নির্জন দুপুরে পুকুর কিংবা জলাশয়ের আশেপাশে ছোট গাছের চিকন ডাল বা বাঁশের খুঁটির ওপর স্থির অপেক্ষায় থাকে চোখ ধাঁধানো উজ্জ্বল রঙের মাছরাঙা। পানির দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে যখন শিকারের আশায় চুপ করে বসে থাকে; তখন দূর থেকে দেখে মনে হয় শিল্পীর ক্যানভাসে আঁকা কোনো চিত্রকর্ম।
পানির নিচে শিকার দেখার জন্য মাছরাঙার চোখ বিশেষভাবে অভিযোজিত। এ বিশেষ ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে মাছের অবস্থান টের পাওয়ার সাথে সাথে তীর গতিতে পানির নিচে মাছের উপর মাথা নিচু করে ঝাঁপিয়ে পড়ে। মাছ কিছু বুঝে ওঠার আগেই মাছরাঙা তাকে ধরে ফেলে। কিছুক্ষণ পর দেখা যায়, পাখিটির ঠোঁটের ফাঁকে ছোট্ট একটি মাছ ছটফট করছে। এরপর কয়েকবার আছাড় মারে, তারপর শূন্যে ছুড়ে দিয়ে মাথার দিক থেকে গিলে ফেলে।
এর নাম মাছরাঙা হলেও কি এরা শুধু মাছই শিকার করে? না, এরা অনেক ধরনের প্রাণি শিকার করে। তবে তার বড় একটি অংশজুড়ে রয়েছে মাছ। অন্যান্য শিকারের মধ্যে রয়েছে- পোকামাকড়, ব্যাঙ, সরীসৃপ ইত্যাদি। এখনো গ্রামবাংলায় অসাধারণ সুন্দর মাছরাঙার বুদ্ধিদীপ্ত এমন শিকারের দৃশ্য দেখা যায়।
মাছরাঙা সাধারণত পানির ধারে ও বনে বসবাস করে। মাটির ঢালে, উঁইয়ের ঢিবিতে অন্য পাখির খোড়া গর্ত কিংবা গাছের পচা-গুড়ির ফোকরে বাসা করতে ভালোবাসে। স্ত্রী-পুরুষ পাখি উভয়েই ঠোঁট দিয়ে মাটি বা পচা কাঠ আলগা করে গর্ত খোড়ে এবং পায়ের সাহায্যে মাটি বা কাঠের গুঁড়া গর্তের বাইরে ছুঁড়ে ফেলে বাসা তৈরি করে।
পৃথিবীতে প্রায় ৯০ প্রজাতির মাছরাঙা দেখা যায়। এরমধ্যে বাংলাদেশে প্রায় ১২ প্রজাতির মাছরাঙার অস্তিত্ব রয়েছে। যেমন- ছোট নীল মাছরাঙা, সাদা বুক মাছরাঙা, লাল মাছরাঙা, ছিট বা পাকড়া মাছরাঙা, মেঘ হও মাছরাঙা, সবুজ মাছরাঙা, কালো মাছরাঙা, বাদামি মাছরাঙা, দারুচিনি মাছরাঙা, নীল কানের মাছরাঙা, সাদাগলা মাছরাঙা, বুনো মাছরাঙা। এদের প্রায় সবারই দেহের তুলনায় মাথা বড়, লম্বা, ধারালো ও চোখা চঞ্চু, খাটো পা ও খাটো লেজ রয়েছে। বেশিরভাগ মাছরাঙার দেহ উজ্জ্বল রঙের আর স্ত্রী-পুরুষে সামান্য ভিন্নতা দেখা যায়।
এদের প্রজনন মৌসুম শুরু হয় বর্ষার শেষে কিংবা শরৎকালে। এসময় এরা জোড় বেঁধে একত্রে থাকে। একসাথে ৫-৭টি ডিম পাড়ে। ডিমগুলো দেখতে চকচকে সাদা। বাবা-মা পাখি উভয়ই ডিমগুলোতে দিনের বেলা তা দেয়। তবে রাতের বেলা শুধু মা পাখি ডিমে তা দেয়। ডিম ফুটে বাচ্চা বের হতে ১৯-২০ দিন সময় লাগে। বাচ্চারা আরও ২৪-২৫ দিন বাসায় থাকে। বাসা তৈরি থেকে বাচ্চার যত্ন নেওয়া পর্যন্ত সব কাজই বাবা-মা মিলে করে। তবে বর্ষা আসার ঠিক আগে আগে নীল মাছরাঙা ডিম পাড়ে। পুকুরের পাড়ে বা খাড়া মাটির পাড়ে এক ফুট দীর্ঘ গর্ত করে ওরা বাসা তৈরি করে। গর্তের শেষ প্রান্তটি প্রশস্ত হয়। এ বাসায় নীল মাছরাঙা ৫-৬টি ডিম পাড়ে। ডিমের রং সাদা।
নীল মাছরাঙা একা কিংবা একজোড়া এক জায়গায় বসবাস করে। মাছরাঙা খাদ্য সংগ্রহের ব্যাপারে একটি নির্দিষ্ট নীতি মেনে চলে। খাদ্য সংগ্রহের জন্য নির্দিষ্ট এলাকা ঠিক করে নেয়। সেখানে অন্য মাছরাঙার প্রবেশ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এ পাখির শিকার ধরার স্টাইলও বেশ অদ্ভুত। পানির ওপর ঝুঁকে পড়া কোনো চিকন ডাল বা পানিতে পুঁতে রাখা বাঁশ-খুঁটির ওপর বসে নিচে মাছের গতিবিধির দিকে সজাগ দৃষ্টি রাখে। দূর থেকে দেখে মনে হয় যেন ধ্যানমগ্ন ঋষি। তাক সই হলেই ঋষির ধ্যান ভেঙে যায়। ঝুপ করে তীব্র গতিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে মাছটিকে ধরে ফেলে। এ পাখি কখনো কখনো পানির ২-৩ মিটার ওপরে এক জায়গায় ডানা নাড়িয়ে শূন্যে ভেসে থেকে শিকারকে লক্ষ্য করে। নীল মাছরাঙা চিচি-চিচি-চিচি শব্দে জলাশয়ের ধার ধরে উড়ে চলে। ওদের প্রিয় খাবার ছোট মাছ, জলজ পোকামাকড় এবং ব্যাঙাচি।
গ্রিক পুরাণের সেই কিংবদন্তি হ্যালসিওন পাখি বা মাছরাঙা বৈশ্বিকভাবে বিপদগ্রস্ত বলে বিবেচিত। বন উজাড় করার ফলে মাছরাঙার আবাসস্থল ধ্বংস হচ্ছে। এ ছাড়া জলাভূমি কমায় পাখিটির ভবিষ্যৎ মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে। ফলে আমাদের চারপাশে অবাধে বিচরণ করা পাখিটির বিভিন্ন প্রজাতির সংখ্যা দিনদিন কমে যাচ্ছে।
লেখক: ফার্মাসিস্ট ও সমাজকর্মী।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন