বেইলি রোডের বাইরের আগুন নিভবে কীভাবে?
06 March 2024, Wednesday
বেইলি রোডে আগুন লেগে নিভেও গিয়েছে। মাঝখান থেকে ঝরে পড়েছে ৪৬টি মূল্যবান প্রাণ। আগুনের ছাই উড়ে গিয়ে বেরিয়ে পড়েছে অব্যবস্থাপনার ক্ষত-বিক্ষত চেহারা। ঠিক পুড়ে যাওয়া ভবনটির মতো; চাকচিক্য পুড়ে গিয়ে মুখ ব্যাদান করে রয়েছে বিবর্ণ কাঠামো। সমালোচকরা বলছেন, দেশের উন্নতিও পুড়ে যাওয়া ভবনটির মতো। উপরিকাঠামোতে চাকচিক্য রয়েছে বটে, মূল কাঠামোটি বিবর্ণ। পুঁজিবাদী বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর সঙ্গেও কেউ কেউ তুলনা করছেন; অগ্নিকাণ্ডের মতো দুর্ঘটনা মোকাবিলায় তাদের কী প্রস্তুতি, আর আমরা কোথায় পড়ে আছি!
আমাদের শাসনকর্তারা বলবেন, বলছেনও– উন্নতি সমালোচকদের চোখে পড়ে না। বাংলাদেশে উন্নতি যে হচ্ছে, সেটা পুঁজিবাদী বিশ্বও অস্বীকার করে না। উন্নতির তারা প্রশংসা করে; মাঝেমধ্যে এমনকি সানন্দে পিঠ চাপড়ে পর্যন্ত দেয়। এই উন্নতিতে তারা বাংলাদেশের সহযোগী ও পরামর্শদাতা। পার্থক্য অবশ্য রয়েছে।
বাংলাদেশের উন্নয়নের প্রশংসা করলেও পুঁজিবাদী বিশ্ব নিজেদের দেশের জনগণকে এটা জানাতে চায় যে, এখানে গণতন্ত্রের বিচ্যুতি ঘটছে। গণতন্ত্রের অতন্দ্র প্রহরী হিসেবে তারা এ ব্যাপারে কোনো ছাড় দেবে না। তা ছাড়া বাংলাদেশের মতো উন্নতিকামী দেশগুলোয় যদি পুঁজিবাদী ঘরানার গণতন্ত্রও না থাকে, তাহলে ওইসব দেশের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়বে না। এমন অঘটনও ঘটতে পারে যে, সেখানকার জনগণ বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠবে। বিক্ষুব্ধ হয়ে তারা হয়তো বিপ্লব-টিপ্লবই ঘটিয়ে ছাড়বে।
মানতেই হবে, নির্বাচন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে কার্যকর রাখার জন্য অত্যাবশ্যকীয়। নির্বাচন যদি সুষ্ঠু না হয় তাহলে সে ত্রুটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে সরাসরি আঘাত করে এবং তাকে দুর্বল করে দেয়। সরকারের জবাবদিহির দায় সংকুচিত হয়ে আসে। সবচেয়ে বড় কথা, জনজীবনে হতাশা ও পরাজিতের মনোভাব দেখা দেয়। যুদ্ধ করে বাংলাদেশের যে মানুষ সর্বপ্রকার মারণাস্ত্রে সজ্জিত এক লাখ হানাদারের এক বাহিনীকে হাঁকিয়ে দিল; যুদ্ধ শেষে নিজের দেশে তারা যদি নিজেদের শাসকদের কাছে হেরে গেছে বলে ধরে নেয়, তবে তাদের পক্ষে দারিদ্র্য, পরিবেশ ও বিশ্বব্যবস্থার বৈরিতার বিরুদ্ধে দাঁড়ানো সম্ভব হবে– এমন ভরসা থাকে কি?
এদিকে একটির পর আরেকটি জাতীয় নির্বাচনের মধ্য দিয়ে জনগণের পরাজয়ের ঘটনা ঘটে চলেছে। আর নদীর পানিতে যদি দূষণ দেখা দেয়, তার শাখা-প্রশাখাতে ছড়িয়ে না পড়ে পারে না। জাতীয় নির্বাচনের প্রভাব অন্য সব নির্বাচনেও গিয়ে পড়েছে বৈকি।
আওয়ামী লীগের শাসন ১৫ বছর পার হলো; আরও পাঁচ বছর নির্বিঘ্নেই চলবে বলে অনেকের ধারণা। হয়তো তারপর আরও পাঁচ বছর চালিয়ে নেওয়ার চেষ্টা চলবে। নির্বাচনের পর তারা যে বিজয় উৎসব করেনি, তাতে সুবিবেচনার পরিচয় পাওয়া গেছে। উৎসব করলে বহু অঘটন ঘটতে পারত। আর কিছু না হোক, ক্ষমতাসীন দলের বিজয় উদযাপনে অযাচিত ছুটে আসা হাজার হাজার মানুষের পদদলন ভয়াবহ আকার নিতে পারত।
প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির এখন যে ছত্রভঙ্গ দশা, সেটা আওয়ামী লীগের দম্ভের একটা কারণ নিশ্চয়ই। লক্ষ্য করেছি, দলটির শুভানুধ্যায়ীদের কেউ কেউ পত্রিকায় কলাম লিখে বলার চেষ্টা করেছেন, বিএনপি আওয়ামী লীগের প্রতিদ্বন্দ্বী অবশ্যই, কিন্তু শত্রু নয়; শত্রু হচ্ছে জামায়াতে ইসলামী। তা জামায়াতও এখন কাহিল অবস্থায় রয়েছে। তবে দেশের অগ্রগতির জন্য আগামীতে শত্রুপক্ষ হিসেবে যে মৌলবাদী শক্তি দেখা দেবে বলে আশঙ্কা, তারা জামায়াতের তুলনায় কম নৃশংস হবে– এমনটা মনে হয় না।
মৌলবাদীদের দাবির মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ যেটি– ব্লাসফেমি আইন চালু করা। পাকিস্তানের মৌলবাদীরা ওই আইন কায়েম করে ছেড়েছে এবং তার প্রতিফল কী দাঁড়িয়েছে, টের পাচ্ছে সে রাষ্ট্রের সাধারণ নাগরিকরা। তালেবান পরিচয়ে এ মৌলবাদীরাই আফগানিস্তানের সব প্রগতিশীলতাকে পর্যুদস্ত করেছে তো বটেই, গোটা দেশকেই ছারখার করে দিয়েছে।
বাংলাদেশে বর্তমান সরকার কর্তৃত্ব পেয়ে এবং সে কর্তৃত্বকে দীর্ঘস্থায়ী করার লক্ষ্যে যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে তার মধ্যে একটি হলো, মৌলবাদীদের নানা রকম ছাড় দেওয়া। কতগুলো ছাড় তো অবিশ্বাস্য, প্রায় অকল্পনীয়। আগামীতে বিপদটা কিন্তু আসবে ওই মৌলবাদীদের দিক থেকেই। সে বিপদ এলে আওয়ামী লীগ কীভাবে তার সামাল দেবে, সেটা তাদের ব্যাপার। কিন্তু দেশবাসী যে ভীষণ এক সংকটের আবর্তে নিক্ষিপ্ত হবে, তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। বিশেষ রকমের বিপদ ঘটবে মেয়েদের। মোল্লারা নারীমুক্তি পরের কথা, নারীশিক্ষাতেই বিশ্বাস করে না। সমাজে তারা যে আগুনটা জ্বালাতে চাইবে, তদুপরি সেটা স্থানীয় ও স্বল্পস্থায়ী হবে না। ওই আগুন কেবল যে প্রগতিপন্থি মানুষকে পুড়িয়ে মেরেই ক্ষান্ত হবে, তা নয়; সমাজের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়বে। সব মানুষকেই দগ্ধ করবে এবং কোনো দমকলেরই সাধ্য থাকবে না তাকে নির্বাপিত করার।
বেইলি রোডের বাইরেও অগ্নিকাণ্ডের ক্ষেত্র কিন্তু নানাভাবে প্রস্তুত হচ্ছে। ক্ষেত্রগুলোর সবচেয়ে বড়টি হচ্ছে মানুষের ক্ষোভ। দেশের প্রায় সব মানুষই এখন বিক্ষুব্ধ, কিন্তু তাদের ক্ষোভ প্রকাশের কোনো গণতান্ত্রিক পথ খোলা নেই। নির্বাচন ব্যবস্থাকে অকার্যকর করে দেওয়া হয়েছে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সংকুচিত। রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা সর্বক্ষণ ভয় দেখাচ্ছে। সময় পার হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু আমাদের জাতীয় কবি নজরুল ইসলামের সেই পঙ্ক্তি, ‘তোমরা ভয় দেখিয়ে করছ শাসন, জয় দেখিয়ে নয়’– কিছুতেই মিথ্যা প্রমাণিত হচ্ছে না। লোকে সন্ত্রস্ত; মুখ খুলতে ভয় পায়। অথচ তাদের অনেক কথা আছে বলার। বাষ্প জমে উঠছে, ভেতরে ভেতরে।
ওদিকে দুর্নীতি এখন সর্বত্রগামী। ঘুষ ছাড়া কোনো কাজ হয় না। পুলিশ আসছে শুনলে লোকে ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে মারা যায়। কৃষক তার সর্বশক্তি প্রয়োগ করে কৃষিপণ্য উৎপাদন করে, কিন্তু ন্যায্যমূল্য পায় না। শ্রমিকরা বাঁচার মতো মজুরি চাইলে মালিকের পক্ষ নেওয়া পুলিশ ও মালিকের নিয়োজিত মাস্তানরা তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নেই। এখন আবার দেখা যাচ্ছে বেসরকারি হাসপাতালে গিয়ে ভুল চিকিৎসা বা উদাসীনতায় রোগী মারা যাওয়ার হার বেড়েছে। এমনকি খতনার মতো সামান্য অস্ত্রোপচারেও শিশুদের প্রাণ যাচ্ছে। রাস্তায় বের হলে গাড়িচাপা পড়ে মরতে হয়। আদালতের বিচার চাওয়ার বিষয়টিও আর সুলভ নয়; অনেক অর্থকড়ির ব্যাপার। মানুষ তাহলে যাবেটা কোথায়? কে দেবে আশ্রয়?
প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলগুলো দাঁড়াতেই পারছে না। অত্যন্ত হতাশ ও চরমভাবে অসহায় মানুষ আশ্রয় খুঁজছে ধর্মের কাছে। ভাবছে, ইহকালে ন্যায়বিচার পাওয়া গেল না, পরকালে নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে। সবকিছু মিলে মানুষ নিজেদের অজান্তেই দক্ষিণপন্থার দিকে ঝুঁকে পড়ছে। এতে সুবিধা হচ্ছে ধর্মকে নিজেদের ইহজাগতিক স্বার্থে যারা ব্যবহার করে, তাদের।
কেবল বাংলাদেশে নয়, বিশ্বজুড়েই ধর্ম নিয়ে উস্কানি বা ধর্মীয় পরিচয়ে হত্যা ও নির্যাতন বাড়ছে। ইউরোপজুড়ে কেবল উগ্র ইসলামভীতি প্রচারিত হচ্ছে, তাই নয়; দক্ষিণপন্থি দলগুলো মুসলমানদের বিরুদ্ধে নানা ধরন ও মাত্রার ক্রুসেড ঘোষণা করছে। গাজায় হাজার হাজার ফিলিস্তিনিকে হত্যা করছে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী ও শাসকগোষ্ঠী। পাশের দেশ ভারতে সরকারের সহায়তায় উগ্র হিন্দুত্ববাদী আচরণ সীমান্তের এপাশেও ঝুঁকি তৈরি করছে। বেইলি রোডের বাইরে বিস্তীর্ণ বাংলাদেশজুড়ে ধিকিধিকি জ্বলতে থাকা এই আগুন নিভবে কীভাবে?
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: ইমেরিটাস অধ্যাপক,
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
উৎসঃ সমকাল
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন