মাদকবিরোধী পুলিশি অভিযান নিয়ে এখন যে মাতামাতি শুরু হয়েছে তাতে দেশের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা ধামাচাপা পড়েছে। এতে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। কারণ সমস্যা ধামাচাপা দেয়ার জন্য কোনো না কোনো ধরনের হুজুগ তোলা সব সরকারেরই একটা পরিচিত কৌশল।
বাংলাদেশে এখন মাদকবিরোধী অভিযানের নামে যা করা হচ্ছে তাতে প্রতিদিনই দশ-বিশজনের জীবন যাচ্ছে। মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত বা জড়িত সন্দেহে পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে যারা মরছে, তারা সাধারণভাবে গরিব ও বস্তিবাসী।
বাংলাদেশে অস্বাভাবিক মৃত্যু এখন আর আতঙ্কিত হওয়ার মতো কোনো ব্যাপার নয়। বহুদিন থেকেই পুলিশি হেফাজতে মৃত্যু, ক্রসফায়ার বা এনকাউন্টারে মৃত্যু নিয়মিতভাবেই ঘটে চলেছে। এসব হত্যাকাণ্ডের বিচার আজ পর্যন্ত হয়নি। অবস্থা দেখে মনে হয়, যারা এই হত্যাকাণ্ড ঘটাচ্ছে তাদেরকে বাংলাদেশের সংবিধানে মানুষ হত্যার লাইসেন্স দেয়া আছে! এখানে লক্ষ করার বিষয় যে, এসব বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড যতই অমানবিক হোক, এর পক্ষেও কিছু লোকের সমর্থন আছে।
আজকের সংবাদপত্রেই দেখা যাচ্ছে ইসলামী ঐক্যজোট নামে একটি সংগঠন আয়োজিত ইফতার পার্টিতে জোটের ভাইস-চেয়ারম্যান মওলানা আমিনী বলেছেন, ‘মাদক কারবারিদেরকে প্রকাশ্যে গুলি করে মারতে হবে’ (যুগান্তর, ২৮.০৫.২০১৮)।
অনেক মওলানা সেই ইফতার পার্টিতে উপস্থিত থাকলেও তাদের মধ্যে কেউ এ বক্তব্যের অথবা বলা চলে পুলিশের প্রতি এই আহ্বানের বিরোধিতা করেননি। অর্থাৎ এ বিষয়ে তাদেরও সম্মতি আছে। তারা এরসঙ্গে একমত! পুলিশের মাদকবিরোধী অভিযানে মানুষ যেভাবে নিহত হচ্ছে তা যতই ভয়াবহ হোক, তাদের এই কাজের পক্ষে এ ধরনের সমর্থন একদিক দিয়ে আরও ভয়াবহ। কারণ এক্ষেত্রে শুধু কর্তৃপক্ষের উদাসীনতাই নয়, এ ধরনের লোকদের সমর্থনও পুলিশকে বেপরোয়া হতে উৎসাহিত করে।
উপরোক্ত ইসলামী নেতাদের মতো যারাই পুলিশের এ ধরনের মাদকবিরোধী অভিযানে তাদের কথিত বন্দুকযুদ্ধ সমর্থন করেন, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে তারা সবাই নিমকণ্ঠে এটাই বলেন যে, এই ব্যবসার পেছনে যে রাঘববোয়ালরা আছে তাদেরকেও ধরতে হবে। কিন্তু তাদের ক্ষেত্রে এটা শুধু কথার কথা।
এর কোনো গুরুত্ব তাদের কাছে নেই। পত্রিকায় রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে যে, কোনো কোনো সংসদ সদস্য ও তাদের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়স্বজন মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। যারা বর্তমান ধারার অভিযানের সমর্থক, তারা কি বলতে পারেন, মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত থাকার জন্য এ ধরনের বিচারবহির্ভূত শাস্তিই তাদের প্রাপ্য?
যদি কেউ তা বলেন তাহলে তার সঙ্গে আমাদের একমত হওয়া সম্ভব নয়। কারণ এই ব্যবসার সঙ্গে জড়িত একজন বস্তিবাসীই হোক বা সংসদ সদস্যই হোক, কাউকে বিনা বিচারে শাস্তি দেয়া সংবিধানবহির্ভূত অমানবিক অপরাধ ছাড়া আর কিছুই নয়।
বাংলাদেশের বিপুল অধিকাংশ বুদ্ধিজীবীই দেশে সংঘটিত হতে থাকা নানা অপরাধমূলক কাজকে বিচ্ছিন্নভাবে দেখে থাকেন। সমাজ যে একটা অখণ্ড সত্তা এবং সমাজে যা কিছু ঘটে তা যে পরস্পর বিচ্ছিন্ন নয়, এ ধারণা তাদের নেই।
কাজেই তারা মনে করেন, সারা দেশ আজ যেভাবে দুর্নীতির দ্বারা বিধ্বস্ত হচ্ছে সেই পরিপ্রেক্ষিতে মাদক ব্যবসাকে দেখার প্রয়োজন নেই। কাজেই ব্যাংক ডাকাতি, সরকারি বড় বড় প্রকল্পে চুরি-ঘুষখোরী, বিদেশ থেকে সরকারি কেনাকাটায় দুর্নীতি, খাদ্যে ভেজাল দেয়া, শুধু মুনাফাখোরীর উদ্দেশ্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের মূল্যবৃদ্ধি, শিল্পপ্রতিষ্ঠান এবং অন্যত্র চাকরির জন্য ঘুষের কারবার ইত্যাদি নানা ধরনের অপরাধ যে মাদক ব্যবসায়ীদের অপরাধের সঙ্গে একই সূত্রে গ্রথিত এই দৃঙ্গিভঙ্গি তাদের নেই।
তাছাড়া আরও লক্ষ করার বিষয় যে, প্রত্যেক সরকারের আমলেই সরকারসমর্থক বুদ্ধিজীবীরা এ ধরনের অপরাধের বিরুদ্ধে লেখেন না, মুখও খোলেন না! এজন্য দেখা যায়, বিএনপি সরকারের আমলে যে আওয়ামী ঘরানার বুদ্ধিজীবীরা পুলিশি হেফাজতে ‘হার্ট ফেল’ করে মৃত্যু অথবা নির্যাতনের কারণে মৃত্যুর বিরুদ্ধে গিয়েছিলেন, তারা আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে একই ঘটনা ঘটতে থাকলেও সে বিষয়ে চুপ থাকেন, যেমন বিএনপি সরকারের আমলে সরকারি নির্যাতনের ব্যাপারে বিএনপিসমর্থক বুদ্ধিজীবীরা চুপ থাকতেন। এটাই হল বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের নৈতিকতা ও মানসিকতার দৌড়।
তাদের নৈতিকতা ও মানসিকতা শ্রেণীর ঊর্ধ্বে তো নয়ই, এমনকি দলের উর্ধ্বেও নয়! এই পরিস্থিতিতে সরকারি পুলিশ যে কোনো সরকারের আমলেই অপহরণ, জেল হেফাজতে নির্যাতন, ‘ক্রসফায়ার’, মাদকবিরোধী অভিযান বা অন্য ক্ষেত্রে যে বেপরোয়া আচরণ করবে এতে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। ধর্মের নামে যারা ব্যবসা করে, তাদের অবস্থাও একইরকম।
এটা সাধারণ বুদ্ধি দিয়েই বোঝা যায় এবং অসংখ্য সংবাদপত্র রিপোর্ট থেকে জানা যায় যে, যে আকারে বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে মাদক ব্যবসা চলছে তাতে হাজার হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ আছে। অর্থাৎ এ অপরাধমূলক কাজ যারা করছে, তারা কোটি কোটি টাকার মালিক এবং এ ব্যবসা থেকে তারা কোটি কোটি টাকা মুনাফা করছে। অথচ দেখা যাচ্ছে, মাদক ব্যবসার অভিযোগে যারা কথিত বন্দুকযুদ্ধে মারা যাচ্ছে তারা বস্তিবাসী গরিব মানুষ।
এই বস্তিবাসীরা যে মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত এতে সন্দেহ নেই। এদের মাধ্যমেই মাদকদ্রব্য সরাসরি মাদক সেবনকারীদের হাতে পৌঁছায়। একাজ মাদক ব্যবসার ‘গডফাদার’ নামে যারা পরিচিত, তারা সরাসরি করতে পারে না এবং করে না। তারা বস্তিবাসী গরিবদের দারিদ্র্যের ও কর্মহীনতা বা বেকারত্বের সুযোগ নিয়েই তাদেরকে ব্যবহার করে। কিন্তু মাদকবিরোধী পুলিশি অভিযান কি তাদের গোয়েন্দা বিভাগের তথ্য অনুযায়ী ‘গডফাদার’দের বিরুদ্ধে পরিচালিত হচ্ছে?
শত শত বস্তিবাসীকে মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে তাদের বিরুদ্ধে বেআইনি ব্যবস্থা নেয়া হলেও একজন ‘গডফাদার’কেও কি গ্রেফতার করে যথাযথ বিচারের সম্মুখীন করা হয়েছে? এমন কোনো রিপোর্ট সংবাদপত্রে পাওয়া যায় না।
এ পরিস্থিতিতে মাদক ব্যবসা যেভাবে চলছে সেভাবে যে চলতেই থাকবে এতে সন্দেহ নেই। কারণ হাজার হাজার বস্তিবাসী গরিব বেকারদের এ ব্যবসায়ে টেনে আনা ও নিযুক্ত করা কোনো অসুবিধার কাজ নয়। কিন্তু এই ‘গডফাদারদের’ আইনের আওতায় আনা হচ্ছে না, যেভাবে ব্যাংক ডাকাতদেরও ছাড় দেয়া হচ্ছে।
এই ডাকাতদের শাস্তি তো দেয়া হচ্ছেই না, উপরন্তু তারা যে ঋণ ব্যাংক থেকে নিয়েছে তা মাফ করেও দেয়া হচ্ছে। যদি বলা যায়, এই ব্যাংক ডাকাতদের অনেকেই মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত তাহলে কি ভুল বলা হবে?
আসলে সরকারি ক্ষমতাবানদের সঙ্গে নানা সূত্রে সম্পর্কিত লোকজন এসব অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকার জন্যই যে পুলিশ ও সরকারি সংস্থাগুলো এই অপরাধীদের গায়ে হাত দিচ্ছে না, এটা এক মহা সত্য। এ পরিস্থিতিতে ব্যাংকের সংকট যেমন প্রতিদিন তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে, নানা অপরাধের বিস্তার ঘটছে, তেমনি মাদক ব্যবসাও মহামারীর আকার ধারণ করে মানুষকে, বিশেষত অল্পবয়স্ক নতুন প্রজন্মকে মাদক সেবনের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এর ফলে সমাজের সর্বনাশ হচ্ছে।
এই সর্বনাশের হিসাব করার কোনো প্রয়োজনও ক্ষমতাসীন শাসক শ্রেণীর নেই। কারণ এই সর্বনাশের পথ ধরেই তারা নিজেদের ধনসম্পদ বৃদ্ধি করছে, দেশে ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে বৈষম্য কল্পনাতীতভাবে বাড়িয়ে দিচ্ছে।
পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, মাদক ব্যবসার মূলোচ্ছেদের জন্য তারা বদ্ধপরিকর। কিন্তু এই ব্যবসার আসল হোতাদের প্রতি নজর না দিয়ে তারা যাদের মাধ্যমে মাদকদ্রব্য সরাসরি ক্রেতাদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে এই ব্যবসা বন্ধ করা যাবে না। এর বিস্তার বন্ধ করা সম্ভব হবে না। মিয়ানমারে ইয়াবা তৈরি হয়ে বাংলাদেশে আসছে এবং এই আসার পথ বন্ধ করার ঘোষণা পুলিশ কর্তৃপক্ষ থেকে দেয়া হচ্ছে।
কিন্তু সীমান্তে যে অসংখ্য ছিদ্রপথ দিয়ে ইয়াবা বাংলাদেশে আসছে সেগুলো বন্ধ করা পুলিশের পক্ষে কোনোভাবেই সম্ভব নয়। যে পর্যন্ত ইয়াবার চাহিদা দেশে থাকবে সে পর্যন্ত মিয়ানমার থেকে ইয়াবা বাংলাদেশ আসতেই থাকবে। ভারত থেকে ফেনসিডিল আসবে, আফগানিস্তান থেকে আসতে থাকবে হেরোইন। কাজেই এক্ষেত্রে শুধু মাদকদ্রব্য বাংলাদেশে বন্ধ করার কথা ভাবলেই হবে না, মাদকদ্রব্যের চাহিদা বন্ধ করাই হল এক্ষেত্রে মূল কাজ। কেন হঠাৎ করে বিগত কয়েক বছরে মাদকদ্রব্য সেবন মানুষের মধ্যে অভূতপূর্বভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে, সেদিকে তাকানো সরকার ও বেসরকারি নানা মহলের জরুরি কর্তব্য।
আসলে যে কারণে গরিব বস্তিবাসীরা মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত হচ্ছে, ঠিক সে কারণেই দেশের মানুষের মধ্যে মাদক সেবনের প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। হতাশার গর্ভেই মাদকদ্রব্য সেবন প্রবণতার সৃষ্টি। নতুন প্রজন্ম ও সেই সঙ্গে বিপুলসংখ্যক মানুষ তাদের জীবনে প্রাপ্তির কোনো সম্ভাবনা না দেখে, বেকারত্ব ও ভবিষ্যৎহীনতার চিন্তায় জর্জরিত হয়েই মাদক সেবনের মধ্যে ডুবে যাচ্ছে। এখানে এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ নেই। কিন্তু এ সমস্যার প্রতি দৃষ্টি না দিয়ে, সমস্যাটির বিশ্লেষণপূর্বক সমাধান না করলে পুলিশি অভিযানের মাধ্যমে মাদক ব্যবসা ও মহামারীর আকারে মাদক সেবন বন্ধ করা যে সম্ভব নয়, এটা বলাই বাহুল্য।
বদরুদ্দীন উমর : সভাপতি, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল
উৎসঃ যুগা ন্তর
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন