বিএনপি ও জামায়াত একসঙ্গে থাকলে আওয়ামী লীগের অবস্থা হবে ত্রিশঙ্কু
25 September 2022, Sunday
বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলনের কথা বলে ফের আলোচনায় নিষ্ফ্ক্রিয় ২০ দলীয় জোটের অন্যতম শরিক লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) সভাপতি কর্নেল (অব.) অলি আহমদ বীরবিক্রম। এ প্রসঙ্গে সমকালের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় তিনি বলেছেন, জাতির বৃহত্তর স্বার্থে জামায়াতকে নিয়ে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের কথা বলেছি। আমি যেটা ভালো মনে করেছি, সেটাই বলেছি। এটা গ্রহণ করা না-করা বিএনপির ব্যাপার। গতকাল শনিবার রাজধানীর মহাখালীর বাসায় কর্নেল (অব.) অলি আহমদের সঙ্গে কথা বলেছেন প্রধান প্রতিবেদক লোটন একরাম।
সমকাল: নির্দলীয়-নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিতে ডান-বাম-ইসলামী সমমনা দলগুলো নিয়ে বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার উদ্যোগ সম্পর্কে মূল্যায়ন কী?
অলি আহমদ: বিএনপিসহ আমরা সবাই অত্যন্ত সতর্কতা ও সুচিন্তিতভাবে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। বিএনপি ও জামায়াত একসঙ্গে মাঠে থাকলে আওয়ামী লীগের অবস্থা ত্রিশঙ্কু হবে।
সমকাল: বিতর্কিত জামায়াতকে দূরে রেখেই বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য গড়তে সমমনা প্রগতিশীল দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করছে বিএনপি। সম্প্রতি আপনি এলডিপি, নাগরিক ঐক্য এবং জামায়াতও বিএনপির নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে থাকবে বলেছেন। এখনও একই কথা বলছেন- এর যৌক্তিকতা কী?
অলি আহমদ: এ মুহূর্তে সবার দায়িত্ব দেশকে রক্ষা করা। তাই দল-মত নির্বিশেষ সব রাজনৈতিক দলকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। এ ছাড়া অন্য কোনো পথ নেই। যুদ্ধাপরাধীদের আমি কখনও কদমবুসি করিনি। আওয়ামী লীগ তাদের কদমবুসি করেছে। এরশাদবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনের সময় আওয়ামী লীগ ও জামায়াত ১৯৮৬-৮৭ সালে একসঙ্গে এরশাদের অধীনে নির্বাচনে অংশ নিয়েছে। বিএনপি ওই নির্বাচনগুলোতে অংশ নেয়নি। এ ছাড়া ১৯৯৫ সালে তত্ত্বাধায়ক সরকারের দাবিতে আওয়ামী লীগ ও জামায়াত ঐক্যবদ্ধভাবে বিএনপির বিরোধী আন্দোলন করেছিল। তখন তো জামায়াতের বিষয়ে আওয়ামী লীগের কোনো আপত্তি ছিল না। বাস্তবতা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই।
সমকাল: আপনার এ বক্তব্য নিয়ে বিএনপির শীর্ষ নেতারাও অসন্তুষ্ট। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও ব্যাপক সমালোচনা হচ্ছে। কেউ কেউ নির্বাচনী এলাকায় আপনি জামায়াতের ভোট টানতে এ কৌশল বলেও মনে করছেন। সরাসরি কেউ কিছু বলেছেন কি?
অলি আহমদ: আমার নির্বাচনী এলাকায় অন্য কোনো রাজনৈতিক দলের আধিপত্য নেই। আল্লাহর মেহেরবানিতে ১৯৮০ সালের পর থেকে আমাকে কেউ পরাজিত করতে পারেনি। আমার জন্য ৮০ শতাংশ লোকের সমর্থন রয়েছে। এটা হয়তো তারা আবেগপ্রবণ হয়ে চট্টগ্রাম-১৫ আসনের কথা বলেছে। প্রকৃতপক্ষে আমার নির্বাচনী এলাকা চট্টগ্রাম-১৪। এ বিষয়ে বিএনপির কারও সঙ্গে আমার কোনো আলাপ হয়নি।
সমকাল: যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে জামায়াতের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের ব্যাপারে প্রগতিশীল বাম দলগুলোর ঘোর আপত্তি। একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা ও বীরবিক্রম হিসেবে জামায়াতের সঙ্গে আপনার ঘাড়চড়া ভাবের কারণ কী?
অলি আহমদ: জামায়াত দেশের একটি সুসংগঠিত তৃতীয় বৃহৎ রাজনৈতিক দল। তারাও বর্তমান নিশিরাতের সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছে। আমরা বিরোধী দলের সবাই এই অবৈধ সরকার থেকে মুক্তি চাই। বাম-ডান এবং উত্তর-দক্ষিণ সবার দাবি প্রায় একই। নিজ নিজ জায়গা থেকে আমরা আমাদের কর্মসূচি পালন করে যাচ্ছি। জনগণের বৃহত্তর স্বার্থে অনেক সময় অনেক জিনিস অপছন্দ হলেও মেনে নিতে হয়। বিএনপি ও আমাদের পক্ষ থেকে অত্যন্ত পরিস্কার ভাষায় বলা হয়েছে, সরকারবিরোধী দলগুলো নূ্যনতম ঐকমত্যের ভিত্তিতে নিজ নিজ জায়গা থেকে সরকার পতনের আন্দোলনে অংশ নেবে। এক মঞ্চ থেকে আন্দোলনের বিষয়বস্তু এখনও আসেনি।
এ ছাড়া জামায়াত গণমাধ্যমকেও জানিয়েছে, তারাও এ সরকারের বিদায় চায়। নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন চায়। সংসদ বিলুপ্ত চায়। প্রশাসন ও নির্বাচন কমিশনের পুনর্বিন্যাস চায়। বিরোধী দলগুলোর দাবি-দাওয়া ৯০-৯৫ শতাংশ একই। সবার একটি স্লোগান- 'হটাও সরকার বাঁচাও দেশ'।
সমকাল: এর আগে ২০১৯ সালেও আপনি জামায়াতকে নিয়ে 'জাতীয় মুক্তি মঞ্চ' নামে একটি আলাদা প্ল্যাটফর্ম গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। এমনকি বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে সোচ্চার আন্দোলন গড়ে তোলারও ঘোষণা দিয়েছিলেন। তবে বিএনপির বিরোধিতার কারণে শেষ পর্যন্ত সে উদ্যোগ বেশিদূর এগোয়নি।
অলি আহমদ: এটা ঠিক নয়, বিএনপির ক্ষতি করতে কোনো উদ্যোগ নিইনি। বরং বিএনপির হাতকে শক্তিশালী করতে এবং খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য আমরা কয়েকটি দল যৌথভাবে ওই উদ্যোগ নিয়েছিলাম। এটা আলাদা জোট বা বিএনপির বিরুদ্ধে কোনো ষড়যন্ত্র ছিল না।
সমকাল: অনেকে ওই উদ্যোগকে 'মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশি' বলেও মন্তব্য করেছেন।
অলি আহমদ: ওই অর্ধশিক্ষিত লোকগুলো জিয়া এবং তাঁর পরিবারের সঙ্গে আমার দীর্ঘদিনের সম্পর্কের বিষয়ে আদৌ অবগত নন। এখন ফেসবুক এবং গুগলের কারণে অনেক 'গরু-ছাগল'ও নিজেকে 'হাতি' মনে করে।
সমকাল: বিএনপির সঙ্গে আপনার দলের সংলাপের সময় সিনিয়র রাজনীতিবিদ হিসেবে নতুন বৃহত্তর জাতীয় ঐক্যের শীর্ষ নেতা হওয়ার ব্যাপারে আগ্রহ ব্যক্ত করেছেন। বিষয়টি সম্পর্কে স্পষ্ট করে কিছু বলবেন?
অলি আহমদ: এটা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। সরকারের কিছু দালাল বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে এ ধরনের বক্তব্য দেয়। আমাদের মধ্যে কখনও কোথাও এ ধরনের আলোচনা আসেনি। আমি আল্লাহর ওপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল। আমার ব্যক্তিগত বিষয় এখানে প্রাধান্য পেতে পারে না। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে জনগণের পাশে দাঁড়ানোই আমার দায়িত্ব।
সমকাল: নানা বক্তব্য ও উদ্যোগের মাধ্যমে আপনি মাঝেমধ্যেই রাজনীতিতে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে আসেন- এটার নেপথ্যে রহস্য কী?
অলি আহমদ: একটা দলের প্রধান এবং একাত্তরের সর্বপ্রথম বিদ্রোহকারী হিসেবে আমি আমার দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে পারি না। আমার দৃষ্টিতে যেটা ভালো এবং জনগণের মঙ্গল হবে, তা অকপটে বলি। কে শুনল, কে শুনল না- সেটা প্রত্যেকের নিজস্ব ব্যাপার।
সমকাল: বিএনপির বর্তমান কাণ্ডারি দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নেতৃত্বের বিরোধিতা ও নানা অভিযোগ উত্থাপন করে দল ছেড়ে ছিলেন। এমনকি আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটের শরিক হয়েও নির্বাচনও করেছেন। এখন তারেক রহমানের নেতৃত্ব মেনে জোটে থাকার যৌক্তিকতা কী?
অলি আহমদ: আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটে কখনও নির্বাচন করিনি। ২০০৯ সালে দলের ছাতা প্রতীকে নির্বাচনে অংশ নিয়েছি এবং আল্লাহর রহমতে জয়ী হয়েছিলাম। আর আমি যেহেতু কখনও দুর্নীতি ও বেআইনি কোনো কাজে জড়াইনি, সংগত কারণে অনেকে আমার বিরোধিতা করছে। এটা তাদের অধিকার। আর বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার অনুরোধে ২০১০ সালে এলডিপি বিএনপি জোটে যুক্ত হয়। তখন বিএনপির নেতৃত্বে চারদলীয় ঐক্যজোট ছিল। এলডিপি একটি স্বতন্ত্র এবং নির্বাচন কমিশনের এক নম্বর নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল।
সমকাল: রাজনীতির নতুন মেরূকরণের প্রস্তাবে দলের মহাসচিবসহ সম্প্রতি আপনি গোপন বৈঠক করতে যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েছিলেন বলে গুঞ্জন রয়েছে। ওই উদ্যোগের অংশ হিসেবে কয়েক দিন আগে থাইল্যান্ডে বিএনপিসহ অন্যান্য দলের কয়েকজন নেতা গিয়েছিলেন বলে আলোচনা আছে। আপনার বক্তব্য কী?
অলি আহমদ: নানাজনের নানা মত, সবারই মুখ আছে। যখন যা ইচ্ছা তা বলতে পারে। তাদের মুখ বন্ধ করার অধিকার আমার নেই। প্রত্যেকেই রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত। এটা তাদের গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক স্বাধীনতা।
সমকাল: বিএনপির রূপরেখার বিষয়ে কিছু বলবেন?
অলি আহমদ: রাজনৈতিক গুণগত মানোন্নয়নে রূপরেখার বিষয়ে আমাদের আলোচনা হয়েছে। আমাদের মধ্যে কোনো দ্বিমত নেই। সবাই বর্তমান অসহনীয় অবস্থা থেকে মুক্তি চায়।
সমকাল: বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বের সংকট রয়েছে বলে দাবি করে আসছেন আওয়ামী লীগের নেতারা। আন্দোলন ও নির্বাচনে বিএনপির শীর্ষ নেতা কে তা নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন তাঁরা?
অলি আহমদ: এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগের এত মাথাব্যথা কেন? বিএনপির বিষয় বিএনপি ঠিক করবে। বিএনপি দেশের সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দল। তারা ভালোভাবেই জানে, কখন কী করতে হবে।
সমকাল: রাজনীতি সংঘাতপূর্ণ হয়ে ওঠার পেছনে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ও রাজপথের প্রধান বিরোধী দল বিএনপির শীর্ষ নেতাদের হুমকি-পাল্টা হুমকি কি কর্মীদের উস্কানি দেওয়া হচ্ছে না?
অলি আহমদ: রাজনীতিকে তার স্বাভাবিক গতিতে চলতে দিতে হবে। যে কোনো জিনিসকে তার স্বাভাবিক গতিতে চলতে দিতে হয়। জোর করে এ দেশের মানুষকে দাসত্বে পরিণত করতে পারেনি। বিএনপি এবং বিরোধী দলগুলো আটঘাট বেঁধে মাঠে নেমেছে। বর্তমান অবৈধ সরকার সময় থাকতে বিদায় না নিলে করুণ পরিণতি হতে পারে। বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোর প্রতিটি কর্মসূচিতে আওয়ামী লীগ ও পুলিশ যৌথভাবে হামলা ও গোলাগুলি করছে। অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে বাধাগ্রস্ত করছে। ফলে বিরোধী দলগুলোর কর্মসূচি আরও গতি সঞ্চার করছে। আওয়ামী লীগকে বুঝতে হবে, তাদের দিন শেষ।
সমকাল: সার্বিকভাবে বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী?
অলি আহমদ: বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি সংকটাপন্ন এবং অস্বস্তিকর অবস্থায় আছে। কখন কী হবে, কারও পক্ষে বলা সম্ভব নয়। অতীতে বাংলাদেশ কখনও ত্রিভুজ রাজনৈতিক অবস্থানে ছিল না। বর্তমানে ভৌগোলিক কারণে এবং আওয়ামী লীগের দুঃশাসন ও দুর্নীতির কারণে এক ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। এখানে ত্রিভুজ রাজনীতি নিয়ে একটা ব্যাখ্যা দিতে চাই- একদিকে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত এবং অন্যদিকে চায়না। চায়না থেকে বের হওয়ার গুরুত্বপূর্ণ তিনটি পথ যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে। বর্তমান সরকার তিনটা দেশের সঙ্গে সমানতালে সম্পর্ক বজায় রাখতে গিয়ে সমুদ্র বিপদে পড়েছে। 'শ্যাম রাখি না কূল রাখি' উভয় সংকটে পড়েছে। কোনো দিক থেকে সরে আসার উপায় নেই এ সরকারের। এই সংকটের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ডলার সংকট। সব স্তরে সীমাহীন দুর্নীতি, অর্থ পাচারসহ নানা সামাজিক সমস্যায় জর্জরিত দেশ। জনসমর্থন হারিয়ে আওয়ামী লীগ পুলিশকে ব্যবহার করে 'গায়ের জোরে' ক্ষমতায় টিকে আছে। পরিস্থিতি যেভাবে অবনতির দিকে যাচ্ছে, এটা আর সম্ভব নাও হতে পারে।
সমকাল
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন