শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ছোট করে দেখার অবকাশ নেই
07 August 2018, Tuesday
২৯ জুলাই ঢাকায় দুই শিক্ষার্থী বাস দুর্ঘটনায় নিহত হওয়ার পর থেকে স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা যেভাবে হাজারে হাজারে রাস্তায় নেমেছে তা অভূতপূর্ব। এই দেশ ছাত্র আন্দোলনের জন্য আগে বিখ্যাত ছিল। কিন্তু এমন আন্দোলন এখানেও আগে কোনোদিন হয়নি।
আগে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাই আন্দোলন করত নানা সরকারি অপকর্ম ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে। এখন শুধু ঢাকা নয়, বাংলাদেশের সর্বত্র রাস্তায় নেমেছে স্কুলের বাচ্চারা, ছাত্রছাত্রী নির্বিশেষে। শুধু তাই নয়, এই আন্দোলনে ছাত্রীরা যত ব্যাপকভাবে এসেছে, এটা এক অভূতপূর্ব ব্যাপার। বাংলাদেশের ইতিহাসে এর নজির নেই। তাই বর্তমান পরিস্থিতিতে চলমান ছাত্র আন্দোলনকে ছোট করে দেখা অথবা এই আন্দোলনকে হুমকি দেয়ার মতো বোকার কাজ আর নেই।
মনে রাখতে হবে যে, এ ধরনের কোনো আন্দোলন যখন জনগণের কোনো বিশেষ অংশের দ্বারা হয় তখন তার মূল শুধু আন্দোলনের সাক্ষাৎ কারণের মধ্যেই নিহিত থাকে না, সারা দেশের পরিস্থিতির প্রতিফলনই তার মধ্যে ঘটে থাকে। ভাষা আন্দোলন থেকে নিয়ে ১৯৬৯-এর আন্দোলন, ১৯৭১-এর মার্চ মাসের আন্দোলন ইত্যাদি সর্বক্ষেত্রেই এটা দেখা যায়। এখনও সেটাই ঘটছে। স্কুলের কোমলমতি ছাত্রছাত্রীরা তীব্র ক্রোধ অন্তরে ধারণ করে যেভাবে দিনের পর দিন রাস্তায় রয়েছে, এর কারণ শুধু বাস দুর্ঘটনায় মৃত্যুকে দিয়ে ব্যাখ্যা করা যাবে না। বাংলাদেশে আজ সামগ্রিকভাবে যে পরিস্থিতি বিরাজ করছে তার সঙ্গে এই আন্দোলন খুব ঘনিষ্ঠ এবং ওতপ্রোতভাবেই যুক্ত।
সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী, যার দায়িত্ব হচ্ছে সড়ক পথের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, তিনি তার দায়িত্ব কোনোভাবেই পালন না করে তার দলের লাউড স্পিকার ও মুখপাত্র হিসেবে কাজ করতে এবং প্রতিদিন নানা ধরনের হুমকি দিতে ব্যস্ত থাকেন।
তিনি ৫ আগস্ট আন্দোলনরত ছাত্রছাত্রীদের উদ্দেশ করে বলেছেন, ‘যদি কেউ আওয়ামী লীগ অফিসের দিকে গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে অগ্রসর হয়, তাহলে কি তাকে চুমু খেতে হবে, না তার বিরুদ্ধে বলপ্রয়োগ করতে হবে?’ (Daily Star, 06.08.2018).
এখানে প্রশ্ন হল, গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে আওয়ামী লীগ অফিসের দিকে আন্দোলনরত স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা অগ্রসর হচ্ছে, না এই পরিস্থিতিতে তাদের ঘাড়ে দোষ চাপানোর উদ্দেশ্যে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের গুণ্ডারা এ কাজ করছে, যাতে সড়ক পরিবহনমন্ত্রীর পক্ষে এ ধরনের বিবৃতি দেয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়? কারণ স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের হাতে তো কোনো আগ্নেয়াস্ত্র নেই। তারা কোনো লাঠি বা ছড়ি পর্যন্ত ব্যবহারের প্রয়োজনবোধ করে না। নৈতিক শক্তির জোরে এবং বিদ্যমান পরিস্থিতিতে ক্রোধের বশবর্তী হয়েই তারা যেভাবে আন্দোলনে নেমেছে তাতে দোষের কিছু নেই।
কিন্তু শুধু সড়ক মন্ত্রীই নন, বাংলাদেশের সুযোগ্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও পিছিয়ে নেই। তিনি আরও কড়া ভাষায় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের হুমকি দিয়ে বলেছেন, ‘আইন প্রয়োগকারীরা ধৈর্যের পরিচয় দিচ্ছেন। তার অর্থ এই নয় যে, তারা (প্রতিবাদকারীরা) সীমা লঙ্ঘন করবে আর আমরা অলসভাবে বসে থেকে সেটা দেখব। যদি সীমা লঙ্ঘন করা হয় তাহলে আমরা কড়া পদক্ষেপ গ্রহণ করব।’ (উধরষু ঝঃধৎ, ০৬.০৮.২০১৮). এ দুই মন্ত্রী যখন ছাত্রছাত্রীদেরকে একই ভাষায় এভাবে হুমকি দিচ্ছেন তখন মনে হয় এই মুহূর্তে এটাই প্রশাসনের চিন্তা! কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে তারা যদি তাদের হুমকি কার্যকর করেন তাহলে এর পরিণতি কী দাঁড়াবে এ বিষয়ে মনে হয় তাদের কোনো ধারণা নেই। এর ফলে তারা যে কড়াই থেকে আগুনে পড়বেন এতে সন্দেহ নেই। আমাদের দেশের ইতিহাসেও এর উদাহরণের কমতি নেই।
বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রীর অবস্থান বিস্ময়কর। দেশের শাসন পরিচালনার দায়িত্ব তার। কিন্তু তিনি মোটেই ভেবে দেখছেন না এই পরিস্থিতি কেন সৃষ্টি হয়েছে। যে সড়ক দুর্ঘটনার থেকে এই আন্দোলন শুরু হয়েছে তার দিকে না তাকিয়ে, তার প্রশাসনের আমলে সড়ক পরিবহন ক্ষেত্রে যে চরম অরাজকতা বিরাজ করছে সেটা জনগণের কাছে স্বীকার না করে তিনি এখন পরিস্থিতির জন্য দায়ী করছেন ‘তৃতীয় পক্ষ’কে।
এই তৃতীয় পক্ষ কারা? তার নিয়মিত কথাবার্তার থেকে এটা বোঝার অসুবিধা নেই যে, এই ‘তৃতীয় পক্ষ’ বলতে তিনি বোঝাচ্ছেন বিএনপি এবং বর্তমানে জেলবন্দি তার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী খালেদা জিয়াকে। কিন্তু তার এই বক্তব্যের দ্বারা যে তিনি প্রকৃতপক্ষে বিএনপির পক্ষেই রাজনৈতিক প্রচারণা করছেন এতে সন্দেহ নেই। বিএনপি যদি এই আন্দোলনের পেছনে থাকে এবং তা পরিচালনা করে (যার কোনো বাস্তব ভিত্তি নেই), তাহলে তো তারা রাজনৈতিকভাবে যথেষ্ট শক্তিশালী।
‘তৃতীয় পক্ষের’ কথা বলে তাদেরকে এক্ষেত্রে দায়ী করে তিনি প্রকৃতপক্ষে বলছেন তারা খুব শক্তিশালী ও সংগঠিত। তাই যদি হয় তাহলে আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের কী হবে? ২০১৪ সালের জানুয়ারির নির্বাচনে আওয়ামী লীগ যেভাবে কারচুপি এবং পুলিশকে ব্যবহার করেছিল, আগামী নির্বাচনে তো সেটা তাদের পক্ষে কিছুতেই সম্ভব হবে না।
প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন থেকে এক ভিডিও কনফারেন্সে বক্তব্য দেয়ার সময়েই প্রধানমন্ত্রী ‘তৃতীয় পক্ষের’ কথা বলেছেন। ট্রাফিক আইন লঙ্ঘন বিষয়ে এ বক্তৃতায় তিনি যা বলেছেন তা অবাক হওয়ার মতো। ‘বাসচাপায় শহীদ রমিজ উদ্দিন স্কুল অ্যান্ড কলেজের দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যু প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এ ঘটনায় দায়ীদের এরই মধ্যে গ্রেফতার করা হয়েছে এবং বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। রাস্তায় চলাচলে ট্রাফিক আইন মেনে চলার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, স্কুল থেকেই শিশুদের ট্রাফিক আইন শেখতে হবে। স্কুল থেকে ট্রাফিক আইন শেখাতে সরকারের উদ্যোগের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, স্কুল থেকে ট্রাফিক আইন শিক্ষার জন্য এরই মধ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দেয়া হয়েছে (যুগান্তর, ০৬.০৮.২০১৮)।
২৯ তারিখের দুর্ঘটনার জন্য দায়ীদের গ্রেফতার করা হয়েছে এর মধ্যে কৃতিত্বের কিছু নেই। কারণ এ ধরনের গ্রেফতারের বিষয়ে সবাই জানে। অনেক সময় গ্রেফতার করা হয় অপরাধীর বিচার ও শাস্তির জন্য নয়। পরিস্থিতির চাপে অপরাধীকে গ্রেফতার করে পরে তাকে ছেড়ে দেয়ার জন্য। কিন্তু এক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের দ্বারা তিনি প্রকৃতপক্ষে দুর্ঘটনার জন্য স্কুলের শিক্ষার্থীদের ট্রাফিক আইন ও চলাচলের নিয়ম-কানুন বিষয়ে অজ্ঞানতাকেই মূলত দায়ী করেছেন। তাদেরকে জ্ঞান দানের ব্যবস্থার জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে নির্দেশের কথাও বলা হয়েছে।
আসলে এ ধরনের নির্দেশেরও কোনো কার্যকারিতা নেই। এগুলো প্রায় ক্ষেত্রেই কথার কথা হয়েই থেকে যায়। তবে এখানে বলা দরকার, স্কুলের কোমলমতি শিশুদেরকে ট্রাফিক আইনের শিক্ষা দানের থেকে বাস, ট্রাক ও গাড়ি ড্রাইভারদের লাইসেন্স এবং এসব গাড়ির ফিটনেস বা রাস্তায় চলাচলের যোগ্যতার লাইসেন্স থাকা জরুরি। সরকারি হিসাব অনুযায়ী দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশে লাখ লাখ ড্রাইভারের কোনো লাইসেন্স নেই।
লাখ লাখ গাড়ির কোনো ফিটনেস সার্টিফিকেট নেই। দুর্ঘটনা তো শুধু শহরের রাস্তায় এবং স্কুলের সামনেই হচ্ছে না। দূরপাল্লার চলাচলের সময়েও সড়ক দুর্ঘটনা হচ্ছে এবং তাতে প্রতিদিন নিয়মিতভাবে মানুষ মারা যাচ্ছে। এক্ষেত্রে সরকার কী করে এসেছে এবং এখনই বা আসলে কী করবে? এরা তো সবাই ক্ষমতাশালী লোকদের সঙ্গে সম্পর্কিত। তাদেরই লোক।
এ ছাড়া অন্য বিষয়ও আছে। প্রায়ই সংবাদপত্রে রিপোর্টে দেখা যায়- মন্ত্রী, এমপি, সরকারি অফিসার, এমনকি উচ্চপর্যায়ের পুলিশ কর্মকর্তারাও রাস্তার ডান দিক দিয়ে গাড়ি চালান। পুলিশ রিপোর্টেও এ ধরনের ঘটনার উল্লেখ থাকে। স্কুল শিক্ষার্থীদেরকে ট্রাফিক আইন শেখানোর কথা বলা হয়েছে। কিন্তু ট্রাফিক আইন ভঙ্গকারী বড় কর্তাদের ট্রাফিক আইন শেখানোর কী ব্যবস্থা? এর জন্য জাতীয় সংসদ, সরকারি সেক্রেটারিয়েট এবং পুলিশ প্রশাসন কি কোনো প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করবে? তাহলে এই আইন লঙ্ঘনকারীদের বেপথ থেকে পথে ঠিকমতো চলাচলে বাধ্য করার ক্ষেত্রে কী হবে?
এসব খুব প্রাসঙ্গিক ও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। বর্তমানে স্কুলের শিক্ষার্থীরা যে আন্দোলন করছে তার সঙ্গে এসব ব্যাপার যে সম্পর্কহীন এটা ভাবার কোনো কারণ নেই। দেশের সর্বত্র যে অরাজক পরিস্থিতি বিরাজ করছে, প্রকৃতপক্ষে তার বিরুদ্ধেই এখন ছাত্রছাত্রীরা আন্দোলনে নেমেছে। এ আন্দোলন একসময় থামবে। কিন্তু এটা সরকারকে যেভাবে আঘাত করেছে সেটা সামলে ওঠা সরকারের পক্ষে সহজ হবে না।
কাজেই নিজেদের স্বার্থেই প্রধানমন্ত্রীর এসব দিকে খুব সতর্ক নজর দেয়া দরকার। সেটা না করে ‘তৃতীয় পক্ষের’ ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে নিজেদের দায়দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ার অবস্থা হবে চোখ বন্ধ রাখার মতো। যা দেখা দরকার সেটা না দেখে চোখ বন্ধ রাখা কারও জন্য নিরাপদ নয়।
যে পরিস্থিতিতে শিশুরা রাস্তায় বের হয়ে দিনের পর দিন ব্যাপক আকারে বিক্ষোভ দেখায়, সে পরিস্থিতির কারণ সরকারকে ভেবে দেখতে হবে। ‘তৃতীয় পক্ষ’ নামে কেউ যে হ্যামিলনের বাঁশি বাজিয়ে শিশুদের রাস্তায় নামিয়েছে এ ভাবনা সম্পূর্ণ অবাস্তব। কাজেই এই আন্দোলন বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতি ক্ষেত্রে যে বড় আকারে প্রভাব বিস্তার করবে এতে সন্দেহ। একে ছোট করে দেখার কোনো অবকাশ নেই।
বদরুদ্দীন উমর : সভাপতি, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল
উৎসঃ যুগান্তর
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন