মামুনুর রশীদ। নাট্যকার, নাট্যনির্দেশক ও অভিনেতা। স্বাধীনতা–উত্তর বাংলাদেশের মঞ্চ আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ। নাট্যকলায় বিশেষ অবদানের জন্য ২০১২ সালে তিনি একুশে পদক পান। বাংলাদেশে সংস্কৃতিচর্চা, ক্ষমতার রাজনীতি, সাংস্কৃতিক সংগঠনের ভূমিকা নিয়ে তিনি প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সোহরাব হাসান ও মনোজ দে
প্রথম আলো: এ মুহূর্তে বাংলাদেশে সংস্কৃতিচর্চা কী অবস্থায় আছে?
মামুনুর রশীদ: সংস্কৃতি বলতে যদি বাঙালি ও বাংলাদেশের সংস্কৃতি বুঝি, তাহলে সেটা খুব খারাপ অবস্থায় রয়েছে। বাঙালি সংস্কৃতি এখন কোণঠাসা। একটা সময় আমরা বলতাম পশ্চিমা সংস্কৃতি এসে আমাদের পচিয়ে দিল। এখন ধর্মীয় সংস্কৃতি এসে আমাদের শক্তিশালী বাঙালি সংস্কৃতিকে একেবারেই প্রান্তিক করে দিচ্ছে। আমাদের পোশাক-আশাকে এর প্রতিফলন দেখা যায়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উল্লেখযোগ্য অংশ যেসব পোশাক–পরিচ্ছদ পরছে, তাতে আমরা যে বাংলাদেশে আছি, সেটা বোঝা মুশকিল। স্কুল-কলেজগুলোতে একই চিত্র। পোশাক-আশাকের দরজা দিয়ে একটা বাড়িতে যে সংস্কৃতি ঢোকে, সেটা আমরা বুঝতে চেষ্টা করিনি। অনেক এলাকায় এখন স্কুলের চেয়ে মাদ্রাসার সংখ্যা বেশি। এখন ওয়াজ মাহফিল, ধর্মসভা শুধু বড় বড় আয়োজন করে হচ্ছে তা নয়, ডিজিটাল মিডিয়াতেও এর ব্যাপক প্রসার ঘটেছে। সেই তুলনায় বাঙালি সংস্কৃতির প্রভাব ক্রমেই কমে যাচ্ছে।
প্রথম আলো: সারা জীবন আপনারা সংস্কৃতি নিয়ে কাজ করলেন, নাটক ইত্যাদির মাধ্যমে মানুষকে জাগানোর চেষ্টা করলেন। তারপরও সংস্কৃতির সংকট এত ঘনীভূত হলো কেন?
মামুনুর রশীদ: এর অনেক কারণ আছে। আমার কাছে প্রধান কারণ মনে হয় রাজনৈতিক। আমাদের প্রতিবেশী দেশেও রাজনৈতিক কারণে ধর্ম একটা বড় জায়গা দখল করে নিয়েছে। পয়লা বৈশাখ বা বাংলা নববর্ষ যে সম্রাট আকবরের আমল থেকে প্রচলন শুরু হয়েছে, তারা সেটা মানতে রাজি নয়। তারা নানা আয়োজন করে বলতে চাইছে, শশাঙ্কের আমল থেকে বাংলা সন চালু হয়েছে। অথচ আমরা জানি আকবরের সময় বাংলা সন চালুর কারণ হলো, বৈশাখের এ সময়টাতে কৃষকের ঘরে গম উঠত। সে সময় খাদ্যদ্রব্যের মাধ্যমে খাজনা আদায় করা হতো। পরবর্তীকালে পয়লা বৈশাখে হালখাতার প্রচলন হয়েছে।
আমাদের দেশে সংস্কৃতির সংকটটা খুব দ্রুত হয়েছে ১৯৭৫ সালের পর সামরিক শাসনের আমলে। সামরিক শাসনের আমলে যাঁরা বাংলাদেশের জন্মেরই বিরোধিতা করেছেন, তাঁরা রাষ্ট্রক্ষমতার অংশ হয়ে যান। সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম যুক্ত করা হয়। সমাজে ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার ব্যাপকভাবে বেড়ে গেছে। প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলেও ধর্মের ব্যবহার হচ্ছে। কিন্তু এগুলো যে সংস্কৃতিচর্চার অংশ, সেটা আমাদের রাজনীতিবিদেরাও বুঝতে পারেননি, আমাদের অনেক শিক্ষিত মানুষও সেটা বুঝতে পারেননি।
প্রথম আলো: সামরিক শাসকেরা ধর্মের রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করেছেন, এ কথা সত্যি। সেটা সমাজকে নানাভাবে প্রভাবিত করেছে। কিন্তু ১৪ বছরের বেশি সময় ধরে আওয়ামী লীগ একটানা ক্ষমতায় আছে। এ সময়ে সেই ধারার কোনো পরিবর্তন কি দেখতে পেয়েছেন?
মামুনুর রশীদ: একটা পরিবর্তন আশা করেছিলাম, কিন্তু বাস্তবে তা ঘটেনি। আমার বিবেচনায় বাংলাদেশ উপমহাদেশের সবচেয়ে সেক্যুলার ও অসাম্প্রদায়িক দেশ। এত কিছুর পরও আজও আমি সেটাই মনে করি। বাংলাদেশকে অসাম্প্রদায়িক রাখার মূল দায়িত্বটা রাজনৈতিক দলগুলোর। আমি শুধু আওয়ামী লীগের কথা বলব না, কমিউনিস্ট পার্টিসহ অন্য যেসব রাজনৈতিক দল, তারাও তো সংস্কৃতির এসব সংকটে কিছু বলছে না। আমি একটা ভিন্ন উদাহরণ দিতে চাই। ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত দেখেছি এখানকার মধ্যবিত্ত, উচ্চমধ্যবিত্ত পরিবারে বিয়ের কার্ড ইংরেজিতে করত। ১৯৬৮ সাল থেকে সেটা বাংলায় শুরু হয়ে গেল। ১৯৬৯ সালে সবখানেই বাংলা চালু হয়ে গেল। ১৯৭৫ সালের পর আবার ইংরেজিতে বিয়ের কার্ড করা ফিরে আসে। নব্বইয়ে যখন স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে, সে সময় বিয়ের কার্ড বাংলায় লেখা শুরু হলো। এখন আবার বিয়ের কার্ড ইংরেজিতে লেখা শুরু হয়েছে। আমি কোনো কোনো বিয়ের অনুষ্ঠানে গেলে বর-কনের বাবা-মাকে বলি, তোমাদের এই নিমন্ত্রণে একজন বিদেশিকেও তো দেখতে পাচ্ছি না। তোমরা কাদের জন্য ইংরেজিতে কার্ড করেছ। এটাও একটা সংস্কৃতি। কয়েক বছর আগে আমি প্রথম আলোয় একটা লেখায় লিখেছিলাম, বাংলা ও ফারসিতে নিমন্ত্রণের চমৎকার ভাষা আছে, যেটা ইংরেজিতে নেই।
প্রথম আলো: সম্প্রতি আপনার একটা বক্তব্য নিয়ে বেশ বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। রুচির দুর্ভিক্ষ বলতে কী বোঝাতে চেয়েছেন?
মামুনুর রশীদ: ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে সংস্কৃতির একটি মুক্ত ব্যবস্থা এসেছে। যে কেউ যেকোনো কথা, যেকোনো চিন্তা, যেকোনো নাটক ডিজিটাল মিডিয়ার মাধ্যমে প্রচার করতে পারছেন এবং এটা গ্রহণের সুযোগটাও অবারিত। আগে একটা রেডিও, টেলিভিশনের জন্য লাইসেন্স লাগত, এখন তা–ও লাগছে না। একটা ছোট্ট স্ক্রিনে লাখ লাখ মানুষ সেটা দেখতে পাচ্ছে। অশ্লীলতার প্রতি মানুষের জন্মগত একটা ঝোঁক আছে। ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে একেবারে নিচু স্তরের শিল্প প্রচার ও প্রসারের একটা সুযোগ তৈরি হয়েছে। এটাকেই আমি রুচির দুর্ভিক্ষ বলেছিলাম। ব্যক্তিগতভাবে কাউকে হেয় করতে চাইনি। যাঁরা শিল্প-সংস্কৃতির নামে নিচু স্তরের কাজ করছেন, তাঁরাই এর জন্য একমাত্র দায়ী নন, এর কারণটা রাজনৈতিকও বটে।
প্রথম আলো: কোন প্রেক্ষাপটে আপনি এটাকে রাজনৈতিক বলছেন?
মামুনুর রশীদ: রাজনীতিতেও নানা স্থূল বিষয় চলে এসেছে। রাজনৈতিক নেতাদের ক্ষেত্রে রুচির মান ভীষণভাবে কমে গেছে, এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। রুচির দীনতা, শিক্ষার দীনতা—সবকিছুর কারণেই এটা কমেছে। আমি মনে করি, এর পেছনে মূল কারণটা শিক্ষা। শিক্ষাব্যবস্থায় প্রবলভাবে ধস নেমেছে। এই ধসের পেছনেও রাজনৈতিক কারণ রয়েছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে গেলে কয়েক লাখ টাকা ঘুষ দিতে হয়। আমাদের সন্তানের হাতেখড়ি হবে যাঁর হাতে, সেই শিক্ষকের অবস্থা কী? যিনি ঘুষ দিয়ে শিক্ষক হচ্ছেন, তিনি কি কোনো দিনও মেরুদণ্ড সোজা করে কথা বলতে পারবেন? রাজনৈতিক শক্তি এগুলো বুঝতেও পারে না এবং প্রতিকারেরও কোনো ব্যবস্থা নেয় না।
প্রথম আলো: ডিজিটাল বিশ্বে প্রাইভেট ও পাবলিক এই দুই ধারণার কোনো সীমারেখা থাকছে না। নিয়ন্ত্রণ দিয়ে ডিজিটাল মাধ্যমে কি নৈতিকতা প্রতিষ্ঠা করা যাবে?
মামুনুর রশীদ: কোন জিনিসটা পাবলিক বা জনসমক্ষে যাবে আর কোন জিনিসটা ব্যক্তিগত বা প্রাইভেট থাকবে, সেই নৈতিকতাটা মানতে হবে। ব্রডকাস্টিংয়ের একটা নৈতিকতা আমরা সারা জীবন মেনে চলেছি। কস্টিউমের ক্ষেত্রেও আমরা সেটা মেনেছি। একটা সময় আমরা মেনে চলতাম, নাটকে কোনো অভিনেত্রীকে এমন কোনো শাড়ি পরানো যাবে না, যেটা একজন গৃহবধূ দেখে অবাক হন। সিরিয়ালে এখন দেখি জামদানি শাড়ি পরে একজন গৃহবধূ রান্নাঘরে যাচ্ছেন, ড্রয়িংরুম বসে কথা বলছেন। এ বিষয়গুলোও একসময় দেখা হতো। নিয়ন্ত্রণের কথা আমি বলতে চাই না, নিয়ন্ত্রণে আমি বিশ্বাস করি না। একটা বিষয় হচ্ছে, কোনো একটা বিষয় তার যদি শিল্পের কোনো মোড়কও থাকে, সে ক্ষেত্রে কিন্তু ভাবতে হবে কোন বিষয়টা আমরা পাবলিকলি করব আর কোন বিষয়টা প্রাইভেট থাকবে। আমি যে কথাগুলো বলেছি, সেটা শুধু একজন ব্যক্তিবিশেষকে উদ্দেশ করে বলিনি। আমি এটাও বলিনি যে তাঁরা শুধু ডিজিটাল মিডিয়ায় এমনটা করছেন। আমাদের টেলিভিশনগুলোতেও রুচির দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছে। এর বড় কারণ প্রতিযোগিতা। যেমন টেলিভিশন নাটকে কোনো সিরিয়ালের নাম দেওয়া হচ্ছে ঠসা, ল্যাংড়া, কানা অমুক...। মানুষের প্রতিবন্ধিতাকে এভাবে ব্যঙ্গ করা যায় না। আমরা এটা বোঝাতে পারিনি যে শিল্প-সংস্কৃতি শিক্ষার একটা বড় অংশ। রামকৃষ্ণ বলেছেন, নাটকে লোকশিক্ষা হয়। কিন্তু আমরা নাটককে কেবল বিনোদন হিসেবে দেখি।
প্রথম আলো: আপনার বক্তব্য ধরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যে প্রতিক্রিয়া হলো, সেটাকে কীভাবে দেখছেন?
মামুনুর রশীদ: আমি মনে করি, পৃথিবীর সর্বোৎকৃষ্ট বক্তব্যও বিতর্কের ঊর্ধ্বে নয়। আমার বক্তব্য নিয়ে বিষয়ভিত্তিক বিতর্ককে আমি সাধুবাদ জানাই। কিন্তু সেই বিতর্কটা খুব কমই হয়েছে। বরং ব্যক্তিগত আক্রমণ যেভাবে হয়েছে, তাতে আমি শুধু দুঃখিত হইনি, মর্মপীড়ায় ভুগেছি।
প্রথম আলো: আমরা এমন এক সময়ে বাস করছি, যখন ডিজিটাল বিশ্ব সবকিছুর নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠছে। এই পরিবর্তিত বাস্তবতায় যে চ্যালেঞ্জ, সেটা মোকাবিলায় সংস্কৃতিকর্মীরা কতটুকু প্রস্তুত?
মামুনুর রশীদ: ডিজিটাল বাস্তবতার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সংস্কৃতিকর্মীরা প্রস্তুত নন। তঁাদের প্রস্তুতি নেওয়া দরকার ছিল। এই দায়িত্ব কিন্তু সবার। অনেক ধরনের সংগঠন আছে, যাদের এ বিষয়ে অনেক বেশি সক্রিয় হওয়ার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু সেটা তারা করেনি। সংস্কৃতিকর্মীদের যে ভূমিকা পালন করার কথা ছিল, তাঁরা সেটা করতে পারেননি। একটা দেশে যদি অবাধ গণতন্ত্র থাকে, তাহলে দেখবেন মানুষের দেখার মান, চিন্তার মানও বেড়ে যায়।
প্রথম আলো: বুদ্ধিজীবীদের কেউ কেউ এটাকে বলতে চেয়েছেন নিম্নবর্গের মানুষের সংস্কৃতিকে অভিজাত সংস্কৃতিকর্মীরা গ্রহণ করতে পারেন না। এই সমালোচনার কী উত্তর দেবেন?
মামুনুর রশীদ: অধিকার সবারই আছে, কিন্তু ধ্বংস করার অধিকার কারও নেই। আমি কথা বলেছি সেই ধ্বংস করার অধিকারের বিরুদ্ধে। বাঙালির সংস্কৃতির সমৃদ্ধ ইতিহাসে নিম্নবর্গের মানুষের অবদান অনন্য। শ্রীচৈতন্য তো বড়লোকের সন্তান ছিলেন না, তাঁর অবদান দেখুন। তাঁর জন্ম না হলে, এ দেশটা কী পরিমাণ সাম্প্রদায়িক দেশ হতো। যাত্রাপালা তৈরি করা থেকে শুরু করে গ্রামেগঞ্জে সবখানেই তিনি অসাম্প্রদায়িকতার বাণী ছড়িয়ে গেছেন। আমাদের লালন সাঁই কোন বর্গের মানুষ ছিলেন? তিনি হিন্দু কি মুসলমান, সেই পরিচয়ও জানা যায় না। অথচ তাঁর গানে তিনি আন্তর্জাতিকতাবাদ তৈরি করে গেছেন।
প্রথম আলো: সংস্কৃতির জাগরণে সারা জীবন কাজ করলেন। কিন্তু সেভাবে কি জাগাতে পেরেছেন? ভুলটা কোথায় ছিল বলে মনে করেন?
মামুনুর রশীদ: ভুল তো হয়েছে অনেক ক্ষেত্রেই। সংস্কৃতির বিকাশের জন্য পাঠ্যপুস্তক খুব গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। পাঠ্যপুস্তক ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করা হয়েছে। আমরা শিক্ষার সঙ্গে আপস করেছি, সিলেবাসের সঙ্গে আপস করেছি। শিক্ষক নিয়োগে আপস করেছি। একসময় শিক্ষকদের বেতন কম ছিল, কিন্তু সম্মান ছিল অনেক উঁচুতে। এখন তাঁদের বেতন বেড়েছে, কিন্তু সম্মান কমে গেছে। ধীরে ধীরে সমাজ-রাজনীতি দুর্নীতির মধ্যে ঢুকে পড়েছে। সমাজে যখন জবাবদিহি থাকে না, তখন দুর্নীতি সহজ হয়ে যায়। সংস্কৃতির বিকাশও রুদ্ধ হয়ে যায়। সামরিক শাসনের সময় সে কারণেই সর্বোচ্চ দুর্নীতি হতে দেখেছি। নানা কালো আইন পাস হয়েছে দেশে। বিচারহীনতার সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে। এ সময় সংস্কৃতিকর্মীদের সবচেয়ে বেশি ভূমিকা পালনের প্রয়োজন ছিল।
প্রথম আলো: সবখানেই অন্তর্ভুক্তিমূলকতা বা গ্রহণের বিপরীতে আমরা একটা বর্জন বা নাকচের সংস্কৃতি দেখছি। এ থেকে উত্তরণের পথ কী?
মামুনুর রশীদ: সবকিছুরই একটা প্রাকৃতিক সমাধানের উপায় আছে। প্রাকৃতিকভাবেই এটা কমে আসবে। ফেসবুকে আমরা দেখি, কোনো একটা বিষয়ে ঝড় ওঠে তিন-চার দিনের জন্য। তারপর দেখা যায়, নতুন কোনো ইস্যু তৈরি হয়, আগের ইস্যুটি হারিয়ে যায়। তবে ভেতরে বিস্তারটা থেকে যায়। সেটার সবটা মোচনীয় নয়, কিন্তু এর বড় অংশটা মোচনীয়। একটা বড় সমস্যা হলো আমরা খুব বিস্মরণপ্রিয় জাতি। আমরা খুব দ্রুত ভুলে যেতে পারি। কিন্তু এই ভুলে যাওয়ার বিষয়টা ঠিক নয়। আবার বিপরীত বিষয়টাও আছে। বাঙালি একটা সামান্য বিষয়ও সারা জীবন মনে রাখে, কিন্তু গুরুতর বিষয় খুব তাড়াতাড়ি ভুলে যায়। যেটা তার ব্যক্তিগত স্বার্থের সঙ্গে যুক্ত নয়, যেটা সামষ্টিক স্বার্থের সঙ্গে যুক্ত, সেটা খুব তাড়াতাড়ি ভুলে যায়।
প্রথম আলো: সমাজের একটা বৃহত্তর অংশকে বাদ রেখে কি সাংস্কৃতিক জাগরণ সম্ভব?
মামুনুর রশীদ: গ্রামেগঞ্জে ভেতর থেকে আমাদের যাত্রা, পালাগান, লোকগান—ধীরে ধীরে ধ্বংস হয়ে গেছে। বাঙালি সংস্কৃতির বিরুদ্ধে একটা প্রতিবিপ্লব হয়ে গেছে। আমাদের অজান্তেই সর্বনাশ হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমরা একটা সময় মুক্ত নাটক আন্দোলনের মাধ্যমে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সঙ্গে সংযুক্ত থাকার প্রক্রিয়া শুরু করেছিলাম। আমরা গ্রামগঞ্জে থেকে কাহিনি সংগ্রহ করে, নাটক নির্মাণ করা শুরু করেছিলাম। কিন্তু আশির দশকে সেখানে একটা বড় শক্তির জন্ম হয়ে যায়। এনজিওগুলো ত্রাতা হিসেবে সমাজে আবির্ভূত হয়, কিন্তু তাদের রাজনীতি ছিল না। এনজিওর প্রকল্পগুলো টেকসই ছিল না। আমরা যাঁরা মঞ্চনাটক করতাম, তাঁরা আর্ট ফর্মের সঙ্গে সামাজিক কর্মকাণ্ড যুক্ত করে নাটকের মাধ্যমে একটা লোকশিক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করেছি। সেখানে এনজিও এই মাধ্যমটাকে ব্যবহার করতে শুরু করে। এনজিওর অর্থ আছে, সম্পদ আছে, কিন্তু আমাদের নাট্যকর্মীদের সেটা নেই। ফলে আমাদের নাট্যকর্মীরা এনজিওতে যুক্ত হলেন। ফলে আমাদের মুক্ত নাটক আন্দোলন ক্ষতিগ্রস্ত হলো।
প্রথম আলো: আশির দশকে আপনারা সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের নেতৃত্ব দিয়েছেন, স্বৈরাচার এরশাদের পতনে ভূমিকা রেখেছেন। এর লক্ষ্য ছিল সমতা, গণতন্ত্র ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠায় সাংস্কৃতিক জাগরণ সৃষ্টি করা। অভিযোগ যে এ সংগঠনটি দলীয় সংগঠনে পরিণত হয়েছে।
মামুনুর রশীদ: এ অভিযোগ একেবারে অসত্য নয়। একটি সংগঠন যদি দিবস পালনের মধ্যে ব্যস্ত থাকে, তাহলে তার পরিণতি এটা হবেই। বড় বড় সংকট আসছে, সেসব সংকটে তো যুক্ত হতে হয়। কিন্তু সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট তা পারছে না। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট দলীয় সংগঠন হয়ে গেছে, সেটা বলব না। সেখানে আমরা মাঝেমধ্যে তর্কবিতর্কও করতে পারি। সেখানে গণতান্ত্রিকতাও আছে। কিন্তু সংস্কৃতির কাজটা তো আর রাজনীতির মতো না। সাংস্কৃতিক কাজের জন্য চিন্তা, ভাবনা, অনুশীলন দরকার।
প্রথম আলো: পাকিস্তান আমলে পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক সংগ্রাম করতে গিয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উদ্ভব ঘটিয়েছিলাম। স্বাধীনতার পর কী হয়েছে?
মামুনুর রশীদ: আমরা বাঙালি জাতীয়তাবাদ যদি রক্ষা করতে পারতাম, তাহলে সংস্কৃতির ক্ষেত্রে এ সংকটটা তৈরি হতো না। আমি মনে করি, জাতীয়তাবাদকে আমরা যদি জরুরি মনে করতাম, তাহলে অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যেত। শুধু সংস্কৃতি কেন, অর্থনীতির ক্ষেত্রেও জাতীয় স্বার্থটা আমরা প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি। বাংলাদেশ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার হচ্ছে, কানাডায় বেগমপাড়া গড়ে উঠছে। যদি এখানে যথার্থ জাতীয়তাবাদী চেতনা বিকশিত হতো, তাহলে কি এ ধরনের ঘটনা ঘটতে পারত? অর্থনীতির সঙ্গে সংস্কৃতির গভীর সম্পর্ক আছে। মধ্যপ্রাচ্য থেকে যখন রেমিট্যান্স আসছে, তার সঙ্গে সেখানকার সংস্কৃতি কি এখানে আসছে না? ঢাকায় বনানী, গুলশান, উত্তরার মতো উপশহর গড়ে উঠেছে যেখানে বইয়ের লাইব্রেরি নেই, সিনেমা হল নেই, একটা মঞ্চ নেই। মিরপুর, মোহাম্মদপুরে একই অবস্থা। এখানকার বাসিন্দাদের মনের খোরাকটা আসবে কীভাবে।
প্রথম আলো: ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন স্বাধীন সংস্কৃতিকর্মীদের সামনে কতটা চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে?
মামুনুর রশীদ: ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন মতপ্রকাশের ক্ষেত্রে বড় প্রতিবন্ধক। এই আইনে শুধু সাংবাদিক নয়, সংগীতশিল্পী, পালাগান যঁারা করেন, জারি গান, সারি গান, বাউল গান যঁারা করেন, তঁারা সবাই আক্রান্ত হচ্ছেন। ডিজিটাল ক্ষেত্রে মানুষকে নিরাপদ রাখার জন্য হয়তো আইনের দরকার আছে। কিন্তু আইন করার আগেই চিন্তা করার প্রয়োজন ছিল, সেটা নিবর্তনমূলক হচ্ছে কি না।
প্রথম আলো: যেটা ভাবেন, সেটা কি বলতে পারেন? নাটকে সেটা প্রকাশ করতে পারেন?
মামুনুর রশীদ: কখনো পারি, কখনো পারি না। বয়সের কারণে আমরা হয়তো পারি। কিন্তু অনেক তরুণ লেখক, তরুণ নাট্যকার আমাকে বলেন, এটা তো লেখা যাবে না, এটা লিখলে পরদিন আমাকে পাওয়া যাবে না। এ কথাটা তো মারাত্মক। তিনি নিজের ওপরে একটা সেলফসেন্সরশিপ আরোপ করছেন। কিন্তু আমরা তো চিরদিন এর বিরুদ্ধেই লড়াই করেছি। একটা ভয়ের সংস্কৃতি যে তৈরি হয়েছে, সেটা অস্বীকার করা যাবে না।
প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।
মামুনুর রশীদ: আপনাদেরও ধন্যবাদ।
প্রথম আলো
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন