প্রজেক্ট জিন্দাবাদ
30 October 2017, Monday
বাংলাদেশকে মধ্য আয়ের দেশ হিসেবে উন্নত করার কথা সরকারি ও শাসক শ্রেণীর বিভিন্ন মহল থেকে শোনা যাচ্ছে। এ নিয়ে এরা যে গৌরব-কীর্তন করছেন তার থেকে মনে হয়, এভাবে যে লক্ষ্য তারা নির্ধারণ করেছেন তা ইতিমধ্যেই অর্জিত হয়ে গেছে! এখানে বলা দরকার যে, এ দেশ যদি কিছুদিন পর মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হয়, তাহলেও এ নিয়ে গর্ব করার কিছু নেই। কারণ ‘মধ্য আয়ের দেশ’-এর ‘মর্যাদা’ লাভ করলেও জনগণের তাতে কোনো লাভ নেই। মধ্য আয়ের দেশ হিসেবে মাথাপিছু গড়পড়তা আয় যা দাঁড়াবে, তার মানে সাধারণ শ্রমজীবীদের আয় বৃদ্ধি নয়। এই ‘উন্নতি’ ঘটবে এদেশে চোর-দুর্নীতিবাজদের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং তাদের হাতে লুণ্ঠিত অর্থসম্পদ বর্ধিত আকারে জমা হওয়ার কারণেই।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর এদেশের যে অনেক ‘উন্নতি’ হয়েছে এতে কোনো সন্দেহ নেই। পাকিস্তান আমলে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে কোটিপতির সংখ্যা চার-পাঁচজনের বেশি ছিল না। কিন্তু এখন হাজার হাজার কোটি টাকার মালিকের সংখ্যা কম নয় এবং এ সংখ্যা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। ১৯৭২ সাল থেকেই বাংলাদেশে ব্যাপক আকারে লুটপাট, ঘুষ-দুর্নীতি এবং চোরাচালান ইত্যাদির মাধ্যমে সরকারি ক্ষমতায় থাকা ও তাদের সঙ্গে সম্পর্কিত লোকজনের হাতে ধনসম্পদ জমা হতে থাকে। এরপর অল্পদিনের মধ্যেই ব্যবসায়ীদের মধ্যে রাজনৈতিক ক্ষমতা অর্জনের প্রক্রিয়া শুরু হয়।
এ শ্রেণীটিই এখন বাংলাদেশের শাসক শ্রেণী হিসেবে আবির্ভূত হয়ে প্রভূত ক্ষমতার অধিকারী হয়েছে। বাংলাদেশকে ‘মধ্য আয়’-এর দেশে উন্নীত করার জন্য এরাই সব থেকে বেশি সচেষ্ট, কারণ এই ‘উন্নতির’ ফায়দা তারা ছাড়া আর কেউ পাবে না।
বাংলাদেশের কৃষক ও শ্রমিকের মতো এত পরিশ্রমী এবং উৎপাদনে যত্নশীল কম দেশেই দেখা যায়। বাংলাদেশের কৃষি ও যা কিছু শিল্প আছে, সে ক্ষেত্রের উন্নতির প্রকৃত নায়ক এ কৃষক-শ্রমিকরা। কিন্তু সরকার ও শাসক শ্রেণীর লোকেরা এদের এ অর্জনকে কোনো মূল্য না দিয়ে প্রচার করে থাকে যে, বাংলাদেশের বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্যই এখানে উন্নতি হচ্ছে। অর্থাৎ পুঁজিবাদী ও লুটপাটকারীরা এ ‘উন্নতির’ মূল চালিকাশক্তি!! এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। কারণ তাদের এ প্রচারণা তাদের শোষণ-লুণ্ঠন প্রক্রিয়া মসৃণ রাখার জন্যই প্রয়োজন। শ্রমিকরা তাদের শ্রমের উপযুক্ত পাওনার ধারেকাছেও কিছু পান না। সরকারি ও বেসরকারি মালিকানাধীন কলকারখানাতে যে শ্রমিকরা কাজ করেন তাদের শ্রমশক্তির মূল্য এদেশে দুনিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় সব থেকে কম। উৎপাদনে শ্রমিকদের তাদের অবদানের জন্য উপযুক্ত প্রশংসা করলে তার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে তাদের মজুরিও উপযুক্ত করতে হবে। কিন্তু বাংলাদেশে তো তা সম্ভব নয়। কৃষকরা উৎপাদন ক্ষেত্রে যে অবদান রাখেন তার উপযুক্ত মূল্যায়ন করলে তো তাদের উৎপাদিত ফসলের ন্যায্য দাম নিশ্চিত করতে হবে, তার জন্য সমবায় ব্যবস্থা ইত্যাদি কার্যকরভাবে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এ কাজ করলে তো মধ্যস্বত্বভোগী ফড়িয়াদের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ ও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ব্যবসায়ীদের দ্বারা পরিচালিত এ রাষ্ট্র ও সরকার সে কাজ তো করতে পারে না। কাজেই কৃষকরা এ উন্নতির ভাগ পান না। এ কারণে বাংলাদেশ মধ্য আয়ের দেশে উন্নীত হলেও কৃষকদের তাতে কোনো লাভ নেই, যেমন লাভ নেই শ্রমিকদের।
কৃষকদের থেকে শ্রমিকদের অবস্থা আরও খারাপ। কারণ কৃষকরা যা উৎপাদন করেন তার উপযুক্ত মূল্য তারা না পেলেও, ফসলের মূল্য তারা নিজেরা কিছুটা বাড়াতে পারেন। কিন্তু শ্রমিকদের মজুরি তো এভাবে বৃদ্ধি করা যায় না। শ্রমিকের মজুরি সামান্য বৃদ্ধির জন্যও অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়। অনেক আন্দোলন করতে হয়। অনেক সময় এর জন্য তাদের মুখোমুখি হতে হয় সরকারি পুলিশ ও মালিকদের গুণ্ডাবাহিনীর। শ্রমিকরা বাংলাদেশে যে মজুরি পান তার দ্বারা মধ্যবিত্ত জীবনযাপন সম্ভব নয়। চিকিৎসা, সন্তানদের শিক্ষা ইত্যাদি এ মজুরিতে চলে না বললেই হয়। তার ওপর এখন জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধি যেভাবে হচ্ছে তাতে সপরিবারে একজন শ্রমিকের খাওয়া-দাওয়া করে বেঁচে থাকাও মুশকিল। মাছ-গোশতের তো কথাই নেই। শাকসবজির দামও যে পর্যায়ে উঠেছে তাতে নুনভাত খেয়ে তারা প্রাণ বাঁচানোর চেষ্টা করছেন। এ অবস্থায় নিজেদের কর্মশক্তি টিকিয়ে রাখাও তাদের পক্ষে সংকটময় ব্যাপার। এর ফলে তারা যে সপরিবারে পুষ্টির অভাবে থাকবেন এটা তো বলাই বাহুল্য। নির্দিষ্ট আয়ের মধ্যবিত্তের অবস্থাও একেবারে সঙ্গিন।
দেশের কৃষক-শ্রমিক-নিম্ন মধ্যবিত্তকে এ অবস্থায় ফেলে রেখে দেশে নানা ধরনের প্রজেক্টে লাখ লাখ কোটি টাকা খরচের ব্যবস্থা আছে এবং আরও হচ্ছে। দেশের লোকের দিকে তাকানোর কোনো আগ্রহ সরকারের না থাকলেও এভাবে প্রজেক্ট তৈরি করে বেহিসাব খরচের কোনো কমতি এখানে নেই। বেশ ফুর্তির সঙ্গে সরকার এসব প্রজেক্টের জন্য বিদেশ থেকে উচ্চ সুদে ঋণের ব্যবস্থা করে। কোনো প্রজেক্টই সময়মতো শেষ হয় না। এবং যত দেরি হয় ততই প্রজেক্টের প্রাথমিকভাবে হিসাবকৃত ব্যয় বাড়তেই থাকে। অনেক সময় তা বেড়ে তিন-চারগুণও হয়!! এর কারণ সরকারি প্রজেক্ট মানেই চুরি-দুর্নীতি। এক একটা প্রজেক্টের জন্য যা ব্যয় হয়, অনেক সময় তার সমতুল্য অর্থ চোর-দুর্নীতিবাজদের পকেট ভর্তি করে।
এ ধরনের ছোট-বড় বিশাল প্রজেক্টের অভাব নেই। পদ্মা সেতু নিয়ে সরকারের গর্বের শেষ নেই। কিন্তু এ পদ্মা সেতুর ব্যয়ও প্রাথমিকভাবে ধার্য ব্যয়ের থেকে অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। পদ্মা ব্রিজে চুরি-দুর্নীতির অবস্থা যাই হোক, এর প্রয়োজন আছে। কিন্তু এখন অনেক প্রজেক্ট সরকার গ্রহণ করছে যা বাংলাদেশের জন্য এ মুহূর্তে সম্পূর্ণ নিষ্প্রয়োজন। উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যায় ঢাকা-আশুলিয়া এক্সপ্রেসওয়ে। এ এক্সপ্রেসওয়ের প্রয়োজন হতে পারে, কিন্তু এর দ্বারা কাদের প্রয়োজন মিটবে? এ প্রয়োজন মেটানো তো ঢাকা বা বাংলাদেশের জন্য এ মুহূর্তে জরুরি ব্যাপার নয়। এছাড়া ঢাকা-চট্টগ্রাম এক্সপ্রেসওয়ে তৈরির যে পরিকল্পনা হয়েছে, তাতে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম দেড় ঘণ্টায় যাওয়া যাবে। ভালো কথা। কিন্তু এ ধরনের দ্রুতগতির ট্রেন চীন-জাপানের প্রয়োজন, শিল্পোন্নত দেশ হিসেবে। কিন্তু বাংলাদেশের পশ্চাৎপদ অর্থনৈতিক অবস্থায় এর যে বিন্দুমাত্র কোনো প্রয়োজন নেই এটা যে কোনো সৎ ও সুবুদ্ধিসম্পন্ন লোকই স্বীকার করবে। এজন্য ব্যয় হবে হাজার হাজার কোটি টাকা, আসলে লাখ লাখ কোটি টাকা। এ ধরনের প্রজেক্ট যে কত তৈরি হচ্ছে তার হিসাব নেই।
এ প্রজেক্টগুলোর কথা এভাবে এখানে উল্লেখ করা দরকার এ কারণে যে, এর মাধ্যমে বাংলাদেশের বর্তমান শাসক শ্রেণী ও তার সরকারের অগ্রাধিকারের বিষয়টি স্পষ্টভাবে বোঝা যায়। এ কথা কারও অজানা নেই যে, বাংলাদেশের গরিবদের, এমনকি মধ্যবিত্তের এক বিশাল অংশেরও চিকিৎসার কোনো সুব্যবস্থা নেই। গ্রামাঞ্চলে অর্থাৎ কৃষক অধ্যুষিত অঞ্চলে এ অবস্থা খুব খারাপ। শ্রমিকদের অবস্থাও একই রকম। কয়েকদিন আগে প্রকাশিত একটি রিপোর্ট থেকে দেখা যায়, বাংলাদেশের ৭০টি জেলের হাজার হাজার বন্দির জন্য চিকিৎসক আছেন মাত্র ৬ জন। এ অবস্থা তো কল্পনা করাও কঠিন। কিন্তু যা সাধারণভাবে কল্পনা করা কঠিন, সেই অবস্থাই এখন বাংলাদেশের এক বাস্তব চিত্র। জেলখানায় আটক গরিবদের কোনো চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই, তারা যত কঠিন রোগেই আক্রান্ত হন। গ্রাম ও শহর অঞ্চলেও গরিবদের চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই, যদিও বড়লোকের চিকিৎসার অনেক উন্নতি হয়েছে ঢাকায়। যে লাখ লাখ কোটি টাকা সরকার বিভিন্ন নিষ্প্রয়োজনীয় প্রজেক্টে ব্যয় করছে, সেটা এভাবে ব্যয় না করে বহু মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল সারা দেশে করা যেত। ঢাকা এবং মফস্বলের বিভিন্ন শহরে অনেক ছোট-বড় হাসপাতাল ও চিকিৎসাকেন্দ্র স্থাপন করা যেত। গ্রামাঞ্চলে গরিবদের শিক্ষার উন্নতির জন্য স্কুলের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং সেখানে উপযুক্ত শিক্ষা প্রদানের ব্যবস্থা করা যেত। এছাড়া আরও অনেক কল্যাণকর কাজে অর্থ ব্যয় করা যেত, যা জনগণের জন্য প্রয়োজন। কিন্তু এটা বাংলাদেশে সম্ভব নয়। কারণ বাংলাদেশের সরকারের কাছে এসবের কোনো অগ্রাধিকার নেই। জনগণের কোনো উপকার ও লাভের বিষয় এদের চিন্তায় নেই। এদের চিন্তা শুধু কিভাবে চুরি দুর্নীতির মাধ্যমে দেশের সম্পদ লুটপাট করা যায়। দেশের সম্পদ লুটপাট করে কিভাবে মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া থেকে নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তা চালান করে সেখানে সম্পদ বানানো যায়। কাজেই জনগণ জিন্দাবাদ না। এদের নীতি হল, বাংলাদেশকে মধ্য আয়ের দেশে পরিণত করার লক্ষ্যে প্রজেক্টের পর প্রজেক্ট জিন্দাবাদ!
বদরুদ্দীন উমর : সভাপতি, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল
উৎসঃ যুগান্তর
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন