটি হলে বরং আমরা রাজনীতির ভবিষ্যৎ নিয়ে আরও বেশি আশাবাদী হতে পারতাম।
প্রথম আলো: এত দিন বিএনপি শান্তিপূর্ণ সমাবেশ কর্মসূচি দিয়ে আসছিল। এখন হরতাল ও অবরোধের ঘোষণাকে কীভাবে দেখছেন?
মাহবুবউল্লাহ: এখন বুঝতে হবে, হরতাল ও অবরোধ শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির পর্যায়ে পড়ে কি না। আমার মনে হয় শান্তিপূর্ণও হতে পারে, আবার অশান্তিপূর্ণও হতে পারে। এ ধরনের আন্দোলনে বলপ্রয়োগও হতেও পারে, আবার সেটি না–ও হতে পারে। এটি পুরোপুরি নির্ভর করে যারা কর্মসূচি ডেকেছে তারা তা কীভাবে বাস্তবায়ন করছে এবং যারা প্রতিপক্ষ হিসেবে আছে, তারা তা কীভাবে মোকাবিলা করছে।
কর্মসূচিতে সম্পৃক্ত হওয়ার জন্য যদি জনগণকে যথেষ্ট পরিমাণে নৈতিকভাবে উৎসাহিত করা যায়, তাহলে আমি বিশ্বাস করি, অবরোধ বা হরতালের মতো কর্মসূচিও শান্তিপূর্ণভাবে সফল হতে পারে। এটিরও একটি শর্ত আছে, তা হচ্ছে প্রতিপক্ষ যদি বলপ্রয়োগ না করে। যদি বলপ্রয়োগ করা হয়, শান্তির শর্তটা রক্ষা করা সম্ভব হবে না।
প্রথম আলো: বিএনপি নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে আবারও মামলা ও গ্রেপ্তার শুরু হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে কি বিএনপিকে নির্বাচনে আনার চাপ তৈরি করছে সরকার?
মাহবুবউল্লাহ: এখন দেখার বিষয়, বিএনপি কতটা অটল থাকতে পারবে, নাকি সরকারের নিপীড়ন-নির্যাতনে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে বাধ্য হবে। এমনও হতে পারে, দেশের বড় বিরোধী দল ছাড়াই একটি নির্বাচন হয়ে গেল। অতীতে এমন নির্বাচন করে সরকার গঠন করে শাসনক্ষমতা চালিয়ে নিতে সমস্যা হয়নি। তবে এবার অতীতের মতো সে সাফল্য পাওয়া যাবে, তা ভাবা হয়তো ঠিক হবে না।
নির্বাচন করে ফেলে ক্ষমতাসীনেরা যে সাফল্য পাবে বা যে স্বস্তিবোধ করবে, পরে হয়তো অল্প সময়ের মধ্যে তাদের জন্য তা দুঃস্বপ্নে পরিণত হতে পারে। দেশের জন্যও মঙ্গলজনক হবে না।
প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।
মাহবুবউল্লাহ: আপনাকেও ধন্যবাদ।
প্রথম আলো
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন