কাশ্মীরের জটিল পরিস্থিতি ও ভারতের নির্বাচন
26 February 2019, Tuesday
ভারত অধিকৃত কাশ্মীরে এখন এক নতুন জরুরি পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। বিগত ১৪ জুন পাকিস্তানভিত্তিক জয়শে মহাম্মদ নামে একটি সন্ত্রাসী সংগঠন কাশ্মীরের পুলওয়ামায় তাদের নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর সশস্ত্র হামলা চালিয়ে ৪০ জনকে হত্যা করেছে।
জয়শে মহম্মদ স্বীকার করেছে যে, এ কাজ তাদের। তবে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান এক টেলিভিশন বক্তৃতায় এ ঘটনার সঙ্গে তাদের সম্পর্কের কথা অস্বীকার করেছেন। তিনি একথা বললেও এই আক্রমণ যে তাদের সামরিক বাহিনীর জ্ঞাতসারে অথবা উসকানিতেই হয়েছে এতে কোনো সন্দেহ নেই।
খুব স্বাভাবিকভাবেই এই আক্রমণের তীব্র বিরুদ্ধ প্রতিক্রিয়া হয়েছে ভারতে। সারা ভারতে এখন সাম্প্রদায়িকতা চাগিয়ে উঠেছে এবং প্রধানমন্ত্রী ও তার দল বিজেপি এ পরিস্থিতির পূর্ণ সুযোগ নিচ্ছে।
ভারতের আগামী নির্বাচন সামনে রেখে বিজেপি খুব সংকটের মধ্যে আছে। কারণ ভারতের সব রাজনৈতিক দল একটি জোটের মধ্যে ঐক্যবদ্ধ না হলেও দুই প্রধান জোট ইতিমধ্যেই নির্বাচনী প্রচারে সুবিধাজনক অবস্থায় আছে এবং তাদের ভয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি রীতিমতো আতঙ্কিত।
এ পরিস্থিতিতে পাকিস্তানভিত্তিক জয়শে মহম্মদ ভারতের নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর যে আক্রমণ করেছে, সেটা প্রচারের দিক থেকে বিজেপির অনেক সুবিধা করে দিয়েছে। এটা নতুন নয়।
কাশ্মীর সমস্যা নিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ১৯৪৭ সাল থেকে এই দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষ উভয় রাষ্ট্রের জন্যই একটা মহা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এ কারণে যে, যখনই ভারত বা পাকিস্তান অথবা উভয় দেশে একই সময়ে কোনো সংকটজনক অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে, তখনই তারা এই ইস্যুকে ব্যবহার করেছে নিজের নিজের দেশীয় সংকটজনক অবস্থা থেকে বিদেশের সংকটের দোহাই পেড়ে। ১৯৭১ সাল বাদ দিয়ে এ কারণে পাকিস্তান ও ভারত পরস্পরের বিরুদ্ধে তিনটি যুদ্ধ করেছে। এই মুহূর্তে যে পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে তাতে এটা যুদ্ধ পরিস্থিতি না হলেও যথেষ্ট খারাপ পরিস্থিতি।
পাকিস্তান ও ভারত দুই সরকারই এখন খুব সংকটের মধ্যে রয়েছে। আগামী মে মাসে নির্বাচন নিয়ে বিজেপি খুব সংকটের মধ্যে আছে। জয়শে মহম্মদের সামরিক হামলা এবং ৪০ জন ভারতীয় নিরাপত্তা কর্মীর নিহত হওয়ার ঘটনা এক্ষেত্রে বিজেপির পক্ষে একটা মহা সুবিধাজনক অবস্থার সৃষ্টি করেছে।
কারণ এখন এই পরিস্থিতি সামরিক বিষয়ে সীমাবদ্ধ নেই। এটা হয়ে দাঁড়িয়েছে একটা রাজনৈতিক বিষয়। ভারতজুড়ে সাম্প্রদায়িকতার একটা ঢেউ উঠেছে এবং তার ফায়দা বিজেপির পকেটেই যাচ্ছে।
এর থেকে দেখা যাচ্ছে, ভারত-পাকিস্তান খারাপ সম্পর্ক, এমনকি শত্রুতামূলক সম্পর্ক দুই দেশের শাসক শ্রেণীর জন্য সংকট উত্তরণের একটা পথ। যখনই কোনো ধরনের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সংকট দেখা দেয়, তখন উভয় দেশই ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক খারাপ করে কাশ্মীর সমস্যাকে কেন্দ্র করে।
এদিক দিয়ে কাশ্মীর সমস্যা প্রকৃতপক্ষে তাদের জন্য একটা আশীর্বাদস্বরূপ। ভারতে বিজপি যখন এক মহা সংকটজনক পরিস্থিতিতে পড়েছে, ঠিক এই মুহূর্তেই পাকিস্তান থেকে সাহায্য এসেছে জয়শে মহম্মদের হামলার মধ্য দিয়ে। এটা যে কোনো কাকতালীয় ব্যাপার নয় একথা বলেছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি।
তিনি বলেছেন, জয়শে মহম্মদের এই আক্রমণের আগাম তথ্য সরকারের হাতে থাকা সত্ত্বেও কেন তারা তা বন্ধ বা এর মোকাবেলা করার চেষ্টা করেননি এটা তাৎপর্যপূর্ণ, বিশেষত আগামী নির্বাচন সামনে রেখে (Daily Star, 24.02.2019)। সরাসরি একথা না বলে তিনি ইঙ্গিত করেছেন যে, আগামী নির্বাচনে অবস্থা কাহিল হওয়ায় এই হামলা বিজেপির সাম্প্রদায়িক প্রচারাভিযানে সাহায্য করবে।
মেঘালয়ের গভর্নর কুখ্যাত তথাগত রায়, যিনি একসময়ে পশ্চিমবঙ্গ বিজেপির সভাপতি ছিলেন, কাশ্মীরের বিরুদ্ধে খোলাখুলি যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। তিনি সব কাশ্মীরিকে বয়কট এবং মেঘালয় থেকে সব কাশ্মীরিকে বের করে দেয়ার কথা বলেছেন। রাজস্থান, দিল্লি, এমনকি কলকাতায় পর্যন্ত এই পাকিস্তানি আক্রমণের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক প্রচার-প্রচারণা এখন জোরদার হয়েছে।
এই পরিস্থিতি থেকে উপমহাদেশে সাম্রাজ্যবাদী ষড়যন্ত্রের বিষয়টিকে উহ্য রাখলে সেটা অবাস্তব হবে। কারণ ইঙ্গ-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ সবসময়েই ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংকট পরিস্থিতি টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করে থাকে তাদের বাহ্যিক শান্তির বাগাড়ম্বর সত্ত্বেও। ১৯৪৭ সালে এর সূচনা করে গিয়েছিলেন তৎকালীন গভর্নর জেনারেল লর্ড মাউন্ট ব্যাটেন।
জওহরলাল নেহেরুর সঙ্গে চক্রান্ত করে তিনি এমন এক সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা তৈরি করেছিলেন, যাতে ভারত ও পাকিস্তান বিভক্ত হলেও এ দুই দেশের মধ্যে এমন তিক্ত সম্পর্ক স্থায়ীভাবে তৈরি করে রাখা যায় যাতে একে ভবিষ্যতে দেশের অভ্যন্তরে সাম্প্রদায়িকতা ব্যবহারের জন্য জিকির তোলা যায়।
এ প্রসঙ্গে এখানে কিছু বলা দরকার। ভারত বিভক্তির সময় ঠিক হয়েছিল হিন্দুপ্রধান দেশীয় রাজ্যগুলো ভারতের অন্তর্ভুক্ত হবে এবং মুসলমানপ্রধান দেশীয় রাজ্য পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হবে। এই হিসেবে জুনাগড়, হায়দরাবাদ, ভুপাল ইত্যাদি ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল শাসক মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও।
কাশ্মীর নিয়ে একটা সমস্যা সৃষ্টি করা হয়েছিল, যাতে কাশ্মীর মুসলমানপ্রধান হওয়া সত্ত্বেও পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত না হতে পারে। বিষয়টি নিয়ে জাতিসংঘে আলোচনা হয়েছিল এবং সর্বসম্মতক্রমে এ সিদ্ধান্ত হয়েছিল যে, কাশ্মীরে একটি গণভোটের মাধ্যমে ঠিক হবে তারা ভারত অথবা পাকিস্তান কার সঙ্গে যুক্ত হবে। এ বিষয়ে ভারত সরকার এবং তার প্রধানমন্ত্রী নেহেরুও একমত হয়েছিলেন। কাশ্মীরের রাজাও এ বিষয়ে রাজি ছিলেন।
১৯৪৭ সালের ২ নভেম্বর জওহরলাল নেহেরু এবং কাশ্মীরের নেতা শেখ আবদুল্লাহ রাজধানী শ্রীনগরের লালচকে এক জনসভায় এই ফরমুলা ঘোষণা করেন। কাশ্মীরের গণভোট সম্পর্কে নেহেরু বলেছিলেন, এটা শুধু কাশ্মীরের জনগণের কাছে একটা প্রতিশ্রুতি নয়, এটা হল সারা দুনিয়ার কাছে একটা প্রতিশ্রুতি।
কিন্তু মজার কথা, এর ঠিক এক বছর পরেই শ্রীনগরের একই জনসভায় ১৯৪৮ সালের শেষের দিকে জওহরলাল নেহেরু ভারতের পতাকা উত্তোলন করেন। (Frontline, December 21, 2018) । এভাবে তিনি শুধু কাশ্মীরের জনগণের কাছে নয়, সারা দুনিয়ার জনগণের কাছে দেয়া প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে কাশ্মীর সমস্যার ভিত্তি রচনা করেন।
এটা ছিল প্রতারণার এক অতি নিন্দনীয় দৃষ্টান্ত। লর্ড মাউন্ট ব্যাটেনের সঙ্গে ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কে নেহেরু যে চক্রান্ত করেছিলেন এটা ছিল তারই একটি অংশ। নেহেরু এভাবে ১৯৪৮ সালে কাশ্মীরে ভারতীয় পতাকা উত্তোলন করার পর ১৯৫৩ সালের আগস্ট মাসে তিনি শেখ আবদুল্লাহকে কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ ছাড়াই কাশ্মীরের প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে বরখাস্ত করে তার জায়গায় বখশী গোলাম মোহাম্মদকে প্রধানমন্ত্রী করেন এবং শেখ আবদুল্লাহকে জেলে পাঠান। এই কাজে সাংগঠনিক নিয়ম-কানুনের কোনো স্থান ছিল না। কারণ নেহরু এসব কাজ এক পূর্বপরিকল্পিত চক্রান্তের মাধ্যমেই করেছিলেন।
এখানে বলা দরকার, নেহেরু যেভাবে সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে শেখ আবদুল্লাহকে গ্রেফতার করেছিলেন, ঠিক সেইভাবেই এখন নরেন্দ্র মোদি কাশ্মীরে ২১ নভেম্বর নির্বাচিত সংসদ ভেঙে দিয়েছেন। ইতিপূর্বে তারা মেহবুবা মুফতির মন্ত্রিসভার শরিক হিসেবে ছিলেন। সেই প্রথম বিজেপি কাশ্মীরে ক্ষমতায় আসে।
কিন্তু আগামী নির্বাচনে কাশ্মীরকে ব্যবহার করার উদ্দেশ্যে বিজেপি ছয় মাস আগে মেহবুবা মুফতির মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করে। মুফতি সংসদ ভেঙে দিয়ে নির্বাচনের দাবি করলেও ছয় মাস ধরে সেখানে গভর্নরের নামে চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে কট্টর সাম্প্রদায়িক সত্য পাল মালিককে নতুন গভর্নর নিযুক্ত করে।
মেহবুবা মুফতির সরকার ছিল একটা কোয়ালিশন সরকার। তাতে বিজেপি ছড়া অন্য দলও ছিল। মন্ত্রিত্ব থেকে সরে এলেও সংসদ ভেঙে না দেয়ার কারণ ছিল মুফতিকে বাদ দিয়ে অন্য দলগুলোর ছুটা অংশ নিয়ে মন্ত্রিসভা গঠন করা। সেটা কিছুতেই সম্ভব হচ্ছিল না।
ইতিমধ্যে মেহবুবা মুফতি মন্ত্রিসভা গঠনের জন্য অন্যদের সঙ্গে কোয়ালিশন গঠনের চেষ্টা করছিলেন। এজন্য তিনি জম্মু ও কাশ্মীরের ন্যাশনাল কনফারেন্স নেতা ওমর আবদুল্লাহ এবং কংগ্রেসের সঙ্গে কথা বলে একটা ঐকমত্যে পৌঁছেছিলেন। তারা তিন দল যৌথভাবে কোয়ালিশন মন্ত্রিসভা গঠনের জন্য প্রস্তুত হয়েছিলেন।
যে মুহূর্তে এই ঘোষণা দেয়া হল, ঠিক সেই মুহূর্তেই নরেন্দ্র মোদির নির্দেশে গভর্নর কাশ্মীরের সংসদ ভেঙে দিলেন! সাবেক মুখ্যমন্ত্রী মেহবুবা মুফতির দাবি অনুযায়ী যারা ছয় মাস ধরে সংসদ ভেঙে না দিয়ে বিকল্প বিজেপি সরকার গঠনের চেষ্টা করছিলেন, তারা হঠাৎ করেই এভাবে কাশ্মীরের সংসদ ভেঙে দিয়ে সেখানে পুরোপুরি গভর্নরের শাসন বহাল রাখলেন।
বিজেপি কেন্দ্রীয় সরকারের এই কাজের বিরুদ্ধে সারা কাশ্মীরে বিক্ষোভ সৃষ্টি হয় এবং আন্দোলন শুরু হয়। সারা ভারতেও এর বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। এমন সময়েই এলো ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর জয়শে মহম্মদের হামলা। একে যে কাকতালীয় মনে করার কারণ নেই এটা মমতা ব্যানার্জি সোজা কথায় না বলে ইঙ্গিত করেছেন।
কিন্তু এটা মোটেই ছোট করে দেখার উপায় নেই। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষের সম্পর্ক থাকলেও কাশ্মীরকে যে তারা একটা পরিত্রাতা ইস্যু হিসেবে দেখে থাকে, এটা আগেই বলা হয়েছে। এক্ষেত্রে দুই সরকারের গোয়েন্দা বাহিনীর মধ্যে গোপন যোগসাজশ মার্কিন ও ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে থাকা খুবই সম্ভব।
বিজেপি ভারতের নির্বাচন সামনে রেখে যে রীতিমতো সংকটেই পড়েছে এটা পাকিস্তান এবং জয়শে মহম্মদ এবং সেই সঙ্গে ইঙ্গ-মার্কিন সম্রাজ্যবাদীদের অজানা নয়। আসলে নরেন্দ্র মোদির মতো সাম্প্রদায়িকতাকে শুধু ইঙ্গ-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদেরই নয়, পাকিস্তানেরও দরকার।
কাজেই নির্বাচনের মুখে নরেন্দ্র মোদি এবং তার বিজেপি সরকারকে টিকিয়ে রাখার উদ্দেশ্যে জয়শে মহম্মদকে দিয়ে এই বোমা হামলা যদি পাকিস্তানের গোয়েন্দা বাহিনী করে থাকে, তাহলে তাতে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই।
এতেও বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই যে, মমতা ব্যানার্জি যেমন বলেছেন, আক্রমণের পূর্বাভাস ও তথ্য ভারত সরকারের হাতে থাকা সত্ত্বেও তাদের দ্বারা এটা ইচ্ছাকৃতভাবে ঘটতে দেয়ার বিষয়টিও উড়িয়ে দেয়ার নয়।
বদরুদ্দীন উমর : সভাপতি, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল
উৎসঃ যুগান্তর
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন