পরিবর্তনটা ঘটেছে অতিরিক্ত মুনাফালোভী পুলিশের কতিপয় সদস্যের মাত্রাতিরিক্ত তৎপরতার কারণে। ঘটনাটা আমরা সবাই জানি। সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান কক্সবাজারে গিয়েছিলেন একটি ডকুমেন্টারি ফিল্ম তৈরি করবেন বলে। সঙ্গে ছিল তিনজন তরুণ সহকর্মী। রাতের বেলায় পাহাড়ে উঠে শ্যুটিং শেষে নিজের গাড়িতে করে সিনহা ও সহকর্মীদের একজন হোটেলে ফিরছিলেন। পথিমধ্যে পুলিশের খপ্পরে পড়ে যান। গুলি করে তাকে হত্যা করা হয়। কেন হত্যা করা হলো তার সঠিক ব্যাখ্যা এখনো পাওয়া যায়নি। তবে পুলিশ বলেছিল গুলি করা হয়েছে ‘আত্মরক্ষার’ জন্য। আত্মরক্ষার জন্য গুলি করা হলো, তবে পায়ে নয় কেন, কেন বুক তাক করে সে জিজ্ঞাসা রয়ে গেছে। আত্মরক্ষার জন্য গুলি করে পুলিশ একজন মানুষকে হত্যা করেছে এটা তেমন কোনো খবর নয়। হামেশাই ঘটছে।
এটিও খবর হতো না, যদি গণমাধ্যমে খবরটি চলে না আসত। গণমাধ্যমেও আসত না, সিনহা যদি সেনাবাহিনীর সাবেক সদস্য না হতেন। খবর গণমাধ্যমে এলেও চাপা পড়ে যেত, পুলিশের ‘আত্মরক্ষায়’ গুলি করার গল্পটিই গ্রাহ্য হয়ে থাকত, যদি না সেনাবাহিনীর প্রাক্তন অফিসারদের সংস্থা সঙ্গে সঙ্গে এর প্রতিবাদ জানাত। তারা বলেছেন এ ঘটনায় সংস্থার প্রতিটি সদস্যের ভেতর রক্তক্ষরণ ঘটেছে। বলেছেন ন্যায়বিচারের স্বার্থে প্রয়োজন হলে তারা রাস্তায় নামবেন। এসব না ঘটলে পুলিশের প্রচারিত আত্মরক্ষা ও তার অনুষঙ্গী কল্পকাহিনীই সত্য হয়ে বহাল থাকত। কল্পকাহিনীতে বলা হয়েছিল সিনহা ও তার সঙ্গীকে গ্রামবাসী ডাকাত বলে সন্দেহ করে। গ্রামবাসী ডাকাত ডাকাত বলে চিৎকার করেছিল। পরে অবশ্য জানা গেছে গ্রামবাসী নয়, চিৎকার করেছিল পুলিশের শাসনাধীন কিছু লোক। তাদের শিখিয়ে দেওয়া হয়েছিল। পুলিশের এসপি থানার ওসি’কে গল্পের সঙ্গে নতুন উপাদান যোগ করবার সঠিক পরামর্শটি দিয়েছিলেন। সেটা হলো, বলতে হবে সিনহা একজন মাদক ব্যবসায়ী। থানার লোকেরা নিহত সাবেক সেনা অফিসার ও তার ছাত্রসঙ্গীটিকে আসামি করে মামলা দায়ের করার সব উদ্যোগ সুসম্পন্ন করে ফেলেছিল। লোক দু’টি নাকি পুলিশের কর্তব্যপালনে বাধা দিয়েছে, এবং কর্তব্যরত একজন পুলিশ অফিসারকে হত্যা করার জন্য পিস্তল তুলেছিল, পুলিশ তাই নিরুপায় হয়ে ইত্যাদি ইত্যাদি। কক্সবাজার থানার প্রবল অতি-পরাক্রমশালী ওসি ও তার সহযোগীরা গ্রেপ্তার হয়েছে, এবং সর্বোপরি অত্যাশ্চর্য ওই সংবাদ জানা গেছে যে পুলিশই পুলিশকে রিমান্ডে নিয়েছে। এসব কারণেই মনে হয় অল্পস্বল্প হলেও আবহাওয়ার একটু পরিবর্তন ঘটেছে। গ্রীষ্ম মোটেই শেষ হয়নি, তবে গরম সামান্য একটু কমেছে। তাতে করে মানুষের নিরাপত্তা যে বাড়বে তেমন ভরসা নিতান্তই মিছে।
গোটা ব্যবস্থাটাই যখন মনুষ্যত্ববিরোধী তখন কোথায় পাওয়া যাবে নিরাপত্তার আশ্বাস? মসজিদকে তো এদেশের মানুষ সব সময়েই নিরাপদ আশ্রয়স্থল ভেবে এসেছে। ঊনসত্তরের সেই বিখ্যাত অভ্যুত্থানের সময় দেখেছি রাজনৈতিক নেতারা বায়তুল মোকাররম মসজিদের ভেতরে আশ্রয় নিয়েছেন, পুলিশ সেখানে ঢুকতে পারবে না এই ভরসায়। মওলানা ভাসানী ওই মসজিদের সামনে গায়েবানা জানাজা পড়িয়েছেন। এখন, এই করোনাকালে নারায়ণগঞ্জের এক মসজিদে নামাজ পড়তে গিয়ে মুসল্লিরা জীবন্ত দগ্ধ হলেন। ৩৭ জন ইতিমধ্যেই প্রাণ হারিয়েছেন। আরও কয়েকজন মারাত্মক দগ্ধ হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন, বাঁচার জন্য লড়ছেন। কারণ কি? নাকি গ্যাস লিকেজ। গ্যাস লিকেজের ব্যাপারটা নাকি অজানা ছিল না। তিতাস গ্যাসের লোকদের অনুরোধ করা হয়েছিল সারিয়ে দিতে। তারা গা করেননি। কারণ ঘুষ দেওয়া হয়নি। ৫০ হাজার টাকা চেয়েছিলেন। মসজিদ কমিটি রাজি হয়নি। আবার এটাও সত্য যে, দেশে এখন মসজিদ বানানোর আগে জায়গাটা নিরাপদ কি না তা দেখা হয় না। এবং মসজিদ নির্মাণের পেছনে সবসময় যে আধ্যাত্মিক কারণই সক্রিয় থাকে তাও নয়, জমি দখলের প্রেরণাও কখনো কখনো কাজ করে।
সবাই বলছেন এমন অবস্থা চলতে পারে না। বিশ্বময় একই আওয়াজ। কিন্তু অবস্থাটা বদলাবার আগে তো পরিষ্কার ধারণা চাই অবস্থার কারণ কী। আগে রোগটিকে চিহ্নিতকরণ, তার পরে না ব্যবস্থাপত্র প্রণয়ন। বর্তমান অবস্থাটা প্রোথিত রয়েছে বিশেষ ধরনের ব্যবস্থার ভেতরে। এক কথায় সে ব্যবস্থাটার নামে পুঁজিবাদ। কথাটা স্থূল, কিন্তু এটা জোরেশোরে বলা হচ্ছে না। রক্ষণশীলরা বলবেন না, কারণ এই ব্যবস্থাটাকে তারা পছন্দ করেন তা তারা জর্জ বুশপন্থি বা লাদেনপন্থি, যে পন্থিই হোন না কেন। সম্পত্তি ও সম্পদের ব্যক্তিমালিকানা ব্যবস্থাটাকে তারা রক্ষা করতে চান। ব্যবস্থা বদলাবার কথাটা উদারনীতিকরা যে তোলেন না, তার কারণ একে তারা ভদ্রলোক, তদুপরি তারা মনে করেন সংস্কারেই কুলাবে। এবং তৃতীয়ত তারা যে গাছে বসে আছেন তার গোড়াটি কেটে ফেলতে চাইবেন এমনটা তো স্বাভাবিক নয়। হ্যাঁ, বদলাবার কথা বামপন্থিরা বলেন। পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অবসান ঘটিয়ে তারা সামাজিক মালিকানার নতুন পৃথিবী গড়ে তুলতে চান। কিন্তু তাদের কণ্ঠরোধ করা হয়। রাষ্ট্র, সমাজ, মিডিয়া, সবাই মিলে তাদের গলা চেপে ধরে। ফিলিস্তিনিদের গলা যেভাবে চেপে ধরা হচ্ছে প্রায় প্রায় সে-ভাবেই।
মধ্যবর্তী উদারপন্থিদের নিয়ে মস্ত সমস্যা। তারা বুঝতে চান না। বুঝতে গেলে দেখেন ঘুমন্তকে জাগিয়ে দেওয়ার এবং ক্ষেত্রবিশেষে পাগলকে ক্ষেপিয়ে তোলার ঝুঁকিটা রয়ে গেছে সামনে। স্বভাবতই তারা দু’কদম এগোতে গেলে অন্তত এক কদম পিছিয়ে আসেন, এবং পেছানো অবস্থানেই দাঁড়িয়ে থাকেন। এই অগোনো-পেছানোর দু-একটি দৃষ্টান্ত দেওয়া যাক।
লন্ডনের নিউ স্টেটসম্যান সাপ্তাহিকটি মোটেই রক্ষণশীল নয়, উদারনীতিকই, কিছুটা বামঘেঁষাই মনে করা হয়। সেখানে বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে একজন বিশ্লেষক গভীর উৎকণ্ঠার সঙ্গে লিখেছেন : পুরনো দুনিয়া বিদায় নিয়েছে। অথচ আমরা এখনো জানি না ভবিষ্যতের কেমন নতুন দুনিয়া আমরা চাই। এটা একটা অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থা, উদ্বেগ আর অনিশ্চয়তায় ভরপুর সময়। এমন অবস্থায় উসকানিমূলক গণবক্তাদের বাগাড়ম্বর আর মিথ্যা প্রতিশ্রুতির উর্বর সময়।
তিনি আরও যা দেখছেন আমরাও তা দেখতে পাচ্ছি। দেখছেন একদিকে রয়েছে বড় বড় রাষ্ট্রগুলোর জাতীয়তাবাদী তৎপরতা; অন্যদিকে চলছে কিছু ভালো কাজ। ভালো কাজগুলোর মধ্যে রয়েছে আগামী মহামারী ঠেকানোর প্রস্তুতি, এবং জলবায়ুজনিত জরুরি অবস্থার মোকাবিলার, সাইবার সন্ত্রাসবাদ ঠেকানোর, তথ্যপ্রযুক্তির অন্ধকার দিকগুলো সামলানোর ব্যাপারে চেষ্টা। (প্রথম আলো, ০৮-০৯-২০)
তা ভাই আপনি অনেক কিছুই তো বললেন, আমরা প্রীত হলাম শুনে, কিন্তু এটা তো বললেন না সবকিছুর পেছনে আছে পুঁজিবাদ, আর এটা তো বললেনই না যে আগামীতেও যদি পুঁজিবাদের রাজত্ব চলতে থাকে তাহলে পৃথিবীর মরণদশা ঘটবে, এই কথাটা। বড় রাষ্ট্রগুলোর জাতীয়তাবাদী তৎপরতা আসলে তাদের পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী অভীপ্সারই অংশ, এবং করোনা প্রতিরোধের অত্যাবশ্যকীয় যে টিকা, যার জন্য পৃথিবীব্যাপী মানুষের অতিশয় উৎকণ্ঠিত প্রতীক্ষা, সেখানেও যে জাতীয়তাবাদ প্রবেশ করেছে সেটা কি স্পষ্ট নয়? রোগের লক্ষণগুলোকে ঠেকানোর চেষ্টার কথা বলছেন। তাতে রোগাক্রান্তদের দুর্দশা কিন্তু কমবে না, এবং তদ্বিপরীতে সুবিধা যা হওয়ার হবে সুবিধাভোগীদের। সুবিধাপ্রাপ্তি তো চলছেই, এই যে অতীব দুর্দশাগ্রস্ত আমাদের এই বাংলাদেশ, এখানেই তো করোনার প্রথম তিন মাসেই, ভীষণ রকমের মন্দার ভেতরেও, নতুন কোটিপতি গজিয়েছেন ৩,৪১২ জন। (কালের কণ্ঠ, ১৯-০৯-২০)
জাতিসংঘের মহাসচিব তার কর্তব্য পালন করে চলেছেন, অন্যকাজের মধ্যে এ কথাও বলতে ভুলছেন না যে করোনাভাইরাসই শেষ বিপদ নয়, আরও বিপদ আছে, এবং তা ঘাড়ের খুব কাছে। সেটা হলো জলবায়ু পরিবর্তন। এর বিরুদ্ধে বিশ্ববাসী হয় এক হবে নয় তো মহাপ্রলয়ের মুখে পড়বে। তবে ব্যাপার কিন্তু ওই একই। লক্ষণকে দেখতে-পাওয়া, রোগকে না-দেখে। জলবায়ু পরিবর্তন যে ঘটাচ্ছে তাকে আড়ালে রেখে পরিবর্তনকেই শুধু দেখতে চাওয়া। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের প্রধানের ভাষাটা কিছুটা সাহিত্যিক ধরনের, টিকা জাতীয়তাবাদের বিপদ বিষয়ে সতর্ক করে দিতে গিয়ে তিনি বলেছেন (১৭ সেপ্টেম্বর) : ‘আমরা কেউ কিন্তু নিরাপদে থাকব না যতক্ষণ না সবাই নিরাপদে থাকছেতা যেখানেই আমাদের বসবাস হোক না কেন এবং যা-ই আমাদের হাতে থাকুক না কেন।’ পুঁজিবাদ কিন্তু জাতীয়তাবাদ মানে না, তা পুঁজিবাদীরা যতই জাতীয়তাবাদী হোক না কেন। পুরনো সত্য, নতুন উন্মোচনের অপেক্ষায়।
লেখক ইমেরিটাস অধ্যাপক
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
উৎসঃ দেশরূপান্তর
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন