বদরুদ্দীন উমর বামপন্থী গবেষক ও রাজনীতিবিদ। জন্ম ১৯৩১ সালের ২০ ডিসেম্বর, ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমানে। ১৯৬১ সালে যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিপিই ডিগ্রি পান। ১৯৬৩ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠা করেন সমাজবিজ্ঞান বিভাগ। একটি ঘটনায় গভর্নর মোনায়েম খানের প্রতি প্রতিবাদ জানিয়ে ১৯৬৮ সালে শিক্ষকতা ছেড়ে সক্রিয় রাজনীতিতে যোগ দেন। তিনি ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন নিয়ে মৌলিক ও বিশদ গবেষণা করেন, যা একটি আকরগ্রন্থ হয়ে উঠেছে। এ সাক্ষাৎকারে তিনি বলছেন ভাষা আন্দোলন এবং সে প্রসঙ্গের সূত্র ধরে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বিকাশ, নয়া মধ্যবিত্তের বৈশিষ্ট্য, স্বাধীন রাষ্ট্রের আন্দোলন–বিমুখতার কারণ ইত্যাদি নিয়ে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন প্রথম আলোর নির্বাহী সম্পাদক সাজ্জাদ শরিফ
সাজ্জাদ শরিফ: শুরুতেই আপনার ভাষা আন্দোলনের সময়কার কিছু ব্যক্তিগত স্মৃতি শুনতে চাই।
বদরুদ্দীন উমর: ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের আগেও তো অনেক আন্দোলন হয়েছে। সংবিধান ইত্যাদি অন্য সব ইস্যু নিয়েও আন্দোলন হতো। আরমানিটোলা ময়দানে মিটিং হতো, কখনো ভিক্টোরিয়া পার্কে, সেখানে যেতাম। তবে আমি কখনো ছাত্ররাজনীতি করিনি। বর্ধমানে থাকার সময়ে স্কুল-কলেজে করিনি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও করিনি। তবে রাজনীতির সঙ্গে সব সময় সম্পর্কিত ছিলাম, যাকে বলে ওয়াকিবহাল ছিলাম। ১৯৫০ সালের এপ্রিল মাসে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলন হচ্ছে, আমতলায় মিটিং হচ্ছে—আমার মতো একজন মানুষ যে ছোটবেলা থেকেই রাজনৈতিক আবহাওয়ায় বড় হয়েছে, সে এগুলো থেকে বিচ্ছিন্ন থাকবে কী করে!
সাজ্জাদ: আপনার বাবা আবুল হাশিমের সূত্রেই কি রাজনীতির বিষয়ে ছোটবেলা থেকে সচেতন হয়ে উঠেছিলেন?
উমর: না না। আমার বাবার রাজনীতির একটা প্রভাব আমার ওপর ছিল। কিন্তু আমি তো তাঁর রাজনীতি করিনি। কোনো সময়ে ছাত্রলীগ বা মুসলিম লীগ এসব করিনি। কংগ্রেস, মুসলিম লীগ, কমিউনিস্ট—ছোটবেলায় আমাদের বাড়িতে সব রকমের রাজনীতির সংসর্গ ছিল। তবে আমি ছাত্র ফেডারেশন বা কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে সেভাবে সম্পৃক্ত ছিলাম না। কলকাতায় ২ নম্বর পার্ক সার্কাস রোডে কমিউনিস্ট পার্টির লোকজন আসত। আমরা ওখানে ছিলাম। তাদের ক্লাস করতাম। তাদের একটা প্রভাব পড়েছিল। কিন্তু ছেলেবেলা থেকে আমার মধ্যে একটা টানাপোড়েন ছিল। সম্ভবত সেই টানাপোড়েনের কারণে আমি কোনো দল বা ছাত্ররাজনীতি করিনি। সিদ্ধান্ত নিতে পারিনি, কোথায় যাব।
সাজ্জাদ: আপনি রাজনীতি না করলেও ১৯৫২ সালের ঘটনা আপনাকে টেনে নিয়ে আসে?
উমর: এ বিষয়ে আমি বলেছি। ১৯৫২ সালের আন্দোলনে আমি নেতা তো নই-ই, একজন কর্মীও ছিলাম না। যদিও ভাষা আন্দোলন নিয়ে একটা বই লিখেছি। সে সময়ে, বলা যেতে পারে, আমি একজন সচেতন অবলোকনকারী ছিলাম।
সাজ্জাদ: আপনার কখন কেন মনে হলো যে ভাষা আন্দোলন নিয়ে একটা গবেষণাধর্মী বই লেখা দরকার?
উমর: এর একটা ইতিহাস আছে। ১৯৬০-এর দশকের শেষের দিকে এসে মনে হলো, পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক ঘটনাবলি নিয়ে আমি একটা কাজ করব। আমি তখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক। ১৯৫০ সালে এখানে আসার আগে আমরা থাকতাম বর্ধমানে। এখানকার বিষয়ে কিছুই জানতাম না। ১৯৪৭ থেকে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত কী হয়েছে, জানতাম না। বাইরে থেকে এসেছি বলে ভেতরকার অনেক ব্যাপার বুঝতে পারতাম না। কোনো সংগঠনের সঙ্গেও জড়িত ছিলাম না। তখন ঠিক করলাম, প্রথমে মানুষজনের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করব। কামরুদ্দীন আহমদ ছিলেন আমাদের পারিবারিক বন্ধু। খুব বিদ্বান আর সচেতন মানুষ। তাঁর সঙ্গে আমাদের ঘনিষ্ঠতা ছিল খুব। বিষয়টা তাঁকে বলি। তাঁর সঙ্গে বসে আমি ১৯৪৭ সাল থেকে এ দেশে কী হয়েছে, তা নিয়ে দিনের পর দিন আলোচনা করে করে নোট নিতে থাকলাম। সে সময় তো টেপরেকর্ডারও ছিল না। তাই আমি নোট নিতাম। এরপর বাড়িতে ফিরে বিস্তারিতভাবে সেটা লিখে ফেলতাম। তাতে সব মনে থাকত।
এই কাজ কিছু দূর করেছি, তখন আমাদের আত্মীয় এসে আমাকে বললেন, ভাষা আন্দোলন নিয়ে ছোটখাটো একটা বই লেখা যেতে পারে। আমি বললাম, ঠিক আছে, দেখি। আমি ভাষা আন্দোলন নিয়ে তথ্য সংগ্রহ করতে নেমে গেলাম। লোকজনের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করতে লাগলাম। দেখি, ভাষা আন্দোলনের ওপর লাইব্রেরিতে কাজ করার মতো কোনো কিছু নেই। সব আমাকেই সংগ্রহ করতে হবে। কাজেই তখন ভাবতে শুরু করলাম, কী কী করা যেতে পারে।
সাজ্জাদ: এই যে আপনি ভাবলেন, কীভাবে লেখার রসদ জোগাড় করতে হবে বা লিখতে হবে, মানে একটা মেথডোলজি ঠিক করতে হবে, সেই সময় আপনার মাথায় এটা এল কীভাবে?
উমর: অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক বলেছিলেন, বইয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে এর মেথডোলজি। এটা আগে ঠিক করা দরকার। ভাষা আন্দোলন নিয়ে আমার কাজটা তো আসলে সমসাময়িক কালের ইতিহাস রচনা। সে জন্য আমি সাক্ষাৎকার, বিভিন্ন লিফলেট-প্যাম্ফলেট, চিঠি—এসব নিয়ে কাজ শুরু করি। শহীদুল্লা কায়সার আমাকে এ ব্যাপারে অনেক সাহায্য করেছিলেন। তিনি আমাকে কমিউনিস্ট পার্টির সার্কুলারগুলো এনে দিয়েছিলেন।
সাজ্জাদ: শহীদুল্লা কায়সার তখন কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য?
উমর: শহীদুল্লা কায়সার কমিউনিস্ট পার্টির লোক ছিলেন। তাঁদের দলিলপত্রের তত্ত্বাবধান করতেন। তাঁকে হত্যা করে ফেলার কারণে সুন্দরভাবে সংরক্ষণ করা কমিউনিস্ট পার্টির দলিলপত্র চিরদিনের মতো হারিয়ে গেছে। একদম শেষ। তাঁর দেওয়া ভাষা আন্দোলনের সময়কার সার্কুলারগুলো আমি রাজশাহীতে জেরক্স কপি করে রেখেছিলাম। সমাজকল্যাণ বিভাগে একজনের কাছে একটা জেরক্স মেশিন ছিল। এগুলো যে আমার কাছে আছে, মণি সিংহ সে কথা জানতেন। তিনি একদিন প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান এবং নূরুর রহমান নামে কুমিল্লার কৃষক সমিতির একজন নেতাকে আমার কাছে পাঠিয়ে দিলেন। তাঁরা আমার শান্তিনগরের বাসায় এসে বললেন, মণি সিংহ বলেছেন, তাঁদের যেন একবার সেগুলো দেখতে দেওয়া হয়। নৈতিকভাবে সেগুলো তাঁদের দেখাতে আমি বাধ্য বলে মনে করলাম। তাঁরা সেগুলো দেখে পরে আমাকে ফেরত দিয়ে যান।
যাহোক, এই সার্কুলারগুলোও আমি ব্যবহার করেছি। আমি ভাবলাম, পরবর্তী সময়ে যারা লিখবে, তাদের তো আমার মতো সুবিধা হবে না। যেভাবে আমি সাক্ষাৎকার নিতে পারি বা যেভাবে দলিলপত্র জোগাড় করতে পারি। কাজেই আমি ব্যাপকভাবে দলিলপত্র জোগাড় করতে লাগলাম, সেটা ছিল আমার মেথডোলজির একটা অংশ। মেথডোলজির কারণে আমার বইটি অন্য রকম হয়ে গেল।
সাজ্জাদ: আপনি তাজউদ্দীন আহমদের ডায়েরিও অন্তর্ভুক্ত করেছেন। এটা আপনার মাথায় এল কী করে? আপনি কি জানতেন তিনি ডায়েরি রাখেন?
উমর: আমি তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে দেখা করে আমার কাজটা নিয়ে একবার কথা বলছিলাম। কামরুদ্দীন আহমদও তখন আমার সঙ্গে ছিলেন। কথাবার্তার একপর্যায়ে তাজউদ্দীন আহমদ বললেন, আমার একটা ডায়েরি আছে। জানি না আপনার কাজে লাগবে কি না, তবে দেখতে পারেন। তিনি একটা ছেঁড়া কাপড়ের ব্যাগে করে ডায়েরিটা নিয়ে এলেন। তাতে ১৯৪৭ থেকে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত লেখা ছিল। দেখে আমি বললাম, এটা তো একটা সোনার খনি। এটার গুরুত্ব তিনি তখনো বুঝে ওঠেননি। আমি তাঁকে বললাম, ডায়েরিটা আমাকে দিন। পরে আমি ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত সব ডায়েরিই নিয়ে আসি। দেখেশুনে ১৯৫২ সালের পরের ডায়েরিগুলো তাঁকে ফেরত দিয়ে আসি।
১৯৪৮ সাল থেকে নানা রকম আন্দোলন চলছে দেশে। ঘরোয়া সভা হচ্ছে, আরমানিটোলায় জনসভা হচ্ছে। কোথায় কারা কারা রয়েছেন, কে সভাপতিত্ব করছেন—পত্রিকার রিপোর্টে এসব পাইনি। কিন্তু তাজউদ্দীন আহমদের ডায়েরিতে সেসব বিস্তারিত লেখা ছিল। অনেক সময় ওই ডায়েরি পড়ে আমি পত্রিকায় খবর খুঁজে বের করেছি। ডায়েরিটা আমাকে খুবই সাহায্য করল। আমার গবেষণাটা তাজউদ্দীন আহমদেরও বেশ উপকার করেছিল। বইটা বের হওয়ার পর একবার তিনি কলকাতায় গিয়েছিলেন। সেখানে কেউ তাঁকে চিনত না। তিনি জানিয়েছিলেন, বইটাতে এই ডায়েরি পড়ে লোকজন জেনেছিল, তাঁর একটা রাজনৈতিক পরিচয় আছে।
সাজ্জাদ: আমরা জানি, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্বে বামপন্থী ছাত্রছাত্রীরাই ছিলেন প্রধান। ভাষা আন্দোলনের পর আরও নানা রকমের ঘটনার মধ্য দিয়ে ১৯৬০-এর দশকের শেষ পর্যন্ত নানা রকম আন্দোলনের ধারা বয়ে এল। ভাষা আন্দোলনকে কি তাহলে পাকিস্তান শাসনামলে বাঙালির রাজনীতির একটা বাঁকবদল বলে চিহ্নিত করা যায়?
উমর: আমি মনে করি, এভাবে দেখাটা যথাযথ হবে না। দেখুন, ১৯৪৭ সালের পর থেকে পুরো রাজনীতির গতিটাই পাল্টে গেল। কারণ, পাকিস্তান রাষ্ট্রে দ্বন্দ্বের চরিত্রটাই তখন পাল্টে গেছে। ফলে ১৯৪৭ সালের পর থেকেই এখানে আলাদা রকমের আন্দোলনের সূচনা ঘটল। ব্রিটিশ-ভারতে হিন্দু-মুসলিম দ্বন্দ্বের ওপর ভিত্তি করে রাজনীতি হয়েছিল, দেশভাগ হয়েছিল। দেশভাগের পর মুসলমানরা এখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে গেল। ক্ষমতা চলে এল তাদের হাতে। যে ভিত্তিতে দেশভাগের আগে রাজনীতি হয়েছিল, সেটা আর থাকল না। হিন্দু-মুসলমানের দ্বন্দ্ব থাকল না। নতুন রাষ্ট্রে দেখা দিল নতুন দ্বন্দ্ব। সমাজে থাকলে তো দ্বন্দ্ব থাকবেই। নতুন দ্বন্দ্বটা কী ছিল? পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানের একটা শোষক চরিত্রের শাসকশ্রেণি পাকিস্তানে কায়েম হলো। তারা পূর্ব পাকিস্তানকে শোষণ করতে লাগল, এই যেমন ভাষার ওপর আক্রমণ। পাকিস্তানের দুই অংশে এক হাজার মাইলের দূরত্ব; ভাষা আর সংস্কৃতির পার্থক্য। সব মিলিয়ে যে দ্বন্দ্বটা তৈরি হলো, সেটা পূর্ব পাকিস্তান-পশ্চিম পাকিস্তানের, বাঙালি-অবাঙালির।
১৯৪৭-৪৮ সালে অতটা স্পষ্ট না হলেও ১৯৪৭ সালের পর থেকে ধীরে ধীরে এই দ্বন্দ্বকে কেন্দ্র করেই রাজনীতি গঠিত হতে লাগল। এই দ্বন্দ্বের ফলেই ভাষা আন্দোলন হয়েছিল। এই দ্বন্দ্ব বিকশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ১৯৬০-এর দশকে নানা রকমের আন্দোলন হয়েছে। ইমার্জেন্স অব বাংলাদেশ নামে একটা বইয়ে আমি পাকিস্তানের ইতিহাস লিখেছি। পাকিস্তানের ইতিহাস তো সেভাবে কেউ লেখেনি। এ বইটাতে আমি ধারাবাহিকভাবে পাকিস্তানের ইতিহাস লিখেছি, জনসাধারণের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। অনেকে লিখেছে, কিন্তু দেখবেন যে খণ্ড খণ্ড, বিচ্ছিন্ন। কোনো যোগসূত্র নেই। আমি যোগসূত্র দিয়েছি। তাতে দেখা যাবে, ১৯৪৭ সালের দ্বন্দ্বের যে পরিবর্তন হলো, সেটি বিকাশের একটা পর্যায়েই ভাষা আন্দোলন হয়েছে। ভাষা আন্দোলনের প্রভাবের চেয়েও যেটা দেখা দরকার, সেই দ্বন্দ্বের বিকাশটা কীভাবে হয়েছে, যার কারণে ভাষা আন্দোলন এবং অন্য আন্দোলনগুলো হলো। ১৯৫০ এবং ’৬০-এর দশকে ছাত্র, বুদ্ধিজীবী, সংস্কৃতিকর্মীদের বড় বড় আন্দোলন হয়েছে। সে সময় বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের বন্ধুবান্ধবই তো পরে বড় বড় সাহিত্যিক, লেখক, আমলা হয়েছে।
প্রথম দিকে আন্দোলন হলো রাজনৈতিক। এরপর হলো সাংস্কৃতিক আন্দোলন। ১৯৬০-এর দশকেও সাংস্কৃতিক আন্দোলন হয়েছে। ১৯৬২ সালে হলো ছাত্র আন্দোলন। ১৯৬০-এর দশকজুড়ে ছাত্র আন্দোলন, কৃষক আন্দোলন, শ্রমিক আন্দোলন ইত্যাদির এক পুঞ্জীভূত প্রতিক্রিয়া দেখা দিল ১৯৬৯ সালের গণ–আন্দোলনে। এর সবই কিন্তু পূর্ব-পশ্চিম পাকিস্তানের দ্বন্দ্বের বিকাশের ফল। ১৯৬৯ সালের গণ–আন্দোলন কিন্তু ১৯৭১-এর আগাম এক মহড়া। তবে ১৯৬৯ সালেও কেউ বুঝতে পারেনি যে দুই বছরের মধ্যেই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে যাবে। কিন্তু দ্বন্দ্বগুলোর অবস্থা এমনই ছিল যে ১৯৭১ সালে ঘটনাটা ঘটেই গেল। এ জন্য আমি ইমার্জেন্স অব বাংলাদেশ বইয়ের আলোচনা মার্চের ২৫-২৬ তারিখের আক্রমণের মধ্যেই শেষ করে দিয়েছি। ওখানেই বাংলাদেশ হয়ে গেছে৷ তারপর তো আলাদা ইতিহাস।
সাজ্জাদ: ১৯৫০-৬০-এর দশকে বাঙালি মধ্যবিত্তরা যেভাবে প্রগতিশীল আন্দোলনে সম্পৃক্ত হতে পারল, স্বাধীনতার পর তারা কেন নানা তীব্র বিরূপ পরিস্থিতিতেও সে রকম আন্দোলন করতে ব্যর্থ হলো?
উমর: এর জবাবেও আমি বলব, কারণ একই, দ্বন্দ্বের পরিবর্তন। ব্রিটিশ আমলে যেমন হিন্দু-মুসলমান দ্বন্দ্ব ছিল, পাকিস্তান আমলে তেমন পূর্ব-পশ্চিম পাকিস্তান দ্বন্দ্ব ছিল। ১৯৭১ সালের পর এই দুই দ্বন্দ্বই আর থাকল না। একটা মৌলিক দ্বন্দ্ব তাত্ত্বিকভাবে এখানে তৈরি হলো, একে এক হিসেবে বাস্তবতাও বলা চলে, সেটা হলো শ্রেণিদ্বন্দ্ব। বাংলাদেশ রাষ্ট্রে এল বাঙালিদের শাসন। সুতরাং হিন্দু-মুসলমান বা বাঙালি-অবাঙালি দ্বন্দ্ব বলে কিছু রইল না। এখন সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে অনেকে কথা বলেন। ১৯৪৭ সালে কিন্তু সাম্প্রদায়িকতার মূল উপড়ে গেছে। এখন যে হিন্দুদের বাড়িঘর লুটপাট করা হচ্ছে, এগুলো ডাকাতি, সম্পত্তি দখল করার লোভে। এই সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তি রাজনৈতিক নয়। সাম্প্রদায়িকতা যে রাজনৈতিক বর্গ, বাংলাদেশে এখন সে রকম কিছু নেই। এ নিয়ে আমি লিখেছি। হিন্দুদের ওপর কারা আক্রমণ করে, সেটা আমি স্পষ্ট করে লিখেছিলাম। যাহোক, বাংলাদেশ হওয়ার পর নতুন একটা দ্বন্দ্ব তৈরি হলো। এখন একদল শোষণ করছে, যারা শাসন করছে; আর আরেকটি দল শোষিত হচ্ছে, যারা শাসিত হচ্ছে। ব্রিটিশ ভারতে ছিল সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্ব, পাকিস্তান শাসনামলে এল আঞ্চলিক দ্বন্দ্ব। আর এখন এসে দাঁড়াল শ্রেণিদ্বন্দ্ব।
৫০ বছর পেরিয়ে গেলেও এই শ্রেণিদ্বন্দ্বের বিকাশ যে এখন পর্যন্ত হলো না, এর কারণ কি? আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করল। তার শ্রেণিচরিত্র উৎপাদনের সঙ্গে সম্পর্কহীন। ব্রিটিশ আমলের দ্বন্দ্বের মূলে ছিল এর দুটো উৎপাদক শ্রেণির মধ্যে গন্ডগোল। পাকিস্তান আমলেও তা–ই। বাংলাদেশ আমলে সংগঠন হিসেবে আওয়ামী লীগ ছিল সম্পূর্ণভাবে মধ্যস্বত্বভোগী বা অনুৎপাদক শ্রেণি। এর নেতারা ছিলেন উকিল, মোক্তার, চিকিৎসক, স্কুলশিক্ষক, ছাত্রনেতা, বেকার। শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন তাঁদের নেতা। তিনি মানুষকে জড়ো করতে পারতেন, আলোড়িত করতে পারতেন। এগুলোকে অবলম্বন করে তিনি ১৯৭১ সাল পর্যন্ত এলেন।
স্বাধীনতার পর তিনি ক্ষমতায় এলেন। এই অনুৎপাদক শ্রেণি ক্ষমতা দখলের পর যে ধনসম্পদ অর্জন করল, তা তো উৎপাদনের মাধ্যমে করছিল না। যে মধ্যবিত্ত শ্রেণি এরপর তৈরি হলো, সেটা তো লুণ্ঠনজীবী শ্রেণি, কোনো উৎপাদক শ্রেণি নয়। উৎপাদক শ্রেণি শোষক হলেও লুণ্ঠনজীবীদের চেয়ে ভালো। কারণ, তারা কাজের সুযোগ তৈরি করে। মানুষ কাজ পায়। এর মধ্যে পড়ে যে নতুন প্রজন্ম তৈরি হলো, সে কোথায় যাবে। সে জালের মধ্যে পড়ে গেল। লুণ্ঠনজীবীরা তো পাচ্ছে, তারা প্রতিরোধ করবে কেন? কাজেই প্রতিরোধ আন্দোলন হওয়ার মতো কোনো বাস্তব পরিস্থিতি এখন নেই।
সাজ্জাদ: ইতিহাসকে তো আমরা বারবার নতুন নতুন চোখে দেখি। সেখানেই এর মাধুর্য। তাতে ইতিহাস এই বর্তমানের মধ্যে একটা অর্থবহ তাৎপর্য পায়। ভাষা আন্দোলনের থিসিসটাকে যদি বর্তমান প্রেক্ষাপটে আমরা নতুন করে হাজির করতে চাই, সেই থিসিসটা কী হতে পারে?
উমর: দেখুন, ১৯৭১ সালের আগপর্যন্ত ভাষা আন্দোলনকে আমরা পালন করে আসছি প্রতিরোধের দিবস হিসেবে, শোকের দিবস হিসেবে নয়। শোক নয়, শক্তি। কেউ কেউ অবশ্য তখনো একে শোক দিবস হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল, কিন্তু সফল হয়নি। ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আওয়ামী লীগ একটা রীতি চালু করল যে রাত ১২টার সময় প্রধানমন্ত্রী শহীদ মিনারে গিয়ে ফুল দিয়ে উদ্বোধন করবেন বা এ–জাতীয় কিছু একটা করবেন। এরপর হলো কি, ভোরে যে মিছিলটা হতো, প্রভাতফেরিতে যে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর লেখা এবং আলতাফ মাহমুদের সুর দেওয়া ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ গানটা গাওয়া হতো, সেটা ম্রিয়মাণ হয়ে গেল। ২১ ফেব্রুয়ারিতে জনতার যে আবেগময় অংশগ্রহণ ছিল, এ ঘটনার ফলে তার সৌন্দর্য বা মহিমা নষ্ট হয়ে গেল। শোকের দিবসে তো প্রতিরোধের চেতনা থাকে না। তা ছাড়া ভাষা আন্দোলন তো হয়েছিল সর্বস্তরে বাংলা চালু করার জন্য। সেটা হলো কই?
সাজ্জাদ: বাংলাদেশ রাষ্ট্রে বাংলা ভাষার পরিস্থিতি কেমন দেখছেন?
উমর: এখন তো এখানে কাজকর্মের বড় অংশই চলে ইংরেজিতে। সংসদে যে এখনো যে বাংলা বলে, তার কারণ তা না হলে বেশির ভাগ লোক কথা বলতে পারবে না। নইলে ইংরেজিতেই চলত। আদালতে ইংরেজিতে রায় দেয়, বাংলাতেও মাঝেমধ্যে দিচ্ছে। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে এখানকার সব দোকানপাটের সাইনবোর্ড ইংরেজিতে লেখা ছিল। স্বাধীনতার পর সব বাংলায় হয়ে গেল। এখন আবার সব ইংরেজি হয়ে গেছে। এগুলো হচ্ছে একটা নির্দেশক।
১৯৫২ সালে শিক্ষার মাধ্যম বাংলা করার জন্য আন্দোলন হয়েছে। শেখ সাহেব ১৯৭২ সালে এসেই সেটা চালু করে দিলেন। স্পষ্টতই খুব প্রশংসনীয় কাজ। কিন্তু অবাস্তবভাবে সেটা করা হলো। পরিকল্পিতভাবে একটা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে করা হলো না। যে ইংরেজি ভাষায় ২০০ বছর ধরে পড়ানো হচ্ছে, রাতারাতি সেটা ভেল্কিবাজির মতো বদলে ফেলা হলো। শিক্ষার মাধ্যম বাংলা করা হলেও বাংলায় লেখা বই থাকল না। প্রাথমিক পর্যায়ে কোনো সমস্যা না থাকলেও মাধ্যমিক, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে বড় সমস্যা দেখা দিল। এই শূন্যতায় শিক্ষার বিরাট একটা অবনতি ঘটে গেল। পাঠ্যবইয়ের জন্য যোগ্য একটা টেক্সট বই বোর্ড করা দরকার ছিল। করা হলো, কিন্তু একেবারে অযোগ্য। সবচেয়ে বেশি দরকার ছিল একটা অনুবাদ সংস্থা করা, যেখানে ব্যাপক আকারে গুরুত্বপূর্ণ বইগুলো অনুবাদ করা হবে। সেটা হলো না। এর শূন্যতা পূরণ করল তৃতীয় শ্রেণির নোটবই। টেক্সট বইয়ের বদলে নোটবই পড়ে ছেলেমেয়েরা এমএ পর্যন্ত পাস করতে লাগল।
সাজ্জাদ: ভাষা আন্দোলন নিয়ে আপনি তো গবেষণা করেছেনই। নতুন কোনো বিষয়ে বা দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এ নিয়ে কি আরও কোনো গবেষণার জায়গা আপনি দেখতে পান?
উমর: হ্যাঁ হ্যাঁ, অবশ্যই জায়গা আছে। ভাষা আন্দোলনের মতো একটা বিষয়কে অনেকভাবেই তো দেখা যেতে পারে। ধরুন কৈবর্ত বিদ্রোহ, ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ, সাঁওতাল বিদ্রোহ—এসব বিষয়ে এখনো গবেষণা হচ্ছে না? তাহলে ভাষা আন্দোলন নিয়ে কেন হবে না? ভাষা আন্দোলন নিয়ে কিছু কাজ অবশ্য হয়েছে। আতিউর রহমানকে আমি বলেছিলাম, ঢাকার বাইরে যেসব জায়গায় ভাষা আন্দোলন হয়েছিল, তা নিয়ে গবেষণা করতে। সেটা তিনি করলেন কোথায়! বাংলা একাডেমি থেকে বশীর আল্হেলাল একটা বই করেছেন। সেটাও ভালো বই। সেটাতে সাংস্কৃতিক দিকগুলো এসেছে বেশি, তবে বিশিষ্ট কোনো দৃষ্টিভঙ্গি নেই। অনেকভাবেই এখন এ নিয়ে গবেষণা হতে পারে।
প্রথম আলো
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন