কাশ্মীর সমস্যা প্রসঙ্গে
27 August 2019, Tuesday
ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর কয়েকদিন আগে বাংলাদেশ সফর করেছেন। ঢাকায় তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন ও কথাবার্তা বলেছেন। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তার সাক্ষাতের পর বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী একেএম আবদুল মোমেন বলেন, কাশ্মীরে এখন যে পরিস্থিতি চলছে এটা ভারতের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার।
লক্ষ করার বিষয় যে, কাশ্মীর সমস্যা আজ হঠাৎ করে দেখা দেয়নি। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় থেকে কাশ্মীর সমস্যার একটা ইতিহাস আছে। জাতিসংঘ কাশ্মীর বিষয়ে প্রস্তাব গ্রহণ করে বলেছিল, কাশ্মীর ভারতের সঙ্গে থাকবে নাকি অন্য ব্যবস্থা হবে, এটা সেখানে গণভোটের মাধ্যমে মীমাংসা করতে হবে। এই প্রস্তাব ভারত ও পাকিস্তান উভয়েই মেনে নেয়।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু কাশ্মীরে গণভোটের প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু পরে তিনি তার প্রতিশ্রুতি সম্পূর্ণ ভঙ্গ করে কাশ্মীরকে প্রকৃতপক্ষে ভারতের শাসনভুক্ত করেন! তবে ভারতের সংবিধানের ৩৭০ ও ৩৫(এ) ধারায় কাশ্মীরকে একটি আত্মনিয়ন্ত্রিত অঞ্চল হিসেবে যে স্বীকৃতি দেয়া হয়, তা বর্তমান পরিস্থিতির পূর্ব পর্যন্ত কার্যকর ছিল।
এখন নরেন্দ্র মোদির সরকার ভারতীয় সংবিধানের উপরোক্ত দুই ধারা বাতিল করে কাশ্মীরকে আত্মসাৎ করেছে। তারা ঘোষণা করেছে, কাশ্মীর ভারতের অন্যান্য রাজ্যের মতোই ভারতের অন্তর্ভুক্ত।
ভারতের এই কাণ্ড ও দাবি সত্ত্বেও এর স্বীকৃতি আন্তর্জাতিকভাবে কোথাও নেই। জাতিসংঘ এর বিরোধিতা করে প্রস্তাব পাস করেছে, কোনো দেশই ভারতের এই পদক্ষেপকে সমর্থন করেনি, একমাত্র ইসরাইল ছাড়া। আসলে কাশ্মীর আন্তর্জাতিকভাবে একটি বিতর্কিত সমস্যা এবং কাশ্মীর বিষয়ে জাতিসংঘের প্রস্তাব আইনগতভাবে এখন পর্যন্ত গ্রাহ্য।
এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী কর্তৃক কাশ্মীরকে ভারতের অভ্যন্তরীণ সমস্যা হিসেবে আখ্যায়িত করা এক ব্যতিক্রমী ও বিস্ময়কর ব্যাপার।
এখানে আরও বলা দরকার যে, ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ ও ৩৫(এ) ধারা বাতিলের পর থেকে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফরের আগ পর্যন্ত বাংলাদেশ কাশ্মীর পরিস্থিতির ওপর কোনো মন্তব্য করেনি। এখন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফরের সময়, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তার সাক্ষাৎকারের পরই বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী কাশ্মীর বিষয়ে উপরোক্ত মন্তব্য করেছেন।
উত্তর-পূর্ব ভারতে নাগাল্যান্ড, মিজোরাম, মনিপুর, আসাম অঞ্চলে স্বাধীনতা আন্দোলন আছে। নাগা, মিজো ও মনিপুরীরা দীর্ঘদিন ভারত সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র লড়াই করেছেন এবং এসব অঞ্চলের লোকদের ওপর ভারত সরকার ভয়াবহ নির্যাতন ও সশস্ত্র হামলা করে এসেছে।
কিন্তু তা সত্ত্বেও উত্তর-পূর্ব ভারতের এই অঞ্চলগুলোর সঙ্গে কাশ্মীরের পার্থক্য আছে। এই অঞ্চলগুলো আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ভারতের অন্তর্ভুক্ত অঞ্চল। কিন্তু কাশ্মীরের ক্ষেত্রে এটা বলার উপায় নেই। আগেই বলেছি, ঐতিহাসিকভাবে কাশ্মীর সমস্যা হল আন্তর্জাতিকীকরণকৃত একটি বিতর্কিত ব্যাপার।
কাশ্মীরের ওপর ভারতের সার্বভৌম অধিকার আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত নয়। এ কারণেই কাশ্মীর সমস্যাকে কোনোমতেই ভারতের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার হিসেবে আখ্যায়িত করা চলে না।
কাশ্মীর সমস্যা ভারতের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার, এই ঘোষণা দিয়ে বাংলাদেশ প্রকৃতপক্ষে ভারত সরকার এখন কাশ্মীরে যা করছে তার প্রতি সমর্থনই জুগিয়েছে। কাশ্মীরের ভারতভুক্তির পর থেকেই সেখানকার জনগণের ওপর ভারত সরকারের নির্যাতন বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
কাশ্মীরে জরুরি অবস্থা ও সর্বত্র কারফিউ জারি রেখে সেখানে মানুষের জীবন দুর্বিষহ করা হয়েছে। ঘরে ঘরে খাদ্যাভাব, চিকিৎসার অভাব, জনগণের গৃহবন্দি অবস্থা। সামরিক বাহিনীর গুলিতে মারা যাচ্ছে অনেক মানুষ।
এই পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য রাহুল গান্ধী, সিপিএম নেতা সীতারাম ইয়েচুরিসহ বিভিন্ন দলের ১১ জন নেতা কাশ্মীর যান। কিন্তু তাদেরকে বিমানবন্দরে গ্রেফতার করে জোরপূর্বক দিল্লি ফেরত পাঠানো হয়েছে।
কাশ্মীরের জনগণের ওপর যে নির্যাতন নেমে এসেছে, তার সঙ্গে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি তুলনীয়। ভারতের লাগোয়া অঞ্চল না হয়ে কাশ্মীর যদি বাংলাদেশের মতো পাকিস্তান থেকে হাজার মাইল দূরে হতো, তাহলে সেখানকার জনগণ বাংলাদেশের থেকে অনেক আগেই স্বাধীন হয়ে যেত। এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ কর্তৃক কাশ্মীরে ভারত সরকারের আগ্রাসন সমর্থন করা এক বিস্ময়কর ব্যাপারই বটে।
দুনিয়ার যে কোনো দেশে একটি ফ্যাসিস্ট সরকার যদি জনগণের ওপর চরম নির্যাতন-নিপীড়ন চালায় তাহলে সেই অবস্থায় দুনিয়ার অন্যান্য দেশ কি চোখ বন্ধ করে নির্লিপ্ত থাকতে পারে?
তা যদি হয় তাহলে ইসরাইল ফিলিস্তিনিদের ওপর যে নির্যাতন ও দখলদারি বজায় রেখেছে তাকেও ইসরাইলের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার হিসেবে আখ্যায়িত করা দরকার। কিন্তু দুনিয়া কি তাই করছে? একমাত্র সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলো ও তাদের কিছু দালাল রাষ্ট্র ছাড়া দুনিয়ার সব দেশই ইসরাইলি নির্যাতন ও দখলদারির বিরুদ্ধে সোচ্চার।
কিন্তু শুধু ইসরাইল নয়, মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর যে নির্যাতন চলছে, সেখানকার ফ্যাসিস্ট সরকার এবং ধর্মীয় ও ফ্যাসিস্ট বৌদ্ধদের একটা বড় অংশ তাদের ওপর যে নিপীড়ন, ধর্ষণ, ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে লাখ লাখ লোককে দেশছাড়া করছে তাকেও কি মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার বলে নিশ্চুপ ও নির্লিপ্ত থাকা যায়?
এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশও নিশ্চুপ ও নির্লিপ্ত নেই। মিয়ানমারের এই পরিস্থিতিকে সেখানকার অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে দুনিয়ার বিভিন্ন দেশও নিশ্চুপ ও নির্লিপ্ত নেই। বাংলাদেশ মিয়ানমার থেকে উৎখাত হওয়া লাখ লাখ উদ্বাস্তুকে আশ্রয় দিয়েছে। জাতিসংঘ এই উদ্বাস্তুদের জন্য সাহায্য-সহযোগিতা করছে।
এর থেকেই প্রমাণিত হয়, কোনো দেশের অভ্যন্তরে এই নির্যাতন চললে সে বিষয়ে উদাসীন থাকা এবং তাকে সমর্থন করা নৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে সম্ভব নয়। অভ্যন্তরীণ নির্যাতনকে শুধু ‘অভ্যন্তরীণ’ নির্যাতন বলে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার নিয়ম আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও নেই।
বাংলাদেশের জন্য এভাবে ভারতের ‘অভ্যন্তরীণ’ ব্যাপারে নিশ্চুপ ও নির্লিপ্ত থাকা এক চরম অনৈতিক ও অসামঞ্জস্যপূর্ণ বিষয় ছাড়া আর কী? ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সরকার যখন বাংলাদেশের জনগণের ওপর ব্যাপক নির্যাতন, ধর্ষণ, গৃহদাহ, হত্যাকাণ্ড ঘটাচ্ছিল তখন সারা বিশ্ব পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ছিল।
কিন্তু সে সময় চীন নিজেদের আঞ্চলিক ও জাতীয় স্বার্থে বাংলাদেশের পরিস্থিতিকে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার বলে আখ্যায়িত করেছিল। কাশ্মীর সমস্যাকে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ ব্যাপার বলে যদি ভারতকে সমর্থন করে, তাহলে ১৯৭১ সালে চীন বাংলাদেশের সমস্যাকে অভ্যন্তরীণ বলে নির্লিপ্ত থাকলে দোষারোপ করা যায় কীভাবে?
কিন্তু ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ পরিস্থিতি সম্পর্কে চীনের মন্তব্য ও অবস্থানের বিরুদ্ধে বাংলাদেশেও তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছিল, যে প্রতিক্রিয়া ন্যায্য ছিল। তাই যদি হয়, তাহলে এখন বাংলাদেশ কাশ্মীর সমস্যাকে ভারতের অভ্যন্তরীণ সমস্যা বলে কীভাবে আখ্যায়িত করে ভারতকে এ ক্ষেত্রে সমর্থন করতে পারে? এর নৈতিক ও রাজনৈতিক গ্রাহ্যতা কোথায়?
উত্তর-পূর্ব ভারতের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য সরকার তাদেরকে করিডোর থেকে শুরু করে সব কিছুই দিয়েছে। তাদের যা প্রয়োজন সবই মিটিয়েছে। কিন্তু তার পরিবর্তে তিস্তার পানিসহ বাংলাদেশ কিছুই পায়নি। দেখে মনে হয়, এ সম্পর্ক ভারতের দিক থেকে একতরফা।
বাংলাদেশের বিভিন্ন সমস্যা সত্ত্বেও বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক বিষয়ে বাংলাদেশের বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফেব্রুয়ারি মাসে তার প্রথম ভারত সফরের সময় সেখানে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের বিষয়ে বলেছিলেন, ‘স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সম্পর্ক ঠিক থাকলে ছোটখাটো সমস্যা বড় হয়ে ওঠে না। মিটমাট হয়ে যায়’! (প্রথম আলো, ৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৯)।
কোনো দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অন্য দেশে গিয়ে পারস্পরিক সম্পর্ক বিষয়ে যে এ ধরনের কথা বলতে পারেন এটা কল্পনার অতীত। কিন্তু বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী তা-ই করেছেন। এই পরিপ্রেক্ষিতে কাশ্মীর সম্পর্কে বাংলাদেশ যে অবস্থান গ্রহণ করেছে তাতে বিস্ময়ের কিছু নেই।
বদরুদ্দীন উমর : সভাপতি, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল
উৎসঃ যুগান্তর
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন