ব্যবসায়ী বুর্জোয়া শাসনে বাংলাদেশে শিক্ষা, ইতিহাস ও সংস্কৃতি চর্চা
01 May 2018, Tuesday
যে কোনো শাসনব্যবস্থায় জনগণের প্রতিবাদী চিন্তাভাবনা, ক্ষোভ-বিক্ষোভ, প্রতিরোধ নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখার এক অতি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হলো শিক্ষাব্যবস্থা। এ কারণে শিক্ষাব্যবস্থার ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখার জন্য শাসক শ্রেণী সব সময়ই তাকে নিজেদের প্রয়োজনমতো তৈরি ও ব্যবহার করে থাকে।
এটা করতে গিয়ে তারা সব থেকে বেশি গুরুত্ব দেয় চিন্তাভাবনার ওপর প্রভাব বিস্তার এবং ইতিহাস নিজেদের মতো করে সাজিয়ে-গুছিয়ে ছাত্রদের কাছে উত্থাপিত করার ওপর। বাংলাদেশ এদিক দিয়ে কোনো ব্যতিক্রম নয়। এখানকার শাসক শ্রেণী প্রথম থেকেই এ দুই বিষয়ের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখার জন্য যা কিছু প্রয়োজনীয় মনে করেছে তা-ই করেছে এবং এখন পর্যন্ত করে চলেছে।
পাকিস্তানিরা শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে ধর্মীয় উপাদান ব্যবহার করে ছাত্রদের মধ্যে তাদের তথাকথিত রাষ্ট্রীয় আদর্শ প্রচার করতে নিযুক্ত ছিল। শিক্ষাব্যবস্থার ইসলামীকরণ করতে গিয়ে তারা অনেকরকম চেষ্টা করেছিল। উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করা, বাংলায় আরবি অক্ষর প্রচলন করা থেকে নিয়ে নানা ধরনের ইসলামি ভাবধারা সিলেবাসের মাধ্যমে প্রচার তারা এ উদ্দেশ্যে করেছিল। কিন্তু প্রথম থেকেই প্রতিরোধের মুখে পড়ায় এদিক দিয়ে তাদের কোনো বড় সাফল্য আসেনি। ইতিহাস নিজেদের মতো করে তৈরি করার ক্ষেত্রেও তাদের দুর্বলতা ছিল। কাজেই সে চেষ্টাও বিশেষ কাজে আসেনি। তখনকার পূর্ব বাংলায় সংস্কৃতি ও রাজনীতি ক্ষেত্রে যে প্রতিরোধ শুরু হয়েছিল, তার ভূমিকা এদিক দিয়ে ছিল বেশ উল্লেখযোগ্য।
বাংলাদেশের শাসক শ্রেণীর সাফল্য এ ক্ষেত্রে পাকিস্তানিদের তুলনায় অনেক বেশি। শুধু তাই নয়, বলা চলে পাকিস্তানিরা এ ক্ষেত্রে যেভাবে ব্যর্থ হয়েছিল সে রকম কোনো ব্যর্থতা এ ক্ষেত্রে ঘটেনি। উপরন্তু আদর্শগত চিন্তাভাবনা প্রভাবিত ও নিয়ন্ত্রণ করা এবং ইতিহাসকে নিজেদের মতো করে তৈরির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের শাসক শ্রেণীর সাফল্য অভূতপূর্ব!
পূর্ব বাংলা বা পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ পাকিস্তানের জাতিগত নির্যাতনের হাত থেকে নিজেদের রক্ষার জন্য এক গণতান্ত্রিক আন্দোলন করেছিলেন। শিক্ষা, সংস্কৃতি, রাজনীতি ইত্যাদি ক্ষেত্রে তার প্রতিফলন ঘটেছিল নানাভাবে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর নতুন এ রাষ্ট্রে জনগণের সেই জাতীয় প্রতিরোধকে রূপান্তরিত করা হয়েছিল উগ্র জাতীয়তাবাদে।
এ ক্ষেত্রে মনে রাখা দরকার, জাতীয় নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের একটা গণতান্ত্রিক চরিত্র আছে। কিন্তু উগ্র জাতীয়তাবাদ হল পুরোপুরি প্রতিক্রিয়াশীল। অন্যদের ওপর নির্যাতনের মাধ্যমেই এই জাতীয়তাবাদ কার্যকর করা হয়।
এ আদর্শের ভিত্তিতে সবরকম সংখ্যালঘু জাতি ও জাতিসত্তার বিরুদ্ধে শোষণ-নির্যাতন অধিক মাত্রায় ঘটে থাকে। বাংলাদেশে যেভাবে জাতিগত ও ভাষাগত নির্যাতন জারি আছে, তার দিকে তাকালেই এ বিষয়টি স্পষ্ট হবে।
পাকিস্তান ছিল একটি ধর্মীয় রাষ্ট্র। এ জন্য ধর্মীয় উপাদান তারা স্কুল-কলেজের সিলেবাসের মধ্যে ঢুকিয়েছিল। কিন্তু লক্ষ করার বিষয়, বাংলাদেশ সংবিধান অনুযায়ী হল একটি ধর্মবিযুক্ত (Secular) দেশ। তা সত্ত্বেও বর্তমান বাংলাদেশের প্রাথমিক-মাধ্যমিক স্কুল সিলেবাসে এখন ধর্মীয় উপাদান যেভাবে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে সেটা ধর্মীয় রাষ্ট্র পাকিস্তানেও দেখা যায়নি।
এটা যতই বিস্ময়কর ব্যাপার হোক, অস্বীকারের উপায় নেই। এই সিলেবাসের সর্বশেষ অবস্থা যদি পরীক্ষা করা হয় তাহলে এটা বলা একেবারেই সম্ভব নয় যে, এই স্কুল সিলেবাস কোনো ধর্মবিযুক্ত দেশের। এটা এখন আর কোনো গোপন ব্যাপার নয় যে, সিলেবাস বা পাঠ্যক্রমের মধ্যে যেটুকু ধর্মবিযুক্ততা ছিল সে বিষয়ে কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক ধর্মীয় সংগঠন হেফাজতে ইসলামের নেতা মওলানা শফীর প্রকাশ্য আপত্তির কারণে তাদের সন্তুষ্টি বিধানেই পরিবর্তন করা হয়।
এ পরিবর্তনের কারণে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুল সিলেবাস দেখে এখন বোঝার কোনো উপায় নেই যে, বাংলাদেশ একটি ধর্মবিযুক্ত রাষ্ট্র। এ সিলেবাসের দিকে তাকালে এখন মনে হবে, বাংলাদেশ পাকিস্তানের থেকেও কট্টর এক ইসলামি রাষ্ট্র।
এতেও বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই, কারণ সিলেবাসে এ হস্তক্ষেপের অনেক আগেই সাংবিধানিক সংশোধনের মাধ্যমে ঘোষণা করা হয়েছে, বাংলাদেশের রাষ্ট্রধর্ম হল ইসলাম। ইসলাম যদি বাংলাদেশের রাষ্ট্রধর্ম হয় তাহলে এ রাষ্ট্রের শিক্ষাব্যবস্থা যে ইসলামি হবে এটা তো যুক্তিসঙ্গত।
কিন্তু বর্তমান শাসক দলের প্রচার অনুযায়ী, বাংলাদেশ একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রও বটে! অর্থাৎ ধর্মীয় ও ধর্মনিরপেক্ষ এখানে উভয় চরিত্রই পরিগ্রহ করেছে। কাজেই আদর্শগতভাবে শিক্ষাব্যবস্থার এই অবস্থাকে সোনার পাথরবাটি ছাড়া অন্য কিছু বলার উপায় নেই।
ইতিহাসের অবস্থাও এদিক দিয়ে খুব খারাপ। আমাদের সময়ে এবং তার পরেও স্কুলপর্যায়ে মহেঞ্জোদারো-হরপ্পা সভ্যতাসহ প্রাচীন ভারতবর্ষের ইতিহাস পড়ানো হতো, যে ইতিহাস আমাদের ইতিহাসেরও এক অবিচ্ছেদ্য অংশ।
কিন্তু আগের সিলেবাসে প্রাচীন ভারতবর্ষের ইতিহাস থেকে নিয়ে মধ্যযুগে সুলতানি ও মোগল যুগের ইতিহাস, ব্রিটিশ আমলের ইতিহাস পাঠক্রমের অন্তর্ভুক্ত ছিল। কাজেই একজন ছাত্র ম্যাট্রিক বা স্কুল ফাইনাল পরীক্ষায় পাস করলে তার সঙ্গে ভারতবর্ষের ইতিহাসের যেভাবে পরিচয় হতো এখন তার কিছুই নেই।
এখনকার সিলেবাসে এ বিষয়ে অল্প কয়েক পৃষ্ঠায় ছিটেফোঁটা যা থাকে তাতে ভারতবর্ষের ইতিহাস বিষয়ে কোনো ছাত্রেরই কোনো শিক্ষা হয় না। বাংলাদেশের বর্তমান সিলেবাসে ইতিহাসের পাঠ প্রকৃতপক্ষে উচ্ছেদ করা হয়েছে। এখনকার সিলেবাসে এ দেশের ইতিহাসের শুরু ১৯৭১ সালে।
এমনকি পাকিস্তান আমলের ইতিহাস বিষয়েও ছাত্রদের জানার কিছুই থাকে না। ভাষা আন্দোলন এবং একুশে ফেব্রুয়ারি নিয়ে বাংলাদেশে আবেগের ছড়াছড়ি হলেও তার ইতিহাসও ছাত্রদের কাছে প্রায় অজানাই থেকে যায়। তার পরিবর্তে একাত্তর সালের মুক্তিযুদ্ধই হচ্ছে বাংলাদেশের ইতিহাসের প্রায় একমাত্র উপজীব্য। এভাবে ইতিহাস পাঠের ব্যবস্থা সিলেবাসে থাকায় তার মধ্যে চিহ্নিত মিথ্যা ছাড়া আর বিশেষ কিছুই থাকে না।
এ ধরনের ইতিহাসে সত্য ঘটনা ধামাচাপা যেভাবে হয়ে আছে এবং সত্যের পরিবর্তে মিথ্যা যেভাবে পরিবেশিত হচ্ছে, তাকে ইতিহাস হত্যা ছাড়া আর কিছু বলা যায় না। এদিক দিয়ে বলা চলে, শিক্ষা ক্ষেত্রে ইতিহাসই হল বাংলাদেশের সব থেকে বড় শহীদ।
ইতিহাসের সিলেবাসে এভাবে এই শহীদকে প্রকৃতপক্ষে কবর দেয়া হয়েছে। এ ইতিহাসকে বাংলাদেশের শাসক শ্রেণীর ইতিহাসও বলা যায় না। এ হল ক্ষমতাসীনদের একদলীয় ইতিহাস। একটি দেশের ইতিহাস শিক্ষা ক্ষেত্রে এর থেকে বড় ট্র্যাজেডি আর কী হতে পারে?
শিক্ষাব্যবস্থা, বিশেষত এর মধ্যে ধর্মীয় উপাদান এবং দলীয় স্বার্থের প্রচার যেভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, এটা অকারণে হয়নি। ১৯৭২ সাল থেকেই বাংলাদেশ বেশ দ্রুত ব্যবসায়ী বুর্জোয়াদের শাসনের অধীন হয়েছে। আগেকার রাজনীতিবিদরা, রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীরা, যেভাবে রাজনীতি ক্ষেত্রে উপস্থিত থাকতেন, এখন তার পরিবর্তে ব্যবসায়ীরা রাজনীতিবিদদের স্থলাভিষিক্ত হয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা করছেন।
এ পরিস্থিতিতে যে সামান্য কিছু সাবেক রাজনৈতিক ব্যক্তি এখনও টিকে আছেন, তারাও তাদের পূর্ববর্তী রাজনৈতিক চরিত্র বিসর্জন দিয়ে এখন পরিণত হয়েছেন ব্যবসায়ীতে। এ কারণে শুধু শিক্ষাব্যবস্থার যে এ পরিণতি ঘটেছে তা নয়, সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশে শাসকদের আচরণগত সংস্কৃতির মধ্যে সভ্যতা এখন প্রায় বিলুপ্ত হয়েছে। এর ফলে চারদিকে দুর্নীতি, উচ্ছৃঙ্খলতা, মিথ্যা ও অশ্লীলতা সংস্কৃতি ক্ষেত্রে প্রবল আধিপত্য বিস্তার করে আছে।
ওপরতলার এ চরিত্র এখন চুইয়ে চুইয়ে নিচের দিকে নেমে সমগ্র সমাজকে গ্রাস করেছে। এ কারণে সারা দেশে এখন আচরণ ক্ষেত্রে যেভাবে চুরি, দুর্নীতি, মিথ্যা ও অশ্লীলতা বিস্তার লাভ করেছে এর কোনো পূর্ব দৃষ্টান্ত নেই। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর বাহ্যত অনেক দিক দিয়ে উন্নতি দেখা যায়। এখানে সাহিত্য ও শিল্পের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনেকেই প্রসিদ্ধি লাভ করেছেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও আচরণগত সংস্কৃতির ক্রমাগত চরিত্রগত নিুগামিতা এদের চরিত্রের এক চিহ্নিত ও উল্লেখযোগ্য দিক।
১৯৭২ সাল থেকে ব্যবসায়ী বুর্জোয়াদের রাজনৈতিক ক্ষমতা ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে পেতে এখন তারা যেভাবে বাংলাদেশে সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী হয়েছেন, তার থেকে উপরে যা কিছু বলা হয়েছে তাকে বিচ্ছিন্ন করে দেখার কোনো উপায় নেই। কেউ সে চেষ্টা করলে তাকে অবাস্তবই বলতে হবে।
বদরুদ্দীন উমর: সভাপতি, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল
উৎসঃ যুগান্তর
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন