বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় বৈষম্য পশ্চাৎপদতা ও নৈরাজ্য
08 January 2018, Monday
নন-এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা বিগত ২৬ ডিসেম্বর থেকে যে ধর্মঘট শুরু করেছিলেন এবং পরে আমরণ অনশন ধর্মঘটে গিয়েছিলেন, তারা প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক তাদের দাবি পূরণের আশ্বাস পেয়ে ধর্মঘট প্রত্যাহার করেছেন। এভাবে ধর্মঘট, আমরণ অনশন এবং সরকারি আশ্বাস পেয়ে ধর্মঘট প্রত্যাহারের ঘটনা কোনো নতুন ব্যাপার নয়। উপরন্তু দশকের পর দশক ধরে এ ধরনের ধর্মঘট ও ধর্মঘট প্রত্যাহার এবং তারপর আশ্বাস পূরণে সরকারের পিছিয়ে যাওয়ার ঘটনা এক অতি পরিচিত ব্যাপার। কাজেই এবার প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাসের পরিণতি কী হয় সেটা দেখার ব্যাপার। তবে মনে হয় এখন সরকার কর্তৃক কিছুসংখ্যক শিক্ষককে এমপিওভুক্ত করার একটা সম্ভাবনা আছে, যদিও নিশ্চিতভাবে কিছুই বলা যায় না। এমপিওভুক্ত স্কুল শিক্ষকরা মাত্র কয়েকদিন আগে তাদের বেতন প্রধান শিক্ষকের তিন ধাপ নিচের পরিবর্তে এক ধাপ নিচে করার দাবিতে যে আমরণ অনশন ধর্মঘট করেছিলেন সে ধর্মঘট সরকারি আশ্বাসের পর শিক্ষকরা প্রত্যাহার করেছেন এবং এখন পর্যন্ত এ নিয়ে সরকারের কোনো কথাই আর শোনা যাচ্ছে না। অবস্থা দেখে মনে হয়, ধর্মঘটি শিক্ষকদের আশ্বাস দেয়ার পর তাদের সঙ্গে প্রতারণাই করা হবে।
শিক্ষকদের বেতনের পরিমাণকে সমগ্র শিক্ষাব্যবস্থা থেকে বিচ্ছিন্নভাবে দেখা এক অবাস্তব চিন্তা। প্রথমত, তারা যে বেতন পান তাতে তাদের জীবনযাত্রার মান খুব নিচেই থাকে। এমনকি যে প্রধান শিক্ষকদের বেতনের এক ধাপ নিচে সহকারী শিক্ষকরা নিজেদের বেতন বৃদ্ধির দাবি করেছেন সেই প্রধান শিক্ষকদের বেতন পর্যন্ত বেশি নয়। বাংলাদেশে শিক্ষাব্যবস্থা যে অবস্থায় আছে তাতে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষকদের বেতন তাদেরকে দারিদ্র্যের মধ্যেই ফেলে রাখে। এ নিয়ে বিতর্কের কোনো অবকাশ নেই।
সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশে শিক্ষাব্যবস্থার দিকে তাকালে এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ থাকে না যে, সুচিন্তিত শিক্ষাব্যবস্থা বলে এখানে কিছু নেই। সরকারি বাজেটে শিক্ষা খাতে যে মোট বরাদ্দ থাকে তার দ্বারা যে শিক্ষাব্যবস্থার কোনো প্রকৃত উন্নতি সম্ভব নয়, এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা শিক্ষাব্যবস্থার উন্নতির জন্য বর্তমান সরকার ও তাদের শিক্ষামন্ত্রী ঢাকঢোল পিটিয়ে অনেক পরিবর্তন এনেছেন। কিন্তু এসবের দ্বারা শিক্ষাব্যবস্থার কোনো উন্নতি তো হয়ইনি, উপরন্তু ব্যাপকভাবে এ ব্যবস্থার মধ্যে বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্য সৃষ্টি হয়েছে। এর একটা বড় উদাহরণ হল, শিক্ষামন্ত্রীর দ্বারা ‘সৃজনশীল প্রশ্ন’ নামে এক উদ্ভট প্রশ্ন পদ্ধতির প্রচলন। শিক্ষা ক্ষেত্রে নানা ধরনের নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলার মধ্যে যেখানে শিক্ষাব্যবস্থায় সৃজনশীলতা বলে কিছু নেই, উপরন্তু তার প্রতিবন্ধক অনেক কিছু পাঠ্যক্রম বা সিলেবাস থেকে নিয়ে সর্বত্র জারি আছে, সেখানে পরীক্ষায় ‘সৃজনশীল’ প্রশ্নের বিষয়টি যে এক উদ্ভট, হাস্যকর ও নিস্ফল চেষ্টা, এটা ইতিমধ্যে প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু এই তথাকথিত সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতির পক্ষে দাঁড়িয়ে এবং তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে সরকারসমর্থক উচ্চমার্গের শিক্ষক, লেখক ও বুদ্ধিজীবীরা তাদের লেখালেখি দিয়ে সংবাদপত্রের পাতা ভরিয়ে দিয়েছেন। সরকারের খেদমতগার এসব শিক্ষক ও বুদ্ধিজীবীরা যে দেশের শিক্ষাব্যবস্থার মান উন্নত করতে এবং শিক্ষাব্যবস্থাকে বিজ্ঞানসম্মত ও প্রগতিশীল করার ক্ষেত্রে কোনো প্রকার অবদান রাখারই যোগ্য নন, এটা তাদের এসব বক্তব্য ও কার্যকলাপের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে।
বাংলাদেশে স্কুলগুলোয় যে পাঠ্যক্রম চালু করা হয়েছে তাতে একজন শিক্ষার্থী এই পাঠ্যক্রম অনুযায়ী লেখাপড়া করে খুব ভালো ফল করলেও এর দ্বারা সে কোনো প্রকৃত শিক্ষা লাভ করে এমন নয়। এটা হতে পারে না। কারণ এই পাঠ্যক্রমে যে পশ্চাৎপদ চিন্তাধারা ঢোকানো হয়েছে এবং ইতিহাসের নামে মিথ্যা প্রচারের ব্যবস্থা আছে, তাতে এই শিক্ষা লাভ করে ছাত্রদের চিত্তের বিকাশ হওয়া সম্ভব নয়। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা দরকার, সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয় স্কুলের পাঠ্যক্রমে নিজেরাই অনেক পশ্চাৎপদ ও প্রতিক্রিয়াশীল বিষয় রাখলেও তার মধ্যেও ধর্মবিরোধী আখ্যা দিয়ে অনেক কিছু পরিবর্তনের জন্য হেফাজতে ইসলামের নেতা মওলানা শফী যে আপত্তি জানিয়েছিলেন এবং যেসব পরিবর্তনের দাবি জানিয়েছিলেন, সেগুলোর প্রায় সবই মেনে নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় পাঠ্যক্রম পরিবর্তন করেছে! ধর্মবিযুক্ত রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে প্রচার করলেও হেফাজতে ইসলামের দাবির কাছে এই নতিস্বীকার নতুন করে প্রমাণ করেছে যে, বাংলাদেশে শিক্ষা বিষয়ে কোনো প্রগতিশীল চিন্তাধারাই নেই; পাঠ্যক্রম পশ্চাৎপদ ও প্রতিক্রিয়াশীল উপাদানে ভরপুর। এ ব্যবস্থায় ছাত্ররা প্রচলিত পাঠ্যক্রম অনুযায়ী যে কোনো প্রকৃত সৃজনশীল ও প্রগতিশীল শিক্ষা লাভ করতে পারে না, এটা বলাই বাহুল্য।
পাঠ্যক্রমের এই দুরবস্থা কোনো অবহেলার বিষয় নয়। কারণ পাঠ্যক্রমের এ অবস্থা হলে ভালো শিক্ষকদেরও এ ক্ষেত্রে করার কিছুই থাকে না। কাজেই এ পরিস্থিতিতে স্কুল পাঠ্যক্রম নিয়ে দেশে ব্যাপকভাবে আলোচনা ও বিতর্ক হওয়া একান্ত আবশ্যক। কিন্তু বাংলাদেশের শিক্ষক, লেখক, বুদ্ধিজীবীদের এ নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই। কারণ তাদের মধ্যে যারা নানা বিষয়ে সোচ্চার থাকেন এবং সংবাদপত্রে লেখালেখি করেন, তারা সরকারসমর্থক ও সরকারি ঘরানার লোক। এদের মধ্যে যারা কিছুটা সাবধানী তারা এসব বিষয়ে আলোচনা থেকে বিরত হয়ে নিজেদের গা বাঁচিয়ে চলাকেই শ্রেয় মনে করেন!
এ প্রসঙ্গে স্কুল শিক্ষকদের ভূমিকার বিষয়েও কিছু বলা দরকার। শিক্ষক হিসেবে এদের যোগ্যতা অনেকেরই নেই উপযুক্ত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের অভাবে। কিন্তু এর থেকে গুরুত্বপূর্ণ কথা হল, নিজেদের বেতন ছাড়া শিক্ষা বিষয়ে তাদের কোনো চিন্তাভাবনা নেই। যে পাঠ্যক্রম অনুযায়ী তারা ছাত্রদের পাঠদান করেন তার মধ্যে যে পশ্চাৎপদতা, মিথ্যা ইত্যাদি থাকে সেগুলো লক্ষ করার যোগ্যতা অধিকাংশ শিক্ষকের নেই এবং যাদের সে যোগ্যতা সামান্য হলেও আছে, তারা এ নিয়ে কোনো ঝামেলায় জড়াতে চান না। অর্থাৎ তারা সুবিধাবাদী। শুধু পাঠ্যক্রমই নয়, স্কুলের প্রয়োজনীয় উপকরণ নিয়েও তাদের কোনো সমিতিই কিছু বলে না। কোনো দাবি তারা করে না। এ ক্ষেত্রে ছাত্রদের সঙ্গে নিয়ে সরকারের কাছে কোনো দাবি উত্থাপন তাদের চিন্তার বাইরে। কাজেই স্কুলের বাড়িঘর, বসার বেঞ্চ, ব্ল্যাকবোর্ড ইত্যাদির বেহাল দশা অধিকাংশ স্কুলের থাকলেও তার কোনো উন্নতি হয় না। পত্রিকায়ই সচিত্র রিপোর্টে দেখা যায় অনেক স্কুলে শিক্ষকরা গাছতলায় বসে ক্লাস নিচ্ছেন। এসব সমস্যা নিয়ে ছাত্র-শিক্ষকদের মিলিত আন্দোলন এবং সরকারের কাছে দাবি-দাওয়া উত্থাপন কোনো স্কুলশিক্ষক সমিতির ক্ষেত্রে দেখা যায় না। তারা চিন্তা করতেই পারে না যে, এগুলো নিয়েও আন্দোলন করা তাদের কর্তব্য। আন্দোলন বলতে তারা শুধু বোঝে নিজেদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধির আন্দোলন! বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই যে, এ অবস্থায় যোগ্য শিক্ষকের অভাব, শিক্ষা উপকরণের অভাব এবং সাধারণভাবে অবহেলিত হওয়ার কারণে গ্রামাঞ্চলের অধিকাংশ স্কুলেই পরীক্ষার ফলও ভালো হয় না। কোনো কোনো স্কুলে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় শতভাগ ছাত্রই ফেল করে। যেসব সরকারসমর্থক ও সরকারি ঘরানার উচ্চমার্গের শিক্ষক ‘সৃজনশীল’ প্রশ্ন পদ্ধতি নিয়ে মাতামাতি করেন, তারাও এসব বিষয়ে লেখালেখির ধারেকাছে থাকেন না। কাজেই বাংলাদেশের বিদ্যমান শিক্ষাব্যবস্থায় গ্রামাঞ্চলের স্কুলগুলোয় গরিবের শিক্ষার কোনো উন্নতি হয় না। শহরের স্কুলগুলোর ছাত্ররা তুলনায় অনেক ভালো করে সমাজে সব ক্ষেত্রেই এগিয়ে থাকে। এর মূল কারণ যে শিক্ষা ক্ষেত্রে শ্রেণীগত বৈষম্য, এটা এক বড় সত্য। অবশ্য এই বৈষম্যকেও বিচ্ছিন্নভাবে দেখা ঠিক নয়। সারা দেশে শাসক শ্রেণী সর্বক্ষেত্রে যে শ্রেণীবৈষম্য জারি রেখে শাসন কাজ পরিচালনা করে, তার থেকে শিক্ষা ক্ষেত্রে এ বৈষম্যকে স্বতন্ত্রভাবে দেখা বা বিচার করা এক মহা আহাম্মকি ছাড়া কিছু নয়।
বদরুদ্দীন উমর : সভাপতি, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল
উৎসঃ যুগান্তর
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন