তারিখটা ১৯৮৮ সালের খুবসম্ভবত ২৭ জানুয়ারি। বিবিসিতে নিজের অফিস থেকে স্টুডিওতে যাওয়ার সময় হয়েছে। হঠাৎ টেলিফোন বাজল। আওয়ামী লীগ নেতা তোফায়েল আহমেদ চাটগাঁ থেকে ফোন করেছেন। বললেন, সিরাজ ভাই, আমি তোফায়েল। নেত্রী আপনার সাথে...। তার কথা শেষ হলো না। টেলিফোন ছিনিয়ে নিলেন শেখ হাসিনা। আমি সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কেমন আছেন শেখ হাসিনা? তিনি তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলেন। বললেন, কেমন থাকব! আমাকে হত্যা করার জন্য গুলি করেছে। আমি উদ্বিগ্ন হলাম। বললাম, গুলি আপনার গায়ে লাগেনি তো? তিনি বললেন, না, লাগেনি; তবে গুলি আমার গাড়ির কয়েক গজ দূর দিয়ে চলে গেছে। আমি জানতে চাইলাম, গুলি কে চালাল। তিনি বললেন, কে আবার? এরশাদ ছাড়া আর কে? আমি বললাম, এরশাদ কেমন ঘাতক পাঠাল আপনাকে হত্যা করতে, যার গুলি গাড়ির কয়েক গজ দূর দিয়ে চলে যায়?
শেখ হাসিনা চটে গেলেন আমার ওপর। বললেন, আমার কোনো কথা আপনার বিশ্বাস হয় না! এই বলে টেলিফোন তিনি তোফায়েল সাহেবের হাতে ছেড়ে দিলেন। তার কাছ থেকে জানতে পারলাম, আওয়ামী লীগের মিছিল যাচ্ছিল লালদীঘি ময়দানের কাছে। পুলিশ সেখানে গুলি চালিয়েছে এবং প্রায় ১৫ জন মারা গেছে। এর পর আমি চাটগাঁয় আমার নিজস্ব দুই ‘সোর্স’কে টেলিফোন করে জানলাম, পুলিশ গুলি চালিয়েছে ঠিকই, কয়েকজন লোক মারাও গেছে, তবে শেখ হাসিনা সেখানে ছিলেন না। তিনি চট্টগ্রাম বার কাউন্সিলের সভায় বক্তৃতা করছিলেন।
প্রতিবাদে শেখ হাসিনা ৩০ জানুয়ারি ঢাকায় শহীদ মিনারে সমাবেশ ডাকেন। সেদিন স্টুডিওতে যাওয়ার আগে ঢাকায় বিবিসির সংবাদদাতা আতাউস সামাদকে ফোন করে খবর জেনে নিতে চাইলাম। সামাদ তো হেসে কুটিপাটি। বললেন, শেখ হাসিনা সমাবেশে আসেননি, এসেছিলেন খালেদা জিয়া এবং তিনি হাসিনার হাজার চল্লিশেক সমর্থক নিয়ে মিছিলে বেরিয়েছেন। আমি শেখ হাসিনাকে ফোন করলাম। জানতে চাইলাম তিনি কেন সমাবেশ ডেকে সেখানে যাননি। কয়েক মুহূর্ত নীরব থেকে তিনি বললেন, আমি গোপন সূত্রে খবর পেয়েছিলাম যে পুলিশ সমাবেশে গুলি চালাবে।... পুরনো পাঠকদের মনে থাকার কথা, সে সময় খালেদা জিয়া সামরিক স্বৈরতন্ত্রের পতনের সংগ্রাম করছিলেন, আর শেখ হাসিনা সকালে আন্দোলনে আর বিকেলে এরশাদের পক্ষে থাকতেন।
তারপর থেকে শেখ হাসিনা কতবার দাবি করেছেন যে, তাকে হত্যার ষড়যন্ত্র হয়েছে সে হিসাব কে রাখে? আর ‘নাটক‘ ও ‘চমক‘ কথা দুটো কতশত বার তিনি উচ্চারণ করেছেন তারও হিসাব সম্ভব নয়। আসলে হত্যার ঘটনা অজস্রবার ঘটিয়েছে তার পুলিশ, তার র্যাব আর তার আদরের দুলাল ছাত্রলীগ ও যুবলীগ। বাংলাদেশের ঘরে ঘরে খুন হওয়া, গুম হওয়া, বিনা বিচারে আটকে থাকা রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীর জন্য শোকের অ্যাটম বোমা তৈরি হচ্ছে। নারায়ণগঞ্জে ভাড়াখাটা র্যাবের ৭+৪ খুনের মামলায় জনৈক কর্নেল জিয়ার নামও উচ্চারিত হয়েছিল। সেই কর্নেল জিয়াই এখন রায় দেন যে, সিটি নির্বাচনে শান্তি ও নিরপেক্ষতা বজায় রাখার জন্য সেনা মোতায়েনের প্রয়োজন নেই।
আর নাটক? সিটি নির্বাচনের প্রচারে তিনবারের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ১৯ এপ্রিল রোববার গাড়িবহর নিয়ে বেরিয়েছিলেন। বহু সাংবাদিক, ভিডিওচিত্রী ও মোবাইলধারী দেখল লাঠিসোটা ও ইটপাটকেল নিয়ে মুখচেনা এবং শনাক্ত করার উপযোগী লোকেরা খালেদার গাড়িবহরে আক্রমণ চালাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী বললেন, খালেদা জিয়া মাঠে নেমে নাটক করছেন। সরেজমিনে উপস্থিত পুলিশ কর্মকর্তা বললেন, ‘আপনারা যেভাবে একটা পরিস্থিতি দেখেন আমরা সেভাবে দেখি না।’ পরের দিন সোমবার আবার খালেদার গাড়িবহরে হামলা হলো। এবার গুলি ছোড়া হলো গাড়ির ওপর। বুলেটপ্রুফ জানালায় ফাটল হলো। বিএনপির বহু নেতাকর্মী আহত হলেন। প্রধানমন্ত্রী বললেন, খালেদা জিয়ার নিরাপত্তাবাহিনী গুলি চালিয়েছে তার গাড়িবহরের ওপর। আর স্থানীয় এক আওয়ামী লীগ নেতা এক শ’ জন বিএনপি নেতাকর্মীকে আসামি করে মামলা করলেন। প্রধানমন্ত্রী আর তার লোকদের কথা বাংলাদেশে কেউ বিশ্বাস করে কি? নাটক আর চমক এমন জিনিস, স্থ’ূলভাবে অথবা অতি ব্যবহারে সেগুলো ভোঁতা ও অকেজো হয়ে যায়। এগুলোর ব্যবহার হতে হয় শিল্পকর্মের মতো সূক্ষ্ম ও সুনিপুণ। একটা দৃষ্টান্ত ছিলেন শেরেবাংলা ফজলুল হক।
নাটক ও চমকের গুরু
শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের রসবোধ ও রসিকতা এবং সমর্থক ও ভোটারদের আস্থা অর্জনের কৌশল সম্বন্ধে অজস্র কাহিনী প্রচলিত ছিল। ১৯৪৬ সালের জুন মাসে ভারতবর্ষ জুড়ে নির্বাচন হয়। সে নির্বাচনে মুসলিম লীগের প্রাপ্ত ভোটের ভিত্তিতেই ব্রিটিশরা ভারত ও পাকিস্তান রূপে উপমহাদেশকে স্বাধীনতা দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। পাকিস্তানের প্রস্তাবক শেরেবাংলা কিন্তু সে নির্বাচনে মুসলিম লীগকে ভোট দেননি। স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানের নেতৃত্ব নিয়ে কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগ নেতাদের সাথে বিরোধের কারণে তিনি মুসলিম লীগের বিপক্ষে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন এবং বিপুল গরিষ্ঠতায় জয়ী হন।
সে নির্বাচনে তিনি একদিন গলায় একটা কাপড়ের থলেতে পুরু একটা বই ঝুলিয়ে প্রচারে গিয়েছিলেন। জনতা বলাবলি করছিল, শেরেবাংলা গলায় কুরআন শরিফ ঝুলিয়ে প্রচারণা চালাচ্ছেন। এতই ধর্মভীরু ও বিশ্বাসী তিনি। তাই তাকে ভোট দেয়া সবার কর্তব্য। এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু পরে কুরআন শরিফকে নির্বাচনী প্রচারে ব্যবহারের ঔচিত্য নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। শেরেবাংলা তখন থলি থেকে বইটি বের করলেন। দেখা গেল যে, সেটি ছিল মোটা একটা এ মুখার্জির ডায়েরি। কিন্তু এ কে ফজলুল হকের নির্বাচনী উদ্দেশ্য সফল হয়েছিল। ভোটদাতারা গলায় ঝোলানো বইকে কুরআন শরিফ মনে করেছিল এবং ‘পুণ্যাত্মা’ শেরেবাংলাকে ভোট দান কর্তব্যজ্ঞান করেছিল।
বাংলাদেশের বর্তমান অবৈধ সরকারও প্রায়ই এজাতীয় চমক দেখানোর চেষ্টা করে, কিন্তু প্রায় সব ক্ষেত্রেই তাদের অজ্ঞতা কিংবা বুদ্ধির স্থূলতার কারণে সে চমক ব্যর্থ হয়। যেমন হয়েছে তারেক রহমানকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনার জন্য ইন্টারপোলের ‘রেড অ্যালার্টের’ কাহিনী। তারেক রহমানের ওপর এই সরকারের বহু আক্রোশ আছে। তিনি স্বাধীনতার ঘোষক ও গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠাতা শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়া এবং তিনবারের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার পুত্র। নিজেও তিনি বিএনপির নির্বাচিত সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট। শেখ হাসিনার ‘আন্দোলনের ফসল’ বর্ণচোরা সামরিক সরকার রিমান্ডে নির্যাতন করে তার কোমর ভেঙে দিয়েছিল এবং তাকে দেশ থেকে নির্বাসিত করেছিল। আওয়ামী লীগ আশা করেছিল যে, এরপর আর তারেক রাজনীতি করতে পারবেন না এবং বাংলাদেশের মানুষ, বিশেষ করে তরুণসমাজ শিগগিরই তাকে ভুলে যাবে। ২০০১ সালের নির্বাচনে তারেকের সাংগঠনিক প্রতিভা যে তাদের পরাজয়ের একটা বড় কারণ ছিল, সেটা কিছুতেই তারা ভুলে যেতে পারছে না।
আমাদের মামলা আমরা করব, যত খুশি তত করব
নির্বাসিত তারেকের বিরুদ্ধে ১২টি রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা আদালতে উঠছে বলে গত কয়দিনে জোর প্রচার চালাচ্ছে অবৈধ সরকার। সেই সাথে পয়লা বৈশাখের পর থেকে আরো প্রচার চলছে যে তারেককে ফিরিয়ে আনার জন্য ইন্টারপোল ‘রেড অ্যালার্ট’ জারি করেছে। সবাই জানে, এখনকার বিচার বিভাগে আওয়ামীকৃত বিচার হয় এবং মিথ্যা মামলা সাজানোর ব্যাপারে এই সরকার মহাবাহাদুর। খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে ১৩০টি মামলা সাজানো হয়েছে বলে শুনেছি। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বিরুদ্ধে সাজানো হয়েছে কয়েক ডজন। সব মিলিয়ে বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে সাজানো মামলার সংখ্যা ১৫-২০ হাজার তো হবেই। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, স্বয়ং প্রধান বিচারপতিও মামলার আধিক্য নিয়ে প্রকাশ্যে উদ্বেগ জানিয়েছেন। আদালত তাদের, মামলাও তাদের। তাদের মামলা তারা সাজাবে। তারেকের বিরুদ্ধে ১২ হাজার মামলা সাজালেও তাদের ঠেকায় কে?
ইন্টারপোলকে দিয়ে তারেককে দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার কাহিনী কতবার আপনি পড়েছেন এবং শুনেছেন মনে আছে কি? তফাতের ভেতর এবারে সে কাহিনীতে লাল রঙ চড়ানো হয়েছে। একই সাথে লাল রঙের ‘অ্যালার্ট’ দিয়ে ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল জাব্বারকেও আমেরিকা থেকে দেশে ফেরত আনার কাহিনী ছড়াচ্ছে বিশেষ করে সরকারের অনুগ্রহভোগী মিডিয়া। এই কাহিনীগুলো যারা তৈরি করছে তারা হয় মিথ্যাবাদী, নয়তো ইন্টারপোলের কার্যপ্রণালী এবং বিদেশের সাথে অভিযুক্ত প্রত্যর্পণের নিয়ম-কানুন সম্বন্ধে কিছুই জানে না তারা। শেখ হাসিনা জামায়াত নেতাদের ফাঁসি দেয়ার প্রক্রিয়া যখন থেকে শুরু করেছেন, তখন থেকে মোট ৮৩ জনকে বিদেশ থেকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেছে এই সরকার। কিন্তু একটিতেও সফল হয়েছে কি তারা? তারা যে সফল হবে না, অভিযুক্ত ৮৩ জনের একজনকেও ফিরিয়ে আনতে পারবে না; সে কথা আমি কয়েকবার এ কলামেই বলে দিয়েছি। বাংলাদেশের মানুষ এখন বুঝে গেছে, ব্রিটিশ কিংবা মার্কিন সরকার আওয়ামীকৃত পুলিশ কিংবা র্যাব নয় যে, এই অবৈধ সরকারের অন্যায় নির্দেশও তারা অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলবে। কোনো বিরোধী রাজনীতিককে বাংলাদেশে প্রত্যর্পণের অর্থ যে নিশ্চিত ফাঁসি, পশ্চিমা সরকারগুলো সেটা বুঝে গেছে। আর তাদের মনে আছে, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর সাথে বাংলাদেশ প্রধানমন্ত্রীর আলোচনা সম্বন্ধে মিথ্যা সংবাদ প্রচার হয়েছিল বাংলাদেশ থেকে।
কিন্তু একটা ব্যাপার লক্ষ করা দরকার। হঠাৎ করে এজাতীয় ‘প্রচারের চমক’ ফুলে-ফেঁপে উঠেছে ১৪ এপ্রিলের পর থেকে। একটা দিনের কথাই ধরুন- শুক্রবার, ১৭ এপ্রিল। এ দিনের কিছু খবর। মন্ত্রী আমির হোসেন আমু তোপ দাগলেন, ‘তারেককে পাকিস্তানে পাঠানো হবে।’ বাংলাদেশী মন্ত্রীদের মুরোদের বহর দেখে আহা মরি যাই! তারেক রহমানকে তারা বাংলাদেশেই আনতে পারছেন না, পাকিস্তানে পাঠাবেন কী করে? আর শেখ মুজিব যখন ১৯৫ জন আসল যুদ্ধাপরাধী পাকিস্তানি সেনাকে স্বদেশে পাঠিয়েছিলেন, তখন তাদের মুখে টুঁ-শব্দটি শোনা গিয়েছিল? স্বাস্থ্যমন্ত্রী (যিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালে বিচারপতিদের ভয় দেখানোর জন্য গজারি কাঠের লাঠিধারীদের মিছিলে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন) মোহাম্মদ নাসিম বলেছেন, ২০১৯ সালের নির্বাচনেও তারাই জয়ী হবেন। নাসিম নিশ্চয়ই লাঠির জোরে জয়ের কথা ভাবছেন। লাঠির জোর যে ২০০১ সালের অক্টোবরে কাজে লাগেনি, নাসিম সেটা ভুলে গেছেন। ১৯৭২-৭৫ সালের রক্ষীবাহিনীর (যে বাহিনী ৩০ থেকে ৪০ হাজার রাজনৈতিক কর্মীকে হত্যা করেছিল) প্রধান তোফায়েল আহমেদ বলেছেন, ‘খালেদা (সিটি) নির্বাচনের আইনবিধি লঙ্ঘন করছেন। আর প্রধানমন্ত্রী মুজিবনগর দিবস উপলক্ষে (তার পিতা) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন।
মুজিবনগর ও মুজিব
পিতার প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা জানাতে শেখ হাসিনার উপলক্ষের প্রয়োজন কোথায় বুঝতে পারি না। কিন্তু মুজিবনগর দিবসের উল্লেখে খটকা লাগল। ইতিহাস জানা থাকলে এ দিবসটির কথা প্রধানমন্ত্রী সম্ভবত ভুলে যেতেই চাইতেন। শেখ হাসিনা কি জানতেন যে, তার পিতা তাজউদ্দীন আহমদের সরকার ও প্রধানমন্ত্রিত্বের অনুমোদন করেননি, তেমনি তিনি মুজিবনগরের নামও উচ্চারণ করেছেন বলে শুনিনি। বরং এটা জানি যে, নিজে তিনি কখনো মুজিবনগরে যাননি, বিভিন্ন মন্ত্রী চেষ্টা করেও তাকে সেখানে নিতে পারেননি।
প্রকৃত ব্যাপার হচ্ছে, এ সরকার যখনই বিপদে পড়ে, প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে চুনোপুঁটি মন্ত্রীরাও উল্টাপাল্টা বিতর্কিত কথাবার্তা বলে দেশের মানুষের মনোযোগ ভিন্নমুখী করতে চান। আর অস্তিত্ব সঙ্কট দেখা দিলে তারা গালিগালাজের ভাষা আরো নোংরা করে তোলেন। ১৪ এপ্রিল ছিল বর্ষবরণের দিন, কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর আদরের দুলাল সোনার ছেলেদের ছাত্রলীগ আর যুবলীগ দিনটাকে বস্ত্রহরণ আর নারী ধর্ষণের উপলক্ষে পরিণত করেছিল। দিনদুপুরে, সন্ধ্যায় নারীর শ্লীলতাহানি করা হয়েছে, স্বামীর সামনে স্ত্রীকে বিবস্ত্র করা হয়েছে, সন্তানের সামনে মাকে ধর্ষণ করা হয়েছে, বাসে ধর্ষিত হয়েছেন নারী, বর্ষবরণের মেলা থেকে এক নারীকে অপহরণ করে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে।
শুনেছি ১৭টি ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরা বসানো হয়েছিল সেদিনের অনুষ্ঠানে। বিদেশে বসে টেলিভিশনের ফুটেজ আর ভিডিওর ছবিও কিছু কিছু দেখতে পেয়েছি। কিন্তু সেসব ছবি থেকে পুলিশ নাকি কাউকে শনাক্ত করতে পারছে না।
বাংলাদেশের পুলিশকে নিয়ে হাসব, না কাঁদব, বুঝতে পারি না। হাসিনার দ্বিতীয় দফার সরকারের প্রথম দিকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ গুণ্ডারা শিবিরকর্মী সন্দেহ করে এক হিন্দু দর্জিকে খুন করেছিল। মিডিয়ায় সুস্পষ্ট ছবি প্রকাশের পরও পুলিশ নাকি তাদের শনাক্ত কিংবা গ্রেফতার করতে পারছে না। অথচ সাধারণ মানুষ হরহামেশা তাদের দেখছে, সবার চোখের সামনে দিয়ে তারা ঘুরে বেড়াচ্ছে। রেল দুর্নীতিতে চাকরি খোয়ানো মন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্তও বলতে বাধ্য হয়েছেন, ‘নারীর শ্লীলতাহানির ঘটনায় পুলিশের ভূমিকা অমার্জনীয়।’
রতনে রতন চেনে
কিন্তু সরকার ও মন্ত্রীদের লজ্জা-শরম কিছু আছে বলে মনে হয় না। তাদের মা-বোনেরা কি নারী ছিলেন না? কেন শ্লীলতার মর্যাদা তাদের জানা থাকবে না? তথ্যমন্ত্রী ইনু ১৪ এপ্রিলের অমানুষিক আর নারকীয় ঘটনাগুলোর জন্য ‘জঙ্গি ও তালেবানদের’ ওপর দোষ চাপানোর প্রয়াস পেয়েছেন। আওয়ামী লীগের সরকারে মন্ত্রী তিনি। তিনি ছাত্রলীগ শনাক্ত করতে পারেন না, কিন্তু জঙ্গি ও তালেবান চিনতে তার দেরি হয় না। ‘রতনে রতন চেনে’ আর কি! আর ঘটনাগুলোর তদন্তের জন্য সরকার ‘মেট্রোপলিটন পুলিশের’ দু’টি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে- যে পুলিশ ইতোমধ্যেই কোজড সার্কিট টেলিভিশন আর ভিডিও ছবি দেখেও কাউকে শনাক্ত করতে পারেনি বলে জানিয়ে দিয়েছে। সরকার নির্দেশ দিলে ইঁদুরের গর্ত থেকেও এ পুলিশ বিএনপি সদস্যদের ধরে আনতে পারে, আর প্রধানমন্ত্রীর আদরের দুলাল ছাত্রলীগ-যুবলীগ চোখের সামনে মহিলাদের উলঙ্গ করলেও তাদের চোখে পড়ে না। পুলিশি তদন্ত কমিটির চেয়ারম্যান ডিবির যুগ্মকমিশনার মনিরুল ইসলাম তদন্ত শুরু হতে না হতেই বলে দিয়েছেন, নারীকে বিবস্ত্র করার কোনো ঘটনা ঘটেনি। প্রধানমন্ত্রীর সোনার ছেলেদের গ্রেফতার করার কোনো ইচ্ছা যে পুলিশের নেই, মনিরুল ইসলামের উক্তি থেকে সেটা পরিষ্কার হয়ে গেছে। তার চেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক এমাজউদ্দীনের একটি উক্তি সঠিক মনে হতে পারে। তিনি বলেছেন, সিটি নির্বাচনে নারীরা যাতে ভোট দিতে না আসেন, সেজন্য তাদের ভয় দেখানোর লক্ষ্যেই ‘ওপরওয়ালাদের’ নির্দেশে ১৪ এপ্রিলের অমানুষিক ঘটনাগুলো ঘটানো হয়েছে।
নারীর ক্ষমতায়ন সম্বন্ধে অন্যদের সবক দিতে প্রধানমন্ত্রী বিরাট বিরাট সঙ্গীদল নিয়ে বিশেষ বিমানে সারা বিশ্ব চষে বেড়িয়েছেন, বাংলাদেশের অজস্র কোটি টাকা অপচয় করেছেন; কিন্তু এ সরকারের আমলে বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়নের পরিবর্তে তাদের মর্যাদার অবনতি হয়েছে বলেই আমার মনে হয়। শেখ হাসিনা নিজেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ছিলেন। কিছু কিছু কারণে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম ইতিহাসে সোনার অক্ষরে লেখা থাকবে। এ প্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা বহু দেশের মানুষকে উচ্চশিক্ষা দিচ্ছেন, বহু বিজ্ঞানী ও শিক্ষাব্রতী তৈরি হয়েছেন এখানে। এখানে নির্মল ছাত্ররাজনীতির উদ্ভব হয়েছিল, ভাষা আন্দোলনের জন্ম এবং স্বাধীনতার অঙ্কুর বিকশিত হয়েছিল এখানেই। কিন্তু শেখ হাসিনার আমলে কী হয়েছে? মিডিয়ায় হরহামেশা এখানে ছাত্রীদের উত্ত্যক্ত ও নির্যাতিত করার খবর পড়ছি, পর্নো তৈরি ও ব্যবসায়ের একটা বড় ঘাঁটি এখানে। ছাত্রলীগের নেতাদের ছাত্রী হলে থাকতে না দিলে খুনোখুনি হয়। এই নেতাদের উৎপাতে বহু পিতামাতা কন্যাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করতে অনিচ্ছুক এবং কোনো কোনো পিতামাতা ছাত্রীদের ইতোমধ্যেই ছাড়িয়ে নিয়েছেন বলেও শুনেছি। আর এখন তো সারা বিশ্বই জেনে গেল, ১৪ এপ্রিলের মতো ঘটনাগুলো ঘটে এখানেই।
আসল কথা হচ্ছে, এ সরকার গদি দখল করে রাখতে চায়। বিদেশীদের তারা দেখাতে চায় যে সিটির নাগরিকেরাও তাদের সমর্থন করে। সেজন্য গত বছরের ৫ জানুয়ারির মতো করে হলেও তারা ২৮ এপ্রিলের নির্বাচনও ডাকাতি করতে চায়। তিন সিটিতে ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করা হচ্ছে সে আশায়। কিন্তু ‘আশায় বৈরাগী নাচে চিঁড়ার ছালার কাছে।’
উৎসঃ নয়া দিগন্ত
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন