এদেশে যা হচ্ছে এমন ছাত্ররাজনীতি বিশ্বে কোথাও নেই
02 October 2022, Sunday
ড. কামরুল হাসান মামুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের জ্যেষ্ঠ অধ্যাপক। পাশাপাশি তিনি সংবাদ ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শিক্ষা এবং সমকালীন বিষয়াবলি নিয়ে লেখালেখি করেন। দেশে চলমান ছাত্ররাজনীতি ও এ বিষয়ের নানা সংকট নিয়ে দেশ রূপান্তরের সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সম্পাদকীয় বিভাগের সাঈদ জুবেরী
দেশ রূপান্তর : ছাত্ররাজনীতি দেশের শিক্ষার্থীদের অধিকার রক্ষায় কোনো ভূমিকা রাখছে বলে মনে করেন কি?
ড. কামরুল হাসান মামুন : বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যা হচ্ছে তাকে কি ছাত্ররাজনীতি বলা যায়? বরং বলা যায় অসভ্য রাজনীতি। ছাত্ররা রাজনীতি করবে ছাত্রদের মঙ্গলের জন্য। শিক্ষায় বরাদ্দ বৃদ্ধি, আবাসিক হলে সুশৃঙ্খল জীবন এবং সুন্দর ব্যবস্থাপনার জন্য। ছাত্ররাজনীতি হবে শিক্ষা গবেষণার মান বৃদ্ধির জন্য। লাইব্রেরিতে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থা স্থাপন করে উচ্চ মানের বই এবং জার্নালের সংখ্যাবৃদ্ধির জন্য। এর বদলে আমাদের দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষা ও গবেষণার পরিবেশ হত্যা করা হয়। ছাত্র হয়ে ছাত্রদের জোর করে মিছিলে নেওয়া, রাজনীতিতে যেতে বাধ্য করা, এই রাজনীতি কি পৃথিবীর কোনো দেশে হয়?
দেশ রূপান্তর : দেশের বিদ্যমান শিক্ষাকাঠামো এবং উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়নে ছাত্ররাজনীতির কোনো ভূমিকা রয়েছে কি?
ড. কামরুল হাসান মামুন : অবশ্যই রয়েছে। কিন্তু সেটা মারাত্মক নেতিবাচক। বর্তমানে যাকে ছাত্ররাজনীতি বলছি সেটা আসলে ক্রিমিনাল এবং স্বার্থপরদের রাজনীতি। আমরা যেই গৌরবোজ্জ্বল ছাত্ররাজনীতির কথা বলি সেই রাজনীতি কারা করত? নির্বাচিত হল সংসদের প্রায় সব সদস্য একেকটি ক্লাসের সেরা ছাত্র ছিল। সাধারণ ছাত্ররাও ভালো ছাত্র এবং ভালো মানুষ না হলে ভোট দিত না। এখন ক্লাসের সবচেয়ে খারাপ ছাত্রটা ছাত্ররাজনীতি করে। বছরের পর বছর ফেল করে আর বিশেষ পরীক্ষা, বিশেষের বিশেষ পরীক্ষা দিতেই থাকে। এই করে তারা মেধাবীদের মেধাকে হত্যা করে। দুঃখজনক হলো এদেরই নেতা হিসেবে আখ্যা দিতে হয়। আমরা ভালো নেতা তৈরির জায়গাটা নষ্ট করে ফেলেছি বলে দেশে ভালো মানের জাতীয় নেতাও পাচ্ছি না। সবকিছু এখন নষ্টদের দখলে। রাজনৈতিক দল এই নষ্টদের একত্রিত হওয়ার প্লাটফর্ম দেয়। নষ্টদের হাতে ক্ষমতা যাওয়াটা এখন প্রায় গ্লোবাল ফেনোমেনা। তবে সভ্য দেশে ভালো সিস্টেম আছে বলে নষ্টরাও তেমন ক্ষতি করতে পারে না, যেটা আমাদের দেশে পারে।
দেশ রূপান্তর : যে যায় লঙ্কায় সেই হয় রাবণ। আমরা ছাত্রদল এবং ছাত্রলীগ উভয়ের আচরণই দেখেছি। বিশ^বিদ্যালয়ের হলগুলো কার্যত ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলগুলোর ছাত্র সংগঠনগুলোর হাতে জিম্মি। তাদের নির্যাতনে সাধারণ ছাত্রদের মৃত্যুও হয়েছে। মুক্তির উপায় কী?
ড. কামরুল হাসান মামুন : ৯০-এর অভ্যুথানের মাধ্যমে স্বৈরাচারী সরকারকে হটিয়ে তথাকথিত গণতন্ত্রের জন্মের পরের ঘটনা কী? মাঝে তত্ত্বাবধায়ক ও সেনাশাসন বাদ দিলে বিএনপি, আওয়ামী লীগ যখন যেই ক্ষমতায় সেই দলের ছাত্র সংগঠনের দখলেই ক্যাম্পাস চলে যায়। অন্য ছাত্র সংগঠন যারা ক্যাম্পাসে থাকে তাদের ছোটখাটো হয়েই থাকতে হয়। সুতরাং এই দুই দলের কেউই সুশাসনের উদাহরণ রাখতে পারেনি। শুধু তাই না, ক্যাম্পাস যখন যাদের দখলে আবাসিক হলগুলোও তাদের দখলে চলে যায় এবং সময়ের সঙ্গে এর মাত্রা বেড়েছে।
আমাদের দেশে যা হচ্ছে এই ফর্মে ছাত্ররাজনীতি বিশ্বে কোথাও নেই। কল্পনা করা যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে একদল ছাত্র আরেক দল ছাত্রের ওপর হামলা করতে পারে! এই রাজনীতি করে বা শিখে এরা কেমন নাগরিক হবে তার প্রতিফলন তো আমরা আমলাদের মধ্যে দেখছি, পুলিশের মধ্যে দেখছি, শিক্ষকদের মধ্যে দেখছি। ছাত্ররাজনীতির এই ভয়ংকর রূপের আছর আজ দেশের সব সেক্টরে বিদ্যমান।
দেশ রূপান্তর : পাবলিক বিশ^বিদ্যালয়ের পাশাপাশি এখন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও ছাত্ররাজনীতি চালুর চেষ্টাকে কীভাবে দেখছেন?
ড. কামরুল হাসান মামুন : বাংলাদেশের অনেক পরিবার সন্তানদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতে চান না যার অন্যতম কারণ ছাত্ররাজনীতি। যারা মোটামুটি ভালো ছাত্র অথবা সচ্ছল তাদের একটা বড় অংশ বিদেশে চলে যাচ্ছে। যারা এই ব্যয় বহন করতে পারবে না, তারা দেশের প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। এই প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর এখনো শিশুকাল পার হয়নি। মাত্রই র্যাংকিং-এ আসা শুরু করেছে। এই অবস্থাতেই যদি ছাত্ররাজনীতি চালু করে দিই তাহলে ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে কী দেখব? প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্ষমতা নেই রাজনৈতিক উচ্ছৃঙ্খলতাকে নিয়ন্ত্রণে রাখার। চোখ বন্ধ করলে আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি কী অরাজক পরিস্থিতি তৈরি হবে। সুসংবাদ হলো প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রশাসন একমত হয়েছে যে তারা কোনোভাবেই তথাকথিত ছাত্ররাজনীতি ঢুকতে দেবে না। সরকার এবং সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের কাছে অনুরোধ তারা যেন আমাদের এই ক্ষতিটা না করেন। তা নাহলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আমাদের ক্ষমা করবে না।
দেশ রূপান্তর : ছাত্ররাজনীতির চলমান ধরন কি নতুন প্রজন্মকে রাজনীতিবিমুখ করে তুলছে?
ড. কামরুল হাসান মামুন : ছাত্রদের রাজনীতিতে রিক্রুট তো কম হচ্ছে না। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রাজনীতিতে হাতেখড়িটা ছাত্রছাত্রীদের নিজেদের ইচ্ছেয় হয় না। এখন রাজনীতিতে রিক্রুট একটি ট্র্যাপ। ইচ্ছে করে আবাসিক সিটের ক্রাইসিস তৈরি করে, একে পুঁজি করে রাজনীতির ছত্রছায়ায় গণরুমে ঘুমানোর ব্যবস্থা করা হয়। বিনিময়ে ছাত্রদের মিছিল মিটিং-এ যেতে বাধ্য করা হয়। এইভাবে কেউ কেউ দলবদ্ধ হয়ে চলার ক্ষমতার একটা স্বাদ পায়। সেই ক্ষমতা দিয়ে অনেক অনৈতিক কাজেও হাতেখড়ি হয়। এদের মধ্য থেকে কেউ কেউ নেতা হয়। এখনকার ছাত্রনেতারা দারুণভাবে ভোগবাদী।
দেশ রূপান্তর : ২৯ বছর পর সম্প্রতি ডাকসু নির্বাচন হয়েছিল। তখন অন্য বড় বিশ^বিদ্যলয়গুলোতেও ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবি উঠেছিল। কিন্তু আবারও সব বন্ধ হয়ে গেল। ছাত্র সংসদ কেন কার্যকর করা যাচ্ছে না?
ড. কামরুল হাসান মামুন : ছোট করে বললে এর উত্তর হলো এক ডাকসু নির্বাচন দিয়েই সরকারের শিক্ষা হয়ে গেছে। সবগুলোতে যদি সরকারি দল হেরে যায় সেটা সরকার কোনো অবস্থাতেই হজম করতে প্রস্তুত না, কারণ এর ফলাফল সরকারি দলকে অনেক মূল্য দিয়ে চুকাতে হতে পারে। এক ডাকসুর ভিপিকেই সামাল দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। তাই এই রাস্তা আপাতত বন্ধ।
দেশ রূপান্তর : সাম্প্রতিককালে দেশব্যাপী আলোড়ন তুলেছিল ‘নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলন’ এবং ‘কোটা সংস্কার আন্দোলন’। এই দুটি আন্দোলন সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী?
ড. কামরুল হাসান মামুন : স্ট্যাটিস্টিক্যাল মেকানিক্সের পার্কোলেশন তত্ত্বের মাধ্যমে দেখানো যায় যে, মানুষের মধ্যে খ- খ- বিভাজিত ক্ষোভ পুঞ্জীভূত অবস্থায় বিচ্ছিন্ন ক্লাস্টার হিসেবে থাকে। যতক্ষণ ক্লাস্টারগুলো বিচ্ছিন্ন থাকে সরকারের জন্য উদ্বেগের কারণ নেই। কিন্তু সরকার যদি এর বিরুদ্ধে নানা বাহিনী ও মেকানিজম ব্যবহার করে তাহলে ক্লাস্টারের সংখ্যা বাড়তেই থাকে এবং একটা ক্রিটিক্যাল অবস্থায় পৌঁছায় যাকে বলে পাউডার-কেগ ইফেক্ট। যেখানে সামান্য একটু স্পার্ক কোথাও হলে মুহূর্তের মধ্যে ছোট ছোট ক্লাস্টারগুলো একত্রিত হয়ে হঠাৎ ক্ষোভের বিশাল একটি ক্লাস্টারে পরিণত হতে পারে। ‘নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলন’ এবং ‘কোটা সংস্কার আন্দোলন’ একটি বড় আন্দোলনেরই প্রিকার্সর। যেকোনো সময় বিস্ফোরণ ঘটতে পারে।
দেশ রূপান্তর
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন