নির্যাতিত কোনো জাতির সমস্যা সমাধান জাতিসংঘের কাজ নয়
24 September 2017, Sunday
‘জোর যার মুল্লুক তার’ এই নীতির ওপর দাঁড়িয়েই জাতিসংঘ নামক আন্তর্জাতিক সংস্থাটি তার জন্মের পর থেকেই কাজ করে আসছে। আজ পর্যন্ত তা-ই চলছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ‘লীগ অব নেশনস’ও তা-ই ছিল। পরে বিশ্ব দুই বৈরী শিবিরে বিভক্ত হয়ে যুদ্ধে লিপ্ত হলে সংস্থাটি বিলুপ্ত হয়। একই উদ্দেশ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর প্রতিষ্ঠা করা হয় ‘জাতিসংঘ’। যারা ‘লীগ অব নেশনস’ প্রতিষ্ঠা করেছিল, তারাই একই উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠা করেছিল ‘জাতিসংঘ’। বাইরের অনেক ধানাইপানাই কথা সত্ত্বেও এর মূল উদ্দেশ্য ছিল বিশ্বে শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বিবাদ-বিসংবাদ মিটমাট করা এবং তাদের স্বার্থের দিকে তাকিয়েই সব সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও কার্যকর করা।
বাস্তবত জাতিসংঘ সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলোর স্বার্থেই কাজ করে এবং তারা নিজেদের স্বার্থ অনুযায়ী পরস্পরের সঙ্গে বিবাদ ও সংঘর্ষের মীমাংসা করে। তারা এই আন্তর্জাতিক সংস্থাটির মাধ্যমেই বিশ্বের দুর্বল, পশ্চাৎপদ ও অনগ্রসর দেশগুলোর জনগণের ওপর বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রের আধিপত্য, শোষণ-শাসন ও নিয়ন্ত্রণ সৃষ্টি এবং তা বজায় রাখার জন্য কাজ করে। এভাবে কাজ করতে গিয়ে তারা কোনো সুনির্দিষ্ট নীতির দ্বারা পরিচালিত হয় না, যদিও জাতিসংঘের নীতির অভাব নেই। প্রত্যেকেই নিজের নিজের স্বার্থে জাতিসংঘকে ব্যবহার করে এবং এভাবে কাজ করতে গিয়ে জাতিসংঘের অবমাননা থেকে নিয়ে জাতিসংঘকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করা পর্যন্ত কিছুই বাদ রাখে না। জাতিসংঘের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে এর ভূরি ভূরি উদাহরণ পাওয়া যাবে।
বর্তমানে বার্মায় (মিয়ানমার) সামরিক বাহিনী রোহিঙ্গাদের ওপর যে সর্বাত্মক সশস্ত্র হামলা চালিয়ে হাজার হাজার রোহিঙ্গাকে হত্যা করছে, তাদের ঘরবাড়িতে আগুন দিচ্ছে, রোহিঙ্গা নারীদের ধর্ষণ করছে এবং লাখ লাখ রোহিঙ্গাকে তাদের দেশ থেকে তাড়িয়ে বাংলাদেশে শরণার্থী হিসেবে আসতে বাধ্য করছে, এ বিষয়ে রাশিয়া এক সরকারি বিবৃতিতে বলেছে, এটা বার্মার অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। কাজেই মানবিক কারণে তারা রোহিঙ্গাদের জন্য বাংলাদেশে কিছু সাহায্য পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিলেও বার্মায় কোনো ধরনের হস্তক্ষেপের অথবা তাদের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপের বিরোধী! ভালো কথা। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যখন ইরাকে গণবিরোধী অস্ত্র রাখার মিথ্যা অভিযোগে ইরাকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে সে দেশটি দখল করেছিল, তখন তারা কোথায় ছিলেন? যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইরাকের মতো একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিশাল সামরিক আক্রমণ চালাচ্ছিল, সে সময় তাদের ‘অভ্যন্তরীণ তত্ত্ব’ কোথায় ছিল? কেন তারা এর বিরুদ্ধে নিরাপত্তা পরিষদের অধিবেশন ডেকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের ক্রিমিনাল আগ্রাসনের বিরুদ্ধে কোনো হস্তক্ষেপ করা তো দূরের কথা, প্রতিবাদ পর্যন্ত করেননি? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র লিবিয়ার মতো একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রের ওপর বিমান আক্রমণ পরিচালনার জন্য নিরাপত্তা পরিষদে প্রস্তাব পাস করার সময় তারা (রাশিয়া) ও চীন কেন ভেটো প্রদান করে তা বন্ধ করেনি? এটা তো কারও অজানা নয় যে, সেই মার্কিন সামরিক আক্রমণ সম্ভব করার জন্য রাশিয়া ও চীন সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিল। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট সারকোজির সরকারের সঙ্গে এদিক দিয়ে রাশিয়া ও চীন সরকারের নীতির কোনো পার্থক্যই বাস্তবত ছিল না। সিরিয়ায় রাশিয়ার সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ খুব গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় তারা সিরিয়ার ওপর মার্কিন বিমান হামলা হতে দেয়নি। তাদের এই সিদ্ধান্ত সিরিয়ার জনগণের স্বার্থে ছিল না। ভূমধ্যসাগরে সিরিয়ার উপকূলে তাদের সামরিক নৌঘাঁটির স্বার্থসহ অন্য স্বার্থের কারণেই তারা ইরাক ও লিবিয়ার মতো সিরিয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক হামলা হতে দেয়নি।
লক্ষ করার বিষয়, জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল থেকে নিয়ে সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর প্রতিনিধিরা বার্মার সামরিক বাহিনীর গণহত্যা এবং রোহিঙ্গা বিতাড়ন নিয়ে অনেক বক্তৃতা-বিবৃতি দিলেও এবং নিরাপত্তা পরিষদে এর বিরুদ্ধে নিন্দা প্রস্তাব গৃহীত হলেও বার্মায় সরকার ও সামরিক বাহিনীর ফ্যাসিস্ট কার্যকলাপের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থাই তারা গ্রহণ করেনি! শুধু তাই নয়, এ নিয়ে তারা কোনো আলোচনা পর্যন্ত করেনি!! কাজেই এ বিষয়ে তাদের বক্তৃতা-বিবৃতি তথাকথিত নৈতিক নিন্দাবাদ ছাড়া আর কিছুই নয়। কিন্তু নৈতিক নিন্দাবাদ দিয়ে যে গণহত্যা এবং কোনো জাতি বা ধর্মীয় গোষ্ঠীর ওপর ফ্যাসিস্টদের আক্রমণ ঠেকানো সম্ভব নয়, এটা বলাই বাহুল্য। কাজেই জাতিসংঘ থেকে নিয়ে সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর নিন্দাবাদ কুম্ভীরাশ্রু ছাড়া আর কিছুই নয়। এ পরিস্থিতিতে বার্মায় সরকার ও সামরিক বাহিনী রাখাইনে গণহত্যা অপ্রতিহতভাবে চালিয়ে যাচ্ছে। বিশ্ব শক্তিগুলোর নিষ্ক্রিয়তা তাদের রোহিঙ্গা নিধনযজ্ঞেও ভালোভাবেই শক্তির জোগান দিচ্ছে।
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশন বছরে একবার অনুষ্ঠিত হয়, যেমন এটা অনুষ্ঠিত হচ্ছে এই মুহূর্তে। কিন্তু এই অধিবেশন একটা রুটিন ব্যাপার ছাড়া আর কিছুই নয়। এতে উপস্থিত হয়ে বিভিন্ন সদস্য রাষ্ট্রের প্রতিনিধিরা বক্তৃতা করেন। সাম্রাজ্যবাদের দ্বারা নির্যাতিত কোনো কোনো রাষ্ট্রের প্রতিনিধিরা সাম্রাজ্যবাদের শোষণ-নিপীড়নের বিরুদ্ধে জোর বক্তৃতা দেন। কিন্তু এসব বক্তৃতার দ্বারা আজ পর্যন্ত কোনো গুরুতর বৈশ্বিক সমস্যার সমাধান হতে দেখা যায়নি। উপরন্তু শেষ পর্যন্ত প্রত্যেক ক্ষেত্রে সাম্রাজ্যবাদীরাই নিজেদের স্বার্থ উদ্ধার করে। এর জন্য আছে তাদের দ্বারা সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রিত জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ। জাতিসংঘের জন্মলগ্ন থেকেই দুনিয়ার সব থেকে শক্তিধর পাঁচটি দেশ- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্স, রাশিয়া ও চীন ‘নিরাপত্তা পরিষদের’ স্থায়ী সদস্য। অন্য দেশগুলোর নির্দিষ্ট কয়েকজন প্রতিনিধি এতে ধারাবাহিকভাবে অস্থায়ী সদস্য হিসেবে থাকেন। কিন্তু তাদের কোনো প্রকৃত ভূমিকা নিরাপত্তা পরিষদে নেই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সোভিয়েত ইউনিয়নকে বাদ দিয়ে নিরাপত্তা পরিষদের গঠন সম্ভব ছিল না। কাজেই সোভিয়েত ইউনিয়ন তার সদস্য ছিল। চীন কোনো শক্তিশালী দেশ না হলেও ছিল বিশাল এক দেশ। তাছাড়া তারা তখন ছিল সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গেই গাঁটছড়ায় বাঁধা। সাম্রাজ্যবাদীদের নির্ধারিত নীতি ও সিদ্ধান্তের বাইরে যাওয়ার কোনো ক্ষমতাই তাদের ছিল না।
কিন্তু নিরাপত্তা পরিষদে শুধু যে সাম্রাজ্যবাদীদের স্থায়ী সদস্যপদ আছে তাই নয়। পাঁচজন স্থায়ী সদস্যের যে কোনো একজন কোনো প্রস্তাবে ভেটো দিলে সে প্রস্তাব নাকচ ও অকার্যকর হয়ে থাকে। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক ইরাক আক্রমণের সময় দেখা গেছে, তারা বিষয়টি অগ্রাহ্য করেই গায়ের জোরে সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে নিরাপত্তা পরিষদের কোনো সম্মতি ছাড়াই ইরাকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে দেশটি দখল করেছিল। এর থেকেই প্রমাণিত হয়, সাম্রাজ্যবাদীরা জাতিসংঘ ও নিরাপত্তা পরিষদকে শুধু নিজেদের মধ্যকার বিবাদ-বিসংবাদ মীমাংসার জন্যই ব্যবহার করে না, তারা জাতিসংঘকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে একতরফাভাবে নিজেদের সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ উদ্ধারও করে থাকে। বার্মায় এখন যে পরিস্থিতি দেখা যাচ্ছে তাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন, ভারতসহ বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্র নিজেদের ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ থেকে নিয়ে বাণিজ্য স্বার্থ, তেল-গ্যাস স্বার্থ ইত্যাদির কারণে বার্মা সরকারের ও তাদের সামরিক বাহিনীর পেছনেই শক্তির জোগান দিচ্ছে। কাজেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এবং জনগণের বিভিন্ন অংশ থেকে এর বিরুদ্ধে যে নিন্দাবাদ ও প্রতিরোধ হচ্ছে, তা গ্রাহ্য করার প্রয়োজন বর্তমান বার্মা সরকারের নেই।
বদরুদ্দীন উমর : সভাপতি, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল
উৎসঃ যুগান্তর
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন