খবরটি পড়ে শিরদাঁড়া দিয়ে একটি হিম বেয়ে নেমে গেল। সরকার বলেছে, মাছ, গোশত, ডিম উৎপাদনে দেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে গেছে। তবে কি এসবের দাম শিগগিরই আরো বাড়বে? কারণ, সরকার যে পণ্য বিষয়ে বলেছে, ওই পণ্যে দেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে গেছে, সাথে সাথে ব্যবসায়ীরা সেসব পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। সরকারের মন্ত্রীদের কেউ কেউ বলেছেন, তারা সিন্ডিকেট করে দাম বাড়ায়।
‘স্বয়ংসম্পূর্ণ’ বলতে আমার মতো নাদানরা বোঝে যে, দেশে এই পণ্যের আর অভাব নেই। সুতরাং আমরা বেকুবরা ভাবি, বোধহয় পণ্যটির দাম এখন কমে আসবে; কিন্তু দেখা যায়, যখনই সরকার ঘোষণা করে যে, ওই পণ্যে আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছি তখনই পণ্যটির দাম বেড়ে যায়। যেমন- মাছে যদি স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে থাকি তাহলে বাজারের অবস্থা কী? এক কেজি রুই মাছের দাম ৩৫০ টাকা। এই স্বয়ংসম্পূর্ণতার ঘোষণার আগে এর দাম ছিল কেজিপ্রতি ২৮০ টাকা। গোশত তিন প্রকার- গরুর গোশত, খাসির গোশত ও ব্রয়লার মুরগির গোশত। গরুর গোশতের কেজি ৮০০ টাকা, খাসির গোশতের দাম হাজার টাকার বেশি, ব্রয়লার মুরগির কেজি ১৪০-১৫০ টাকা ছিল। এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২০০-২২০ টাকা। তাহলে এই স্বয়ংসম্পূর্ণতা নাগরিকদের কী দিয়েছে?
বর্তমান সরকারের আমলে ধনীরা আরো ধনী হয়েছে, গরিবরা আরো গরিব। মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্তরা বাজারে গিয়ে বিষণ্ণ মনে ঘোরাফেরা করেন। কাঁচকি মাছ ৪০০ টাকা, মৌরলা ৬০০ টাকা, বাইম মাছ ৮০০-৯০০ টাকা, কী কিনবেন, একজন মধ্যবিত্ত মানুষ? আগে যদি আধা কেজি মৌরলা কিনতেন, এখন কেনেন ২৫০ গ্রাম। বাড়িতে এসে মাছের আয় হওয়ার জন্য নিজেই রেসিপি তৈরি করেন। মৌরলা হলে বেশি করে করলা বা বেগুন দিয়ে রাঁধতে বলেন। রুইয়ের টুকরা অর্ধেক করেন। তরিতরকারির দাম বেশি, আকাশছোঁয়া। ফলে রুই রান্না হয় আলু দিয়ে। তরকারিটা ঝোলে ভাসে। কোনো কিছুর ওপরই যেমন সরকারের নিয়ন্ত্রণ নেই, তেমনি নিয়ন্ত্রণ নেই মাছ, গোশত, ডিমের ওপরও। ডিমের হালি ৫৫-৬০ টাকা। আগে দেখতাম, গৃহিণী বাটিভর্তি তরকারি টেবিলে রাখতেন। তাতে ইচ্ছা করলে একজন দু’টুকরাও খেতে পারতেন। এখন দেখি, বাটিতে বাটিতে তরকারি সাজানো। একেকজনের একেক বাটি যাতে কেউ দুই টুকরা খেয়ে ফেলতে না পারে।
স্বয়ংসম্পূর্ণতা একটি কিচ্ছায় পরিণত হয়েছে। দাদীরা দুপুরে আমাদের ঘুম পাড়িয়ে দেয়ার জন্য নানান কিচ্ছা শোনাতেন। তেমন কিচ্ছায় পরিণত হয়েছে সরকারের স্বয়ংসম্পূর্ণ নিয়ে। আমরা অবিরাম শুনছি- এটায় আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে গেছি, ওটায় আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে গেছি, আরো কত কিছুতে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে যাওয়ার পথে।
সরকার বলছে, আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে গেছি। খাদ্যপণ্য এত বেশি মাত্রায় উৎপাদিত হচ্ছে যে, এখন তা রফতানি করতে হবে। একবার তো সরকার ঢাকঢোল পিটিয়ে ঘোষণা করল যে, পৃথিবীর কোনো দেশে নাকি তারা চাল রফতানি করেছে; কিন্তু ওই ঘোষণার পাশাপাশি আমরা দেখলাম, সরকার ভারত, থাইল্যান্ড, লাওস, ভিয়েতনাম ও মিয়ানমার থেকে চাল আমদানির জন্য দৌড়ঝাঁপ করছে। আর ঠিক সে সময় পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের ভাষায়- ‘স্বামী রাষ্ট্র’ ভারত তাদের চালের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। এখন কেন প্রধানমন্ত্রী নিজেই বলছেন, আগামী বছর দেশে দুর্ভিক্ষ হতে পারে? সবাই প্রস্তুত থাকুন।
বর্তমান সরকারের প্রিয় ভারতের নোবেলবিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন বলেছেন, খাদ্যের অভাবে কোনো দেশে দুর্ভিক্ষ হয় না, দুর্ভিক্ষ হয় গণতন্ত্র ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতার অভাবে। সুতরাং দুর্ভিক্ষ এড়াতে গণতন্ত্র ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা এখন সবচেয়ে জরুরি।
এটি শুরু হয়েছিল ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে। ক্ষমতায় এসে তারা বলতে শুরু করল, বিএনপি তার শাসনকালে এক মেগাওয়াটও বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারেনি যদিও বিএনপি কখনো দাবি করেনি যে, তারা দেশকে বিদ্যুতে স্বয়ংসম্পূর্ণ করেছে। বিদ্যুতের সঙ্কট তখনো ছিল; কিন্তু এরা কুইক রেন্টালের নামে লুটতরাজের গজব সৃষ্টি করে বিদ্যুতে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার চেষ্টা করে। তবে এটি নিশ্চিত করেই বলা যায়, বিএনপি যদি সে চেষ্টা করত তাহলে আওয়ামী লীগের তরফ থেকে শত কণ্ঠে বলা হতো যে- এই কুইক রেন্টালের টাকা লন্ডনে তারেক রহমানের কাছে পাচার হয়ে গেছে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে শত শত কুইক রেন্টাল প্লান্ট অনুমোদন দেয়। প্রাথমিকভাবে তারা কিছু বিদ্যুৎও দেয়। এসব কোম্পানির বেশির ভাগের মালিক আওয়ামী লীগের হোমরা-চোমরারা। তারা বিদ্যুৎ দিক বা না দিক তাদের হাজার হাজার কোটি টাকার মাসিক চার্জ দেয় সরকার। এর মধ্যে ভারতীয় কিছু কোম্পানিও রয়েছে। সরকার জানত যে, কুইক রেন্টালের মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হবে। আর তাই একেবারে শুরুর দিকে আইন করে রেখেছে যে, ‘এই কুইক রেন্টাল ও এর সাথে সংশ্লিষ্ট কারো বিরুদ্ধে কোনো আদালতে মামলা করা যাবে না।’ ভাবখানা যেন এমন- ওলটপালট করে দে মা, লুটেপুটে খাই।
দেশের প্রচলিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর ক্ষমতা বাড়ানো বা সেগুলোর সার্ভিসিংয়ের জন্য কোনো ব্যবস্থা না নিয়েই সরকার কুইক রেন্টালের দিকে ঝুঁকে পড়ে। কিন্তু কুইক রেন্টালের অনিবার্য পরিণতি এই যে, একসময় তার উৎপাদন ক্ষমতা শেষ হয়ে যায়। সরকার কিছু পুরনো গীত গেয়ে যেতেই থাকে যে, ‘আমরা দেশ বিদ্যুতে ভাসিয়ে দিচ্ছি। বিএনপি তার শাসনামলে এক মেগাওয়াট বিদ্যুৎও উৎপাদন করতে পারেনি।’
কিন্তু একসময় বকোয়াজি ধরা পড়েও যায়। আস্তে আস্তে বিদ্যুতের ঘাটতি দেখা দিতে শুরু করে। প্রথম দিকে কোনো কোনো আওয়ামী লীগ মন্ত্রী বলার চেষ্টা করেছিলেন, ‘এই ঘাটতি বিএনপি আমলের দুর্নীতির ফল।’ ঢাকায় তখনো বিদ্যুৎ মোটামুটি চালু ছিল। কিন্তু গ্রামগঞ্জে বিদ্যুতের জন্য হাহাকার উঠল। সেখানে দিনে ১২-১৪ ঘণ্টা করে লোডশেডিং শুরু হয়ে গেল। ঘরে বিদ্যুৎ নেই, রাতে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া বন্ধ, জমিতে সেচ দেয়া যাচ্ছে না, হাহাকার উঠল গ্রামবাংলায়। সরকার বলল, ‘এ সমস্যা সাময়িক, শিগগিরই বিদ্যুতের সঙ্কট শেষ হবে।’
সরকার বলল, ‘দেশ বিদ্যুতে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে গেছে। দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রফতানি করা হবে।’ পথে পথে গান গাওয়া এক বাউলকন্যা এখন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য। সংসদকে ‘নাচে গানে ভরপুর’ করে তোলার জন্য সম্ভবত এদের সংসদ সদস্য করা হয়েছে। তিনি তার তীক্ষ্ণ গলায় বললেন, ‘দেশে ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেয়া হয়েছে। এখন আর বিদ্যুতের কোনো সমস্যা নেই।’ পরিস্থিতি নাকি এমন দাঁড়িয়েছে যে, সরকারকে ফেরি করে চুড়িওয়ালিদের মতো বলতে হবে, ‘বিদ্যুৎ লাগবে? বিদ্যুৎ’? তিনি যখন সংসদে এই সং গাইলেন, তখনো ঢাকায় বিদ্যুতের জন্য হাহাকার। ঘণ্টায় ঘণ্টায় লোডশেডিং হচ্ছে।
কখনো কখনো দিনে চার-পাঁচ ঘণ্টা। গ্রামে তো কথাই নেই, ১৪-১৫ ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকে না। সেচ দেয়ার কায়দা নেই। ডিজেল দিয়ে যে বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে সে চিন্তাও দূরঅস্ত। কারণ ডিজেলের দাম বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘বিদ্যুতের চিন্তা বাদ দিয়ে রেড়ির তেল, ভেন্নার তেল ও কেরোসিন, কুপি ব্যবহার করতে হবে।’ উন্নয়নের ঠেলা বোঝো! কিছুদিন পর নাকি সরকার বলে বসে যে, ‘লাইটারে তেল খরচ না করে পাথরে পাথরে ঘষে আগুন জ্বালাও।’ সে কাজ কখনো করিনি। কিন্তু প্রয়োজন হলে তো করতে হবে। দরকার হলে কাঁচা মাছ গোশত খেতে হবে। তিনি অবশ্য এও বলেছেন, ‘লাকড়ির চুলায় রান্না করতে হবে।’ এমনিতেই তো সরকার নানা প্রকল্পের নামে বন বিনাশ করেছে। তার ওপর ১৬ কোটি লোক লাকড়ির চুলায় রান্না করলে কয়েক বছরের মধ্যেই দেশে সব গাছপালা উজাড় হয়ে যাবে।
কিন্তু গ্যাসে কী হলো? প্রধানমন্ত্রী গর্ব করে বলেছিলেন- আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে আল্লাহর রহমত নাজিল হয় এবং দেশ গ্যাসের ওপর ভাসতে থাকে। কিন্তু এখন গ্যাসের ভাণ্ডার শূন্য। গৃহস্থালির চুলা ঠিকমতো জ্বলছে না। সারকারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। যে একটি টিম টিম করে চালু আছে তা শিগগিরই বন্ধ হবে। শিল্প-কারখানায় উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। ফলে রফতানি হ্রাস পাচ্ছে। ডলারের দাম ৬৪-৬৫ টাকা থেকে ১২০ টাকায় উঠেছে। টাকার হিসাবে আমদানি পণ্যের দাম স্বাভাবিক কারণে দ্বিগুণ হয়ে যাবে। তাহলে নিম্নবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্তদের কী অবস্থা হবে?
বাজারে ৬০ টাকার নিচে কোনো চাল নেই। সে দিকে না গিয়ে সরকারের কর্তাব্যক্তিরা মিনিকেট নিয়ে ব্যস্ত আছেন। তারা বলছেন, যেহেতু মিনিকেট বলে কোনো ধান নেই, সেহেতু মিনিকেট নামে কোনো চালু বিক্রি করা যাবে না। এটি কি সরকারের ‘যুগান্তকারী পদক্ষেপ নয়?’ বাংলাদেশ নাকি বিশ্বের কাছে এক নম্বরের রোলমডেল। গরম খবর। কিন্তু আমি সাধারণ মানুষ আপনাদের রোলমডেল বা রোলস রয়েস দিয়ে কী করব? আমি আমার হিসাবের মধ্যে চাল, ডাল, পেঁয়াজ, তরিতরকারি, গ্যাস, বিদ্যুৎ কিনতে চাই। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, আমাদের শুধু ডিজেল আমদানি করতে হবে। ‘আমাদের গ্যাস ক্ষেত্রগুলোতে চাহিদার চেয়ে বেশি পেট্রল, অকটেন রয়েছে। আমরা পেট্রল, অকটেন আমদানি করি না। এত পেট্রল, অকটেন উৎপাদন করি যে, দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রফতানি করতে পারি।’ তবে আমরা বলি কী, রফতানির দরকার নেই। আপনারা এই দুই পণ্যের দাম কমান। আল্লাহ আপনাদের ভালো করবেন।
লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
উৎসঃ নয়াদিগন্ত
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন