বাংলাদেশের এখন বড়ই দুঃসময়। যা আগে কল্পনাও করা যেত না সেই সব ঘটনা এখন ঘটছে। গত রোববার ২৯ জুলাই বিমানবন্দর সড়কে বাসের ধাক্কায় দুই ছাত্রছাত্রীর নিহত হওয়ার ঘটনার পর বিমানবন্দর এলাকাজুড়ে তোলপাড় হচ্ছে।
এই ঘটনার প্রতিবাদে স্বাভাবিকভাবেই ছাত্রছাত্রীরা বের হয়ে সড়ক অবরোধ করে তাদের প্রতিবাদ জানাচ্ছে। কারণ এখনকার বাংলাদেশে প্রতিবাদ জানানোর অন্য কোনো পথ খোলা নেই। এর বিরুদ্ধে মিছিল বের করলে পুলিশের লাঠিতে অনেকের হাত-পা ভেঙে যাবে, মাথা ফেটে যাবে।
সংবাদপত্র রিপোর্ট অনুযায়ী দুটি বাস রেষারেষি করে অন্যটিকে পেছনে ফেলার উন্মাদ চেষ্টা করতে গিয়েই এই দুর্ঘটনা ঘটেছে। এ ধরনের ঘটনাকে আসলে দুর্ঘটনাও বলা চলে না। কারণ অদক্ষ লোকদের বাস চালানোর ক্ষেত্রে এখানে কোনো বাধা নেই। সরকার থেকে নিয়ে সরকারের তাঁবেদার বাস কর্মচারী সমিতির এ বিষয়ে খেয়াল ও নজরদারির কোনো ব্যাপার নেই।
টাকা-পয়সা খেয়ে অদক্ষ বাস চালক নিয়োগ, রাস্তায় চলার অযোগ্য বাস-ট্রাক চলতে দেয়া, দুর্ঘটনায় মৃতদের পরিবারকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ না দেয়া, বাস মালিক ও বাস চালকদের শাস্তি না দেয়া ইত্যাদি অতি পরিচিত কারণেই রাস্তার দুর্ঘটনা এখন এমন পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে যে, প্রতিদিন এর ফলে ৮/১০/১৫ জনের মৃত্যু হচ্ছে।
এক হিসাব থেকে দেখা যাচ্ছে, বর্তমান আফগান যুদ্ধে প্রতিদিন যত লোকের মৃত্যু হচ্ছে তার থেকে বেশিসংখ্যক লোকের মৃত্যু হচ্ছে বাংলাদেশে শুধু বাস দুর্ঘটনায়!
এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ সরকারের নৌপরিবহন মন্ত্রী ও সরকারি সড়ক পরিবহন সমিতির সভাপতি তার সরকারি অফিসে বসে এ বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, ‘ভারতের মহারাষ্ট্রে সড়ক দুর্ঘটনায় ৩৩ জনের মৃত্যু হয়েছে; কিন্তু এ নিয়ে আমরা যা করি সেটা তারা করে না।’
অর্থাৎ তারা শোরগোল-প্রতিবাদ না করলেও আমরা তা করছি! প্রথমত, একথা তাকে কে বলল যে, ‘এটা তারা করে না’? তারা নিশ্চয়ই করে এবং করেছে, তবে দুই দেশের পরিস্থিতির ভিন্নতার কারণে তারা এটা করে অন্যভাবে। তারা এসবের বিরুদ্ধে অবশ্যই জোরালো প্রতিবাদ করে।
দ্বিতীয়ত, ভারতীয়রা কী করে, এ প্রশ্ন বাদ দিয়ে বলা দরকার, যেখানে সদ্য দুই তরুণের প্রাণ এভাবে চলে গেল বাস দুর্ঘটনায়, সেখানে দেশের একজন মন্ত্রী কিভাবে এরকম দায়িত্বহীন ও নিষ্ঠুর বক্তব্য প্রদান করতে পারেন, নিজেদের এ ব্যাপারে দায়িত্ব সম্পূর্ণ এড়িয়ে গিয়ে?
শুধু তাই নয়, সাংবাদিকদের সঙ্গে এসব কথা বলার সময় তিনি যেভাবে হাসাহাসি করেছেন, এটা পরিস্থিতির আরেক দিক। এর থেকে কি বোঝা যায় না আমরা কোন ধরনের সমাজে, শাসনব্যবস্থায় ও সরকারের অধীনে এখন বসবাস করছি? এর থেকে কি বোঝা যায় না, কী ধরনের লোকজন এখন মন্ত্রিত্বের গদিতে বসে দেশ শাসন করছে?
তিনি নিশ্চয়ই দাবি করেন যে, তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন, তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা। এর থেকে বোঝার কোনো অসুবিধা আছে দেশ আজ কোন্ জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে?
সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ছাত্রী দিয়া খানম মিমের বাবা জাহাঙ্গীর আলম দৈনিক যুগান্তরের প্রতিনিধির কাছে ক্ষোভ প্রকাশ করতে গিয়ে বলেন, ‘তার মেয়ে মারা গেল অথচ কেউ তাকে সান্ত্বনা দিতে এলো না। উল্টো শুনলাম আমার মেয়েসহ দু’জন মরার কথা বলতে বলতে আমাগো অভিভাবক মন্ত্রী শাজাহান খান নাকি হাসতেছিলেন। কী বলব ভাষা নেই। দুঃখে আমার বুকটা ভাইঙ্গা আসছে’ (যুগান্তর, ৩১.০৭.২০১৮)।
বর্তমান সরকারি শাসনব্যবস্থায় সারা দেশে যে বেহাল অবস্থা এবং অদৃষ্টপূর্ব নৈরাজ্য বিরাজ করছে তার এই মুহূর্তের একটি উদাহরণ হল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থা। ছাত্রদের কোটা সংস্কার আন্দোলন, তাদের ওপর নির্যাতনের বিরুদ্ধে কিছু নৈতিক চেতনাসম্পন্ন ও দায়িত্বশীল শিক্ষক নির্যাতিত ছাত্রদের পক্ষে দাঁড়িয়ে শহীদ মিনারের সভায় বক্তব্য দেয়ার সময় ছাত্রলীগের গুণ্ডাবাহিনী দ্বারা লাঞ্ছিত হওয়া, শিক্ষকদের এভাবে লাঞ্ছিত হওয়ার বিরুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিপীড়নবিরোধী শিক্ষকদের সমাবেশে অধ্যাপক আকমল হোসেনের বক্তব্যের বিরুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি, সম্পাদকসহ সরকারসমর্থক লোকদের অবিশ্বাস্য প্রতিক্রিয়া একই সূত্রে গাঁথা।
সরকারসমর্থক শিক্ষক সমিতির নেতাদের বক্তব্য এবং নৌপরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খানের উপরোক্ত বক্তব্যের মধ্যে যে অন্তর্নিহিত ঐক্য আছে তার মধ্যে দেখা যায় জনগণ আজ কী ধরনের শাসনব্যবস্থায় ক্ষমতাসীনদের হাতে জিম্মির জীবনযাপন করছেন।
যে দু’জন শিক্ষককে শহীদ মিনারের সভায় লাঞ্ছিত করা হয়েছিল তাদেরকে ছাত্রলীগের গুণ্ডারা জিজ্ঞেস করেছিল, তারা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেননি কেন? মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ না করে তারা কথা বলার অধিকার কোথায় পেলেন? কীভাবে তারা সরকারের সমালোচনা করতে পারেন?
নিপীড়নবিরোধী শিক্ষকদের সভায় অধ্যাপক আকমল হোসেন যথার্থভাবেই বলেছিলেন, কোনো অন্যায়ের প্রতিবাদ করার সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের কোনো সম্পর্ক নেই। রাষ্ট্রের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান তৎকালীন পাকিস্তানে বন্দি থাকায় মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পারেননি, যদিও তিনি ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের নেতা।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৭১ সালে সামরিক বাহিনীর হাতে সপরিবারে আটক থাকায় মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে পারেননি। তাতে কী এসে যায়। এই বক্তব্যের মধ্যে দোষের কী আছে? এর মধ্যে সত্যের অপলাপ আছে, না এর মধ্যে আছে সত্যের বিকৃতি?
কিন্তু তা সত্ত্বেও এই বক্তব্যকে বিকৃত করে এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি নামে সংগঠনটির নেতারা অধ্যাপক আকমলের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করে তার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেয়ার দাবি জানাচ্ছেন। তাকে শাস্তি দিতে বলছেন! এর থেকে বিপজ্জনক ব্যাপার ঢাকা বিশ্বদ্যিালয়ের মতো বিদ্যাপীঠে আর কী হতে পারে?
অধ্যাপক আকমল হোসেনের উপরোক্ত বক্তব্যের প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে ৩০ জুলাই বুধবার এক মানববন্ধনের কর্মসূচি ঘোষণা করে।
সে প্রসঙ্গে এক বিবৃতিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক বলেন, ‘আমরা মনে করি তার (অধ্যাপক আকমল হোসেন) এ ধরনের বক্তব্য ইতিহাস বিকৃতির অপপ্রয়াস, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পরিপন্থী, সংবিধানবিরোধী এবং সর্বোপরি রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল।
এসব মিথ্যা ও দুরভিসন্ধিমূলক বক্তব্যের মধ্য দিয়ে এই চক্র গোটা আন্দোলনকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করছে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে অস্থিতিশীল করার হীন ও গভীর চক্রান্তে লিপ্ত রয়েছে।
আমরা বিস্মিত হই এই ভেবে যে, এ ধরনের ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্য সত্ত্বেও এই সমাবেশের আয়োজকরা তার এ বক্তব্যের কোনো প্রতিবাদ তো করেনইনি, বরং বাহবা দিয়েছেন। ঘটনা পরম্পরায় প্রতীয়মান হয় যে জনাব আকমল হোসেনের এই বক্তব্য তার একক বক্তব্য নয়, এটি সেই অতি প্রতিক্রিয়াশীলদের অপভাবনার বহিঃপ্রকাশ, যারা মহান মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে বারংবার বিতর্ক তৈরির অপপ্রয়াস চালাচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে আঘাত করে তারা শুধু মুক্তিযুদ্ধকেই নয়, বাংলাদেশের অস্তিত্বের ওপর আঘাত করেছে।’
অধ্যাপক আকমল হোসেন সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়িয়ে তার উপরোক্ত বক্তব্য প্রদান করে বর্তমান পরিস্থিতিতে যে সাহসের পরিচয় দিয়েছেন এতে সন্দেহ নেই। কিন্তু তিনি তো একপ্রকার নিরীহ মানুষ, শিক্ষকতা করেছেন কিন্তু কোনো দুষ্টচক্রের সঙ্গে কোনোদিন সম্পর্কিত থাকেননি।
এখানে বলা দরকার, তিনি হলেন সাম্রাজ্যবাদ ও ফ্যাসিবাদ বিরোধী সমিতির সাধারণ সম্পাদক। এই সংগঠনটি কোনো দুষ্টচক্র নয়। উপরন্তু আন্তর্জাতিক ও দেশীয় ক্ষেত্রে সব থেকে শক্তিশালী দুষ্টচক্রের বিরোধিতাই এর ঘোষিত লক্ষ্য। শিক্ষক সমিতির সভাপতি-সম্পাদকের বক্তব্য অনুযায়ী ‘আকমল হোসেন মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে, মুক্তিযুদ্ধকে আঘাত করেছেন এবং তার কর্মের দ্বারা বাংলাদেশের অস্তিত্ব পর্যন্ত বিপন্ন।’
এমন কথা শুনে যে কোনো সৎ ও ওয়াকিবহাল লোকেরই যারপরনাই বিস্মিত হওয়ার কথা। শুধু তাই নয়, অধ্যাপক আকমল হোসেনের বিরুদ্ধে যেভাবে এই সব সম্পূর্ণ মিথ্যা অভিযোগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো একটি মর্যাদাসম্পন্ন বিদ্যাপীঠের শিক্ষক সমিতির সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক ঔদ্ধত্যপূর্ণভাবে করার মতো অবস্থায় এসেছেন এর থেকে বিপজ্জনক অবস্থা একটা দেশের পক্ষে আর কী হতে পারে?
এর থেকে বোঝার কি কোনো অসুবিধা আছে যে বাংলাদেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এখন কতখানি বিপন্ন, বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদ আজ দেশের কত গভীরদেশ পর্যন্ত তার ডালপালা বিস্তার করেছে?
প্রকৃতপক্ষে অধ্যাপক আকমল হোসেন শেখ মুজিবুর রহমান ও শেখ হাসিনা কর্তৃক মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে অপারগ হওয়ার কথা যেভাবে বলেছেন, তার মধ্যে সত্যতা ছাড়া আর কী আছে? তাছাড়া তিনি তার বক্তব্যের মধ্য দিয়ে তাদেরকে কোনোভাবেই দোষারোপ করেননি।
উপরন্তু তিনি বোঝাতে চেয়েছেন যে মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ না করলেও বড় কাজ করা যায়। যারা তার বক্তব্যকে বিকৃত করে ইতিহাস বিকৃতির কথা বলছেন, আসলে তারাই হলেন সবচেয়ে বিপজ্জনক ইতিহাস বিকৃতিকারী।
যারা ফ্যাসিবাদের সঙ্গে, এর ইতিহাস ও চরিত্রের সঙ্গে পরিচিত তারা জানেন, এ ধরনের কথাবার্তা ও হুমকি ফ্যাসিবাদেরই বৈশিষ্ট্য। সড়ক দুর্ঘটনা সম্পর্কে নৌপরিবহন মন্ত্রীর বক্তব্য এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সভাপতি-সম্পাদকের কথাবার্তার মধ্যে অন্তর্নিহিত ঐক্যের কথা আগেই বলেছি। কিন্তু শুধু এ দুই ক্ষেত্রেই নয়, সর্বক্ষেত্রেই আজ ফ্যাসিবাদ বাংলাদেশের জনগণের জীবনকে ত্রাস ও বিপদের মধ্যে রেখেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবন প্রাঙ্গণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির মানববন্ধন অনুষ্ঠানে সমিতির সভাপতি বলেন, ‘আমরা আশঙ্কা করেছি কোটা আন্দোলন এ দেশের ছাত্রদের অধিকারের আন্দোলন নয়।
কোটা আন্দোলন হল নির্বাচনের বছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে অস্থিতিশীল করে রাষ্ট্রীয়ভাবে ক্ষমতা নেয়া যায় তার আন্দোলন। এ আশঙ্কা আমরা সেদিন থেকে করেছিলাম। আর সেদিনকার হাততালি থেকে সে আশঙ্কা প্রমাণিত হল।’
কিসের তাদের এই অদ্ভুত আশঙ্কা হাততালির কারণে প্রমাণিত হল? প্রমাণ সম্পর্কে এই শিক্ষকদের ধারণা কী? যাই হোক, এখানেই শেষ নয়। তিনি আরও বলেন, ‘কোটা আন্দোলনের ভেতর জামায়াত-বিএনপি ঢুকেছে। আয়োজকরা অধ্যাপক আকমলের বক্তব্যের পর কোনো ধরনের প্রতিক্রিয়া করেনি।
অধ্যাপক আকমল হোসেন যে অপরাধে অপরাধী আয়োজকরাও একই অপরাধের অপরাধী। আয়োজকরা তাদের বসিয়ে রেখে হাততালি দেয়ার ব্যবস্থা করেছেন। এই হাততালি ছাত্রশিবির-বিএনপি-ছাত্রদলের হাততালি।’ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কর্তৃক কটূক্তিকারী শিক্ষক অর্থাৎ অধ্যাপক আকমল হোসেনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার আহ্বান জানান তারা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সভাপতি ক্ষমতামদমত্ত অবস্থায় যেসব উক্তি করেছেন তা অবশ্যই ধিক্কারযোগ্য। তিনি যা বলেছেন তার থেকে মনে হয়, বাংলাদেশে এখন সরকারবিরোধী লোকদের সভা-সমাবেশে হাততালি দেয়ার অধিকার পর্যন্ত নেই, থাকা উচিত নয়। হাততালি দিলে তার দ্বারাই প্রমাণিত হবে তারা রাষ্ট্রদ্রোহী, মুক্তিযুদ্ধবিরোধী!
সমিতির সভাপতি তার বক্তৃতায় বলেছেন, কোটা আন্দোলনের ভেতর জামায়াত-বিএনপি ঢুকেছে। অবাক ব্যাপার! তারা ঢুকলে অসুবিধা কী? এ ধরনের ব্যাপক ছাত্র বিক্ষোভ ও আন্দোলনে শুধু জামায়াত-বিএনপি কেন, সব দলের ছাত্ররাই (শুধু ছাত্রলীগের গুণ্ডারা ছাড়া) যোগ দিয়েছে।
তার মধ্যে বড় সংখ্যায় আছে নানা বামপন্থী ছাত্র সংগঠন এবং অন্য দলের ছাত্ররাও। এমনকি ছাত্রলীগের গুণ্ডারা ছাড়া কিছু আওয়ামীপন্থী ছাত্ররাও। এটাই স্বাভাবিক। এর মধ্যে দোষের কিছু নেই, অস্বাভাবিক কিছু নেই।
সব রকম বড় ছাত্র আন্দোলন, গণআন্দোলনেই এটা ঘটে থাকে। কাজেই আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের রাষ্ট্রদ্রোহী, অপরাধী ইত্যাদি বলার মধ্যে উন্মাদতুল্য ঔদ্ধত্য ছাড়া আর কী আছে? এদের ঔদ্ধত্য কোন্ পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে তার অন্য একটা উদাহরণ হল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্য কর্তৃক কোটা আন্দোলনকারীদের তালেবান বলে আখ্যায়িত করা! এসবের মধ্যে বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ও শিক্ষা পরিবেশের দুর্দশার এক করুণ চিত্রই দেখার মতো এবং আতঙ্কিত হওয়ার মতো ব্যাপার।
অধ্যাপক আকমলের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করতে গিয়ে এবং তার ‘অপরাধের’ জন্য শাস্তির দাবি প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির বিজ্ঞ সভাপতি এক চমকপ্রদ সুপারিশ করেছেন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে।
৩৭ বছর শিক্ষকতা জীবনে অধ্যাপক আকমল হোসেন কী পড়িয়েছেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে সেটা খতিয়ে দেখার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘অধ্যাপক আকমল ৩৭ বছর শ্রেণীকক্ষে পড়িয়েছেন। তিনি কি ৩৭ বছর এই বিষয়গুলো পড়িয়েছেন? মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে তিনি ৩৭ বছর শ্রেণীকক্ষে বিভ্রান্তিকর তথ্য পড়িয়েছেন, সেটিও খতিয়ে দেখার বিষয় আজকে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনকে বলব ৩৭ বছর আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের বাংলাদেশের ইতিহাস পড়াতে গিয়ে তিনি কী পড়িয়েছেন, সেখানে সিলেবাস কী আছে বিষয়টি খতিয়ে দেখতে।’ হায় সভাপতি! সিলেবাসে কী আছে সেটা বের করা সহজ।
কিন্তু আকমল সাহেব তার ৩৭ বছরের শিক্ষকতার সময় শ্রেণীকক্ষে কী পড়িয়েছেন সেটা ‘খতিয়ে দেখার’ কোনো উপায় তো নেই। কারণ এজন্য প্রয়োজন প্রত্যেক শিক্ষক বক্তব্য দেয়ার সময় প্রশাসন কর্তৃপক্ষ কর্তৃক শ্রেণীকক্ষে গোয়েন্দা বসিয়ে রাখা। সে রকম কোনো ব্যবস্থা শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নয়, কোনো বিশ্ববিদ্যালয়েই নেই।
তবে ‘আজকের’ দিনের কথা বলে সভাপতি যেভাবে এর প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন, তাতে এখন থেকে শ্রেণীকক্ষে গোয়েন্দা বসিয়ে রাখার ব্যবস্থা তারা করলেও করতে পারেন। এর দ্বারা তারা ফ্যাসিবাদকে অবশ্যই উচ্চতর পর্যায়ে নিয়ে যাবেন। এই মর্মে শিক্ষক সমিতির সভাপতি বর্তমান উপাচার্যের কাছে আবেদন জানাতে পারেন। তার যে অবস্থা তাতে এই ব্যবস্থা প্রবর্তনের উদ্যোগ তিনি নিতেও পারেন। কারণ এ ধরনের কাজের ব্যাপারে তার মস্তিষ্কও সভাপতির মস্তিষ্কের মতো বেশ সক্রিয় দেখা যায়।
বদরুদ্দীন উমর : সভাপতি, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল
উৎসঃ যুগান্তর
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন