আওয়ামী লীগ থেকেও প্রস্তাব এসেছিল
19 May 2022, Thursday
আসিফ আকবর। জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী। বিএনপি’র জাতীয় নির্বাহী কমিটির সাবেক সদস্য। পড়াশোনা করেছেন রাষ্ট্র বিজ্ঞানে। বাবা আলী আকবরও ছিলেন রাজনীতিবিদ। ছাত্র জীবন থেকে রাজনীতির প্রতি ভালোবাসা। সেই ভালোবাসা থেকেই তার রাজনীতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা। এখন সরাসরি রাজনীতির বাইরে থাকলেও রাজনীতিই তার চিন্তাজুড়ে। বিএনপি’র পদ ছেড়ে দিলেও জাতীয়তাবাদী রাজনীতি নিয়ে এখনও চিন্তা করেন। সমসাময়িক নানা বিষয়ে মানবজমিন-এর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছেন, বিএনপি’র পদ ছাড়ার পর আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকেও তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছিল
তিনি সাড়া দেননি। জানিয়েছেন, প্রয়াত প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সান্নিধ্যে এসে রাজনীতির প্রতি ভালোবাসা জন্মেছিল। এখন খালেদা জিয়ার রাজনীতির প্রতি তিনি শ্রদ্ধাশীল। আসিফ আকবরের সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন মানবজমিন-এর স্টাফ রিপোর্টার শাহনেওয়াজ বাবলু।
বিএনপির সঙ্গে আসিফ আকবরের সম্পর্ক কি?
আসিফ: আমি বিএনপি’র একজন ডাই হার্ট সমর্থক। শহীদ জিয়ার প্রতি যে অনুরক্ততা মূলত সেটাই আমাকে বিএনপি’র দিকে ধাবিত করেছে। স্কুলে পড়াশোনা অবস্থায় ওনার সঙ্গে আমার দুইবার সাক্ষাতের সুযোগ হয়েছে। ১৯৮১ সালের জানুয়ারির দিকে শিশু একাডেমিতে এসেছিলাম নাটক করতে। তখন আমি চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ি। তখন ছিল শীতকাল। সেদিন ঠিক সন্ধ্যার দিকে শিশু একাডেমিতে এসে আমাদের চকলেট দিয়েছিলেন তৎকালীন প্রেসিডেন্ট। ওইদিনের চকলেট দেয়ার ঘটনাটা আমার মনে দাগ কেটেছিল। উনার (জিয়াউর রহমান) কিছু মুভমেন্ট ছিল। নতুন কুঁড়ি, বৃত্তিপ্রাপ্ত ছেলে-মেয়েদের নিয়ে নৌ-ভ্রমণে যাওয়া, এগুলো খুব অ্যাট্রাক করতো আমাকে। আমার খুব শখ ছিল বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকার খবর শোনার। আমার আব্বাও এগুলোতে খবর শুনতেন। জিয়াউর রহমান যেদিন মারা যান সেদিন সকালে স্কুলে যাওয়ার আগে আমি দোকান থেকে বাসার জন্য তেল আনতে গিয়েছিলাম। ওখন দোকানে গিয়ে শুনলাম জিয়াউর রহমান শহীদ হয়েছেন। খবরটা শোনার পর আমি অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে ছিলাম। তখন মনে হয়েছিল পৃথিবী থেকে আমার একটা গুরুত্বপূর্ণ জিনিস চলে গিয়েছিল। ওই শিশু মনে যে জিয়াউর রহমান সাহেব আমার মনে ঢুকে গিয়েছিলেন এর উপরে আমি আর অন্যকিছু ভাবতে পারি না। বিএনপিকে সব সময় সমর্থন করার জন্য মূলত এটাই বড় কারণ। এরপরে বেগম খালেদা জিয়া এবং তারেক রহমানের সঙ্গে মিশে বুঝলাম তাদের জন্মই হয়েছে এই দেশকে সেবা করার জন্য।
বিএনপি থেকে পদত্যাগ করলেন কেন?
আসিফ: আমি বিএনপি’র সাধারণ সদস্য পদও গ্রহণ করিনি। ২০০৯ সালের ৮ই ডিসেম্বরের যে কাউন্সিল হয়েছিল সেখানে আমাকে দলের নির্বাহী কমিটির পদ দেয়া হয়েছিল। নির্বাহী কমিটির পদ পাওয়ার কয়েকদিন পরে একটি প্রোগ্রামে অংশ নেয়ার জন্য কুমিল্লায় যাই। সেদিন বুড়িচংয়ে শওকত ভাইয়ের (জাতীয় প্রেস কাবের সভাপতি ও বিএনপি’র ভাইস চেয়ারম্যান শওকত মাহমুদ) একটি সংবর্ধনা ছিল। সেখানে বিএনপি’র কয়েকজন সিনিয়র নেতা উপস্থিত ছিলেন। আমি অনুষ্ঠানস্থলে যাওয়ার পর আমাকে সেখানে কণ্ঠশিল্পী হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু আমিতো তখন দলের নির্বাহী কমিটির সদস্য। বিষয়টি আমার কাছে মোটেও ভালো লাগেনি। বিষয়টি নিয়ে এক পর্যায়ে সেখানে আমার সঙ্গে কথাকাটাকাটি এবং হাতাহাতি হয়। পরে আমি এই ঘটনার প্রেক্ষিতে মামলা করি। যেদিন আমি মামলা করি সেদিন ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন স্যার আমাকে কল দেন। তিনি বলেছিলেন, আমি থানায় না গিয়ে বিষয়টি নিজেদের মধ্যে শেষ করলে ভালো হতো। বিষয়টি আমার কাছে খারাপ লেগেছিল। যদিও উনি (মোশাররফ) উনার জায়গা থেকে ঠিক কথাটি বলেছিলেন। পরে দলের বেশ কয়েকজন নেতা আমাকে কল দেয়ায় আমি ফোন বন্ধ করে রাখি। আমাকে না পেয়ে উনারা আমার স্ত্রীকে ফোন দিয়েছিলেন। পরে আমার পক্ষে আমার স্ত্রী এবং ছোট ছেলে গিয়ে দলের তৎকালীন সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের কাছে পদত্যাগ পত্র দিয়ে আসেন। আমি যেটা জানতে পেরেছি বেগম খালেদা জিয়াও মেনে নিতে পারেননি আমার পদত্যাগের বিষয়টি। তখন আমার সম্মান বা আমার পার্সোনালিটি বলেছিল পদত্যাগ করে আমাকে একটু থামানো উচিত। কারণ রাজনীতিটা হচ্ছে আমার পছন্দের জায়গা। আমার বেসিক কাজ গান বাজনা করা। সেখানে আমি মনোযোগ দেই।
অনেকেই বলে বিএনপি এতোদিন ক্ষমতার বাইরে থাকার কারণ দলের কিছু কৌশলগত ভুল। আপনি কি মনে করেন?
আসিফ: আমি মনে করি বিএনপি প্রপাগান্ডার শিকার। বিএনপিকে দুর্নীতিতে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন বানানো হয়েছে। বর্তমান সরকার আমলে যেসব লুটপাট দেখছি এমন লুটপাট বা দুর্নীতি পৃথিবীর কোথাও হয় বা হয়েছে কিনা আমার সন্দেহ আছে। তবে বিএনপি’রও দোষ ছিল। কিন্তু বর্তমানে যেটা হচ্ছে সেই তুলনায় কিছুই না। বিএনপি’র মূল সমস্যা হচ্ছে- ভারতের প্রতি ওইভাবে সমর্থন না দেখানো, সার্ক সম্মেলন পণ্ড হওয়া, দেশীয় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ষড়যন্ত্র, দলের মধ্যে ঘাপটি মেরে থাকা আওয়ামী এজেন্টরা মূলত: বিএনপি’র বড় ক্ষতি করেছে।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন কেমন হতে পারে?
আসিফ: যেটা শুনতে পাচ্ছি এমন হলে আগের দুইবারের মতোই হবে। আর ইভিএম নিয়ে বিশ্বব্যাপী অনেক প্রশ্ন রয়েছে। আমাদের দেশের মানুষ এটা সম্পর্কে অতোটা সচেতনও না। আমাদের যদি ব্যালটের মাধ্যমে স্বচ্ছ সমাধান করা যায় তাহলে ব্যালটই উত্তম। আর নির্বাচন যদি হয় তাহলে ওই আগের মতোই হবে। বিএনপি যদি বলে তারা নির্বাচনে যাবে তাদের সেটা একান্তই ব্যাপার। বিএনপি কি সিদ্ধান্ত নিবে সেটা আমি জানি না। তবে এখন পর্যন্ত বিএনপি’র কোনো নীতিতে অটল থাকার সিদ্ধান্ত আমি পাইনি। আমি মনে করি বিএনপি’র ঘন ঘন সিদ্ধান্ত বদলের কারণে তৃণমূলের নেতাকর্মীরা খুব বিপদে আছে।
আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিএনপি’র কৌশল কি হওয়া উচিত বলে মনে করেন?
আসিফ: বিএনপি’র জন্য বড় উদাহরণ হচ্ছে ৯১ সালের নির্বাচন। ওই নির্বাচনে আমরা দেখেছি তৎকালীন ছাত্রদলের নেতারা একটা ভোট বিপ্লব করেছেন। যেখানে আওয়ামী লীগ ভেবেছিল বিএনপি ন্যূনতম সিট পাবে সেখানে বিএনপি সংখ্যাঘরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় এসেছে। বর্তমানে নতুন নেতৃত্বকে দলে নেয়ার জন্য সেই ক্যারিশম্যাটিক নেতৃত্ব প্রয়োজন বিএনপি’র। যেটা বিএনপিতে নেই। দলের মধ্যে এখন চলছে ভাই নীতি এবং পকেট কমিটি। এসব কারণেই বিএনপি আন্দোলনে যেতে পারছে না। কারণ এই পকেট কমিটির কারণে দলের একটা গ্রুপ বাদ পড়ে যাচ্ছে। আমি যদি এক দাগে বলতে যাই বিএনপি’র শত্রু বিএনপি। নিজেদের মধ্যে এই শত্রুতা জিইয়ে রেখেছে ঢাকার কেন্দ্রীয় কমিটি। দলকে আরও সুসংহত করতে হলে বিএনপিকে এসব কর্মকাণ্ড থেকে বের হয়ে আসতে হবে। দলের মধ্যে নতুন নেতৃত্ব সৃষ্টি করতে হবে এবং দলের উপর শহীদ জিয়ার পরিবারের পূর্ণ কর্তৃত্ব স্থাপন করতে হবে। আর বিএনপি কিন্তু আওয়ামী লীগের মতো শক্তিশালী দল নয়। বিএনপি’র সবচেয়ে বড় শক্তি হচ্ছে এই দেশের সাধারণ মানুষের ভালোবাসা। তাদের ভালোবাসা শহীদ জিয়া এবং বেগম খালেদা জিয়ার প্রতি। এই ভালোবাসার কারণেই বিএনপি বার বার ক্ষমতায় এসেছে।
বিএনপিসহ বিরোধী দলের নেতারা প্রায়ই বলেন বর্তমানে দেশে কোনো রাজনীতি নেই। দেশে কি আসলেই কোনো রাজনীতি নেই?
আসিফ: রাজনীতি অনেক বড় বিষয়। একজন হুট করে চা দোকানে কথা বললেই রাজনীতি হয় না। এটা চর্চার বিষয়। যেটা পৃথিবীর জন্মের শুরু থেকেই হয়ে আসছে। পৃথিবীর সবাই রাজনীতির অধীনে। যারা বলে আমি রাজনীতিতে নেই বা বুঝি না সেই বেশি রাজনীতি থেকে লাভবান। সবাই যদি নিজের জায়গা থেকে নিজ দায়িত্ব পালন করে তাহলে অবশ্যই রাজনীতি থাকবে। রাজনীতিতে নতুন প্রজন্মকে আরও বেশি উদ্বুদ্ধ করতে হবে। আমি মনে করি রাজনীতি অবশ্যই আছে এবং থাকবে। রাজনীতির বাইরে কিছুই নেই। স্বচ্ছ রাজনীতির জন্য আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন লাগবে, লিডারশিপের পরিবর্তন লাগবে।
ভবিষ্যতে রাজনীতি করার ইচ্ছা আছে কি না?
আসিফ: বিএনপি’র প্রতি আমার সমর্থন সব সময় থাকবে। যতোদিন বাঁচবো আমার নেতা শহীদ জিয়া, আমার নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া। নতুন নেতৃত্বে তারেক রহমান যদি আসেন, উনি যদি চান এবং কখনো যদি প্রেক্ষাপট তৈরি হয় অবশ্যই কাজ করবো একসঙ্গে।
বিএনপি’র বাইরে গিয়ে অন্য কোনো দলের সঙ্গে রাজনীতি করার কোনো সম্ভাবনা আছে কি?
আসিফ: কোনো সম্ভাবনা নেই।
বর্তমান সময়ের অধিকাংশ তারাকারা সরকারি দলের সঙ্গে বিভিন্নভাবে জড়িত। আপনি গেলেন না কেন? না আপনাকে ডাকা হয়নি।
আসিফ: আমার জন্য এখনো আওয়ামী লীগ বসে আছে। আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায় থেকে বিভিন্নভাবে আমাকে বলা হয়েছে। আমি তাদের কোনো প্রস্তাব গ্রহণ করিনি। আমার রক্ত হচ্ছে ‘বি’ পজিটিভ। আমি যেভাবেই থাকি না কেন আওয়ামী লীগ করা আমার পক্ষে সম্ভব না।
কুমিল্লার সন্তান হিসেবে সেখানকার স্থানীয় রাজনীতি নিয়ে আপনার মূল্যায়ন কি?
আসিফ: আমি মনে করি কুমিল্লায় বিএনপি’র রাজনীতি বলতে কিছুই নেই। এটা চলে গ্রুপের রাজনীতি। বিএনপি’র প্রয়াত নেতা আকবর হোসেনের পরে কুমিল্লায় বিএনপি’র রাজনীতি অত্যন্ত জিরো লেভেলে। আর কুমিল্লা সিটি করপোরেশনে যে মেয়র আছেন তিনি হচ্ছেন বর্তমান স্থানীয় এমপি’র বদান্যতায় মেয়র।
আসন্ন কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়ে আপনার কোনো প্রেডিকশন আছে কি না?
আসিফ: আমি প্রথমে বিরোধিতা করি স্থানীয় নির্বাচনে দলীয় প্রতীক দেয়া। এটা একটা বাজে জিনিস। কারণ আমি আমার নগর পিতা নির্ধারণ করবো সেটা মার্কায় দিতে হবে কেন। আমি যতোটুকু জেনেছি সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন আগ্রহী প্রার্থী ছিলেন। যাদের অতীত ইতিহাস খুবই শক্তিশালী। তারা মাঠের রাজনীতিবিদ। এদের সবাই সিটি করপোরেশনের মেয়র হওয়ার যোগ্যতা রাখেন। কিন্তু আওয়ামী লীগের এমন প্রার্থীর বিপরীতে বিএনপি’র এমন কোনো শক্তিশালী প্রার্থী আপনি দেখাতে পারবেন না। যাকে সবাই চেনে। যদিও বিএনপি এই সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে যাচ্ছে না। কিন্তু এদের বাইরে গিয়ে নাগরিক সমাজের কোনো প্রার্থীওতো আমরা দিতে পারিনি।
আপনাকে ধন্যবাদ
আসিফ: আপনাকেও ধন্যবাদ।
মানবজমিন
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন