যুক্তরাষ্ট্র সম্ভবত ভেবেছিল বিভিন্ন দেশে নিষেধাজ্ঞা প্রয়োগ করে তারা যেটুকু ফল পেয়েছিল বাংলাদেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে তার চাইতে বেশি ফল পাবে। এগুলো নিয়ে তারা নানান ফুটানি করে। এসব ফুটানিকে আমাদের বিশ্বসেরা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. আব্দুল মোমেন বলেছেন, এসব নিষেধাজ্ঞা আমেরিকার নতুন ঢং। যুক্তরাষ্ট্রের কি কোনো দিনই শিক্ষা হবে না? তারা ইরাকে আফগানিস্তানে ইরানে ভিয়েতনামে প্রভৃতি জায়গায় এসব নিষেধাজ্ঞা ফিষেধাজ্ঞা দিয়ে একেবারে রাম ধোলাই খেয়ে নিজ দেশে ফিরে গেছে। আর বাংলার মাটি যে দুর্জয় ঘাঁটি সেটা তারা টের পায়নি। তারা সন্ত্রাস দমনে বিশ্বখ্যাত বাংলাদেশের র্যাব বাহিনী ও এর বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের কী সাহস! তারা ভিমরুলের চাকে ঢিল মেরে বসেছে।
বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে তাদের এসব নিষেধাজ্ঞা হুঙ্কারে উড়িয়ে দিতে পারেন সেটা ধারণাও করতে পারেনি যুক্তরাষ্ট্র। সরকার বলেছে, বিএনপি-জামায়াত লক্ষ লক্ষ ডলার খরচ করে যুক্তরাষ্ট্রকে দিয়ে এরকম একটি সঙ্ঘাতমূলক পরিস্থিতি ডেকে এনেছে। তবে আওয়ামী লীগের অতি সরল পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন স্বীকার করে ফেলেছেন যে, তিনি ব্যক্তিগতভাবে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে কৃতজ্ঞ। কারণ তার ব্যক্তিগত দুঃসময়ে যুক্তরাষ্ট্র তাকে আশ্রয় দিয়েছিল, তাকে লেখাপড়ার সুযোগ করে দিয়েছিল। সে জন্য তিনি ব্যক্তিগতভাবে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে কৃতজ্ঞ। তিনি শেখ হাসিনাকে আর একবার ক্ষমতায় রাখার জন্য ভারতকে অনেক অনুনয় বিনয় করেছেন।
কিন্তু মার্কিনিরা বড়ই ছ্যাবলা প্রকৃতির। তাদের কাছে বাংলাদেশে কাজ করার জন্য লবিস্ট নিয়োগ করেছিল সরকার। কিন্তু এতে কোনো ফায়দা হয়নি। মার্কিনিরা এমনিতেই বড় নিষ্ঠুর প্রকৃতির। তারা সাফ জানিয়ে দিয়েছে, গণতন্ত্র, মানবাধিকার, ভোটাধিকার, নির্বাচনে নিজেদের প্রার্থী বেছে নেয়ার অধিকার নাগরিকদের দিতেই হবে। আর গুম-খুন, নির্বিচার হত্যাযজ্ঞ চালাতে পারবে না সরকার। পৃথিবীর কত দেশেই তো মানবাধিকার পরিস্থিতির লঙ্ঘন হচ্ছে, এমনকি যুক্তরাষ্ট্রেও প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ মানুষ গুম হয়ে যায়, তখন তাদের সরকার কোথায় থাকে? তাই তাদের মুখে বাংলাদেশে গুম-খুন হচ্ছে, এটা মোটেও মানায় না। তাছাড়া বাংলাদেশের মানুষ গুম হলো কি না এটা তাদের নিজস্ব ব্যাপার। এখানে তো যুক্তরাষ্ট্রের নাক গলানোর কিছু নেই। ‘বাংলাদেশের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি’ শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনা যুক্তরাষ্ট্রকে এমন ধাতানি দিয়েছেন যে, যুক্তরাষ্ট্র এখন থরথর করে কাঁপছে। তারা এখন একেবারে চুপ হয়ে গেছে।
বাহিনীটা র্যাবের বিরুদ্ধে। গঠনের পর থেকেই এই বাহিনী ভয়ঙ্কর রূপ নিয়ে গুম-খুন চালিয়ে আসছিল। এমনকি নারায়ণগঞ্জসহ অনেক জায়গায় তারা ভাড়াটে ঘাতক হিসেবে দুর্নাম কুড়িয়েছে। সরকার প্রথম দিকে এসব ঘটনা অস্বীকার করলেও শেষ পর্যন্ত টেকনাফের কমিশনার একরামুল হককে খুন করতে গিয়ে তাদের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ প্রমাণ পাওয়া যায়। ফলে র্যাবের মুখোশ উন্মোচিত হয়ে পড়ে। এরপর সরকার বরং যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে বসে। তাতে বলা হয়, বাংলাদেশের এই বাহিনী গঠনে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা ছিল। তাদের অস্ত্র দিয়ে, প্রশিক্ষণ দিয়ে এই বাহিনীকে মদদ দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ফলে দায়িত্ব তাদেরও নিতে হবে। এ কথা অত্যন্ত সত্য যে, যুক্তরাষ্ট্র র্যাব বাহিনীকে প্রশিক্ষণ দিয়েছিল। কিন্তু তারা তো নির্বিচারে মানুষ হত্যার কথা বলেনি। কিন্তু তার পরও যুক্তরাষ্ট্র পিঠটান দিলে তো চলবে না। দায়িত্ব তাদেরও নিতে হবে। কিন্তু তাতেও নিবৃত্ত হয়নি যুক্তরাষ্ট্র। মানুষের ধৈর্যের একটা সীমা আছে; তাই শেষ পর্যন্ত আমাদের চারবারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওয়াজেদ ঘুরে দাঁড়াতে বাধ্য হলেন। তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন যে, নিষেধাজ্ঞা যদি প্রত্যাহার করা না হয়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে কিচ্ছু বিক্রি করবে না বাংলাদেশ। হ্যাঁ, এবার যদি যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষা হয়। এর আগে শেখ হাসিনার সরকারের মন্ত্রীরূপে হাসানুল হক ইনু বলেছিলেন যে, আমরা যদি যুক্তরাষ্ট্রে তৈরী পোশাক রফতানি না করি, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের ইউরোপীয় বন্ধুদের ন্যাংটা থাকতে হবে। গ্রীষ্ম ও বসন্তকালে তারা এমনিতেই প্রায় ন্যাংটা থাকে। তবে শীতকালে এমনটা দেখা যায় না তখন কাপড় লাগবেই। কই, এরপর দুই শীত গেল ইউরোপ আমেরিকার লোকদের তো ন্যাংটা থাকতে দেখলাম না। ইনু সাহেবের আশাও পূরণ হলো না। কিন্তু শেখ হাসিনা তো দমে যাওয়া পাত্রী নন। তিনি বলেই যাচ্ছেন যে, যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের চেয়ে অনেক বেশি গুম-খুন হয়। স্কুলে ঢুকে বাচ্চাদের খুন করা হয়। তখন যুক্তরাষ্ট্রে মানবাধিকার কোথায় থাকে? রাগের চোটে শেখ হাসিনা সরকার এবার দূতাবাসের নিরাপত্তা প্রটোকল প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। এর আগে দু’বার দুই মার্কিন রাষ্ট্রদূতের ওপর হামলা চালিয়েছে আওয়ামী লীগাররা।
সরকার বলেছে, এখন দেশের নিরাপত্তা এতই ভালো যে, রাষ্ট্রদূতদের আর বিশেষ নিরাপত্তার প্রয়োজন নেই। তবে কেউ চাইলে অর্থের বিনিময়ে আনসারদের নিরাপত্তা নিতে পারে।
বাংলাদেশ যদি যুক্তরাষ্ট্র থেকে কিছু না কিনে, তাহলে কী দাঁড়াতে পারে? যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি ওয়েবসাইটের তথ্যমতে, যুক্তরাষ্ট্র থেকে ২০২২ সালে বাংলাদেশের মোট রফতানি ছিল ১১.১৭ বিলিয়ন এবং আমদানি ছিল ২.৮ বিলিয়ন ডলার। চলতি বছর মার্চ পর্যন্ত সেদেশে রফতানি হয়েছে ২.৪০ বিলিয়ন ডলার আর আমদানি হয়েছে ৫৯৫ বিলিয়ন ডলার পণ্য।
এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম সংবাদপত্রে বলেছেন যে, দেখতে হবে, আমদানি আমরা কমাতে পারি কি না। কিন্তু উৎপাদনের জন্য কাঁচামাল, মধ্যবর্তী পণ্য ও যন্ত্রপাতি আমদানি প্রয়োজন। আপনি যখন বলেন, যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমরা কিছু আমদানি করবো না। তাতে মার্কিনিদের খুব বেশি আসে যায় না। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র যদি বলে, যে দেশে গণতন্ত্র নেই, মানবাধিকার নেই, সভা-সমিতির স্বাধীনতা নেই, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা কঠোর নিগড়ে আবদ্ধ, সে সব দেশ থেকে আমরা কিছুই কিনবো না, তাহলে বাংলাদেশে কী অর্থনৈতিক সঙ্কট দেখা দিতে পারে সে বিষয়টা সরকার ভেবে দেখেছে বলে মনে হয় না। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সেরকম পরিস্থিতি দেখা দিলে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ থেকে আমদানি কমিয়ে প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা নিতে পারে। সে ব্যবস্থায় আমরা বিপুল আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারি। কারণ তৈরী পোশাক রফতানির ক্ষেত্রে আমরা যুক্তরাষ্ট্রের ওপর বহুলাংশে নির্ভরশীল। আমরা সবচেয়ে বেশি পোশাক রফতানি করি যুক্তরাষ্ট্রে। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের বাইরের উন্নত দেশগুলোর সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক অত্যন্ত ভালো। সেটা হবে আমাদের জন্য বিপর্যয়কর।
যুক্তরাষ্ট্রের এমন নিষেধাজ্ঞা যে, বাংলাদেশে আসছে সেটা তারা বাংলাদেশ সরকারকে আগেই জানিয়ে দিয়েছিল। আর একথা জানার পর সরকারের মন্ত্রী, হাফ-মন্ত্রী, সিকি মন্ত্রীরা এমন লাফালাফি শুরু করেছিল যে, সেটা বান্দরের খেলার মতো মনে হচ্ছিল। কেউ বলছিলেন বাংলাদেশ গণতন্ত্রের সূতিকাগার। বরং যুক্তরাষ্ট্রে গণতন্ত্রের ঘাটতি রয়েছে। সে ঘাটতি পূরণের জন্য তারা বাংলাদেশ থেকে শিক্ষা নিক। শেখ হাসিনার সরকার গণতন্ত্র ও উন্নয়নের শিখরে তুলেছেন। জাতিসঙ্ঘ মানবাধিকার কমিশন প্রধান ও জাতিসঙ্ঘের মহাসচিব যখন মানবাধিকার বিষয়ে পরামর্শ দিয়েছেন তখন সরকারের তরফ থেকে তাদের বাংলাদেশ থেকে মানবাধিকার শিখে নেয়ার পরামর্শ দেয়া হয়েছিল। তারই ধারাবাহিকতায় প্রধানমন্ত্রী রাগে, ক্ষোভে, দুঃখে বলে বসেছিলেন যে, যারা বাংলাদেশের ওপর স্যাংশন দিবে তাদের কাছ থেকে বাংলাদেশ কিচ্ছু কিনবে না। আমার হারাবার কিছু নেই। আমি আমার পরিবারের সদস্যদের হারিয়েছি। যুক্তরাষ্ট্র মানবাধিকারের কথা বলে। কিন্তু তারা বঙ্গবন্ধুর খুনিকে আশ্রয় দিয়ে রেখেছে। এদের মুখে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের কথা মানায় না।
কিন্তু মাত্র দু’দিনের মধ্যে মা-ছেলে উপলব্ধি করলেন যে, বিষয়টা বোধ করি সঙ্গত হলো না। আর তাই সরকার ঘোষণা দিলো যে, তারা যুক্তরাষ্ট্র থেকে চিনি ও সয়াবিন তেল কিনবে। তাতে অবশেষে শেষ রক্ষা হয়নি। বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা মসৃণ করতে যুক্তরাষ্ট্র তাদের বাংলাদেশ নিয়ে নতুন নতুন ভিসানীতি ঘোষণা করেছেন। থমকে গেছে আওয়ামী লীগ। পুরো পাশা উল্টে গেছে। এখন এর পরের খেলা দেখার অপেক্ষা।
লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
উৎসঃ নয়া দিগন্ত
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন