সংবিধান মেনে চলছে না রাষ্ট্র
24 April 2023, Monday
দেশ রূপান্তর : ৫০ বছর আগে সংবিধান প্রণীত হয়েছে। এই সংবিধানকে কীভাবে মূল্যায়ন করেন?
পঙ্কজ ভট্টাচার্য : ৫০ বছরে সংবিধানের শাসন যেটুকু জনগণ পেয়েছে তা বঙ্গবন্ধুর সাড়ে তিন বছরের শাসনামলে। পঁচাত্তর-পরবর্তী সময়ে সামরিক সরকারগুলো সংবিধান কাটাছেঁড়া করেছে। বঙ্গবন্ধুর আমলেই বাকশালের মতো একদলীয় ব্যবস্থা হয়েছে এবং তা খুব সুখকর হয়নি। পঁচাত্তর-পরবর্তী সময়ে, আমি বলব, সংবিধান ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হত্যার একটি পর্ব চলেছে। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের ও স্বাধীনতাবিরোধীদের পুনর্বাসন ও রাজনীতি করার সুযোগদান আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত ছিল। এ প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশ পিছিয়ে প্রায় পাকিস্তানের কাছাকাছি চলে গিয়েছিল। এই অপকর্মের মাধ্যমে হত্যাকারীদের সরকার হয়ে গেল বিএনপি ও জাতীয় পার্টি। এই নিয়ে বিএনপি বা জাতীয় পার্টিতে আত্মসমালোচনা দেখিনি, যা দুঃখজনক।
দেশ রূপান্তর : সংবিধান প্রণয়নের অন্যতম ভিত্তি ছিল ধর্মনিরপেক্ষ ও অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রের ধারণা। এই চিন্তার প্রতিফলন এখন কতটুকু হচ্ছে?
পঙ্কজ ভট্টাচার্য : ধর্মনিরপেক্ষতার কিংবা অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রের চিন্তা আসলে মৌখিক। আওয়ামী লীগকে আমি সাম্প্রদায়িক দল বলব না। তবে তারা ক্ষমতার জন্য সাম্প্রদায়িকতার সঙ্গে কৌশলগত আঁতাত করেছে। সাম্প্রদায়িকতার সঙ্গে দোস্তি ছাড়েন। না ছাড়লে ’৭২-এর সংবিধানের চেতনা থাকে না। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাও থাকে না।
দেশ রূপান্তর : সংবিধানের চেতনা বর্তমান সরকার কতটুকু ধারণ করে?
পঙ্কজ ভট্টাচার্য : জনগণের পক্ষে ক্ষমতার প্রয়োগ কেবল এই সংবিধানের কর্তৃত্বেই কার্যকর হবে। প্রশ্ন হলো ক্ষমতার মালিক জনগণ কি আওয়ামী লীগের আমলেও ক্ষমতার মালিক আছে! মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কি আজ সুস্পষ্টভাবে আছে? আপনারা (আওয়ামী লীগ) মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলছেন। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ আজকে অচেনা। এখানে রাষ্ট্রধর্ম আছে। ধর্মনিরপেক্ষতাসহ চার মূলনীতিও আছে। জগাখিচুড়ির সংবিধান তো সংবিধানকে অপমান করার শামিল। এই পরিস্থিতির জন্য মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বকারী দল হিসেবে আওয়ামী লীগের দায় সর্বাধিক। সংবিধান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সময় কিন্তু বিএনপি ছিল না। সংবিধান প্রতিষ্ঠার দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে নারীবিদ্বেষী, সাম্প্রদায়িক চিন্তাভাবনার হেফাজতের সখ্য শোভন নয়। আওয়ামী লীগকে এই সমঝোতা ও দোস্তির রাজনীতি ছাড়তে হবে।
দেশ রূপান্তর : ১৯৭২-এর সংবিধানের চেতনায় ফিরে যাওয়ার কথা একসময় শোনা গেলেও এখন শোনা যায় না। কেন?
পঙ্কজ ভট্টাচার্য : বঙ্গবন্ধুর তৈরি ’৭২-এর সংবিধান থেকে আওয়ামী লীগ যোজন যোজন দূরে অবস্থান করছে। সংবিধানে বলা আছে, রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হবে মেহনতি মানুষ, কৃষক-শ্রমিক ও অনগ্রসর শ্রেণিকে শোষণ থেকে মুক্ত করা। এই কর্তব্য কি আওয়ামী লীগ পালন করছে? অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা, চিকিৎসার মতো মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার কাজ কি আওয়ামী লীগ করছে? প্রজাতন্ত্র মানে গণতন্ত্র; সব নাগরিকের সমান অধিকার। প্রশাসনের সবক্ষেত্রে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হবে। আমার প্রশ্ন, জনগণ কি এখন নির্বাচনে যায়? জনগণের অংশগ্রহণ ছাড়া কি গণতন্ত্র হয়? বিএনপি ও তার পূর্বপুরুষরা যে চর্চা করে এসেছে এখন আওয়ামী লীগকে কেন তা অনুসরণ করতে হবে! এককথায় যদি বলি, সংবিধান মেনে রাষ্ট্র চলছে না।
দেশ রূপান্তর : রাষ্ট্রের সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো কি স্বাধীনভাবে চলতে পারছে?
পঙ্কজ ভট্টাচার্য : রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান যেমন জাতীয় সংসদ, বিচার বিভাগ, নির্বাচন কমিশনএসব কীভাবে চলছে তা সবাই দেখছে। পুলিশ-আমলাদের হওয়ার কথা রাষ্ট্রের তথা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী। কিন্তু নির্বাচন কমিশন, পুলিশ, প্রশাসনকে যদি সরকারের মুখাপেক্ষী হতে হয়, তাহলে সরকার কর্তৃত্বপরায়ণ হতে বাধ্যযা অনেকাংশেই আমরা প্রত্যক্ষ করছি। সংবাদপত্র রাষ্ট্রের পরিচালকদের ভুলত্রুটি শুধরে দিতে পারত। এতে ক্ষমতাসীন দল নিজেদের শোধরাতে পারত। এতে অগৌরবের কিছু নেই। কিন্তু সেই ধারা মুক্তিযুদ্ধের আওয়ামী লীগ বহন করছে কিনা আমার বোধগম্য নয়। আওয়ামী লীগ স্বীয় কৃতিত্বকে অস্বীকার করে চলার পথে হাঁটছে। এটা দুঃখজনক।
দেশ রূপান্তর : সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ গণতন্ত্রের বাধা। এটি রাজনৈতিক দলকে স্বেচ্ছাচারী করে। ৫০ বছরেও এই নিয়ে তর্ক থামেনি।
পঙ্কজ ভট্টাচার্য : এই অনুচ্ছেদ, আতঙ্কের অনুচ্ছেদ। আমার দলের সমালোচনা করলে আমি শেষ হয়ে যাব। রাজনৈতিক দলের একজন সংসদ সদস্যকে যদি শুধু দলের প্রশস্তি করার সুযোগ দেওয়া হয়, শুধু ইতিবাচক আলোচনার সুযোগ দেওয়া হয় তাতে সত্য বের করে আনার যে সাধনা তা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। গণতন্ত্রের মূল কথা হলো সত্যটাকে বের করে আনা। এই অনুচ্ছেদটা সংবিধানের একটা বড় বিচ্যুতি। এটাকে যুগোপযোগী করতে হবে।
পঙ্কজ ভট্টাচার্য - বর্ষীয়ান রাজনীতিক, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, ঐক্য ন্যাপের সভাপতি।
(দেশ রূপান্তরকে দেওয়া পঙ্কজ ভট্টাচার্যের বিশেষ সাক্ষাৎকার। সংবিধানের ৫০ বছর উপলক্ষে (৪ নভেম্বর, ২০২২) দেশ রূপান্তরে প্রকাশিত)
দেশ রূপান্তর
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন