বাংলাদেশে কোনো সুকুমার রায় নেই
28 February 2018, Wednesday
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের জনগণের ওপর পাকিস্তান সরকার ও সেনাবাহিনী যে সর্বাত্মক সশস্ত্র আক্রমণ করেছিল তার মুখে দাঁড়িয়ে এ দেশের মাটিতে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধ পরিচালনার কোনো ক্ষমতা তো নয়ই, চিন্তাও তৎকালীন প্রধান দল আওয়ামী লীগ অথবা তার সঙ্গে সম্পর্কিত ছোটখাটো কোনো দলেরই ছিল না। কাজেই তারা পাকিস্তানের আক্রমণের মুখে দেশ ছেড়ে ভারতে উপস্থিত হয়েছিল। এরপর ভারত যা করেছিল তার জন্য অনেকে ভারতের ওপর দোষারোপ করে থাকেন। কিন্তু এক্ষেত্রে ভারতকে ‘দোষ’ দেয়ার কিছু নেই। মনে রাখা দরকার, ভারত একটি শক্তিশালী পুঁজিবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্র। এখানকার জনগণের ওপর বেপরোয়া, নির্মম ও নৃশংস সামরিক আক্রমণ চালিয়ে পাকিস্তান যে পরিস্থিতি তৈরি করেছিল, সে পরিস্থিতির ব্যবহার ভারত নিজের পুঁজিবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থেই স্বাভাবিকভাবেই করেছিল।
এ প্রসঙ্গে এটা অবশ্যই বলা দরকার যে, ভারত সরকার এভাবে সুযোগের ব্যবহার করলেও ভারতের, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ মানুষ নিঃস্বার্থভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ সমর্থন করেছিলেন এবং এ যুদ্ধে যথাসাধ্য সাহায্য সহযোগিতা করেছিলেন।
এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা দরকার, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে অনেক নিরাপদ দূরত্বে যেসব উচ্চ মাপের আমলা ও বুদ্ধিজীবী ইউরোপ, আমেরিকায় সেখানকার সরকারের ও শাসক শ্রেণীর সমর্থন আদায়ের জন্য তদবির করেছিলেন, তারা পরবর্তীকালে ‘মুক্তিযোদ্ধার’ তকমা বুকে ঝুলিয়ে অনেক পরিচিতি ও সুযোগ-সুবিধা অর্জন করলেও মূল শ্রমিক, মধ্যবিত্ত পরিবারের যে হাজার হাজার যুবক নিঃস্বার্থভাবে যুদ্ধে জীবন দিয়েছিলেন, স্বাধীনতার পর তাদের মূল্যায়ন হয়নি এবং যারা সেই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে অনেক বীরত্বের পরিচয় দিয়েছিলেন তাদের ভূমিকা এখন বিস্মৃতির অন্ধকারে। স্বাধীনতার পর ভারতকে অর্থাৎ ভারত সরকারকে বাংলাদেশের ‘শ্রেষ্ঠ বন্ধু’ হিসেবে আখ্যায়িত করে বন্ধুরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কোনো বক্তব্যকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে ঘোষণা করা হলেও ভারতের থেকে এরপর কোনো বন্ধুসুলভ আচরণ পাওয়া যায়নি। না পাওয়ারই কথা। কারণ ভারত বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করেছিল তার রাষ্ট্রীয় স্বার্থে পূর্ব পাকিস্তানকে পাকিস্তান থেকে বিযুক্ত করতে এবং স্বাধীনতা উত্তরকালে বাংলাদেশকে তাদের ওপর নির্ভরশীল একটি রাষ্ট্রে পরিণত করে ফায়দা হাসিলের উদ্দেশ্যে। সে দুই উদ্দেশ্যই সফল হয়েছে।
বাংলাদেশের ‘বন্ধুরাষ্ট্র’ ভারত ১৯৭২ সাল থেকে আজ পর্যন্ত বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের জনগণকে প্রকৃতপক্ষে কিছুই দেয়নি। উপরন্তু নিজের শক্তির জোরে এবং তাদের ওপর বাংলাদেশের রাজনৈতিক নির্ভরশীলতার কারণে এদেশ থেকে তারা যা চেয়েছে তাই তারা আদায় করতে সক্ষম হয়েছে। তিস্তার পানির মতো অতি প্রয়োজনীয় দাবি সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে এবং নানা ধরনের অজুহাত ও টালবাহানা করে আজ পর্যন্ত তারা পানি টেনে নিজেদের দিকেই রেখেছে এবং বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলকে মরুভূমিতে পরিণত করার শর্ত তৈরি করেছে। বাংলাদেশের ওপর দিয়ে তারা উত্তর-পূর্ব ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেছে। বাংলাদেশের নদীবন্দর তারা ইচ্ছেমতো ব্যবহার করছে। জনগণ এসবের বিরোধিতা করলেও তার কোনো মূল্য সরকারের কাছে নেই। বন্ধুরাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য তাদের কাছে তুলনায় অনেক বেশি মূল্যবান ও গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ এখন সামগ্রিকভাবে যে দুর্যোগের মধ্য দিয়ে চলছে এসব হল তারাই এক খণ্ডচিত্র। কিন্তু খণ্ডচিত্র হলেও এর ফলাফল বাংলাদেশের জন্য ভয়াবহ।
কিন্তু শুধু ভারতই নয়, চীন, রাশিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইত্যাদি সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলোও এখন বাংলাদেশের ওপর নানাভাবে তাদের প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে। অবস্থা দেখে মনে হয়, বাংলাদেশের অবস্থা ‘এসো হে আর্য, এসো অনার্য, এসো হে দ্রাবিড় চীন’-এর মতো। বড় বড় প্রকল্পের জন্য ঋণ নেয়া হচ্ছে উন্নয়নের নামে। এসব দেখিয়ে বাংলাদেশের উন্নয়নের কথা বলে ঢেঁড়ি পেটাচ্ছে সরকার। কিন্তু এই প্রকল্পগুলোর দ্বারা উন্নয়ন যাই হোক, এগুলো যে একেকটি চুরি-দুর্নীতির বড় বড় আখড়া এতে সন্দেহ নেই। এজন্য প্রতিটি বড় প্রকল্পের যে ব্যয় নির্ধারণ করা হয় সেটা দফায় দফায় বৃদ্ধি করা হয়। দুই, তিন, এমনকি চারগুণ পর্যন্ত। পদ্মা সেতু নিয়ে সরকার ঢাকঢোল পেটাতে ব্যস্ত। ইতিমধ্যে এ সেতুর নির্মাণ ব্যয় দু’বার বৃদ্ধি করা হয়েছে। এখন এই বৃদ্ধি তৃতীয়বার হওয়ার পথে!! সব আন্তর্জাতিক সমীক্ষা অনুযায়ী উড়াল সেতু থেকে নিয়ে প্রতিটি প্রকল্পে বাংলাদেশে ব্যয়ের পরিমাণ নেপাল, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তানের থেকে দুই-তিনগুণ করে বেশি! ব্যয়ের এই আধিক্য যে চুরি-দুর্নীতির ব্যারোমিটার এতে আর সন্দেহ কী?
এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে ‘সংসদীয় গণতন্ত্রের জয়যাত্রা’ অব্যাহত আছে। বাংলাদেশ সরকার ‘সুষ্ঠু’ ও ‘নিরপেক্ষ’ নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশন ও পুলিশকে ‘গণতন্ত্রের বন্ধু’ হিসেবে ব্যবহার করছে। সব বিরোধী দলের সভা-সমাবেশ-মিছিল এবং অন্যায়ভাবে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা কঠোরভাবে দমন করছে। বিরোধী দলের বিভিন্ন অংশের লোকের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করছে, বেপরোয়াভাবে মানুষকে গ্রেফতার করে জেলে আটক করছে। আদালতের রায়ে অনেকে দোষী সাব্যস্ত হয়ে কারাগারে নিক্ষিপ্ত হচ্ছেন। এ পরিস্থিতিতে সরকারের মুখপাত্ররা বলছেন, এসবই আদালত করছে। তাদের কোনো হাত নেই!! আদালতের রায়ের প্রতি তারা শ্রদ্ধাশীল!! তবে দেখা যাচ্ছে, আদালতের রায় যখন তাদের স্বার্থের পক্ষে তখন তারা আদালতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। যখন আদালতের রায় তাদের পক্ষে অসুবিধাজনক, তাদের স্বার্থের পক্ষে ক্ষতিকর, তখন তারা আর আদালতের রায়ের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নয়। এটা না হলে দেশের প্রধান বিচারপতিকে শেষ পর্যন্ত পদত্যাগে বাধ্য করতেন না।
এসব দিকে তাকিয়ে মনে হয়, দেশে এখন এদের ওপর কবিতা বা ছড়া লেখার জন্য সুকুমার রায়ের মতো একজন প্রতিভাশালী কবির প্রয়োজন ছিল। কিন্তু হায়, বাংলাদেশ। এখানে কোনো সুকুমার রায় নেই।
বদরুদ্দীন উমর : সভাপতি, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল
উৎসঃ যুগান্তর
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন