রিজার্ভ চুরির চাঞ্চল্যকর তথ্য
31 August 2023, Thursday
বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে আট কোটি ১০ লাখ ডলার চুরির ঘটনা নিয়ে হলিউডে নির্মিত হয়েছে একটি প্রামাণ্যচিত্র- ‘বিলিয়ন ডলার হাইস্ট’। এই প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণে অনেক ডকুমেন্ট হাজির করা হয়।
২০০৬ সালে পাঁচ ফেব্রুয়ারি। দিনটি ছিল শুক্রবার। বাংলাদেশে সাপ্তাহিক ছুটির দিন। সেদিন বাংলাদেশ ব্যাংক বন্ধ থাকলেও অল্প কয়েকজন কিছু সময়ের জন্য ব্যাংকে আসেন। তাদের একজন জুবায়ের বিন হুদা। এসে দেখলেন ব্যাংকের প্রিন্টার কাজ করছে না। কারিগরি সমস্যা মনে করে তিনি চলে যান। অন্যরা এলেন পরদিন শনিবার, বিকল্প পথে প্রিন্টার চালু করা হলো। তখনই পাওয়া গেল প্রায় এক বিলিয়ন ডলার হস্তান্তরের অনুরোধ জানানোর সব চিঠি। আর ছড়িয়ে পড়ল আতঙ্ক। ঠিক এভাবেই শুরু হয়েছে প্রামাণ্য চিত্র ‘বিলিয়ন ডলার হাইস্ট’। সাত বছর আগে এই চুরির ঘটনা ঘটলেও সিনেমাটির মাধ্যমে আবার আলোচনায় আসেছে।
বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক টাইমস, লন্ডনভিত্তিক ফিনান্সিয়াল টাইমস ও দ্য গার্ডিয়ানের মতো প্রভাবশালী গণমাধ্যমে এই প্রামাণ্যচিত্রের পর্যালোচনা ছেপেছে। ফলে মামলার ক্ষতি হবে বলে বাংলাদেশ বিষয়টি যতই লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করুক, এ নিয়ে আলোচনা চলছেই। কেননা, এটিই বিশ্বের সবচেয়ে বড় ডিজিটাল চুরির ঘটনা। এই চুরির বিস্তারিত যেকোনো থ্রিলার সিনেমার চেয়ে কম উত্তেজনাপূর্ণ নয়। যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সাল পিকচার্স ও জিএফসি ফিলাসব ব্যাপারে প্রামাণ্যচিত্রটি পরিচালনা করেছেন ডেনিয়েল গর্ডন। গত ১৪ আগস্ট প্রামাণ্যচিত্রটি মুক্তি পেয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি হয়েছিল ২০০৪ সালে। ২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি রাতে। সে সময় আট কোটি ১০ লাখ ডলার চুরি হয়। এসব বাংলাদেশের নাগরিকদের উপার্জিত অর্থ। আর এর ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে ছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। সিনেমাটি নির্মাণের জন্য ডেনিয়েল গর্ডন একদল বিশেষজ্ঞকে হাজির করেছেন। প্রামাণ্যচিত্রটির ধারা বর্ণনা করেছেন ব্রিটিশ সাংবাদিক মিশা গ্লোনি। গ্লোনি সাইবার অপরাধ বিষয়ে একজন বিশেষজ্ঞ। এ বিষয়ে তিনি একটি বইও লিখেছেন। প্রামাণ্যচিত্রের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে মতামত দিয়েছেন সিকিউরিটি বা নিরাপত্তা গবেষক এরিক চেইন, মার্কিন সাংবাদিক যসুয়া হেমার। তিনি নিউজ উইকে কাজ করেছেন। রয়টার্সের সাংবাদিক কৃষ্ণ দাস, নিউজ ইয়র্ক টাইমের সাংবাদিক নিকোল পার্লরথ। এরা সাইবার নিরাপত্তা ও ডিজিটাল গুপ্তচরবৃত্তি নিয়ে কাজ করেন। মতামত প্রদানকারীদের মধ্যে রয়েছেন পোলান্ডের নাগরিক রাফাল রহজিনোসিক। ডিজিটাল ঝুঁকিবিষয়ক বিশেষজ্ঞ তিনি। আর আছেন ইংল্যান্ডের নাগরিক মিকো হাইফোনের ও এজ হিলবার্ট আর আছেন সাবেক এফবিআই স্পেশাল এজেন্ট কেইথমুলারস্কি।
বাংলাদেশের ব্যাংক থেকে আট কোটি ১০ লাখ ডলার চুরির আগে হ্যাকাররা পৃথিবীর তুলনামূলকভাবে দুর্বল নিরাপত্তাব্যবস্থার ব্যাংকগুলোকে টার্গেট করেছিল এবং এক বছরের বেশি সময় ধরে হোমওয়ার্ক করেছিল। তারা অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বাংলাদেশ ব্যাংকেই ডাকাতির জন্য উপযুক্ত বিবেচনা করে এবং নিশ্চিত হয়েছিল যে, এখান থেকেই টাকা সরানো সহজ হবে। এর জন্য তারা বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, ফিলিপাইন প্রভৃতি দেশের ওপর নজরদারি করছিল এবং সম্ভাব্য সহযোগী খুঁজে বের করার চেষ্টা করছিল। আবার টাকা একবার হাতিয়ে নিলে সেই টাকা কিভাবে হজম করা যায় তারও পুঙ্খানুপুঙ্খ ছক কষেছিল। এর জন্য তারা একটি বড় সময় হাতে পাওয়ার ব্যবস্থার কথাও চিন্তা করেছিল। আসলে তারা বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রায় হাজার কোটি ডলার হাতানোর পরিকল্পনা নেয়।
প্রাথমিকভাবে দেখা গেছে, টাকা বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে হাতিয়ে নেয়ার তিন দিন পর বাংলাদেশ ব্যাংক বিষয়টি টের পেয়েছিল। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরসহ এর উচ্চ পর্যায়ের সব কর্মকর্তা বিষয়টি ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু স্মরণকালের সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর এই ব্যাংক ডাকাতির ঘটনা ততদিনে বিবিসি, আল-জাজিরাসহ বিশ্বসেরা সংবাদমাধ্যমের অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশের ফলে সারা বিশ্বে জানাজানি হয়ে যায়। ধামাচাপা দেয়া সম্ভব হয়নি। ওই সব গণমাধ্যমের রিপোর্টে প্রকাশিত হয়েছে, কারা এর পেছনে জড়িত ছিল। কেন বাংলাদেশ ব্যাংককেই বেছে নেয়া হয়েছিল। কাজটি কি করে এত সহজে সম্পন্ন হলো, এখানে বাংলাদেশ ব্যাংকের ভূমিকা কী ছিল- এই পুরো বিষয়গুলোর ওপর আলোকপাত হয়েছে। বিষয়টি ফুটিয়ে তোলার জন্য রিপোর্টে নানা ধরনের এনিমেশন ব্যবহার করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকে এই চুরির ঘটনার আগে সবচেয়ে বড় ব্যাংক ডাকাতির ঘটনা ছিল। দ্য গ্রেট ট্রেন রবারির কাহিনী। তাতে ডাকাতরা ৪০ লাখ ডলার ডাকাতির ঘটনা ঘটায়। মিশা গ্লেনি বলেছেন, বিশ্ব ও মানব জাতির জন্য এখন সবচেয়ে বড় হুমকি চারটি: মহামারী গণবিধ্বংসী অস্ত্র, জলবায়ু পরিবর্তন ও সাইবার হামলা। নব্বইয়ের দশকের শুরুতে হ্যাকাররা ছিল অল্প বয়সী, টিনএজার। এখন তারা মজা করতেই ক্ষতিকর ম্যালওয়্যার তৈরি করত। তখন এই ভাইরাস ফ্লপি ডিস্ক থেকে ছড়াত। কিন্তু এখনকার ইন্টারনেট ব্যবস্থায় এসব ম্যালওয়্যার সেকেন্ডের মধ্যে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়তে পারছে।
নব্বই দশকে যারা এটিকে একটি খেলা হিসেবে নিয়েছিল, ২০০০ সালের দিকে তারা বুঝতে পারল যে, এটি অর্থ উপার্জনের একটি পথ হতে পারে। ডটকম যুগ শুরু হলে এর উদ্ভব ঘটে। কম্পিউটার নেটওয়ার্ক বা সাইট জিম্মি করে টাকা আদায়ের ঘটনা। এই অপরাধ জগতে রাজত্ব করতে সঙ্ঘবদ্ধ অপরাধী দল বা গ্যাংস্টাররা। কিন্তু নব্বইয়ের দশকের পর একদল মানুষ এলো এই জগতে। যারা অঙ্ক ও পদার্থবিদ্যায় খুব ভালো, কম্পিউটারবিজ্ঞানী, নিজেদের গ্যাংস্টারের কারো শাস্তি হয়নি। ফলে এই আট কোটি ১০ লাখ ডলার চুরির ঘটনা এখন পর্যন্ত রহস্যময়ই রয়ে গেছে। বছরের পর বছর তদন্ত রিপোর্ট দেয়ার তারিখ পড়ছে; কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। তদন্ত কর্মকর্তারা মনে করছেন, এই চুরির সাথে বাংলাদেশ ব্যাংকের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তারাও জড়িত থাকতে পারেন।
লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
উৎসঃ নয়াদিগন্ত
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন