বাংলাদেশে মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত প্রায় ১১ লাখ উদ্বাস্তুর উপস্থিতি প্রায় চার বছরে গড়িয়েছে। শিবিরগুলোতে রোহিঙ্গা শিশুদের জন্মের কারণে এ সংখ্যা এত দিনে আরও বেড়েছে। বাংলাদেশ সরকার ভাসানচরে নিজ খরচে উন্নত আবাস তৈরি করে কক্সবাজারের কুতুপালং অঞ্চল থেকে প্রায় ৩০ হাজার পরিবারের ১ লাখ রোহিঙ্গাকে স্থানান্তর করেছে। রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে প্রত্যাবর্তনের জন্য বাংলাদেশ সরকার যে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা শুরু করেছিল, তাতে তেমন অগ্রগতি তো হয়নি; বরং এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী কথিত গণতান্ত্রিক ও বেসামরিক সরকারকে উৎখাত করার পর এ প্রক্রিয়া খাদে পড়েছে। তবে তথাকথিত এ গণতান্ত্রিক ও বেসামরিক সরকারের সঙ্গে কয়েক দফা আলোচনাতেও কোনো উৎসাহব্যঞ্জক ফল পাওয়া যায়নি। এককথায় বাংলাদেশের সামনে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে আপাতত কূটনৈতিক তৎপরতা ছাড়া দৃশ্যমান আর কোনো পথ খোলা নেই।
রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কিছুটা হলেও কূটনৈতিক চাপ সৃষ্টি করতে পেরেছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সাফল্য একেবারেই কম নয়। কিন্তু মিয়ানমারের সামরিক সরকার একে পাত্তা দিচ্ছে না। সম্প্রতি জাতিসংঘের ৭৬তম সাধারণ পরিষদে তৃতীয় কমিটিতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে ১০৭টি দেশের অভিন্ন মতে প্রস্তাব পাস হয়েছে। প্রস্তাবে মিয়ানমার সরকারকে অবিলম্বে বাস্তুচ্যুত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। শুধু রোহিঙ্গা নয়, মিয়ানমারের আরও অনেক জাতিগোষ্ঠী রয়েছে, যাদের দেশছাড়া করা হয়েছে তাদেরও ফেরত আনা এবং ভবিষ্যতে এ ধরনের অত্যাচার যেন না হয়, তার নিশ্চয়তা চাওয়া হয়। একই সঙ্গে সেখানকার প্রকৃত অবস্থা দেখার জন্য মানবাধিকার কমিশনের সদস্যদের যাতে বিভিন্ন অঞ্চলে বিনা বাধায় সফর করতে পারে, সেই ব্যবস্থা নিশ্চিত করারও আহ্বান জানানো হয়েছে।
এ প্রস্তাবের যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ওআইসিভুক্ত দেশগুলোর যৌথ উদ্যোগে এটা সম্ভব হয়েছে। ১০৭টি দেশ একসঙ্গে এ প্রস্তাব উত্থাপন করে, যার মধ্যে ওই দুটি জোটের সদস্য ছাড়াও যোগ দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, সুইজারল্যান্ড, আর্জেন্টিনা, মেক্সিকো, দক্ষিণ কোরিয়া, নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া ও জাপানের মতো দেশ। এ প্রস্তাবের বিপক্ষে কোনো দেশ ভোট দেয়নি। তবে আসিয়ানভুক্ত কয়েকটি দেশসহ ভারত এবং চীন অনুপস্থিত ছিল। লক্ষণীয় বিষয় হলো জাপানের যোগদান। কারণ, জাপান মিয়ানমারে অন্যতম প্রধান অর্থলগ্নিকারী দেশ এবং এ পর্যন্ত মিয়ানমারের জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে কোনো বক্তব্য দেয়নি। এককথায় সামরিক সরকারের সঙ্গে যোগসূত্র বজায় রেখে চলেছে। তথাপি জাপান এ প্রস্তাবের একজন সমর্থক হিসেবে নাম লিখিয়েছে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে মিয়ানমারের জান্তা সরকারের ওপর এ প্রস্তাবের কী প্রভাব পড়তে পারে বা আদৌ পড়বে কি না। অতীতের অভিজ্ঞতায় বলা যায়, জাতিসংঘের এসব প্রস্তাব বিশ্বে খুব বেশি প্রভাব ফেলতে পারেনি। বিশেষ করে যেসব দেশের পেছনে বড় কোনো দেশ বা ভূরাজনৈতিক শক্তি রয়েছে। ইসরায়েল এর অন্যতম দৃষ্টান্ত। ইসরায়েলের জন্মলগ্ন থেকে সাধারণ পরিষদে (১৯৪৭-২০১৮) দেশটির বিরুদ্ধে ১৯৭টি প্রস্তাব পাস হলেও ইসরায়েল এ পর্যন্ত তেমন তোয়াক্কাও করেনি। এর বাইরে নিরাপত্তা পরিষদের ১৮৭টি প্রস্তাব ইসরায়েল ডাস্টবিনে ফেলে রেখেছে। এমনকি ২০১৮ সালের ২৩ ডিসেম্বর নেওয়া নিরাপত্তা পরিষদের ২৩৩৪ নম্বর প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে পাস হলেও ইসরায়েল তা মানেনি। সেখানে বলা হয়েছিল, ১৯৬৭ সালের পর অধিকৃত অঞ্চলে যার মধ্যে পূর্ব জেরুজালেমও রয়েছে, সেখানে কোনো বসতি ও জমি অধিগ্রহণ করা যাবে না। কিন্তু ইসরায়েল এ পর্যন্ত জাতিসংঘের কোনো প্রস্তাবকে ধর্তব্যেই নেয়নি।
মিয়ানমার ইসরায়েলের মতো শক্তিশালী ও গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র না হলেও আয়তনের দিক থেকে পূর্ব এশিয়ায় বৃহত্তম, সম্পদশালী এবং বর্তমান বিশ্বরাজনীতির বিবেচনায় ভূরাজনৈতিকভাবে এ অঞ্চলের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দেশ। দেশটি একদিকে চীনের বিআরআই প্রকল্পের পূর্ব খুঁটি এবং বিশাল লগ্নির স্থান। এমনকি ভারতের জন্যও ভূরাজনৈতিকভাবে মিয়ানমার গুরুত্বপূর্ণ। এসব শক্তির বলে বলীয়ান মিয়ানমার তাই তাৎক্ষণিকভাবে এ প্রস্তাব বাতিল করে দিয়েছে। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ১৭ নভেম্বর ২০২১ বলেছে এ ধরনের প্রস্তাব রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, পক্ষপাতে দুষ্ট এবং বাস্তববিবর্জিত।
প্রশ্ন হচ্ছে মিয়ানমারের জান্তা সরকারের ওপর এ প্রস্তাবের কী প্রভাব পড়তে পারে বা আদৌ পড়বে কি না। অতীতের অভিজ্ঞতায় বলা যায়, জাতিসংঘের এসব প্রস্তাব বিশ্বে খুব বেশি প্রভাব ফেলতে পারেনি। বিশেষ করে যেসব দেশের পেছনে বড় কোনো দেশ বা ভূরাজনৈতিক শক্তি রয়েছে। ইসরায়েল এর অন্যতম দৃষ্টান্ত। ইসরায়েলের জন্মলগ্ন থেকে সাধারণ পরিষদে (১৯৪৭-২০১৮) দেশটির বিরুদ্ধে ১৯৭টি প্রস্তাব পাস হলেও ইসরায়েল এ পর্যন্ত তেমন তোয়াক্কাও করেনি।
মিয়ানমারের সেনাবাহিনী রাখাইন অঞ্চলের অস্থিরতার জন্য আরসাকে দায়ী করে যাচ্ছে। তাদের দাবি, এর সঙ্গে মিয়ানমারকে অস্থিতিশীল করতে যুক্ত হয়েছে এনইউজি, আরএসও, পিডিএফ এবং সিআরপিএফের মতো সন্ত্রাসী সংগঠন। সবশেষে বলেছে মিয়ানমার সরকার রাখাইন থেকে সংঘর্ষের কারণে যারা ভয় পেয়ে পালিয়েছে, তাদের মধ্যে যাদের নাগরিকত্বের কোনো ধরনের কাগজপত্র রয়েছে, তাদের ফিরিয়ে নিতে প্রস্তুত।
এ ধরনের বক্তব্য নতুন কিছুই নয়। এর স্পষ্ট মানে হলো মিয়ানমার এ প্রস্তাবের ধার ধারে না। মিয়ানমার সামরিক সরকার এ ব্যাপারে নিশ্চিত যে চীন, জাপান, রাশিয়া ও ভারতের মতো দেশসহ আরও অনেক দেশ মিয়ানমারের পক্ষেই রয়েছে। মাত্র কয়েক মাস আগেই চীন অর্থনৈতিক করিডর এবং অন্যান্য চুক্তি যার মধ্যে গ্যাস ও জ্বালানি তেল ও যোগাযোগব্যবস্থা উন্নয়নের জন্য প্রায় ছয় বিলিয়ন মার্কিন ডলারের চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে। তা ছাড়া অন্যান্য খাতেও চীনের তহবিল উন্মুক্ত রয়েছে। মিয়ানমারের কোথাও কোথাও সামরিক শাসনের পক্ষে দাঁড়ানোয় চীনের বিনিয়োগ করা প্রকল্পে হামলার ঘটনাও ঘটেছে। এরপরও চীন পিছপা হচ্ছে না। কারণ, চীন এবং ভারত ভালো করেই জানে যে মিয়ানমার এ দুই শক্তির ওপর নির্ভর করবে।
জাতিসংঘের এ প্রস্তাবকে বাংলাদেশের জন্য কিছুটা কূটনৈতিক বিজয় হিসেবে বিবেচনা করা গেলেও রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে তা কোনো প্রভাব ফেলবে না। অবশ্য বাংলাদেশকে কূটনৈতিকভাবে সমস্যা সমাধানের পথেই থাকতে হবে। তবে অন্যান্য পন্থা নিয়েও আলোচনা করতে এবং পরিকল্পনায় রাখতে হবে। এ সমস্যার কার্যকর সমাধানের জন্য মিয়ানমারকে বাধ্য করতে হবে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অন্যতম প্রস্তাব ‘সেফজোন’ তৈরির মাধ্যমে এবং এখন বাংলাদেশের কূটনৈতিক তৎপরতা এ প্রস্তাব বাস্তবায়নের পক্ষেই চালিত হতে হবে। চীনা বিশেষজ্ঞদের মতে, মিয়ানমার সামরিক সরকার সহজেই ক্ষমতা ছাড়ছে না এবং বিশ্বকে এদের সঙ্গেই থাকতে হবে।
ড. এম সাখাওয়াত হোসেন নির্বাচন বিশ্লেষক, সাবেক সামরিক কর্মকর্তা এবং এসআইপিজির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো (এনএসইউ)
প্রথমআলো
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন