বন্ধনই বড় সত্য, মুক্তির চেয়ে, যে জন্য মুক্তির লক্ষ্যে অত আমাদের ব্যাকুলতা। সাহিত্যে সেই সব বিষণœ শিশু-কিশোরের ব্যাকুল আকাক্সক্ষার কথা যখন পড়ি, সেই যে বলছে তারা আকাশের পাখি হবে, মেঘ হবে, দেখবে এবার জগৎটাকে তখন ওই যে তাদের ডানা ঝাপটানো আকাশে সে আমাদের প্রত্যেকেরই বটেÑ টের পাই আমরা। ১৯৮৭ সালে প্রকাশিত মুক্তিযুদ্ধের ওপর দুটি নতুন বইÑ ‘মুক্তিযুদ্ধের কবিতা’ এবং ‘একাত্তরের ঘাতক ও দালালেরা কে কোথায়’Ñ পড়ে আবারও টের পেলাম তা আমি, নতুন করে, যদিও দুটিতে দুভাবে।
মুক্তিযুদ্ধের কবিতাগুলো অনেকে মিলে লিখেছেন, অনেকের লেখা অনেকগুলো কবিতার সংকলন এটি, কিন্তু পড়তে পড়তে মনে হলো সবাই মিলে একটাই কবিতা লিখেছেন তারা, তাদের মধ্যে যদিও ব্যবধান আছে বয়সের, দৃষ্টিভঙ্গির, অনুভবের, বক্তব্যের। একটি বড় কবিতা, অনেকগুলো তার অংশ, অংশে অংশে বৈচিত্র্য, কিন্তু সবগুলো অংশ মিলে একটি অভিন্ন রচনা। অন্যকিছু নয়। অভিজ্ঞতা এক জায়গায় নিয়ে এসেছে কবিদের। পরে অবশ্য তারা ওই এক জায়গায় থাকেননি, বিভিন্ন দিকে গেছেনÑ যেমন অন্যরাও গেলেন, যারা কবিতা লেখেন না তারাও।
by TaboolaSponsored LinksYou May Like
This Woman Reads 100 Books A Month
Blinkist
Panzer Rush
Panzer Rush
যুদ্ধের কবিতা আরও একভাবে লেখা হয়েছিল। ১৯৬৫তে। এদেরও কেউ কেউ লিখেছিলেন বৈকি, যা নিয়ে আলোচনা হয়েছে অন্যত্র। কিন্তু সেসব কবিতার সঙ্গে যুক্তিযুদ্ধের কবিতাগুলোর পার্থক্য সম্পূর্ণ মৌলিক। এই কবিতা এসেছে একেবারে ভেতর থেকে, স্বতঃস্ফূর্তভাবেÑ লোভে নয়, প্রলোভনে নয়, কৃত্রিম কোনো প্ররোচনাতে নয়, এমনকি ভয়েও নয়। পঁয়ষট্টির যুদ্ধ আমাদের নিজেদের যুদ্ধ ছিল না, যেমন ছিল একাত্তরের যুদ্ধ। কী ঘটেছিল একাত্তরে? তার বিবরণ ভিন্ন ভিন্নভাবে পাব মুক্তিযুদ্ধের কবিতায়, যেমন পাব, অন্য বইটিতে, গদ্যে লেখা ‘একাত্তরের ঘাতক ও দালালেরা কে কোথায়’ বইতে। এই দ্বিতীয় বইটিতে উদ্ধৃতি আছে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের একজন ইউরোপীয় অফিসারের একাত্তরে যিনি বাংলাদেশে এসেছিলেন। তিনি বলেছেন, ‘আমি ফ্রান্সের যুদ্ধের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাÑ নরম্যান্ডির হনন কেন্দ্র দেখেছি, কিন্তু এগুলোর কাছে সে কিছুই নয়। কান্না চেপে আত্মসংবরণ করতে আমাকে অনেক বেগ পেতে হয়েছিল।’ কষ্ট বিদেশিদের হয়েছে স্বদেশি ঘাতক ও দালালদের হয়নি।
ওইখানে একটি বড় ব্যবধান দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সঙ্গে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের। শত্রুপক্ষের চরেরা সে যুদ্ধেও ছিল, কিন্তু দেশের ভেতরে এত অধিকসংখ্যক ঘাতক ও দালাল ছিল না। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস কখনই সম্পূর্ণ হবে না, যদি না তাতে ওই দালাল ও ঘাতকদের তৎপরতার বিবরণ থাকে। সরকারি উদ্যোগে লিখিত ইতিহাসের ১৫ খ- ইতোমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে, তাতে এই তৎপরতার ইতিহাসটা নেই, শুনছি আরও কয়েক খ- লেখা হচ্ছে, আমরা অবশ্যই আশা করব যে, তাতে এই এখনো পর্যন্ত অবহেলিত অংশটি স্থান পাবে। নইলে তা পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস হবে না কিছুতেই, পেছনের অন্ধকারটি না থাকলে আলোর উজ্জ্বলতা ফুটে ওঠে না, আলোর তাৎপর্যও বোঝা যায় না।
তুলনা যখন উঠলই তখন এও উল্লেখের দাবি রাখে যে, ইউরোপের ওই যুদ্ধটা ছিল পুঁজিবাদের অভ্যন্তরে দ্বন্দ্বের প্রতিফলন, আমাদের লড়াই ছিল জাতীয় মুক্তির। এখানে দুর্ভোগ ছিল নিকৃষ্টতম, কিন্তু সেই সঙ্গে, পাশাপাশি, আশাও ছিল মানুষের মনেÑ যে আশার হৃদস্পন্দন মুক্তিযুদ্ধের কবিতায় পাই, যার দোলা আমাদের প্রত্যেকের হৃদয়ের ভেতরে ছিল, গভীরতম হতাশার সময়েও। আজ তা নেই। আজ আশা অনেকটাই স্তিমিত। একাত্তরে বীরাঙ্গনাদের নিয়ে কবিতা লেখা সহজ ছিল, স্বাভাবিকও ছিল, আজ নেই। একাত্তরে মুক্তিযোদ্ধার মা এলে সবাই তাকে সম্মান করত, আজ এড়িয়ে চলে। একাত্তরের পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা ছিল একজন বিজয়ী বীর, আজ তার কাঁধে মস্ত বোঝা ব্যর্থতার, পরাজয়ের, অপমানের, সর্বোপরি হতাশার। এর একমাত্র কারণ এটা নয় যে, একাত্তরের দালাল ও ঘাতকরা (একই তারা আসলে, দালালমাত্রই ঘাতক ছিল, খুন করুক আর না করুক, ব্যবধান গুণের নয়, পরিমাণের) আজ পুনর্বাসিত শুধু নয়, অনেকেই উচ্চ আসনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে; তবে যে ব্যবস্থা ও প্রক্রিয়া ঘাতকদের মর্যাদা দিয়েছে, সেটাই যে আশার আলো নেভাতে তৎপর তা অস্বীকার করি কী করে।
একাত্তর আমাদের অনেককেই চোখ দিয়েছে দেখার। যেন বাঁধা ছিল চোখ, রুমালেÑ একটি কবিতার উপমা দিয়ে বলা যায়। তারপর খুলে গেল। তখন আমাদের দেশকে চেনা, দেশের মানুষকে চেনা। সেটা সত্য। কিন্তু দালালরা করছিল অন্য কাজ। তারা চোখ বেঁধে দিচ্ছিল মানুষের। ওভাবেই ধরে নিয়ে গিয়ে খুন করেছে অনেক, অনেক মানুষকে। যাদের হত্যা করতে পারেনি, তাদেরও চোখ বেঁধে দিতে চেয়েছিল। ভ্রান্ত আদর্শের প্রচারণায়। কেবল একাত্তরে করেনি, আগেও করেছে, একাত্তরে ব্যাপারটা একটা চূড়ান্ত পরিণতিতে গিয়ে পৌঁছায়। একাত্তরে দালালরা প্রথমে বলেছে, ভারতীয় চর ও অনুপ্রবেশকারীরা গোলযোগ সৃষ্টি করেছে, পরে যখন দেখল ওতে কুলাচ্ছে না, তখন বলেছে, বাঙালি জাতীয়তাবাদকে উচ্ছেদ করা চাই। বলেছে, দুষ্কৃতিকারীরা তৎপর হয়ে উঠেছে, তাদের খুঁজতে হবে তন্ন তন্ন করে, নির্মূল করে দিতে হবে পাকিস্তানের পাকভূমি থেকে। পাকিস্তান বলতে ভূমিই বুঝত তারা, মানুষ বুঝত না।
‘একাত্তরের ঘাতক ও দালালেরা কে কোথায়’ বইটিতে তাদের এই দৃষ্টিভঙ্গির প্রমাণ আছে বহু রকমের। বলেছে তারা, ‘২৫ মার্চের পর পাকিস্তান সেনাবাহিনী যে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল, তা ছিল এ দেশের মাটি রক্ষার।’ তা মাটি রক্ষাই। মানুষ মেরে। মাটি রক্ষার উদ্দেশ্যটা যে আসলে কী তাও সময় সময় প্রকাশিত হয়ে পড়েছে। যেমন, আমরা দেখি শান্তি কমিটির বৈঠক বসেছে ঢাকার মোহাম্মদপুরে। সেখানে সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে, উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করতে হবে, অবিলম্বে বাংলা লেখা মুছে ফেলতে হবে সাইনবোর্ড ও নাম্বার প্লেট থেকে, বাংলা হরফ বদলে রোমান হরফ চালু করা চাই এবং ‘জাতির স্বার্থে’ উচ্চপদ থেকে বাঙালি অফিসারদের দুই বছরের জন্য ‘অপসারণ’ করতে হবে। অন্যত্র এই ইচ্ছাটাকেই বলা হচ্ছে ‘স্বীয় প্রচেষ্টার দ্বারা নিজেদের ভাগ্য উন্নয়ন।’ লুটপাট করার অবাধ সুযোগ দিতে হবে। ব্যস, ওইটাই। এটা অবাঙালিরা করবে। তারা দালাল নয়, তারা সরাসরি অপহরণকারী। বাঙালি দালালরা কি পাবে? তারা পাবে উচ্ছিষ্ট, আর পাবে হিন্দুদের জায়গাজমি, বিষয়সম্পত্তি। লাকসামের শান্তি কমিটির সিদ্ধান্ত উদ্ধৃত করা হয়েছে বইতে, সেটি কোনো স্থানীয় ব্যাপার ছিল না, বাংলাদেশের সর্বত্র কার্যকর ছিল ওই একই সিদ্ধান্ত : ‘ইউনিয়ন শান্তি কমিটিগুলোকে পুনরায় অনুরোধ করা হলো মালি, মেথর, পেশাদার ধোপি, জেলে এবং নাপিত ছাড়া সব হিন্দুকে উৎখাত করা হোক।’ নোলা বেয়ে পানি পড়ছে। এরা, এই বাংলাভাষী রাজাকাররা কি জানত না তাদের অবাঙালি প্রভুরা তাদের কোন দৃষ্টিতে দেখে? জানত হয়তো। কিন্তু জানতে চাইত না। আর জানা থাকলেও কিছু মনে করত না। আত্মসম্মান জ্ঞান ছিল না। সেই জ্ঞান থাকলে মানুষ কুকুর হয় কী করে? দালাল এ দেশে আগেও ছিল, এখনো আছে, কিন্তু একাত্তরে তারা যেমন ভয়াবহ ও ব্যাপক হয়ে উঠেছিল, তেমন বোধ করি আগে কখনো ঘটেনি। একাত্তর অনন্যÑ যেমনই মহত্ত্বে, তেমনি কদর্যতায়। মানুষের মনুষ্যত্বের এমন গভীর পরীক্ষা কমই হয়েছে মানুষের ইতিহাসে।
আমরা আগেও জানতাম, নতুন বইটি আরও স্পষ্ট করে প্রমাণ করল যে, ঘাতকদের সর্বাগ্রে ছিল জামায়াতে ইসলামী। ইতিহাসের নির্মম পরিহাস এটি যে, বাংলাভাষী রাজাকার, আলবদর, আল-শামসরা যখন বাঙালিদের হত্যা করছে, তখন তার প্রতিবাদ উঠছে শুনি খোদ পাকিস্তান থেকেই। যে ভুট্টো ছিলেন গণহত্যার উসকানিদাতাদের মধ্যে প্রধান পুরুষ তারই দলের নেতারা বিবৃতি দিয়ে বলেছেন, জামায়াত কাজটা ভালো করছে না। জামায়াতের নেতারা তখন সমানে বলছেন, প্রয়োজন হলে শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে তারা লড়বেন। অর্থাৎ মানুষ মারবেন। শেষ পর্যন্ত অবশ্য লড়েননি তারা। শেষের দিকে অনেকেই আত্মগোপন করেছেন, আরও পরে কেউ কেউ আত্মসমর্পণ করে এবং তার ফলে জেলে গিয়ে বেঁচে গেছেন। আর গোলাম আযমসহ উচ্চপর্যায়ের লড়াকুরা কয়েকজন পালিয়ে গেছেন পশ্চিমে, পাকিস্তানে। সেখানে গিয়েÑ পরিহাস আবারওÑ তারা সমাদর পাননি। বরং পরাজিত সেনাবাহিনীর প্রতি পাকিস্তানবাসীর যে বিরূপতা প্রকাশ পেয়েছিল, তখন তা এদের ওপরও বর্ষিত হয়েছিল। হজ করার নাম করে তারা পাকিস্তান ছেড়ে যেতে যখন উদ্যত হলেনÑ পরিহাসের শেষ নেই, তখন তাদের উড়োজাহাজ থেকে নামিয়ে আনা হয়েছিল। পরে অবশ্য তারা পালাতে পেরেছিলেন, মওদুদীর হস্তক্ষেপের ফলে। হায় মীরজাফর, কে তোমাকে ম্লান করে।
এরা, এই জামায়াতিরা, খোদ পাকিস্তানিদের চেয়েও যে বড় পাকিস্তানি ছিল তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এ অবশ্য স্বাভাবিকও বটে, প্রভুর চেয়ে প্রভুভক্তদের গলাতেই জোর থাকে বেশি, তাদের দায় থাকে প্রভুকে খুশি রাখার, প্রভুর নিজের তো সেই দায় নেই। বেচারা! প্রভুরা বলেছে, উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করতে হবে, প্রভুভক্তরা বলেছে, তা যথেষ্ট নয়, যেখানে যত বাংলা বই আছে হিন্দুদের লেখা ও অপাকিস্তানি মনোবৃত্তিসম্পন্ন তা পুড়িয়ে ছাই করে ফেলা চাই। বলেছে, শিক্ষাব্যবস্থাকে আগাগোড়া বদলে ফেলতে হবে। সেই অনুপ্রেরণায় শিক্ষা কমিটিও গঠিত হয়েছিল। যুদ্ধের ভেতরই। ‘শিক্ষকদের ওপরই সঠিক শিক্ষাদান নির্ভর করছে,’ বলেছে তারাÑ যে বক্তব্য থেকে বোঝা যায় শিক্ষক ও বুদ্ধিজীবীরা কেন বিশেষভাবে লক্ষ্যবস্তু হয়েছিলেন তাদের আক্রমণের। আরও বলেছে, ‘দুষ্কৃতকারীরা নকশালপন্থি ও বামপন্থি শক্তি দ্বারা পরিচালিত’; যে উক্তি ধরিয়ে দেয় তাদের নিজেদের আসল চেহারাটি কি। জামায়াতিরা বলেছে, ‘মুসলমানরা যখন ব্যর্থ হলো তখন আল্লাহ সেনাবাহিনীর মাধ্যমে দেশকে রক্ষা করেছেন।’ এও বলেছে তারা, দেখি আমরা, ‘পূর্ব পাকিস্তানে সাম্প্রতিক গোলযোগ ১৮৫৭ সালে বাংলার বিদ্রোহী আন্দোলনের চেয়ে দশ গুণ বেশি শক্তিশালী।’ বেরিয়ে পড়েছে, লুকাতে পারেনি এ সত্য যে, কেবল ১৯৭১-এ নয়, ১৮৫৭তেও এরা দালাল ছিল। আজকের দালালরা সেদিনকার দালালদেরই বংশধর, যেমন আজকের মুক্তিযোদ্ধারা উত্তরসূরি সেদিনকার মুক্তিযোদ্ধাদের।
মুক্তিযুদ্ধের কবিতাগুলোয় অনেক দৃশ্যের কথা আছে, আছে শব্দের কথাও, এমনকি গন্ধেরও। গন্ধ আছে শ্রমের ও ঘামের, মাটির ও ফুলের, আছে স্বাধীনতার। কিন্তু দালালদের কীর্তিকলাপের যে দুর্গন্ধ তাকে কি তুলে ধরতে পারবেন কবিতায়? বড় কঠিন হবে, কেননা কল্পনা হার মানবে বাস্তবের কাছে। দালাল ও ঘাতকদের তৎপরতার বিবরণ পড়তে গেলে থেকে থেকে বমি আসে। আর দুঃখ হয় এ কথা ভেবে যে, এসব কীর্তিকলাপের যথার্থ উন্মোচন ঘটেনি, বিচার এখনো বাকি। আর পাকিস্তানি সেনাদের তো চলেই যেতে দেওয়া হয়েছে, সাধারণ ক্ষমাও ঘোষণা করা হয়েছে। কে কাকে ক্ষমা করল? মীরজাফরদের কি কেউ কখনো ক্ষমা করেছে? নাকি উপায় আছে ক্ষমা করার? প্রেমের কথা বলি আমরা, কিন্তু ঘৃণাহীন ভালোবাসা বলে তো কোনো কিছু নেই।
য় সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
উৎসঃ আমাদের সময়
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন