মনে হয় আমরা কিছু আড়াল করছি
04 February 2023, Saturday
সম্প্রতি প্রথম শ্রেণীর পত্রিকায় ইনিয়ে বিনিয়ে এক জঙ্গি কাহিনী ছাপা হয়েছে। কাহিনীটি এভাবে শুরু হয়নি। প্রথম দিকে গল্পটি যেভাবে সাজানো হয়েছিল দেখা গেল তাতে তাদের বিদেশী প্রভুদের উদ্দেশ্য পুরো সিদ্ধ হচ্ছে না। পার্বত্য চট্টগ্রামে ফেনী নদীর পূর্বপাশে ভারতের সাত রাজ্য। এই রাজ্যের সাথে সংযোগের জন্য ফেনী নদীর যোগাযোগব্যবস্থা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পার্বত্য চট্টগ্রামে পর্যটন নিষেধাজ্ঞার পর আমরা লিখেছিলাম সেখানে ভিন্ন কিছু ঘটছে। সেই ভিন্ন কিছু কী, তা নিয়ে আলোচনা করেছিলাম। সেখানে কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) অনেক দিন ধরে বিচ্ছিন্নতাবাদী তৎপরতা শুরু করেছে। তাদের দুই সহস্রাধিক সদস্য সামরিক পোশাক পরে সমরাস্ত্র হাতে বান্দরবানের গহিন অরণ্যে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করছে। সে কথা এখন আর গোপন নেই।
এ পর্যন্ত ঘটনা নিয়ে তেমন কোনো প্রশ্ন নেই। আমরা ভেবেছিলাম সরকার শিগগিরই এই বিদ্রোহীদের বা বিচ্ছিন্নতাবাদীদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে পারবে। কিন্তু দু’-এক দিনের মধ্যেই ঘটনার উল্টা প্রবাহ শুরু হলো। কুকি চিনের সেনাপ্রধান বা দলীয়প্রধান নাথান বম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের মাস্টার্স করা। কিন্তু তিনি বাংলাদেশে একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র আন্দোলন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন এবং এদের উপদ্রবে বান্দরবান এলাকায় চরম অশান্তির সৃষ্টি হয়েছে। ফলে একের পর এক এলাকায় সেখানে পর্যটন বা পর্যটক নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু কী ঘটছে আসলে সেখানে। বান্দরবানের বিভিন্ন ট্যুরিস্ট স্পটে সাধারণত তরুণরাই দল বেঁধে যাতায়াত করে। রামু কিংবা থানচি বা রোয়াংছড়ি এলাকায় এসব আকর্ষণীয় পর্যটন স্পট। নিরাপত্তার করণে এগুলোর সব কটিতে পর্যটকদের যাতায়াত নিষিদ্ধ করা হয়েছে। জানা যায়, এই কেএনএফকে অস্ত্রশস্ত্র ও প্রশিক্ষণ দিচ্ছে ভারত এবং মিনায়মারের একদল জঙ্গি গোষ্ঠী। তাদের হাতে আছে আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র, গ্রেনেড বা অন্যান্য মারণাস্ত্র। বিষয়টি যখন খোলাসা হয়ে যাচ্ছিল যে, কেএনএফকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে ভারত ও মিয়ানমারের বিদ্রোহীরা।
ঘটনার এখানেই শেষ হলে তো চলবে না। এর আগেও আমরা দেখেছি, সন্তু লারমার জনসংহতি সমিতিকে একই গোষ্ঠী বিপুল অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে প্রশিক্ষণ দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে অশান্তির পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল। সেটি অনেকটা সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছিল। ফলে আওয়ামী লীগ সন্তু লারমার সাথে একটি শান্তিচুক্তি করতে বাধ্য হয়। সেই শান্তিচুক্তির পর পরিস্থিতির তেমন কোনো উন্নতি হয়নি। বরং জনসংহতি সমিতি আরো কয়েক ভাগে বিভক্ত হয়ে পাহাড়ে অশান্তি সৃষ্টি করেই যাচ্ছে। গ্রুপে গ্রুপে সঙ্ঘাতে মৃত্যুর ঘটনাও প্রায় নিত্যনৈমিত্তিক। তা ছাড়া পাহাড়ে তারা ব্যাপকভাবে চাঁদাবাজি চালিয়ে যাচ্ছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, এই পরিস্থিতি যেন অনেকটা গা-সওয়া হয়ে গেছে সরকারের জন্য। জেএসএসের লক্ষ্য ছিল পাহাড়ে একটি স্বতন্ত্র আবাসভূমি। কিন্তু সেটি বাস্তবায়ন হয়নি। জেএসএসও প্রশিক্ষণ নিয়েছে বাংলাদেশের বাইরে। তাদের মদদও দিয়েছে প্রতিবেশী একটি শক্তি। এরা এখন চাঁদাবাজি, ডাকাতি ও খুন খারাবিতে লিপ্ত। তাদের কোনো রাজনীতি নেই।
এদের পাশাপাশি এখন যুক্ত হয়েছে কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ)। এই কেএনএফ একটি সুসজ্জিত সামরিক দল। বলা হয়ে থাকে, এদের প্রায় দুই হাজার সদস্য বান্দরবানের গভীরে নিয়মিত প্রশিক্ষণ নিয়ে থাকে। এই বাহিনীর অস্ত্রের উৎসও প্রতিবেশী দেশগুলো। এ নিয়ে সরকার খুবই বিব্রতকর অবস্থায় আছে। সম্ভবত এদের দমনের জন্য অভিযানও পরিচালিত হচ্ছে। আমরা তার কিছুই জানতে পারি না। তবে পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, গত ২৯ জানুয়ারি রুমার গহিন অরণ্যে সেনাবাহিনীর সাথে কুকি চিন সদস্যদের গুলি বিনিময়ে কুকি চিনের একজন গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়। জানা যায়, আহত আরো বেশ কিছু সদস্য পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে। কেএনএফ এক দিনে সংগঠিত হয়নি। তারা প্রায় দু’বছর ধরে পাহাড়ে বিদেশী মদদে নিজেদের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন হিসেবে গড়ে তুলেছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতা রক্ষার তাগিদে এ ধরনের বিদ্রোহী বাহিনী অবশ্যই দমন করতে হবে। তাদের পাকড়াও করে আইনের আওতায় আনতে হবে। রুমা শুধু নয়, বান্দরবানের পাহাড়ি অঞ্চল পুরোটাই দুর্গম। এখানে বসতিও কম।
পুলিশ জানিয়েছে, সেনাবাহিনীর সাথে কেএনএফের সংঘর্ষের পর যারা আশ্রয়চ্যুত হয়েছেন তাদের খাদ্য ও অন্যান্য সহায়তা দেয়া হচ্ছে। এসব বসতি দূরে দূরে অবস্থিত। ফলে তাদের কাছে পৌঁছানো খুব সহজ কাজ নয়। এ বিষয়ে সেনাবাহিনী যে পদক্ষেপ নিয়েছে তার সাথে দ্বিমত পোষণ করার কোনো সুযোগ নেই। যেকোনো মূল্যে এদের পাকড়াও করতেই হবে। কিন্তু লক্ষণীয় ব্যাপার যেটি তা হলো- যখনই এরকম ঘটনা ঘটে তখনই এর সাথে কোনো না কোনোভাবে ইসলামী জঙ্গি সংগঠনের একটি সংযোগ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চলে।
এখন বলা হচ্ছে, সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী কেএনএফের তত্ত্বাবধানে তাদের ক্যাম্পে জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শরক্বীয়ার সদস্যদের সংযোগ রয়েছে। এর সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য প্রমাণ নেই। শারক্বীয়ার সদস্য হিসেবে দুজনকে শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে। একজন মারা গেছে আরো একজন বান্দরবানের গভীর জঙ্গলে পথ ভুলে খাদ্যাভাব ও তৃষ্ণায় কোথাও মৃত্যুবরণ করেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী একটি কবরের সন্ধান পেয়েছে বটে, তবে সে কবরে কোনো লাশ ছিল না। লাশটি সম্ভবত কম্বলে মোড়ানো ছিল। কম্বলটি কবরে পড়ে আছে। ধারণা করা হচ্ছে, লাশটি নিয়ে গেছে কেএনএফ বা শারক্বীয়ার সদস্যরা। এই হিসাব মেলানো যায় না। প্রশাসন সূত্রে বলা হয়েছে, শারক্বীয়ার এই কথিত সদস্যরা উচ্চতর সামরিক প্রশিক্ষণের জন্য অর্থের বিনিময়ে কেএনএফের দ্বারস্থ হয়েছিল। কিন্তু তারও সুনির্দিষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় না। কোনো কোনো পরিবারের সদস্য নিখোঁজ হলেই সরকার তরফ থেকে বলা হয়, সে কোনো জঙ্গি গোষ্ঠীর সাথে জড়িয়ে পড়েছে। এটি সরকারের জন্য সহজ যুক্তি। এমনি যারা গুম হয়, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যাদের তুলে নিয়ে যায়, তাদের সম্পর্কেও সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা বলেন, সে নিজেই প্রেমঘটিত কারণে বা অন্য কোনো হতাশায় গৃহত্যাগ করেছে। এক সময় ফিরে আসবে। কিন্তু তারা আর ফিরে আসে না।
তবে পার্বত্য চট্টগ্রামে সশস্ত্র গোষ্ঠী কেএনএফের তত্ত্বাবধানে তাদের ক্যাম্পে জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার সদস্যদের প্রশিক্ষণের ভিডিওচিত্র বের হওয়ার পর নতুন সংগঠনটি আলোচনায় এসেছে। একই সাথে ভিন্ন ধর্মাবলম্বী ক্ষুদ্র জাতি গোষ্ঠীর সাথে আল কায়েদার মতাদর্শী এই গোষ্ঠীর সদস্যদের সম্পর্ক কিভাবে হলো? একে অন্যকে কিভাবে মেনে নিলো সেই প্রশ্ন সামনে এসেছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, পাহাড়ে নিরাপদ আস্তানা ও প্রশিক্ষণের জন্য কোনো না কোনো গোষ্ঠীর সহযোগিতা শারক্বীয়াদের জন্য জরুরি। এ জন্য তারা কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের সাথে যোগাযোগ গড়ে তোলে। কেএনএফ সদস্যরা মূলত বম জাতি গোষ্ঠী। তারা তুলনামূলকভাবে বিশ্বস্ত। সে কারণেই কেএনএফ অর্থের বিনিময়ে শারক্বীয়াদের প্রশিক্ষণ দিতে রাজি হয়।
কতজন প্রশিক্ষণ নিতে গেছে তার কোনো হদিস মেলেনি। কিন্তু প্রশাসনের তরফ থেকে বলা হচ্ছে- তারা সংখ্যায় দুই শ’ও হতে পারে। আসলে এই বিষয়টির মধ্যে একটি বিরাট ফাঁক রয়ে গেছে। পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর মধ্যে একদল মুসলমান তাদের আস্তানায় থেকে প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। বাস্তবতার বিচারে এটি প্রায় অসম্ভব। কিন্তু বিষয়টিকে সেদিকেই পরিচালনা করা হচ্ছে। প্রকাশিত রিপোর্ট থেকে প্রমাণিত হয়, কেএনএফ সংখ্যায় অনেক বড় এবং অধিকতর আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র তাদের কাছে রয়েছে। সেসব অস্ত্রে প্রশিক্ষণ নিতে গেছে শারক্বীয়া। পাহাড়ে কেএনএফবিরোধী অভিযানে যে সব আলামত পাওয়া গেছে, তা দেখে কর্মকর্তারা নাকি বলেছেন, এ থেকে প্রমাণিত হয়, তারা আল কায়েদার নিয়ম-কানুন মেনে চলত। তারা খিলাফত প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন করতে চায়। প্রয়োজনে তারা গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ও ব্যক্তিদের ওপর হামলা চালানোর প্রশিক্ষণ নিচ্ছিল। এক র্যাব কর্মকর্তা বলেছেন, শারক্বীয়ারা ভারত, পাকিস্তান ও মিয়ানমারের অমুসলমানদের ওপর হামলা চালানোর পরিকল্পনা করছিল। সেই লক্ষ্যে তারা তরুণদের সংরক্ষণ করে বান্দরবানে নিয়ে যাচ্ছিল এবং কেএনএফের অধীনে কঠোর প্রশিক্ষণ নিচ্ছিল।
এখানে খুব স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন তোলা যায়, পাহাড়ে কে অধিক শক্তিশালী। কেএনএফ নাকি শারক্বীয়া। খুব স্বাভাবিকভাবে এটিই প্রমাণিত হয়, যেহেতু কেএনএফ ভারী অস্ত্রশস্ত্রের প্রশিক্ষণ দেয় সুতরাং তারাই সেখানে শক্তিশালী। রিপোর্টে এমন কোনো কথা নেই যে, শারক্বীয়ার সদস্যরা ট্রেনিং শেষে পাহাড়েই অবস্থান করবে; বরং যতদূর বোঝা যায় তারা সমতলে ফিরে এসে তাদের প্রশিক্ষণ কাজে লাগাবে। কিংবা নতুন করে সংগৃহীত সদস্যদের প্রশিক্ষণ দেবে। তবে বান্দরবানের দুর্গম পার্বত্যাঞ্চলে যা সম্ভব সমতলে তা একেবারে অসম্ভব। এখানে কিছুতেই সামরিক পোশাক পরে অস্ত্র কাঁধে দুই হাজার লোককে প্রশিক্ষণ দেয়া যাবে না। যেকোনোভাবেই হোক তারা ধরা পড়ে যাবেই। সুতরাং এ মুহূর্তে দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতাবিরোধী শক্তি কেএনএফকে দমন করাই বড় কথা। শারক্বীয়াদের তৎপরতার ওপর নজর থাকুক, কিন্তু তারাই যেন মুখ্য শত্রু না হয়ে ওঠে। তবে আমরা পাহাড়েই হোক আর সমতলেই হোক- যেকোনো জায়গায় সশস্ত্র তৎপরতার বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অবস্থান সমর্থন করাকে যৌক্তিক মনে করি।
লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
উৎসঃ নয়াদিগন্ত
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন