ড. আসিফ নজরুল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান। তিনি একাধারে একজন কলাম লেখক, ঔপন্যাসিক ও রাজনীতি বিশ্লেষক। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয়ের আইন বিভাগ থেকে ১৯৮৬ সালে স্নাতক এবং ১৯৮৭ সালে স্লাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। ১৯৯৯ সালে সোয়াস ইউনিভার্সিটি অফ লন্ডন থেকে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর জার্মানির বন শহরের এনভায়রনমেন্টাল ল’ সেন্টার থেকে পোস্ট ডক্টরেট ফেলোশিপ অর্জন করেন। শিক্ষকতা পেশায় যোগদানের আগে তিনি কিছুকাল সাপ্তাহিক বিচিত্রায় কাজ করেছেন। সাম্প্রতিক ও ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে কালবেলার সঙ্গে কথা বলেছেন খোলামেলা। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এম এম মুসা, শ্রুতলিখন- মুজাহিদুল ইসলাম।
কালবেলা : কয়েক মাস পর জাতীয় সংসদ নির্বাচন। নির্বাচনকে ঘিরে রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। প্রতি পাঁচ বছর পর এ রকম সংকট তৈরি হয়। বাংলাদেশের নির্বাচনকেন্দ্রিক এই সংকটকে কীভাবে বিশ্লেষণ করবেন?
ড. আসিফ নজরুল : এই মুহূর্তে বাংলাদেশ যে সংকটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে সেটি একটু ভিন্ন আঙ্গিকের। একটি রাজনৈতিক দল সাজানো নির্বাচন করে অনেক বছর ধরে ক্ষমতায় রয়েছে। এমন কোনো রেজিম আমরা আগে বাংলাদেশে দেখিনি। আমরা হুসাইন মোহাম্মদ এরশাদকে দেখেছিলাম। এরশাদ সাজানো নির্বাচন করেছিলেন। কিন্তু সাজানো নির্বাচন করে তিনি বেশি দিন টিকে থাকতে পারেননি। আমরা খালেদা জিয়ার সরকারকে দেখেছিলাম ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে সাজানো নির্বাচন করে টিকতে পারেননি। কিন্তু বর্তমান সরকার যেভাবেই হোক দুটি সাজানো নির্বাচন করে টিকে আছে।
এবারের পরিস্থিতিকে আমি একটু ভিন্ন রকম বলছি। কারণ, এবার আমরা প্রথমবার দেখতে পাচ্ছি, আমাদের নির্বাচন নিয়ে আন্তর্জাতিক মহল সক্রিয়। ২০১৪ বা ২০১৮ সালের নির্বাচন নিয়ে আমাদের আন্তর্জাতিক বন্ধু রাষ্ট্র এবং দাতা গোষ্ঠীদের তেমন কোনো আগ্রহ ছিল না। তারা আপত্তি জানিয়েছিল বটে, কিন্তু তখন কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। গত ১৫ বছরের মধ্যে এবার আমরা প্রথমবারের মতো দেখতে পাচ্ছি, আমেরিকা এবং তাদের মিত্র রাষ্ট্রগুলো অত্যন্ত নিবিড় এবং জোরালোভাবে বাংলাদেশে অবাধ এবং সুষ্ঠু নির্বাচনের আশা প্রকাশ করছে। তারা অনেকেই বাংলাদেশের নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক করার কথা বলছেন এবং বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো আমরা এক ধরনের নিষেধাজ্ঞা দেখতে পাচ্ছি।
যদিও ভিসা নিষেধাজ্ঞাকে পুরোপুরি কোনো নিষেধাজ্ঞা বলা যাবে না; কিন্তু এটা অবশ্যই এক ধরনের নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা। আর এই নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থাকে বাংলাদেশে সুষ্ঠু এবং অবাধ নির্বাচনের সঙ্গে সম্পর্কিত করা হচ্ছে। সুষ্ঠু এবং অবাধ নির্বাচনের পথে যারা বাধা হয়ে দাঁড়াবে তাদের এই ভিসা নিষেধাজ্ঞার আওতায় নিয়ে আসা হচ্ছে। ‘ভিসা দেওয়া হবে না’ কথাটা এমনিতে শুনলে খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ মনে নাও হতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশের মতো একটি রাষ্ট্রে যেখানে প্রচুর পুঁজি পাচারের ঘটনা ঘটে, যেখানে কানাডাতে আমরা বেগমপাড়া হয়ে গেছে বলে শুনি, মালয়েশিয়াতে এরকম পাড়ার কথা শুনি, বিশেষত বাংলাদেশের মতো একটি দেশ যেখানে অসৎ রাজনীতিবিদ-ব্যবসায়ীদের বিরাট সিন্ডিকেট পুঁজি পাচার করছে তাদের জন্য পুঁজির পাহারা দেওয়া এবং তাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নিরাপত্তা এবং স্বার্থের জন্য আমেরিকা এবং কানাডার ভিসা যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা সাধারণ মানুষ সহজে অনুধাবন করতে পারবে না। ভিসানীতি প্রয়োগের মধ্যে আমরা তাদের ভীত দেখতে পাচ্ছি। যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতি বাংলাদেশের অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আজ যদি পাকিস্তান বা মেক্সিকো বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ভিসানীতি দিত তাহলে সেটি কোনো আলোচনাতেই আসত না। আমেরিকা ভিসানীতি দিয়েছে বলেই এটা আলোচনায় এসেছে এবং এটা বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এখন দেখার বিষয় এর ইমপ্যাক্টটা কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়।
আমাদের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এক ধরনের মুখোমুখি অবস্থানের দিকে যাচ্ছে। এখন পর্যন্ত সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের সমঝোতার ইঙ্গিত দেখা যাচ্ছে না। যদিও মনে হচ্ছে, আমেরিকার ভিসানীতি এবং আরও যেসব নিষেধাজ্ঞার কথা আসছে সেগুলোতে সরকার অনেক বিরক্ত। কিন্তু তাদের মধ্যে কোনো ধরনের নমনীয়তা দেখা যাচ্ছে না। বিরোধীদলকেও কোনো ধরনের নমনীয়তা প্রদর্শন করতে দেখা যাচ্ছে না। মধ্যবর্তী প্রোপোজাল নিয়ে কেউ এগিয়ে আসছে না। সব মিলে মনে হচ্ছে আমরা অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে এক ধরনের সংঘাতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি।
কালবেলা : ১৯৯১ সালের পর থেকে প্রায় প্রত্যেকটা নির্বাচনের আগেই এক ধরনের সংঘাতময় পরিস্থিতি তৈরি হতে দেখেছি আমরা। রাজনৈতিক দলগুলো এই সংস্কৃতি থেকে বের হতে পারছে না কেন?
ড. আসিফ নজরুল : যারা ক্ষমতায় থাকে তারা কোনোভাবেই ক্ষমতা ছাড়তে চায় না। তারা বিভিন্ন ধরনের কারচুপি করে, বিভিন্ন ধরনের অন্যায় পন্থা অবলম্বন করে ক্ষমতায় থাকতে চায়। আর বিরোধী দলে যারা থাকে তারা স্বভাবতই এটা হতে দিতে রাজি হয় না। রাজনৈতিক দলের প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে ক্ষমতায় যাওয়া। ক্ষমতায় যাওয়ার মতো শক্তিমত্তা ও সমর্থন যাদের আছে বলে মনে করে, তারা এই কারচুপি ও অন্যায় পন্থার প্রচণ্ড বিরোধিতা করে। আবার অনেকেই বিরোধিতা করে নৈতিক জায়গা থেকে। প্রশ্ন হলো, আপনি নাগরিকের ভোটাধিকার কেন কেড়ে নেবেন? আইনের শাসন, সংবিধান ও গণতন্ত্রের প্রতি যাদের শ্রদ্ধাবোধ রয়েছে তারাও একটা সময় ক্ষুদ্ধ হয়ে ওঠেন। ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়া এক ধরনের সংবিধানের লঙ্ঘন। এর প্রকৃত অর্থ দেশের মানুষকে প্রতারিত করা। একটা রাষ্ট্রকে লুট করার জন্য, একটা রাষ্ট্রকে ধ্বংস করার জন্য তারা নির্বাচনে কারচুপি করে এবং জোর করে ক্ষমতা দখল করে রাখেন। এই অবৈধ এবং ভুয়া নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় থেকে তারা অনেক বড় বড় অপরাধের জন্ম দেন। এটা অনেক বড় বড় অপরাধের প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে দেয়।
আমি সবসময়ই বলি, যারা ভুয়া নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসেন তারা একা একা ক্ষমতায় আসতে পারেন না। তারা ক্ষমতায় আসেন কারো ওপর ভর করে। কার ওপর ভর করে? পুলিশের ওপরে ভর করে, জনপ্রশাসনের ওপরে ভর করে। আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিচার বিভাগের ওপরেও ভর করে ক্ষমতায় আসেন তারা। যেহেতু পুলিশ এবং জনপ্রশাসনভিত্তিক সরকার হয় সেটা তাই জনগণের কাছে তাদের কোনো জবাবদিহিতা থাকে না। সেই সরকার পুলিশ এবং প্রশাসনের মন জুগিয়ে চলে।
সরকার জনগণকে খুশি রাখার চেষ্টা না করে শুধু পুলিশ, জনপ্রশাসন ও তাদের পক্ষের ব্যবসায়ীদের খুশি রাখার চেষ্টা করে। একটি ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর স্বার্থই তাদের কাছে প্রাধান্য পায়। আর এই ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী যেহেতু সরকারের অবাধ আনুকূল্য পায়- তাই তারা এবং তাদের সঙ্গে সম্পর্কিত মহলগুলো রাষ্ট্রীয় অর্থ ও সম্পদ লুটপাট করা শুরু করে। জনগণের প্রতি তারা কোনো ধরনের দায়বদ্ধতা অনুভব করে না।
কালবেলা : জনগণকে খুশি রেখে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ক্ষমতায় আসার সুযোগ ব্যতিরেকে তারা অগণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে বেছে নেন কেন?
ড. আসিফ নজরুল : যারা দেশ শাসন করে তারা দেশকে ঠিকভাবে শাসন করে না। ক্ষমতায় আসার পর তারা অবাধ লুণ্ঠন করে। তারা রাষ্ট্রীয় পুঁজি লুণ্ঠন করে। সরকারের প্রকল্পগুলোকে তারা অতি মূল্যায়িত দেখায়। ১০০ কোটি টাকার প্রকল্প ৩০০ কোটি টাকা ব্যয় দেখিয়ে ২০০ কোটি টাকা মেরে দেয়। তারা ব্যাংকের টাকা অবাধে লুণ্ঠন এবং তা পাচার করে। তারা আমদানি ও রপ্তানির ক্ষেত্রে ওভার ইনভয়েসিং ও আন্ডার ইনভয়েসিং করে পুঁজি পাচার করে। প্রত্যেক সরকারের আমলে কম-বেশি এটি ঘটে। ক্ষমতাসীনদের মনে আগে এক ধরনের ভয় কাজ করত। তারা জানত, পাঁচ বছর পর ক্ষমতা পরিবর্তন হবে। আর ক্ষমতা পরিবর্তন হলে তাদের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। তাই তাদের লুণ্ঠনের একটা সীমা ছিল। তারা অন্যায় করত, কিন্তু রয়ে সয়ে করত।
গত ১৫ বছর ধরে দেশে এ ভয় নেই। ভয় না থাকার কারণে তারা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। আজ পুঁজি পাচারের জন্য অভিযুক্ত একটি শিল্পগোষ্ঠী সুপ্রিম কোর্টে গিয়ে আবেদন করছে যাতে তাদের ব্যাপারে কোনো সংবাদ যেন প্রকাশ করা না হয়। তাদের স্পর্ধা কী আমরা চিন্তা করতে পারি!
গত ১৫ বছরে তাদের স্পর্ধা এই পর্যায়ে গেছে, কোনো কোনো পুলিশ কর্মকর্তা ও ইউএনও প্রকাশ্যে নৌকায় ভোট চাচ্ছেন। পুলিশ বিনা উসকানিতে জনগণের ওপর গুলি করতে পারছে। বিরোধীদলের সংগঠক ও নেতাকর্মীকে গুম করতে পারছে। কারণ ১৫ বছর ধরে এসব করে তাদের ভয় কেটে গেছে। ক্ষমতা হারাতে পারে, মিডিয়া তাকে এক্সপোজ করতে পারে, দুর্নীতি-গুম-খুনের বিচার হতে পারে— এই ভয়টা তাদের মধ্য থেকে চলে গেছে। গত দুটি ভুয়া নির্বাচনের পরেও সরকার টিকে গেছে বলে সংকট অনেক বেশি ঘনীভূত হয়েছে।
কালবেলা : টিআইবির একটি জরিপ বলছে বর্তমান সংসদ সদস্যদের মধ্যে ৬২ শতাংশ ব্যবসায়ী। রাজনৈতিক সংকটের পেছনে এটি কোনো ভূমিকা রাখছে কী?
ড. আসিফ নজরুল : অবশ্যই দেশকে সংকটে ফেলতে এটা একটা বড় কারণ। এখন বাংলাদেশের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ও লাভজনক ব্যবসা হচ্ছে এমপি হওয়া। এমপি হওয়ার সঙ্গে তারা সরকারি প্রকল্প পায়, ব্যাংক থেকে ইচ্ছেমতো ঋণ তুলে নিতে পারে, বিভিন্ন গণমাধ্যম ও শিল্প কারখানা প্রতিষ্ঠিত করার অবাধ অনুমতি পাওয়া যায়। তারা নিজের এলাকার জমিদার বনে যান। আর এসব কিছুর কারণ, দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন নেই। ফলে এখানে এমপি হওয়ার জন্য বিনিয়োগ করতে মানুষ পাগল হয়ে যাচ্ছে।
এমপি হওয়ার বিনিয়োগে কারা এগিয়ে থাকবে? যার কাছে টাকা আছে সেই এগিয়ে থাকবে। ভালো মানুষের কাছে তো অবাধ টাকা থাকবে না। সেজন্য আমরা টিআইবির জরিপে সংসদে ৬২ শতাংশ ব্যবসায়ী দেখতে পাই। আরেকটি জরিপে দেখলাম সংসদ অধিবেশনের অধিকাংশ সময় ব্যয় হয়েছে প্রধানমন্ত্রীকে প্রশংসা করতে গিয়ে।
অথচ সংসদ হওয়ার কথা প্রধানমন্ত্রী এবং তার সরকারের জন্য আতঙ্কের জায়গা। কারণ সংসদে প্রধানমন্ত্রীকে প্রশ্ন করা হবে, তার গৃহীত পদক্ষেপগুলোর ভুল বের করা হবে। সংসদ হবে এমন, যেখানে প্রধানমন্ত্রী এবং তার সরকারকে সারাক্ষণ জবাবদিহিতার আওতায় আনা হবে। আর আমাদের সংসদ হয়ে দাঁড়িয়েছে তোষামোদির জায়গা। জবাবদিহি প্রতিষ্ঠানের পরিবর্তে সংসদ পরিণত হয়েছে তোষামোদির প্রতিষ্ঠানে।
কালবেলা : এক্ষেত্রে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের কোনো ভূমিকা আছে কী?
ড. আসিফ নজরুল : সরকারের বিরোধিতা করলে সংসদ সদস্য পদ চলে যাবে এটা সম্পূর্ণ একটি ভুল ধারণা। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে আছে, যদি কেউ নিজ দলের সরকারের বিরুদ্ধে ভোট দেয় তখন তার সংসদ সদস্য পদ চলে যাবে। সরকারের বিরুদ্ধে যদি কোনো এমপি সকাল থেকে রাত পর্যন্ত সমালোচনা করে, যদি সবচেয়ে কঠোরতম ভাষায়ও সমালোচনা করে তবুও তার সংসদ সদস্য পদ চলে যাবে না। ৭০ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, যদি আপনি দলের বিপক্ষে ভোট দেন এবং নিজে দল থেকে পদত্যাগ করেন—শুধু এই দুটি কারণেই সদস্য পদ চলে যেতে পারে। এমনকি একজন এমপি যদি সরকারকে সমালোচনা করার কারণে দল তাকে বহিষ্কার করে থাকে তবুও তার সংসদ সদস্য পদ চলে যাবে না। শুধু এমপি যদি নিজে দল থেকে পদত্যাগ করেন তখন তার সংসদ সদস্য পদ চলে যাবে।
৭০তম অনুচ্ছেদ কারো কথা বলার অধিকার নিয়ন্ত্রণ করেনি। নিয়ন্ত্রণ করেছে ভোট প্রয়োগের ক্ষমতা। আমাদের এমপিরা কথা বলার জন্য সংসদে যান না, তারা যান তোষামোদি করার সুযোগ প্রয়োগ করতে। আপনি যত বেশি প্রধানমন্ত্রীকে তোষামদি করবেন, আপনি তত বেশি সচিবালয়, ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক ও অন্যান্য সরকারি প্রতিষ্ঠানে সুবিধা পাবেন। সমস্ত রাষ্ট্রযন্ত্র এবং সমস্ত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের মূল লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে সরকার এবং সরকারি পক্ষের লোককে তোষামোদি করা এবং তাদের স্বার্থ পূরণ করা। তাদের যে কোনো অন্যায় আবদার পূরণ করা। বাংলাদেশ এখন আর রাষ্ট্রের পর্যায়ে নেই। রাষ্ট্র নামক বিশাল এক লুটেরা প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। আর এসব হয়েছে ভুয়া নির্বাচনের মাধ্যমে।
একটি ভুয়া নির্বাচনের পরে দুটি বা ৩টি ভালো নির্বাচন হয় তখন সেই ভুয়া নির্বাচনের প্রভাবটাকে কিছুটা প্রশমিত করা যায়। পরপর দুটি ভুয়া নির্বাচন হয়েছে। পরপর ১০ বছর অত্যন্ত বিতর্কিত একটি সরকার ক্ষমতায় রয়েছে। আমি দুঃখিত এটা আসলে বৈধ সরকার কিনা সেটাই আমার প্রশ্ন। যেখানে আগের রাতে ভোট হয়ে যায় কোনোভাবেই সেটি বৈধ সরকার হতে পারে না। ফলে সরকারের নামে এটা একটি গোষ্ঠীর লুটপাটের জায়গায় পরিণত হয়েছে। আর সেই গোষ্ঠী নিজেরা নিজেদেরই নির্বাচিত করছে বিভিন্ন পদ্ধতির মাধ্যমে।
কালবেলা : আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, গণতন্ত্রে কোনো ধরনের অনির্বাচিত সরকার থাকার সুযোগ নেই। তাহলে বিএনপি কেন অনির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কথা বলছে?
ড. আসিফ নজরুল : গণতন্ত্রে অনির্বাচিত সরকারের সুযোগ নেই বুঝলাম। কিন্তু আমাদের দেশে বড় বড় ২টি পদে যারা নির্বাচিত হন তারা পরোক্ষভাবে নির্বাচিত হন। যেমন রাষ্ট্রপতির কথা বলা যায়। রাষ্ট্রপতি সরাসরি জনগণের ভোটে নির্বাচিত হন না। তিনি সংসদ সদস্যদের ভোটে নির্বাচিত হন। বাংলাদেশে মহিলা আসনের এমপিরা নির্বাচিত হন সংসদ সদস্যদের ভোটে বা সংসদ সদস্যদের মনোনয়নে এমপি নির্বাচিত হন।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সেরকমই ছিল। সব সংসদ সদস্য একসঙ্গে মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, এই ব্যক্তিরা ক্ষমতায় থাকবেন। অর্থাৎ সেটাও পরোক্ষভাবে নির্বাচিতই হলো। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল জনপ্রতিনিধিদের অর্থাৎ সংসদ সদস্যদের চাওয়ার ভিত্তিতে। এখানে রাষ্ট্রের মধ্যে একটি সামাজিক চুক্তি হয়েছিল।
বাংলাদেশের রাজনীতির সবচেয়ে বড় স্টেক হোল্ডার কে? আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি। এই দুটি দল অন্তত বাংলাদেশের ৮০ শতাংশ মানুষের প্রতিনিধিত্ব করে। আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি দুটি দলই সেখানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কথা বলেছে। অর্থাৎ জনগণের বৃহত্তম অংশের স্বার্থে যারা কথা বলেন তারাই বলেছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কথা। বিএনপি আমলে যে সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার হয়েছে সেটাও হয়েছে জনগণের প্রতিনিধিদের মাধ্যমে। সে সময় আওয়ামী লীগ সরকার বলেছিল- আমরা চিরকালের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার চাই।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে তাদের মনে যদি এতই সন্দেহ আসে তাহলে আমি তাদের একটি চ্যালেঞ্জ দিলাম। তারা একটি গণভোটের আয়োজন করুক তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে। নির্বাচনকালীন সময় মানুষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার চায় কিনা— সেটি নিয়ে একটি গণভোট হোক। আমি বিশ্বাস করি অন্তত দেশের ৭০ শতাংশ মানুষ বলবে হ্যাঁ, আমরা তত্ত্বাবধায়ক সরকার চাই। তত্ত্বাবধায়ক সরকার জনগণের সম্মতির ভিত্তিতে কিনা, গণতন্ত্রের ভিত্তিতে কিনা তারা এসব প্রশ্ন তুলছেন। বিস্ময়কর বিষয় হচ্ছে আগের রাতে যারা নির্বাচন করেন তারাই এ প্রশ্ন তুলছেন!
আপনাকে একটি বিষয় মনে রাখতে হবে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে হাইকোর্টে যখন চ্যালেঞ্জ হয়েছে তখন হাইকোর্টের মেজরিটি বিচারক দুবার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে রায় দিয়েছেন। রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় আইন বিশেষজ্ঞ যারা ছিলেন, যাদের আন্ডারে বিভিন্ন বিচারপতিরা জুনিয়র হিসেবে কাজ করতেন (আমি ড. কামাল হোসেন, ব্যারিস্টার ইশতিয়াক সাহেবের কথা বলছি। বাংলাদেশের অধিকাংশ প্রধান বিচারপতি এবং বিচারপতি তাদের জুনিয়র ছিল, তারা এত বড় পর্যায়ের আইনজীবী)। তাদের আটজনের মধ্যে সাতজনই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে ছিলেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে তারা সুস্পষ্ট মত ব্যক্ত করেছেন। এমনকি আপিল ডিসিশনেও মাত্র একজন বেশি বিচারক তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করতে বলেছিলেন। হাইকোর্টের সব বিচারপতির রায়ে বেশিরভাগ বিচারপতি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে বলেছেন। দেশের সবচেয়ে বড় বড় আইন বিশেষজ্ঞ যারা রয়েছেন, যারা সংবিধান বোঝেন, আমার আপনার থেকে বেশি আইন বোঝেন, যারা বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ সাংবিধানিক আইনজীবী তাদের মধ্যে ৯০ শতাংশ বলেছেন তত্ত্বাবধায়ক সরকার বৈধ। (১ম পর্ব)
[ নিবন্ধ, সাক্ষাৎকার, প্রতিক্রিয়া প্রভৃতিতে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। দৈনিক কালবেলার সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক, আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের, দৈনিক কালবেলা কর্তৃপক্ষের নয়। ]
কালবেলা
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন