ষোড়শ সংশোধনী বাতিল রায়ের ‘পর্যালোচনা’ প্রসঙ্গে
24 October 2017, Tuesday
বাংলাদেশের মতো পশ্চাৎপদ ও অনুন্নত দেশে সাধারণ মানুষের পক্ষে তাদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের আদালত থেকে সুবিচার পাওয়া যে সহজ নয় এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যে তারা সে বিচার পান না এটা সবারই জানা। প্রথমত, বিচার প্রক্রিয়ার মধ্যে থেকে একজন ব্যক্তিকে যে খরচের পাল্লায় পড়তে হয় সে খরচ মেটানো গরিব মানুষের পক্ষে সম্ভব হয় না। তাছাড়া এ গরিবদের মধ্যে লেখাপড়ার অভাব থাকায় তাদের পক্ষে এক্ষেত্রে করণীয় ঠিক করাও হয়ে ওঠে না। কাজেই দেশে যে পরিমাণ অপরাধ সংঘটিত হয় সেগুলোর একটা বড় অংশ আদালত চত্বরের বাইরেই থেকে যায়।
বাংলাদেশের সংবিধানে আইন, প্রশাসন ও বিচার বিভাগের ক্ষমতার পৃথকীকরণের ব্যবস্থা আছে। কিন্তু সেটা থাকলেও এ পৃথকীকরণ কার্যত দেখা যায় না। ১৯৭২ সাল থেকেই জাতীয় সংসদে সরকারি দলের একচ্ছত্র অবস্থানের কারণে আইন ও প্রশাসন বিভাগ পরস্পরের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত ছিল। সেই অবস্থায় সরকারের নির্দেশ শিরোধার্য করে আদালতকেও কাজ করতে হতো। এ পরিস্থিতি এক চরম পর্যায়ে উপনীত হয় ১৯৭৫ সালে আওয়ামী লীগ সরকার সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী পাস করার পর।
এ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে জনগণকে যতটুকু গণতান্ত্রিক অধিকার ডান হাতে দেয়া হয়েছিল, তা বাঁ হাতে কেড়ে নেয়া হয়েছিল। সরকারবিরোধী সব রাজনৈতিক কার্যকলাপ নিষিদ্ধ, সরকারি দল ছাড়া সব বিরোধী দল বেআইনি ও বিলুপ্ত ঘোষণা, সরকারি চারটি পত্রিকা ছাড়া সব দৈনিক, সাপ্তাহিক, মাসিক, ত্রৈমাসিক পত্রপত্রিকা নিষিদ্ধ করে এবং তার বিরুদ্ধে আদালতের কোনো পদক্ষেপ নিষিদ্ধ করে দেশে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়েছিল তাতে রাষ্ট্রে ক্ষমতার পৃথকীকরণ বলে আর কিছু থাকেনি।
সরকারি নির্যাতনের বিরুদ্ধে আদালত থেকে কোনো প্রতিকারের সম্ভাবনা ছিল চিন্তার বাইরে। বস্তুতপক্ষে একটি নির্বাচিত সরকার দেশের জনগণের সামান্যতম অধিকার ও ব্যক্তিস্বাধীনতা যেভাবে হরণ করেছিল সেটা যে কোনো চরম ফ্যাসিস্ট সামরিক সরকারের থেকেও ছিল বেশি নির্যাতনমূলক। ১৯৭১ সালে ইয়াহিয়ার নয় মাস যুদ্ধকালীন শাসন ছাড়া পাকিস্তানে অন্য কোনো সময়ে এর তুল্য নির্যাতন কখনও থাকেনি। কাজেই স্বাধীন বাংলাদেশে জনগণের জীবনে এ নির্যাতন অনেকের কাছেই মনে হয়েছিল খুব বিস্ময়কর।
আওয়ামী-বাকশালি শাসন অবসানের পর এদিক দিয়ে জিয়াউর রহমান ও এরশাদের সামরিক শাসনের আমলে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও প্রশাসন, আইন ও বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ সবসময়েই ছিল একটি কাগুজে ব্যাপার। আসলে প্রশাসনের চাপ রোধ করে কর্তব্য কাজ করা হাইকোর্টের পক্ষে প্রায় অসম্ভব ছিল। এক্ষেত্রে সামান্য ব্যতিক্রম যাই থাকুক।
বর্তমানে আদালত ও সরকারের মধ্যে যে সাংঘর্ষিক পরিস্থিতি প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের পর দেখা দিয়েছে, সে কথায় আসার আগে ওপরে এত কথা বলতে হল এজন্য যে, স্বাধীন বাংলাদেশে সরকার কর্তৃক আদালতের ওপর হামলা করে ক্ষমতার পৃথকীকরণের সংসদীয় ব্যবস্থাকে বুড়ো আঙুল দেখানোর বিষয়টি নতুন কিছু নয়। ১৯৭২ সাল থেকেই যে কোনো সরকার এ কাজ অল্পবিস্তর মাত্রায় করে এসেছে এবং এর বিরুদ্ধে জনগণ কোনো আন্দোলন করেননি।
তবে এ প্রসঙ্গে এটাও বলা দরকার, সুপ্রিমকোর্ট কর্তৃক ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের পর দেশে যে পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে, আদালতের বিরুদ্ধে অর্থাৎ মূলত বিচার বিভাগের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে সরকার যেভাবে প্রকাশ্য বিরোধিতা ও আক্রমণ করেছে, এর কোনো পূর্ব উদাহরণ নেই। এর ফলে দেশের সংবিধানে, নামমাত্র হলেও, বিচার বিভাগের স্বাধীনতার যে ব্যবস্থা আছে তাকে কার্যত উড়িয়ে দেয়ার ব্যবস্থাই হচ্ছে।
সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতিদের আচরণ বিচার করার অধিকার, এমনকি তাদের শাস্তি দেয়ার অধিকার জাতীয় সংসদকে দেয়ার উদ্দেশ্যেই সরকার জাতীয় সংসদে ষোড়শ সংশোধনী পাস করেছে। এর সরল অর্থ জাতীয় সংসদ নিজের হাতে এ ক্ষমতা নিয়ে আসা ও রাখার উদ্দেশ্যেই এ সংশোধনী পাস করেছে। যেহেতু এ সংশোধনী আদালতের অধিকার ও ক্ষমতা হরণ করার উদ্দেশ্যেই হয়েছে এজন্য আদালত নিজের অবস্থান ও সেই সঙ্গে বিচারব্যবস্থার স্বাধীনতা রক্ষার জন্য এ সংশোধনী বাতিল করেছেন।
এ কাজ করতে গিয়ে সংবিধানে তাদের দেয়া অধিকার তারা লঙ্ঘন করেছেন, এটা বলা যাবে না। সংবিধানের কাঠামোর মধ্যে থেকেই তারা এ কাজ করেছেন। কিন্তু এর দ্বারা সরকার ও তাদের দ্বারা সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রিত জাতীয় সংসদ বিচার বিভাগের ওপর তাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করার ক্ষমতা হারানোর কারণে উভয়েই প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে অদ্ভুতভাবে ক্ষিপ্ত হয়েছে।
হতে পারে, প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতিদের রায়ে ত্রুটি আছে। সে ত্রুটি থাকলে তার মীমাংসার পদ্ধতিও সংবিধানে নির্দিষ্ট আছে। কিন্তু তার ধারেকাছে না গিয়ে রায় প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে সরকার, সরকারের লোকরা, তাদের অনুগত বুদ্ধিজীবীরা যেভাবে প্রধান বিচারপতিকে প্রকাশ্যে গালাগাল করেছেন, তা অনেক ক্ষেত্রে অশ্লীলতার পর্যায়েও দাঁড়িয়েছে।
স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে আদালত ও প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে এ ধরনের যে কোনো কথা আদালত অবমাননারই শামিল। কিন্তু যেভাবে ব্যাপক আকারে সরকার ও সরকারের শীর্ষ নেতানেত্রীরা প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করেছেন ও করে চলেছেন তাতে শীর্ষ আদালত কর্তৃক তাদের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগের সম্ভাবনার কথাও এক হাস্যকর ব্যাপার। এদিক থেকে দেখলে বাংলাদেশে এখন আদালত অবমাননা বলে আর কিছুই নেই!
আদালতের ছুটির মধ্যেই এসব শুরু হয়েছিল। ছুটিতে প্রধান বিচারপতি দেশের বাইরে গিয়েছিলেন। কিন্তু সরকারি মহল থেকে বলা শুরু হয়েছিল, ছুটি শেষ হলে তার কাজে যোগদানের সম্ভাবনা ক্ষীণ। সুপ্রিমকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত এক বিচারপতি শামসুদ্দীন মানিক, যিনি আওয়ামী লীগের ঘোর সমর্থক বলেই পরিচিত, এক বিবৃতি দিয়ে বলেন, সুরেন্দ্র কুমার সিনহাকে ছুটির পর তার কাজে যোগদান করতে কিছুতেই দেয়া যায় না। এছাড়া তিনি প্রধান বিচারপতি সম্পর্কে যেসব কটূক্তি করেন তা-ও আদালত অবমাননার শামিল।
এ কাজ যে তিনি সরকারি লোক হিসেবেই করেছিলেন এতে সন্দেহ নেই। যাই হোক, প্রধান বিচারপতি বিদেশ থেকে ফেরার পর সরকারি লোকজন যা বলেছিল তা-ই হল। তার সরকারি বাসায় প্রভাবশালী সরকারি লোকরা দৃষ্টিকটুভাবে বারবার যাওয়া-আসা শুরু করলেন এবং প্রধান বিচারপতি স্বাস্থ্যগত কারণে এক মাসের ছুটি নিতে বাধ্য হলেন! তার বিদেশ যাওয়ার কথা হল। তিনি শেষ পর্যন্ত বিদেশে গেলেনও।
তবে যাওয়ার আগে এক প্রেস বিবৃতি দিয়ে বললেন, তিনি অসুস্থ নন এবং ছুটি শেষে ফিরে এসে তিনি তার কাজে যোগদান করবেন। কিন্তু ছুটি শেষে দেশে ফেরার পর তিনি তার কাজে যোগদান করবেন এটা এখন কেউই মনে করেন না। আজকের (২১.১০.১৭) পত্রপত্রিকায় পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ লোকরা বলছেন, দেশে ফিরে তার কাজে যোগ দেয়ার সম্ভাবনা সুদূরপরাহত। এটাই হল বাস্তব অবস্থা।
প্রধান বিচারপতি ও আদালতের ওপর এই আক্রমণ জনগণের জন্য এক উদ্বেগের ব্যাপার। কারণ এসবের মাধ্যমে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ বলে এরপর কিছু থাকবে মনে করার কারণ নেই। লক্ষ্য করার বিষয়, প্রধান বিচারপতি সুপ্রিমকোর্টের যে পাঁচজন বিচারপতিসহ সর্বসম্মতিক্রমে ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় দিয়েছেন তারা পাঁচজনই এখন বলছেন, প্রধান বিচারপতির সঙ্গে একত্রে কোনো বেঞ্চে তারা আর বসবেন না!! ইতিমধ্যেই যেসব ঘটনা ঘটেছে তাতে আদালতের আর কোনো মর্যাদা আছে বলে মানুষ মনে করছে না।
আরও লক্ষ্য করার বিষয়, পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে দুর্নীতি ইত্যাদির অভিযোগ এনে সরকার তার বিরুদ্ধে মামলার তোড়জোড় করছে! প্রধান বিচারপতি সরকারের মনোনীত হয়েই শীর্ষ বিচারকের পদে অধিষ্ঠিত হয়ে তার প্রায় পুরো মেয়াদের কাজ সম্পন্ন করেছেন। এখন এমনিতেই ৩০ জানুয়ারি তার অবসরগ্রহণের কথা। কাজেই এতদিন তার ‘দুর্নীতি’ বিষয়ে কোনো কিছু বলা হয়নি, শোনা যায়নি। তাকে প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেয়ার আগেও তার ‘দুর্নীতির’ কথা কেউ বলেনি। কিন্তু ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় দেয়ার পর তিনি কী করে ‘দুর্নীতির’ দায়ে অভিযুক্ত হলেন, এটাও সাধারণ বুদ্ধির লোকের পক্ষে বোঝা মুশকিল।
বদরুদ্দীন উমর : সভাপতি, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল
উৎসঃ যুগান্তর
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন