‘নিরাপদ সড়ক চাই’ আন্দোলনের জন্ম ১৯৯৩ সালের ২২ অক্টোবর। চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন সড়ক দুর্ঘটনায় স্ত্রী জাহানারা কাঞ্চনকে হারিয়ে এ আন্দোলন গড়ে তোলেন। এরপর অন্যান্য প্রতিষ্ঠানও এগিয়ে আসে। সম্প্রতি এসব সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত হয় ‘রোড সেফটি কোয়ালিশন’। ২০১৭ সাল থেকে ২২ অক্টোবরকে জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে সরকার ২০১৮ সালে সড়ক পরিবহন আইন করলেও এখনো তা বাস্তবায়িত হয়নি পরিবহনমালিক ও শ্রমিকদের বিরোধিতার কারণে। অন্যদিকে সড়কে দুর্ঘটনা ও হতাহতের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। এই প্রেক্ষাপটে ইলিয়াস কাঞ্চনের মুখোমুখি হয় প্রথম আলো।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সোহরাব হাসান
ইলিয়াস কাঞ্চন: সড়কের নিরাপত্তার বিষয়ে একসময় মানুষের ধারণাই ছিল না। তারা মনে করত সড়ক দুর্ঘটনা ও হতাহতের বিষয়টি নিয়তিনির্ধারিত। কিছু করণীয় নেই। ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ আন্দোলনের মাধ্যমে আমরা বিষয়টি জনগণের সামনে আনি। দীর্ঘ সময় এককভাবে কাজ করেছি। এরপর আরও অনেক সংগঠন এগিয়ে আসে। জাতিসংঘ ২০১১-২০ সালকে সড়ক নিরাপত্তা দশক ঘোষণা করে। বলা হলো, দুর্ঘটনা রোধ করতে প্রয়োজন সড়ক নিরাপত্তাসংক্রান্ত পরিকল্পনা, ব্যবস্থাপনা ও সমন্বয়; সড়ক দুর্ঘটনাবিষয়ক ডেটা সিস্টেম বা উপাত্ত সংরক্ষণ ব্যবস্থা; সড়ক নিরাপত্তা প্রকৌশল; সড়ক ও যানবাহনসংক্রান্ত আইন; ট্রাফিক এনফোর্সমেন্ট; চালকদের প্রশিক্ষণ ও পরীক্ষা; যানবাহনের নিরাপত্তা; সড়ক নিরাপত্তাবিষয়ক শিক্ষা ও প্রচার। তখন মৃত্যুর হারে সড়ক দুর্ঘটনা ছিল সপ্তম। জাতিসংঘ থেকে বলা হলো, যদি প্রতিরোধ না করি, তাহলে এটি এক নম্বরে চলে আসবে। পরবর্তী সময়ে ব্র্যাক, আহ্ছানিয়া মিশন, রেডক্রস সোসাইটি, হার্ট ফাউন্ডেশনও কাজ করল। বুয়েট এগিয়ে এল। ১৯৯৩ সালে তৎকালীন সরকার রোড সেফটি কর্তৃপক্ষ করল। তাইফুর রহমান নামের এক বাঙালি কর্মকর্তা জাতিসংঘের কর্মসূচিতে বাংলাদেশকে যুক্ত করলেন।
পরে নিরাপদ সড়ক নিয়ে যাঁরা কাজ করছিলেন, তাঁদের আলাদা দায়িত্ব দেওয়া হলো। কেউ গতিসীমা নিয়ন্ত্রণ, কেউ সচেতনতা তৈরি, কেউ প্রশিক্ষণের দায়িত্ব নিলেন। এই সংগঠনগুলোর সমন্বয়েই গঠিত হয়েছে রোড সেফটি কোয়ালিশন। এ বছর জানুয়ারিতে আমরা কাজ শুরু করি। আমাদের আইনে যেসব অসংগতি আছে, সেগুলো সংশোধন করার তাগিদ দেওয়া হলো। শুধু চালকদের নয়, তার পেছনে বা পাশে যিনি বা যাঁরা থাকেন, তাঁদেরও সিটবেল্ট পরতে হবে।
ছাত্রদের আন্দোলনের মুখে সরকার ২০১৮ সালে সড়ক পরিবহন আইন সংসদে পাস করে। কিন্তু আইনটি চার বছর পরও বাস্তবায়িত হলো না কেন?
ইলিয়াস কাঞ্চন: যখন আইনটি পাস হলো, এর দুই মাস পর মালিক ও শ্রমিকপক্ষ—সবাই নয়, তাদের একটি গোষ্ঠী এটি বাতিল করার জন্য আন্দোলন করল। কিন্তু সরকার আইন বাতিল করেনি। এরপর ২০১৯ সালের অক্টোবরে প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দিলেন নভেম্বর থেকে আইন কার্যকর হবে। আইন কার্যকর করার জন্য বিধি জারি করতে হয়। কয়েকজনকে দায়িত্ব দেওয়া হলো। যত দূর জানি, সেই বিধি এখন অর্থ মন্ত্রণালয়ে আছে। যে আইন সংসদে পাস হলো, সেই আইনটি কেন আটকে রাখা হবে? আমরা দাবি করছি অবিলম্বে এটি কার্যকর হোক। বিআরটিএকেও সেভাবে প্রস্তুত করা হয়নি। সড়কে কত গাড়ি চলাচল করছে, কতটির নিবন্ধন আছে, কতটির ফিটনেস নেই—সব বিষয়েও ডেটাবেজ থাকার কথা। কিন্তু তাদের কাছে কোনো হিসাব নেই। আমরা বলছি এগুলো করতে হবে। আইনে ড্রাইভিং লাইসেন্সধারীদের পয়েন্ট বা নম্বর কাটার বিধান আছে। সেটা করতে হলে স্মার্ট ড্রাইভিং লাইসেন্স দিতে হবে। সেটাও কার্যকর হয়নি। এখানেও সরকারের ব্যর্থতা আছে।
রোড সেফটি কোয়ালিশনের সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়েছে, আইনের কতিপয় বিধি সংশোধন করা হয়েছে; যাতে এর কার্যকারিতা খর্ব হবে।
ইলিয়াস কাঞ্চন: কিন্তু বিধির চূড়ান্ত খসড়াই তো আমাদের দেখানো হয়নি। আমরা আশঙ্কা করছি, বিধি শিথিল করলে আইনটি দুর্বল হবে। সরকারের পুরো প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতার অভাব আছে।
সড়ক দুর্ঘটনা কমলে পরিবহনমালিক ও শ্রমিকেরাও লাভবান হবেন। তাহলে কেন তঁারা আইনটি ঠেকিয়ে রাখতে চাইছেন?
ইলিয়াস কাঞ্চন: ঠেকিয়ে রাখা হয়েছে সাধারণ শ্রমিক ও এমনকি মালিকদের স্বার্থে নয়। একশ্রেণির শ্রমিক ও মালিক সংগঠনের নেতা এটি ঠেকিয়ে রেখে লাভবান হতে চাইছেন। আইন কার্যকর হলে তো তাঁরা চাঁদাবাজি করতে পারবেন না। অনেক পরিবহনশ্রমিকের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। তঁারা অনেক কষ্টে আছেন। নেতারা বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের নামে যে চাঁদা নেন, তা তো শ্রমিকদের কল্যাণে ব্যবহার করা হচ্ছে না। আমার সংগঠনের সঙ্গে কাজ করেছেন, একজন পরিবহনশ্রমিক মারা গেলেন, তাঁর পরিবারকে কোনো সহায়তা দেওয়া হলো না। আমরা কিছুটা সহযোগিতা করেছি। পরিবহনশ্রমিকদের কল্যাণের জন্য তাঁরা চাঁদা নিয়েছেন, অথচ শ্রমিকদের জন্য একটি হাসপাতাল করেননি, তাঁদের সন্তানদের স্কুল বা কলেজে পড়াশোনায় সহায়তা করেননি। আসলে সাধারণ শ্রমিকদের কাছ থেকে চাঁদা নিয়ে নেতারা আখের গুছিয়েছেন।
তাহলে কি পরিবহন খাতটি ঘিরে একটি মাফিয়া চক্র সক্রিয় আছে বলে মনে করেন?
ইলিয়াস কাঞ্চন: হ্যাঁ, পরিবহন খাত ঘিরে মাফিয়া চক্র সক্রিয় আছে। এরাই সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে। এরাই সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে। সাধারণ শ্রমিক বা মালিকদের তো সেই সুযোগ নেই।
আপনারা তো সড়ক পরিবহন খাতের সমস্যা নিয়ে সরকারের নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে কথা বলেছেন। তাঁদের প্রতিক্রিয়া কী?
ইলিয়াস কাঞ্চন: অনেকবার কথা হয়েছে আমাদের দাবিদাওয়া নিয়ে। তাঁরা বলেছেন, আপনারা যতক্ষণ পর্যন্ত ধাক্কা দিতে না থাকবেন, ততক্ষণ দাবিদাওয়া আদায় হবে না।
ধাক্কাটি কেমন?
ইলিয়াস কাঞ্চন: ধাক্কা হলো জনগণকে নিয়ে মাঠে নামা। যেমন রমিজউদ্দীন স্কুল অ্যান্ড কলেজের দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যুর পর ছাত্ররা নেমে এসেছিল। আমার স্ত্রী মারা যাওয়ার পর আমিও সমস্যাটি নিয়ে সোচ্চার হয়েছি। অনেকের সমর্থন ও সহযোগিতা পেয়েছি। কিন্তু একটা বিষয় দেখেছি, সড়ক দুর্ঘটনায় যাঁরা মারা যান, তাঁদের পরিবার এ নিয়ে তেমন উচ্চবাচ্য করে না। ভুলে যায়। ভুলে গেলে কোনো সমস্যার সমাধান হবে না। রাস্তায় নামতে হবে। যাঁরা মারা গেছেন, তাঁদের তো ফিরিয়ে আনতে পারব না। কিন্তু ভবিষ্যতে আর যাতে কেউ মারা
না যায়, সে জন্য যদি ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের লোকজন এগিয়ে আসত, আমার সঙ্গে রাস্তায় থাকত, তাহলে আন্দোলনটা আরও জোরদার হতো। সরকার দ্রুত দাবি মানতে বাধ্য হতো।
নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে কি আপনি তাদের পাশে পাননি?
ইলিয়াস কাঞ্চন: খুব কম। আমাকে যাঁরা ভালোবাসেন, যাঁরা সড়ক দুর্ঘটনাকে বড় সমস্যা হিসেবে দেখছেন, তাঁরা এসেছেন। সারা দেশে আমাদের সংগঠন আছে। দলমত-নির্বিশেষে সবাই কাজ করছেন। সচেতনতা তৈরি হয়েছে। কিন্তু ভিকটিমের পরিবার থেকে তেমন সাড়া পাইনি।
আপনি সড়ক ব্যবস্থাপনায় ডেটাবেজের কথা বলছিলেন। কিন্তু সড়ক দুর্ঘটনায় কত লোক মারা গেছে, তার কি কোনো হিসাব আছে?
ইলিয়াস কাঞ্চন: না, নেই। জাতিসংঘ সেই ডেটাবেজের কথা বলেছে। তা প্রতিষ্ঠা করতে পারলে আমরা সঠিক হিসাবটা পেতাম। এমনকি যে গাড়িটি দুর্ঘটনায় পড়ল, কীভাবে পড়ল, পেছন থেকে না সামনে থেকে ধাক্কা লেগেছে, তা-ও বের করা যেত।
অনেক কারণেই সড়ক দুর্ঘটনা হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বিপজ্জনক কারণ হিসেবে কোনটিকে চিহ্নিত করব?
ইলিয়াস কাঞ্চন: আমি বলব, অদক্ষ চালকের কারণেই বেশি দুর্ঘটনা ঘটে। আমাদের চালকদের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক কোনো শিক্ষা নেই। প্রশিক্ষণ মানে কেবল গাড়ি চালনা শিক্ষা নয়। গাড়ির গতিবিধি, সড়কের কাঠামো ইত্যাদি সম্পর্কেও তার সম্যক জ্ঞান থাকতে হবে। গতি সম্পর্কে জানতে হবে। বেশি গতিতে গাড়ি চলতে থাকলে দুর্ঘটনার শঙ্কাও বেশি থাকবে। আমাদের একশ্রেণির চালক বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালিয়ে আনন্দ পান। কিন্তু এর পরিণাম নিয়ে ভাবেন না। আবার গাড়ির যাত্রী ও পথচারীদেরও সচেতনতার অভাব আছে। অনেক সময় দ্রুত যাওয়ার জন্য যাত্রীরা চালককে তাগিদ দেন। আমরা বলি যত গতি তত ক্ষতি।
আমাদের সড়ককাঠামোয় তো সমস্যা আছে।
ইলিয়াস কাঞ্চন: সড়ককাঠামোয় দুর্বলতা আছে। তারপরও বলল চালকেরা যদি গতিসীমার মধ্যে থাকেন, রাস্তার পাশের নির্দেশনাগুলো যদি মেনে চলেন, তাহলে দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব। আমাদের রাস্তার বাঁক বেশি। কিন্তু সেই বাঁকে গাড়ি চালানোর যে একটা নিয়ম আছে, সেটা তো আপনাকে মানতে হবে। হর্ন দিতে হবে। সিস্টেমগুলো কাজ করছে না বলেই দুর্ঘটনা ঘটছে। এরপর দেখাতে হবে গাড়িটির ফিটনেস আছে কি না।
বাংলাদেশের গাড়িচালকদের বেশির ভাগেরই প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ নেই। এ বিষয়ে আপনারা কোনো পদক্ষেপ নিয়েছেন কি?
ইলিয়াস কাঞ্চন: চালকদের প্রশিক্ষণের জন্য আমরা চেষ্টা করছি। আমি একজন চলচ্চিত্র অভিনেতা। আমার যা কিছু সম্পদ ছিল, সবটাই নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের কাজে ব্যয় করেছি। ২০১৩ সালের আগপর্যন্ত আমরা নিজস্ব উদ্যোগেই চালকদের প্রশিক্ষণ ও মানুষকে সচেতন করার কাজ করেছি। আমাদের সদস্যদের চাঁদা ও পৃষ্ঠপোষক সংগঠন বা সংস্থার সহায়তাও নিয়েছি। আমি ওয়ালটনের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। ওই প্রতিষ্ঠানও সহায়তা করেছে। পরে বিদেশি সংস্থাগুলো এগিয়ে এসেছে। আমরা হালকা গাড়ির চালক যাঁরা, তাঁদেরই প্রশিক্ষণ দিচ্ছি। কিন্তু ভারী গাড়ির চালকদের প্রশিক্ষণ দিত পারি না জায়গার অভাবে। সরকারের কাছে জায়গা চেয়েছিলাম। সরকার বলেছে জায়গা নেই। অথচ অনেক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান সরকারি জায়গা দখল করে আছে। চালকদের একটি প্রকল্পের আওতায় প্রশিক্ষণ দেওয়ার চেষ্টা করছি। কিন্তু কাজে নেমে দেখলাম প্রশিক্ষণ দেওয়ার মতো প্রশিক্ষক নেই। এরপর সরকার প্রশিক্ষক তৈরি করার একটি প্রকল্প নিয়েছে। সমস্যা হলো আমাদের কাজ সহজে ও সময়মতো হয় না।
সড়ক পরিবহন আইন প্রণয়নের পাশাপাশি দুর্ঘটনা রোধে প্রধানমন্ত্রী যে পাঁচ দফা নির্দেশনা দিয়েছিলেন, তা–ও বাস্তবায়িত হয়নি। কী বলবেন?
ইলিয়াস কাঞ্চন: প্রধানমন্ত্রী তো নির্দেশনা দিয়েছেন। তিনি তো বাস্তবায়ন করবেন না। বাস্তবায়ন না করায় কারও তো কোনো অসুবিধা হয়নি। তাহলে বাস্তবায়ন করবে কেন? বাস্তবায়ন না করার কারণে যদি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ও দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি অসুবিধায় পড়তেন, তাহলে অবশ্যই নির্দেশনা বাস্তবায়িত হতো। এলজিইডির একজন প্রকৌশলী আমাকে বলেছিলেন, আমরা কাজ করলে অনেক ভুল বের করা হয়। আর কাজ না করলে একটা ভুল। কেবল সড়ক নয়, সরকারের অন্যান্য খাতেও নির্দেশনা, সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হয় না। এখানে অনেক পক্ষের জড়িত থাকার কারণে অনিয়মটাও বেশি।
আইন কার্যকর না হওয়ার জন্য কারা দায়ী বলে মনে করেন?
ইলিয়াস কাঞ্চন: আইন কার্যকর না হওয়ার পেছনে স্বার্থান্বেষী মহল বড় বাধা। সরকার সিদ্ধান্ত নিল সমন্বিত ব্যবস্থাপনায় ঢাকা শহরে বাস চলবে। যার ১০টি বাস আছে, তিনি ১০টি বাসের ভাড়া পাবেন, যার দুটি আছে তিনি দুটি বাসের ভাড়া পাবেন। সাবেক মেয়র আনিসুল হক গুলশানে করেও দেখিয়েছেন। সমন্বিত ব্যবস্থাপনায় বাস চললে অসুস্থ প্রতিযোগিতা থাকত না। লাইসেন্স ছাড়া কেউ বাস চালাতে পারত না। যারা লাইসেন্স ছাড়া বাস চালাতে দিচ্ছেন, যারা ফিটনেসহীন গাড়ি রাস্তায় নামাতে দিচ্ছে, তারাই এটি চালু করতে দিচ্ছে না। এর পেছনে মোটা অঙ্কের টাকা লেনদেন হয়। নিয়মের মধ্যে এলে তো লেনদেন বন্ধ হয়ে যাবে।
কিন্তু যাদের বিষয়টি দেখার কথা, বিআরটিএ বা অন্যান্য সংস্থা কী করছে?
ইলিয়াস কাঞ্চন: তাদের মধ্যেও লেনদেন আছে। পুরো সড়ক বিভাগই লেনদেনের মধ্য দিয়ে চলছে। আমাদের দেশটার অবস্থা হয়েছে, যেখানে অনিয়ম চলছে, চলুক। অনিয়ম হলে সরকারের কোনো অসুবিধা হয় না। হ্যাঁ, মাঝেমধ্যে অসুবিধা হলে সরকারও নড়েচড়ে বসে। নিয়মের মধ্যে আনার চেষ্টা করে। যেমন ২০১৮ সালে ছাত্রদের আন্দোলনের সময় হয়েছিল। এভাবে রাস্তার বড় আন্দোলন করতে পারলে সড়ক পরিবহন নিয়মের মধ্যে আসবে। অন্যথায় এভাবেই চলতে থাকবে।
সাবেক মন্ত্রী শাজাহান খানের বিরুদ্ধে আপনি ১০০ কোটি টাকার মানহানি মামলা করেছিলেন। সেই মামলার অগ্রগতি কী? তদন্ত হয়েছে?
ইলিয়াস কাঞ্চন: আমাদের এখানে আইনের দীর্ঘসূত্রতা একটা বড় সমস্যা। আমি মামলা করলাম, এখন আমাকেই নানা প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। বিবাদীপক্ষ থেকে যেসব কথা বলা হচ্ছে, তা হাস্যকর। তঁারা বলছেন, আমি নিরাপদ সড়ক আন্দোলন করি এর প্রমাণ কী। আমি চলচ্চিত্র অভিনেতা তার প্রমাণ দিতে হবে, সমাজে আমার খ্যাতি আছে, তার প্রমাণ দিতে হবে। তাঁরা বলতে চাইছেন আমার যেহেতু মানই নেই, তাই মানহানি মামলা হতে পারে না। এ অবস্থায় মানুষ ন্যায়বিচার কীভাবে পাবে?
আমরা গণমাধ্যমে দেখেছি, সড়ক বিভাগের কোনো অনুষ্ঠানে আপনি উপস্থিত থাকলে সড়ক পরিবহনের নেতারা যান না। কারণ কী?
ইলিয়াস কাঞ্চন: তাঁরা আমাদের সঙ্গে অসহযোগিতা করছেন। আমি বিভিন্ন বাস টার্মিনালে গিয়ে শ্রমিক ও মালিকদের সঙ্গে কথা বলতাম। তঁাদের সমস্যা বোঝার চেষ্টা করতাম। এখন সেখানে আমার যাওয়া নিষিদ্ধ হয়ে গেছে। একইভাবে আমি সরকারি অনুষ্ঠানে গেলে তাঁরা যান না। আমি তো নিজের জন্য আন্দোলন করছি না। আমি আন্দোলন করছি মানুষের নিরাপত্তার জন্য। সড়ক নিরাপদ থাকলে যাত্রীদের পাশাপাশি চালকও নিরাপদ থাকবেন।
পরিবহনমালিকেরা আপনার ওপর ক্ষুব্ধ কেন?
ইলিয়াস কাঞ্চন: শ্রমিকদের প্রতি মালিকদের যে দায়দায়িত্ব আছে, তাঁরা তা পালন করছেন না। সড়কে দুর্ঘটনা ঘটলে তঁাদেরও দায় আছে। তাঁরা দক্ষ চালক নিয়োগ দেন না, তাঁরা ফিটনেস ছাড়া গাড়ি নামান। এসব কারণে আমাদের কথা তাঁদের ভালো লাগে না।
সড়ক দুর্ঘটনা রোধে সাধারণ মানুষ কতটা সচেতন?
ইলিয়াস কাঞ্চন: সচেতনতাও একটি সংস্কৃতি। এটি আমাদের এখানে গড়ে ওঠেনি। স্বাধীনতার পর এমন একটি সরকারও আসেনি, যারা মানুষকে নিয়মের মধ্যে আনতে, আইনের মধ্যে আনতে যথেষ্ট কাজ করেছে। অনিয়মকে আমরা নিয়মে পরিণত করে ফেলেছি। কেবল উপদেশ দিয়ে মানুষকে সচেতন করা যাবে না। সচেতন করতে হলে সিঙ্গাপুরের মতো আইন মানতে বাধ্য করতে হবে। একসময় সিঙ্গাপুরেও চরম বিশৃঙ্খলা ছিল। তারা সেটি নিয়মের মধ্যে নিয়ে এসেছে। এটি সম্ভব হয়েছে আইনের যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে। যঁারা আইন প্রয়োগ করাবেন, তঁাদের আগে আইন মানতে হবে। আমাদের এখানে ক্ষমতাবানেরা আইন মানে না। নেতারা ও প্রভাবশালী ব্যক্তিরা আইন অগ্রাহ্য করতে করতে জাতিকে অধঃপতনের দিকে নিয়ে গেছেন। তাই আইন মানার সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হলে ক্ষমতাবান ও প্রভাবশালীদের আগে আইনভঙ্গের দায়ে শাস্তি দিতে হবে। তাহলে অন্যরা ভয় পাবে। ভাববে অমুকে যখন শাস্তি পেয়েছেন, আমাকেও ছাড় দেবে না। অনেক দেশে মন্ত্রী-প্রধানমন্ত্রীকেও সড়ক আইন না মানার জন্য জরিমানা দিতে হয়েছে। আমাদের দেশে কি এটা সম্ভব?
সম্প্রতি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা বেড়েছে। অনেক মানুষ হতাহত হচ্ছে। রোধ করার উপায় কী।
ইলিয়াস কাঞ্চন: দুর্ঘটনা কমাতে অনেক দেশই মোটরসাইকেল চলাচলকে নিরুৎসাহিত করেছে। গণপরিবহন টেকসই হলে মানুষ মোটরসাইকেলও কম ব্যবহার করবে। আমাদের দেশে মোটরসাইকেলচালকেরাও কিন্তু প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন না। গাড়ি চালাতে জানাই যথেষ্ট নয়। চলাচলের সময়, পরিবেশ ইত্যাদি বিষয়েও সচেতন থাকতে হবে। ইনস্টিটিউট ছাড়া প্রশিক্ষণ সম্ভব নয়। বন্ধুর বা ভাইয়ের মোটরসাইকেল আছে, আমি দুদিনে শিখে নিলাম এটি কাজের কাজ নয়। প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ নিতে হবে। আবার শিখলেই হবে না। নিয়মকানুনগুলো মেনে চলতে হবে। যেনতেন হেলমেট পরলে হবে না। বিদেশে মোটরসাইকেল আরোহীরা আলাদা পোশাক পরেন। ওই পোশাক শরীরে আঘাত গুরুতর হয় না। কম্বোডিয়া, ভিয়েতনামে মোটরসাইকেল ব্যবহার কমিয়ে দেওয়া হয়েছে।
সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সঠিক হিসাব আছে কি? একেক সংগঠন একেক রকম তথ্য দিচ্ছে।
ইলিয়াস কাঞ্চন: আমাদের এখানে সংগঠনগুলো যেসব তথ্য দিচ্ছে , তার ওপর নির্ভর করা যায় না। জাতিসংঘের দেওয়া তথ্যই সঠিক বলে মনে করি। তারা ২০২০ সালের হিসাব দিয়েছে বাংলাদেশে ২৫ হাজারের বেশি মানুষ মারা গেছে সড়ক দুর্ঘটনায়। তারা কেবল আমাদের দেশের দুর্ঘটনা নিয়ে কাজ করে না। সারা বিশ্বেরই হিসাব দেয়। অথচ আমাদের সরকার মানতে চাইছে না।
২২ অক্টোবর সামনে রেখে আমাদের দাবি হলো, বহু কষ্ট করে কাঠখড় পুড়িয়ে যে সড়ক পরিবহন আইনটি করা হলো, সেটি বাস্তবায়ন করা। আইন বাস্তবায়িত হলে যাত্রী, চালক, মালিক পথচারী সবাই লাভবান হবেন।
আপনাকে ধন্যবাদ।
ইলিয়াস কাঞ্চন: আপনাকেও ধন্যবাদ।
প্রথমআলো
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন