ভারতের আগামী নির্বাচনে গরুর ভূমিকা
20 December 2017, Wednesday
ভারতের গুজরাট রাজ্য নির্বাচনের ফলাফল আজ ১৮ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশিত হওয়ার কথা। সব রকম জরিপের মাধ্যমে ইতিমধ্যে যা দেখা গেছে, তাতে কংগ্রেস আগের থেকে তাদের অবস্থার কিছুটা উন্নতি করতে পারলেও বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয়লাভ করে বিজেপির ক্ষমতায় আসা এক রকম নিশ্চিত। তবে এই জয়লাভ সত্ত্বেও গুজরাটে যে বিজেপির অবস্থা আর আগের মতো নেই- এটা বিজেপির নেতৃত্ব, বিশেষ করে নরেন্দ্র মোদি বেশ ভালোভাবেই উপলব্ধি করেছেন। এ জন্য তিনি এই নির্বাচনের সময় আদাজল খেয়ে গুজরাটে পড়ে থেকে সরাসরি নির্বাচনী প্রচারে অক্লান্তভাবে অসংখ্য জনসভায় বক্তৃতা করে বেড়িয়েছেন। কারণ গুজরাট নির্বাচনে যদি বিজেপি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাহলে ভারতের আগামী নির্বাচনের ওপর তার বড় রকম প্রভাব যে পড়বে- এতে কোনো সন্দেহ তাদেরও নেই। কিন্তু গুজরাট নির্বাচনে বিজেপির জয় হলেও তাদের অবস্থা যে আগের মতো নেই- এই নির্বাচনে বিজেপির উদ্বেগের মধ্যে সেটাই দেখা যায়। তবে তার অর্থ এই নয় যে, আগামী সাধারণ নির্বাচনে বিজেপি পরাজিত হয়ে কংগ্রেস ক্ষমতাসীন হবে- এমন কথা জোর দিয়ে বলা যায়। কারণ বিগত নির্বাচনের সময় আরএসএস ও বিজেপি ভারতের জনগণকে যেভাবে বিশাল আকারে চরম সাম্প্রদায়িকতার স্রোতে ভাসিয়ে দিয়েছে, তার প্রভাব থেকে আগামী নির্বাচন মুক্ত থাকবে- এ চিন্তা অবাস্তব। এদিক দিয়ে বিজেপি সরকার তার শত অপকীর্তি সত্ত্বেও রাজনৈতিকভাবে এখনও শক্ত অবস্থানে আছে।
কিন্তু কংগ্রেসের তুলনায় শক্ত অবস্থানে থাকলেও বিজেপি ৫০০ এবং ১০০০ রুপির নোট হঠাৎ প্রত্যাহার করার ফলে অর্থনৈতিকভাবে জনগণ, বিশেষ করে কৃষক এবং ছোট ব্যবসায়ীরা যেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সেটা বিজেপিকেও বড় রকম ধাক্কা দিয়েছে। মূলত কালো টাকার বিরুদ্ধে সংগ্রাম এবং কালো টাকা বিদেশ থেকে ফিরিয়ে আনার নাম করে এই সিদ্ধান্ত গ্রহণের কথা বলা হলেও, এ ক্ষেত্রে পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি। কালো টাকার রাজত্ব আগের মতোই আছে এবং বিদেশি ব্যাংক থেকে কালো টাকা দেশে ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে সরকার সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছে। এই সিদ্ধান্তের ফলে কৃষক, ছোট ব্যবসায়ী ও গরিবরা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া এবং অর্থনীতিতে কালো টাকার শাসন খতম তো দূরের কথা, তার প্রভাব কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে ব্যর্থতা বিজেপির রাজনৈতিক অবস্থানকে ধাক্কা দিয়েছে। এ ছাড়া নরেন্দ্র মোদি এড়ড়ফং ধহফ ঝধষবং ঞধী (এঝঞ) চালু করে নিজের ক্ষতির পাল্লা আরও ভারী করেছেন। এই সিদ্ধান্তের কারণেও ভারতের ধনিক শ্রেণিই নয়, ছোট ব্যবসায়ী ও জনগণের বিভিন্ন অংশও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিজেপি সরকারের জনপ্রিয়তা হ্রাসের ক্ষেত্রে এই সিদ্ধান্তের ভূমিকাও উপেক্ষার মতো নয়।
কিন্তু এই দুই অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত রাজনৈতিকভাবে বিজেপিকে যতই ক্ষতিগ্রস্ত করুক, আগামী নির্বাচনে বিজেপি পরাজিত হওয়ার মতো বড় ক্ষতির সম্মুখীন হয়নি। এসব সত্ত্বেও এখন পর্যন্ত বিজেপির জনপ্রিয়তা যথেষ্ট। কাজেই আগামী নির্বাচনে এর জন্য বিজেপির পরাজিত হওয়ার আশঙ্কা নেই। বিজেপি পরাজিত হতে পারে একমাত্র সে কারণেই, যে কারণে তারা বিগত নির্বাচনে জয়লাভ করেছিল অর্থাৎ সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটলে। সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে জনমত যদি ঘোরে একমাত্র তাহলেই বিজেপির পরাজয় হতে পারে, অন্যথায় নয়। কিন্তু এ বিষয়ে সন্দেহ নেই যে, কংগ্রেস বা অন্য রাজ্যগুলোর স্থানীয় দলগুলো রাজনৈতিক প্রচারণার মাধ্যমে সাম্প্রদায়িকতার প্রভাব খর্ব করার মতো অবস্থায় আছে। কংগ্রেস যতই অসাম্প্রদায়িকতার আওয়াজ তুলে রাজনীতির মোড় ঘোরাতে চেষ্টা করুক, তার দ্বারা ভারতের বর্তমান পরিস্থিতিতে এই লক্ষ্য অর্জন সম্ভব নয়।
কিন্তু রাজনৈতিকভাবে কংগ্রেস অসাম্প্রদায়িকতার বিরোধিতা করতে নেমে বিজেপিকে পরাজিত করার কোনো সম্ভাবনা না থাকলেও আগামী নির্বাচনে বিজেপির পরাজিত হওয়ার সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দেওয়ার নয়। কংগ্রেস যে কাজ করতে অক্ষম, সে কাজ গরু কর্তৃক সম্পন্ন করার সম্ভাবনা ভারতে এখন দেখা যাচ্ছে। অর্থাৎ বিজেপির গোরক্ষা নীতিই ভারতে বিজেপিকে নির্বাচনে পরাজিত করার সম্ভাবনা তৈরি করেছে। তাদের এই গোরক্ষা নীতির অর্থনৈতিক ফলাফলের কোনো চিন্তা তারা একেবারেই করেনি। বলা চলে, তাদের সাম্প্রদায়িকতা এবং ধর্মীয় উন্মাদনা তাদের চিন্তাকে এমন ঘোলাটে করেছিল, যাতে এ বিষয়ে চিন্তার কোনো অবকাশ তাদের থাকেনি।
ভারতে গোরক্ষার দাবি দীর্ঘদিন থেকে শুধু আরএসএস ও তাদের সংঘ পরিবারের রাজনৈতিক দলগুলোই করে আসছে, এমন নয়। কংগ্রেসের মধ্যেও গোরক্ষার দাবি জানিয়ে এসেছিলেন, তাদের একটা অংশ যার নেতৃত্বে ছিলেন ভারতের প্রথম প্রেসিডেন্ট রাজেন্দ্রপ্রসাদ। কংগ্রেসের একজন শীর্ষস্থানীয় নেতা হলেও রাজেন্দ্রপ্রসাদ ছিলেন কংগ্রেসের মধ্যে আরএসএস ঘরানার লোক। সাম্প্রদায়িক ব্যক্তি হিসেবে তিনি ছিলেন সর্দার প্যাটেলের থেকেও নিকৃষ্ট। এ কারণে ভারত স্বাধীন হওয়ার আগেই তিনি গান্ধী ও নেহরুর কাছে দাবি করেছিলেন স্বাধীন ভারতে গোহত্যা বন্ধের। কিন্তু তাদের দু'জনেই রাজেন্দ্রপ্রসাদের এই দাবিকে পাত্তা না দিয়ে বাতিল করেছিলেন। রাজেন্দ্রপ্রসাদ ভারতের সংবিধানেও গোরক্ষা নীতি অন্তর্ভুক্ত করার পক্ষপাতী ছিলেন। কিন্তু ভারতের সংবিধানেও তার কোনো ব্যবস্থা নেই। এদিক দিয়ে বলা চলে, বিজেপি এখন গোরক্ষা নীতির নামে যা করছে, তা ভারতীয় সংবিধানেরও বিরোধী। তা সত্ত্বেও সংবিধানকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে নরেন্দ্র মোদি ও বিজেপি রাজেন্দ্রপ্রসাদের মতো কংগ্রেস সাম্প্রদায়িকতাবাদীদের দাবি কার্যকর করতে নিযুক্ত হয়েছে।
যাই হোক, নির্বাচনের ক্ষেত্রে গরুর ভূমিকায় ফিরে এসে এ কথা বলা যায় যে, রাজনৈতিকভাবে কংগ্রেস বা অন্যান্য দল অসাম্প্রদায়িকতার আওয়াজ তুলে যে সাফল্য অর্জন করার ধারেকাছে নেই, সে কাজ ভারতে গরুর দ্বারা সম্পন্ন হওয়ার মতো পরিস্থিতি দ্রুত তৈরি হচ্ছে।
ভারতের বিজেপি সরকার গোরক্ষা নীতি কার্যকর করতে গিয়ে বিদেশে গরুর মাংস রফতানি বাণিজ্য, চামড়া শিল্প, জুতা শিল্প ইত্যাদিকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। এমনকি এ জন্য তারা অস্ট্রেলিয়া থেকে গরুর চামড়া পর্যন্ত আমদানি করছে, যদিও তারা ভারতে গোহত্যার বিরোধী। তাদের এই অবস্থা দেখে মনে হয়, শুধু ভারতের গোরক্ষাই তাদের ধর্মীয় আদর্শ এবং সাম্প্রদায়িক লক্ষ্য! বিদেশি গরু হত্যার পর তার চামড়া দেশে আমদানি করে চামড়া শিল্প রক্ষার চেষ্টা থেকে এটাই দেখা যাচ্ছে।
আগেই বলেছি, গোরক্ষা নীতির ফলে গোহত্যা বন্ধ বা গরু বাংলাদেশ এবং অন্যত্র রফতানি বন্ধ করার নীতির ফলে অকেজো গাই, বলদ ইত্যাদির কী অবস্থা হচ্ছে এ নিয়ে নরেন্দ্র মোদি বা তাদের বিজেপি সাম্প্রদায়িকতাবাদীরা কোনো চিন্তা না করলেও এখন এ সমস্যা বেশ ভালোভাবেই মাথাচাড়া দিয়েছে। ব্রিটিশ আমল থেকে কিছু ধনী সাম্প্রদায়িকতাবাদী টাকা-পয়সা দিয়ে বৃন্দাবন, মথুরা ইত্যাদিতে অনেক গরুর খোঁয়াড় করেছিল, যেখানে অকেজো অতিরিক্ত গরু পালন করা হতো। এখনও এ ধরনের গোশালা বা গরুর খোঁয়াড়ে হাজার হাজার গরুও পালন করা হয়। কিন্তু যে সংখ্যক গাই গরু ও বলদ আর দুধ দিতে পারে না এবং ক্ষেতে কাজ করতে পার না, সেগুলোর সংখ্যা শুধু লাখ লাখ নয়; প্রত্যেক বছর এই অতিরিক্ত গরুর সংখ্যা বেড়ে অল্পদিনের মধ্যে দাঁড়াবে কোটি কোটি। এই গরুগুলো বিক্রি করে কৃষকরা যে টাকা পেতেন তার থেকে বঞ্চিত হয়ে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। কিন্তু তার থেকেও বড় কথা, এই উদ্বৃত্ত গরু খাইয়ে রাখার ক্ষমতা তো গরিব কৃষকের নেই। এ অবস্থায় তারা ইতিমধ্যে এই অকেজো উদ্বৃত্ত গরু ছেড়ে দিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দিচ্ছেন। এভাবে বের করে দেওয়া গরু এখন নিজেদের জীবন রক্ষার জন্য ফসলের ক্ষেতে, উৎপাদনশীল গরুর চারণক্ষেত্রে পড়ে ফসল নষ্ট এবং অন্য গরুদের খাদ্যে ভাগ বসাচ্ছে। এর ফলে এর বিরুদ্ধে কৃষকদের মধ্যে ক্ষোভ সৃষ্টি হচ্ছে। তারা এই 'স্বাধীন' গরুগুলোকে পিটিয়ে ফসলের ক্ষেত ও চারণভূমি থেকে তাড়িয়ে দিচ্ছেন। অনেক জায়গায় এর ফলে গরুর পালের সঙ্গে কৃষকদের সংঘর্ষ হচ্ছে। এই পরিস্থিতির ওপর ভারতের পত্রপত্রিকাতেও এখন রিপোর্ট প্রকাশিত হচ্ছে।
কিন্তু এখানেই শেষ নয়। এভাবে ছেড়ে দেওয়া 'স্বাধীন' গরুর সংখ্যা দ্রুতগতিতে বাড়ছে। উত্তর ভারতের উত্তর প্রদেশ, হরিয়ানা, রাজস্থান, মহারাষ্ট্র, মধ্যপ্রদেশ ইত্যাদি রাজ্যে ইতিমধ্যে 'স্বাধীন' গরুরা অর্থনীতির ক্ষেত্রে এবং নিরাপত্তার দিক দিয়ে কৃষকদের কাছে হুমকিতে পরিণত হচ্ছে। এভাবে বাড়তে থাকা গরুর পাল রক্ষার কোনো নীতি বা কর্মসূচি বিজেপির নেই। এ কারণে বিজেপি সাম্প্রদায়িকতার ঢেউ তুলে এসব অঞ্চলের যে কৃষকদের থেকে ভোট পেয়েছিল, তারাই এখন বিজেপির সাম্প্রদায়িক গোরক্ষা নীতির বিরোধিতায় নামছে। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের মধ্যে আছেন দলিত ও গরিব হিন্দু কৃষক। তারা এমন বিপুল সংখ্যায় যেভাবে গরুকে স্বাধীন করে দিচ্ছেন, তাতে বিজেপির গোরক্ষা নীতির কারণে তাদের নিজেদের আগামী নির্বাচনে রক্ষার ক্ষেত্রে যে সংকট তৈরি হচ্ছে, সেটা দ্রুত রাজনৈতিক সংকটে রূপ নিতে বাধ্য। তাদের মুদ্রানীতি, জিএসটি নীতি ইত্যাদি সামাল দেওয়ার সাধ্য বিজেপির থাকলেও নিজেদের গোরক্ষা নীতি সামাল দেওয়ার কোনো ক্ষমতাই তাদের নেই। কোটি কোটি গরুই হয়ে দাঁড়াবে বিজেপির রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ! কাজেই 'বিজেপিকে বধিবে যে গোকুলে বাড়িছে সে!' এই পরিস্থিতিতে কংগ্রেস আজ তার অসাম্প্রদায়িকতার আওয়াজ তুলে যা করতে অক্ষম, গরুর দ্বারাই তা হওয়ার সম্ভাবনা এখন ষোলোআনা।
সভাপতি, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল
উৎসঃ সমকাল
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন