কাকও কাকের মাংস খায়
29 March 2023, Wednesday
এমন একটা কথা প্রচলিত আছে, কাকের মাংস কাকে খায় না। কিন্তু বর্তমান আওয়ামী লীগের শাসনকালে খাওয়া-খাওয়ি এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, কাকের মাংস হরদম কাকে খাচ্ছে। সে নজির সমাজে বহু আছে। কোনো কোনোটি চলছে নীরবে নিভৃতে, আর কোনো কোনোটি প্রকাশ পেয়ে যাচ্ছে। এই সরকার বহুলাংশে গোয়েন্দা বাহিনী ও তাদের তথ্যের ওপর নির্ভরশীল। পুলিশ ও অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থার নির্দিষ্ট ভাষা আছে। তারা সাধারণত বলে ‘ব্যাপারটি খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’ আবার দায়িত্ব এড়ানোর জন্য যেকোনো অপরাধ বা খুনের মামলার ক্ষেত্রে তারা খুনটি তার থানা এলাকায় ঘটেনি বলে মামলা নিতে চায় না। তখন নিহত ব্যক্তির অভিভাবকরা থানায় থানায় ধরনা দিতে থাকেন। পুলিশের আরেকটি ভাষা হচ্ছে- অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেয়া হবে। সেটি খুনের মামলাই হোক আর ডাকাতির মামলাই হোক। ধরা যাক, কোনো দূর গ্রাম থেকে এক ব্যক্তি ঢাকায় এসে খুন হলেন। তার সপক্ষে থানায় গিয়ে অভিযোগ করবে কে? যতদিন তার আত্মীয়-স্বজনরা বিষয়টি জানতে পারবে, তত দিনে হয়তো পুলিশ তাকে বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে আঞ্জুমানে মুফিদুল ইসলামের মাধ্যমে দাফন করে দেবে। এভাবে পুলিশের গাফিলতি ও দায়িত্ব এড়ানোর প্রক্রিয়া চলছে।
পুলিশের ভেতরে নানা ধরনের গোয়েন্দা সংস্থা আছে। আছে ডিবি, এসবি, এনএসআই (সিআইডি), ডিজিএফআই প্রভৃতি। এসব গোয়েন্দা সংস্থা নানা বিষয়ে তদন্ত করে, ডাকাতি করে, বিনা কারণে কাউকে আটক করে মুক্তিপণ আদায় করে। এর ভ‚রি ভ‚রি নজির আছে। এর বিরুদ্ধে অভিযোগ করে সাধারণ মানুষ সাধারণত কোনো প্রতিকার পায় না। কখনো কখনো পুলিশের হেফাজতে থাকা ব্যক্তির আত্মীয়-স্বজনরা থানায় ধরনা দিতে থাকে। কখনো কখনো নিজেদের স্বজনের দেখা পায়। রক্তাক্ত। কথা বলার সামর্থ্যহীন। গায়েবি মামলার অভিযোগে আটক করা হয় হাজার হাজার মানুষকে। সেখান থেকে তাদের ছাড়িয়ে আনতে কিংবা মারধর না করতেও পুলিশকে টাকা দিতে হয়। তারপর একসময় থানায় সে ব্যক্তিকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না। তখন পুলিশ বলে, তাকে তো গতকালই ছেড়ে দেয়া হয়েছে। তিনি বাসায় চলে গেছেন। কিন্তু সে ঘটনা সত্য প্রমাণিত হয় না। বেশির ভাগ সময় ধারণা করা হয়, পুলিশ বা আটককারীর সংস্থার নির্যাতনে ওই ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। তারপর আটককারী কর্তৃপক্ষ তার লাশ গুম করে ফেলেছে। তখন স্বজনদের মধ্যে কান্নার রোল ওঠে। তারা বুক চাপড়ে সাংবাদিকদের কাছে অভিযোগ করেন। তার সবটুকুও প্রকাশিত হয় না। সাংবাদিকরা সরকারের বিভিন্ন ধরনের নিবর্তনমূলক আইন এড়িয়ে সে সংবাদ প্রকাশ করেন।
যেসব সংস্থা এসব অপকর্ম করে তাদের কোনো জবাবদিহিতা নেই। খুব বেশি বিপদে পড়লে সরকারের তরফ থেকে বলা হয়, দায়ী ব্যক্তিকে বদলি করা হয়েছে কিংবা সংশ্লিষ্ট কেন্দ্রীয় দফতরে স্থানান্তর করা হয়েছে। এগুলো কোনো শাস্তিই নয়। বদলি করলে কী হবে? এ থানা থেকে যে থানায় বদলি করল, সেখানেও যে সে একই রকম অপকর্ম করবে না, তার কোনো গ্যারান্টি নেই। ফলে এখন কাক কাকের মাংসই খাওয়া শুরু করেছে।
সম্প্রতি এরকম একটি ঘটনা সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে। তার শিরোনাম ‘সিআইডি কর্মকর্তাকে তুলে নিয়ে মুক্তিপণ আদায় ডিবির।’ অর্থাৎ ডিবিও একটি গোয়েন্দা সংস্থা। সিআইডিও গোয়েন্দা সংস্থা। এই রিপোর্টের সূত্র একটি টেলিফোন কথোপকথনের অডিও রিপোর্ট। অডিও রিপোর্টটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। ২০২০ সালে ২৬ নভেম্বর সিআইডির এসআই আকসাদুদ জামানকে মালিবাগ থেকে উঠিয়ে মিন্টো রোডে ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে নির্যাতন করা হয় এবং জোর করে তার কাছ থেকে মুক্তিপণ বাবদ এক কোটি ৪২ লাখ টাকা আদায় করা হয়। এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপসচিব ফওজিয়া খানের নেতৃত্বে একটি তদন্ত কিমিটি গঠন করা হয়। তদন্ত কমিটি ২৬ অক্টোবর তাদের রিপোর্ট পেশ করে। তাতে এক কোটি ৪২ লাখ টাকা মুক্তিপণ আদায় করার সত্যতা পাওয়া গেছে। ওই ঘটনায় অভিযুক্ত ডিবি সদস্যদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে সুপারিশ করেছে তদন্ত কমিটি। তবে প্রতিবেদন জমা দেয়ার চার মাস পরও কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশ সদর দফতরের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক (প্রশাসন ও পরিচালনা) কামরুল আহসান বলেছেন, অপরাধের ধরন অনুযায়ী মূল অভিযুক্ত ডিবি কর্মকর্তা কায়সার রিজভীসহ অন্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। কায়সার রিজভী কোরায়েশী ছাড়াও এই মামলার অভিযুক্ত অন্যরা হলেন- ডিবির ইন্সপেক্টর জাহিদুল ইসলাম ও মিজানুর রহমান, এসআই মাসুদুল ইসলাম, এএসআই প্রকাশ চন্দ্র গুহ ও জুলহাস এবং কনস্টেবল মাসুদ রানা। তাদের কারো বিরুদ্ধে এখনো কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। পুলিশের সাবেক আইজিপি মোহাম্মদ নুরুল হুদা বলেছেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী ডিবির অভিযুক্ত সদস্যদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি ব্যবস্থা নেয়া উচিত।
ঘটনার বিবরণে প্রকাশ, ২০২০ সালের ১৯ অক্টোবর হজরত শাহজালাল বিমানবন্দরে যাওয়ার পথে দুর্বৃত্তদের কবলে পড়েন দুবাই প্রবাসী নোমান মিয়া। তিনি তার ফুফাতো ভাই মনির হোসেনকে নিয়ে সিএনজি অটোরিকশা করে যাচ্ছিলেন। কাওলা ফুটওভারব্রিজের কাছে মাইক্রোবাস ও মোটরসাইকেল দিয়ে তাদের পথ আটকানো হয়। মনিরকে ধাক্কা দিয়ে রাস্তায় ফেলে নোমান মিয়াকে মাইক্রোবাসে তুলে নেয় তারা। নোমানের হাতে হাতকড়া পরিয়ে চোখ বেঁধে নির্যাতন করা হয়। একপর্যায়ে তার কাছ থেকে পাঁচ হাজার মার্কিন ডলার ও দুই হাজার দিরহাম ছিনিয়ে নিয়ে তাকে রামপুরা এলাকায় ফেলে যায় দুর্বৃত্তরা। পরদিন এই ঘটনায় বিমানবন্দর থানায় মামলা করেন নোমান।
এই মামলা তদন্তের দায়িত্ব পায় ডিবি। তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন ডিবির এডিসি কায়সার রিজভী কোরায়েশী। ডিবি বলছে, তদন্তে প্রবাসী নোমান মিয়াকে রাস্তা থেকে তুলে নেয়া ও ডাকাতির ঘটনায় সিআইডির এসআই আকসাদুদ জামানসহ ৯ জন জড়িত থাকার তথ্য প্রমাণ পাওয়া গেছে। তাদের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেয়া হয়েছে। আকসাদুদ জামান বিকাশ প্রতারণার একটি ঘটনা তদন্ত করতে গিয়ে হুন্ডি চক্রের সন্ধান পান। তখন সিআইডি থেকে তাকে অর্থ পাচার বিষয়ে তদন্তের আদেশ দেওয়া হয়। এরপর খোঁজ নিয়ে তিনি নোমান মিয়ার বিষয়ে জানতে পারেন। আকসাদুদ বলেন, নোমান মিয়ার সঙ্গে কায়সার রিজভীর পূর্ব পরিচয় থাকায় তিনি তদন্তের ভার ডিবিতে নিয়ে যান। কায়সার রিজভী তখন ঢাকা মহানগর পুলিশের ডিবি শাখার উত্তরা বিভাগের বিমানবন্দর জোনাল টিমে ছিলেন।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটির রিপোর্টে বলা হয়, সিআইডি কর্মকর্তা আকসাদুদকে তুলে নেওয়া ও মুক্তিপণ আদায়ের ঘটনা সত্য। ২০২০ সালের ২৬ নভেম্বর সকালে আকসাদুদ সিআইডি কার্যালয়ে যাওয়ার পথে মালিবাগ মোড়ে পৌঁছলে কায়সার রিজভীসহ তার দলের সদস্যরা আকসাদুদকে আটক করে ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে যায়। সেখানে তাকে বলা হয়, কাওলায় প্রবাসী নোমান মিয়ার অর্থ ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনায় আরো পাঁচজনকে আটক করেছে। তারা ঘটনায় আকসাদুদ জড়িত বলে জানিয়েছে। এক পর্যায়ে অভিযোগ থেকে তাদের রেহাই দেওয়া নিয়ে কথা হয়। সেজন্য ডিবির কায়সার রিজভী দুই কোটি টাকা দাবি করেন। এ সময় কায়সার রিজভীর ফোন দিয়ে আকসাদুদ তার স্ত্রীর সাথে কথা বলেন। পরে আটক ব্যক্তিদের সবাইকে মোবাইলে তাদের স্বজনদের সাথে কথা বলতে দেয়া হয়। কথামতো সবাই আকসাদুদের বাসায় টাকা রেখে যান। আকসাদুদ দিয়েছিলেন ৩৩ লাখ টাকা। বাকি পাঁচজন মিলে দেন ৯৫ লাখ টাকা। ওই দিন সন্ধ্যার পর কায়সার রিজভী ও তার টিমের সদস্যরা আকসাদুদকে সাথে নিয়ে খিলগাঁও ঝিলপাড় এলাকায় তার বাসায় গিয়ে এক কোটি ২৮ লাখ টাকা নিয়ে আসেন। তখন আকসাদুদকে আবার ডিবি অফিসে আনা হয়। পরে তার স্ত্রী ডিবির কায়সার রিজভীকে আরো ১৪ লাখ টাকা দেন। এরপর ২৮ নভেম্বর আকসাদুদ ছাড়া পান।
তবে মামলা চলতে থাকে। আটক ব্যক্তিদের একজন ছিলেন হাসান রাজা। তিনি আদালতে স্বীকারোক্তি দেন যে, তাতে নোমান মিয়াকে তুলে নিয়ে টাকা ছিনিয়ে নেয়ার ঘটনায় আকসাদুদও জড়িত ছিলেন। এই ঘটনায় ডিবির রিপোর্টের ভিত্তিতে ২০২১ সালের ১৮ আগস্ট আকসাদুদ জামানকে সাময়িক বরখাস্ত করে সিআইডি। তার কয়েক দিনের মধ্যে আকসাদুদ ডিবির কায়সার রিজভীসহ এই সাতজনের বিরুদ্ধে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে লিখিত অভিযোগ দেন। এর কয়েক দিনের মধ্যে ৮ সেপ্টেম্বর আকসাদুদের স্ত্রীর সাথে ডিবি কর্মকর্তা কায়সার রিজভীর ‘মুক্তিপণ’ লেনদেনের কথোপকথনের অডিও ছড়িয়ে পড়ে। এই দিন রাতে রংপুরের পীরগঞ্জ থেকে আকসাদুদকে গ্রেফতার করে ডিবি। পরে তাকে স্থায়ীভাবে চাকরিচ্যুত করা হয়। আকসাদুদ বর্তমানে ওই মামলায় জামিনে আছেন। ওই মামলায় ব্যবহৃত একটি মাইক্রোবাস জব্দ দেখানো হয়েছে। মাইক্রোবাসের চালক হারুন অর রশিদ ওরফে সজীবের লগবই যাচাই করে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা না নিয়ে তাকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রদত্ত কমিটি কর্তৃক সজীবকে ছেড়ে দেয়ার দায়ে ডিবির সংশ্লিষ্ট সদস্যদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। তা ছাড়া ডাকাতির ঘটনায় আকসাদুদের সংশ্লিষ্টতার অধিকতর তদন্তের সুপারিশ করা হয়েছে। আকসাদুদ জামানের স্ত্রী তাহমিনা ইয়াসমিন ও ডিবির অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) কায়সার রিজভীর সাথে যে কথোপকথন হয়েছে তাও মাত্র দু’টি বাক্য পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। আর তা হলো- ‘এক কোটি ২৮ লাখ টাকা তো নিছেন আপনারা সবাই। আপনাকে ব্যক্তিগতভাবে ১৪ লাখ টাকা দিচ্ছি না? বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার এই যদি হাল তাহলে সাধারণ মানুষের কী হবে?
লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
উৎসঃ নয়া দিগন্ত
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন