বাংলা ভাষার অনেক কেন্দ্র…ঢাকা, কলকাতা, আগরতলা, বরাক, লোয়ার আসাম…। ইউরোপ–আমেরিকায়ও অনেক বাংলাভাষী। ‘জাতীয় বাংলা সম্মেলন’ কোন বাংলার কথা বলছে?
সিদ্ধব্রত দাস: ‘জাতীয় বাংলা সম্মেলন’ ভারতের বাঙালির কথা বলে। বাংলা ভাষার থেকেও আমরা বেশি বলছি ভারতের বাংলাভাষীদের বর্তমান সংকট নিয়ে।
‘বাংলা’ নিয়ে হঠাৎ উদ্বিগ্ন আপনারা। বাংলা ঠিক কী ধরনের বিপদের মুখে আছে? সেই বিপদ থেকে ঠিক কীভাবে উদ্ধার চাইছেন?
সিদ্ধব্রত দাস: বাঙালি আজ নিজ ভূমিতে পরবাসী হয়ে উঠছে। ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় বহুজাতিক চরিত্র দুমড়ে ‘এক রাষ্ট্র, এক ভাষা’ নীতির মাধ্যমে হিন্দির আগ্রাসন বাংলার মানুষের জাতিসত্তার অধিকার খর্ব করছে। অন্যদিকে, ন্যাশনাল রেজিস্ট্রার অব সিটিজেন বা এনআরসির নামেও ভারতীয় বাংলাভাষীদের অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে। স্বাধীনতার ৭৫ বছর পর আমাদের শুনতে হচ্ছে আমরা বহিরাগত অনুপ্রবেশকারী।
এ সংকট থেকে যদি আমাদের মুক্তি পেতে হয়, তাহলে সব ভুলে আমাদের বাঙালি হিসেবে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। জাতিসত্তার অধিকার নিয়ে সচেতন হতে হবে। সর্বশক্তি দিয়ে হিন্দি আগ্রাসনকে রুখে দিতে হবে। ২০১৯ থেকে সেই কাজে নিয়োজিত জাতীয় বাংলা সম্মেলন।
বাংলাভাষীদের মধ্যে শ্রেণিভেদ আছে। অনেক আদিবাসীও আছে। সাধারণভাবে ‘বাংলা’কে সামনে এনে আপনারা সমাজের ভেতরকার শ্রেণিসংকট আড়াল করছেন না তো?
সিদ্ধব্রত দাস: ‘বাংলা’ বলতে যেমন আমরা বাংলা ভাষাকে বোঝাচ্ছি, তেমন বাংলা ভূখণ্ডের সব অধিবাসীর কথাও বলছি, যার মধ্যে আদিবাসী জনজাতির মানুষও আছে। হিন্দির দাপটে বাঙালিসহ বাংলার সব জনজাতি অস্তিত্বের সংকটে। জাতীয় বাংলা সম্মেলন ভারতের মাটিতে বাংলার সব ভূমিজ জাতির মধ্যে সমন্বয়ের কারিগর হিসেবে ভূমিকায় থাকতে চায়। আমাদের অন্যতম দাবি, ইউনিয়ন সরকারের সব চাকরির পরীক্ষার প্রশ্নপত্র সাঁওতালি ভাষায়ও রাখতে হবে। সেই সব ভাষা, যেমন কোচ, লেপচা, কুড়মালি, যা আজও ভারতের সংবিধানের অষ্টম তফসিলে স্বীকৃতি পায়নি, সেই স্বীকৃতির লড়াইও আমাদের।
পশ্চিমবঙ্গে দীর্ঘকাল শ্রেণি–রাজনীতি আধিপত্য করেছে। এখন হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি এবং আপনাদের ভাষাভিত্তিক রাজনীতি শক্তি পাচ্ছে। পালাবদলের সামাজিক কারণ কী? কোনো যোগসূত্র আছে?
সিদ্ধব্রত দাস: হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির লক্ষ্য ভারতকে হিন্দিভাষিক ও হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্র করা। ভাষা আগ্রাসন নিয়ে আমাদের শ্রেণি–রাজনীতির ধারক-বাহকেরা উদাসীন। জাতিসত্তার লড়াই আসলে প্রান্তিক মানুষের অস্তিত্বের লড়াই। এ সত্যকে শ্রেণিসংগ্রামীরা মানতে নারাজ। তাদের এ সচেতন উদাসীনতা জন্ম দিয়েছে জাতিসত্তার রাজনীতি। জাতিসত্তার লড়াই আজ পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে হয়ে উঠছে আর্থসামাজিক প্রান্তিক মানুষের আশ্রয়স্থল; এক নব শ্রেণিসংগ্রাম।
স্বাধীন ভারতে প্রায় আট দশক পর ভাষা প্রশ্নে পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের উপলব্ধি কী?
সিদ্ধব্রত দাস: ভাষা প্রশ্নে আমাদের ইউনিয়ন সরকারের অবস্থান ১৯৪৭ থেকেই হিন্দি আধিপত্যের পক্ষে। ২০১৪–এর পর সেটা বহুগুণ বেড়েছে। ভারতের প্রায় ৫৭ শতাংশ নাগরিক অ-হিন্দিভাষী, যার মধ্যে সবচেয়ে বড় বাংলাভাষীরা। দিল্লির শাসকেরা এই বৈচিত্র্যকে গুঁড়িয়ে উত্তর ভারতীয় আধিপত্যের ভিন্ন ভারত সৃষ্টি করতে চাইছে, যা সম্ভব নয়। ঐতিহাসিকভাবে উত্তর ভারতীয় সংস্কৃতি বাংলার মানুষ মেনে নেয়নি।
আপনাদের স্লোগান ও বিভিন্ন উদ্যাপনে হিন্দু সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখা যায়। ‘বাংলা’ নিয়ে লড়াইয়ে মুসলমানদের ঐতিহ্যকেও শামিল করার বিষয়ে কিছু ভাবছেন?
সিদ্ধব্রত দাস: বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের জীবনসংগ্রামকে সম্মান জানিয়ে ৯ ডিসেম্বর জাতীয় বাংলা সম্মেলন প্রতিষ্ঠিত হয়। ধর্মীয় মেরুকরণ বাঙালির জাতিসত্তার লড়াইয়ের পরিপন্থী। হিন্দি সাম্রাজ্যবাদের আক্রমণের সামনে আমরা বাংলার মাটির সভ্যতাকে এক সাংস্কৃতিক দুর্গে পরিণত করতে চাই, যে মাটিতে সত্য নারায়ণের পূজায় সত্যপীরের আরাধনা হয়, হিন্দু-মুসলমান মায়েরা একই সঙ্গে ওলাবিবির গান গান। চৈতন্য লালনের বাংলায় বাংলা সম্মেলন দোল ও শবে বরাত একই সঙ্গে পালন করায় বিশ্বাস রাখে।
আপনাদের আন্দোলন বরাক, ঝাড়খন্ড, আগরতলা ইত্যাদি অঞ্চলকে কীভাবে যুক্ত করার কথা ভাবে?
সিদ্ধব্রত দাস: আসাম ও ত্রিপুরায় যখন বাঙালি আক্রান্ত হয়েছে, আমরা বিক্ষোভ কর্মসূচি নিয়েছি। এসব অঞ্চলের নিপীড়িত বাঙালির জাতিসত্তার অধিকারের লড়াইকে সার্বিক সমর্থন জানিয়ে এসেছে জাতীয় বাংলা সম্মেলন। আগামী দিনেও আমরা পাশে থাকব।
বাংলা নিয়ে এ লড়াই সবল ও শক্ত হলে, তাতে এ অঞ্চলের অবাঙালিদের ভীত হওয়ার কারণ আছে কি না?
সিদ্ধব্রত দাস: জাতীয় বাংলা সম্মেলন ভ্রাতৃত্বের কথা বলে। অপরের সংস্কৃতিকে সম্মানের কথা বলে। বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের কথা বলে। আমাদের লড়াই হিন্দি আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে, হিন্দি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে। যে অ-বাঙালি বাংলার মানুষকে, মাটিকে, ভাষাকে, সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে সম্মান করবে, ভালোবাসবে, সে আমার ভাই।
ত্রিপুরাসহ উত্তর-পূর্ব ভারতে বাংলাভাষীদের যে ‘বিদেশি’ হিসেবে দেখা হয়, তাকে কীভাবে দেখছেন?
সিদ্ধব্রত দাস: একশ্রেণির মানুষ তাদের সংকীর্ণ স্বার্থ চরিতার্থ করতে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বাঙালির বিরুদ্ধে বিদ্বেষের চাষ করছে। এ হিংসা ও ঘৃণার রাজনীতিকে আমরা সফল হতে দেব না।
হিন্দি ছাড়া ভারতীয় রাজ্যগুলোকে ফেডারেল–ব্যবস্থায় বেঁধে রাখার আর কোনো উপায় দেখা যাচ্ছে না। পশ্চিমবঙ্গে আপনারা বাংলাকে যেভাবে কায়েম করতে চাইছেন, তাতে একধরনের ফেডারেলবিরোধী মনোভাব গড়ে উঠবে কি না?
সিদ্ধব্রত দাস: ভারত একটি দেশ নয়। বহু দেশের সমাহার। বহু ভাষা, সংস্কৃতি, সভ্যতার মিলনে আধুনিক ভারত নির্মিত। স্বাধীন ভারত রাষ্ট্র গড়েই উঠেছে ভাষাভিত্তিক প্রদেশ বা রাজ্য গঠনের মধ্যে দিয়ে। এ বহুত্বের ওপর আক্রমণ হলো একমাত্রিকভাবে হিন্দিকে চাপিয়ে ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকে দুর্বল করা। আমরা এর বিরুদ্ধে, বহুত্বে আস্থাশীল।
আপনাদের উগ্র হিন্দি বিরোধিতায় ভারতের অন্যত্র হিন্দিভাষীদের মধ্যে বাংলা বিদ্বেষের জন্ম দিচ্ছে কি না?
সিদ্ধব্রত দাস: ভারতে বাংলার ভূখণ্ডে আমাদের বাংলা ভাষার সংগ্রাম, বিহারে ভোজপুরি মৈথিলী ভাষার সংগ্রাম, মহারাষ্ট্রে মারাঠি ভাষার সংগ্রাম, পাঞ্জাবে পাঞ্জাবির সংগ্রাম, তামিলনাড়ুতে তামিল ভাষার সংগ্রাম, কর্ণাটকে কন্নড় ভাষার সংগ্রামের মতো। একজন হিন্দিভাষী নাগরিকের ভারতে যা অধিকার, একজন বাঙালিরও যেন সেই অধিকার থাকে, এটাই আমাদের দাবি। আমাদের লড়াই হিন্দি ভাষার বিরুদ্ধে নয়, হিন্দিভাষীর বিরুদ্ধেও নয়, হিন্দি সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে।
বাংলাদেশের বাঙালিদের জন্য আপনাদের কোনো বার্তা আছে?
সিদ্ধব্রত দাস: দেশভাগের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতিসত্তার ভাগ ঘটেছে। সেই খণ্ডিত জাতিসত্তার একটি বৃহৎ অংশ হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে জাতিসত্তার যে প্রদীপ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ প্রজ্বালন করেছে, তা সব দেশের ভাষাসংগ্রামীদের উজ্জীবিত করে। ভাষার সংগ্রাম, রুটিরুজির সংগ্রাম, জীবন–জীবিকার সংগ্রাম একে–অপরের সঙ্গে যুক্ত। এসব সংগ্রামের দ্বীপগুলোকে আমাদের রক্ষা করতে হবে পাশ্চাত্যের ভোগবাদী সংস্কৃতি থেকে, বৃহৎ পুঁজির শোষণ থেকে, ধর্মীয় মেরুকরণ থেকে। আমাদের দুই রাষ্ট্রের এবং ভাষিক, সাংস্কৃতিক ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক দীর্ঘজীবী হোক!
আপনাকে ধন্যবাদ।
সিদ্ধব্রত দাস: আপনাকেও ধন্যবাদ।
প্রথমআলো
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন