রাজনৈতিক ও বিবিধ ব্যস্ততার কারণ গত প্রায় ৩০ মাস নয়া দিগন্ত পত্রিকায় সাপ্তাহিক কলাম লিখতে পারছি না। এ জন্য আমার অন্তর ব্যথিত। তারপরও গুরুত্বপূর্ণ কোনো দিবসে বিবেকের তাড়নায় লিখি। এমন একটি বিষয় বদরের যুদ্ধ। পবিত্র রমজান মাসকে বলা যেতে পারে একটি চিকিৎসার ব্যবস্থাপত্র। পাশাপাশি এটি আখিরাতের কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার ছাড়পত্রও। আজ আমরা আলোচনা করব বদরের যুদ্ধ নিয়ে। যেহেতু এটি ঐতিহাসিক ঘটনা তাই ভুলভ্রান্তি না হওয়াই উচিত। তার পরও অনিচ্ছাকৃত ছোটখাটো ভুলত্রুটি পাঠক ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন এই অনুরোধ রাখছি।
বদরের যুদ্ধের গুরুত্ব ও তাৎপর্য
ইতিহাসে মুসলমানদের সাথে বিভিন্ন সম্প্রদায় বা জাতিগোষ্ঠীর কিংবা বিধর্মীদের যতগুলো যুদ্ধ সঙ্ঘটিত হয়েছে, তার মধ্যে বদরের যুদ্ধ ছিল অত্যধিক গুরুত্বপূর্ণ। কারণ বদরের যুদ্ধ ছিল ইতিহাস নির্ধারণকারী একটি যুদ্ধ। যদি বদরের যুদ্ধে মুসলমানরা পরাজিত হতেন তাহলে দ্বীন ইসলামের ভাগ্যে কী ছিল কিংবা মহান আল্লাহ তায়ালার নাম ডাকার মতো কোনো লোক এই পৃথিবীতে থাকত কি না তা কেবল সেই মহান সৃষ্টিকর্তা ছাড়া আর কারো জানা ছিল না। শত্রুদের দৃষ্টিতে বদরের যুদ্ধ ছিল ইসলাম নামক উদীয়মান বা সবে মাত্র চারা গজাচ্ছে এমন ধর্মটিকে আল্লাহর জমিন থেকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার যুদ্ধ। বদরের যুদ্ধের আরেকটি তাৎপর্য হলো, দ্বীন ইসলাম প্রচার করতে গিয়ে আমাদের প্রিয়নবী হজরত মুহাম্মদ সা:-কে একজন সেনাপতির দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে। বদরের যুদ্ধের তৃতীয় তাৎপর্য হলো, মহান আল্লাহ তায়ালা অদৃশ্য থেকে বিপদের সময় তার প্রিয় বান্দাদের কীভাবে সাহায্য করেন তার জ্বলন্ত প্রমাণ এই যুদ্ধে বিদ্যমান।
বদরের যুদ্ধ ক্ষেত্রের পরিচয়
বদর মূলত একটি জায়গার নাম। মক্কা নগরী থেকে কিছুটা উত্তরে, মদিনা নগরী থেকে কিছুটা দক্ষিণ-পশ্চিমে। প্রায় চৌদ্দশত চল্লিশ বা একচল্লিশ বছর আগে মক্কার কুরাইশদের বাণিজ্য কাফেলা চলাচলের পথ ছিল ‘বদর’ নামক জায়গার পাশে দিয়ে। আধুনিক সৌদি আরবের বদরের যুদ্ধক্ষেত্রটি পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত একটি জনপদ। সেখানে যাওয়া-আসাতে কোনো অসুবিধা নেই। তবে পবিত্র মদিনা নগরী সফর করার সময় হাজীরা বা ওমরাহ-হাজীরা পাঁচ কিলোমিটার দূরে ওহুদের যুদ্ধের ময়দান বেশি দেখতে যান। যৎকিঞ্চিত দূরে হওয়ায়, কম মানুষই বদরের যুদ্ধক্ষেত্র দেখতে যান।
যুদ্ধের প্রেক্ষাপট : কোরাইশদের চিন্তা
মহানবী হজরত মুহাম্মদ সা: মক্কা থেকে হিজরত করে মদিনায় চলে এলেন। তারপর মদিনায় নতুন একটি নগর রাষ্ট্র, নতুন সভ্যতা, সংস্কৃতি, স্বকীয়তা এবং দ্বীন ইসলামের মূল কেন্দ্ররূপে গড়ে তোলার জন্য নিরলস কাজ করে যাচ্ছিলেন। এটি দেখে মক্কার কুরাইশরা ঈর্ষান্বিত হলো। দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে তারা নানা ষড়যন্ত্রের পথ খুঁজতে লাগল। মক্কার কুরাইশরা চিন্তা করল যে, আমরা তো সবাই মিলে মক্কায় তাকে (মুহাম্মদ সা:) দমন করে রাখতে পেরেছিলাম, কিন্তু এখন মদিনায় গিয়ে তিনি নতুনরূপে বাধাহীনভাবে ইসলাম প্রচার করছেন। যদি এভাবে চলতে থাকে, যদি তার এই সংগ্রাম সামনে অগ্রসর হতে থাকে, তাহলে অচিরেই মদিনার মুসলিমরা মক্কার লোকজনের প্রতি হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। অতএব অঙ্কুরেই বিনাশ করা প্রয়োজন।
যুদ্ধের প্রেক্ষাপট : মুসলমানদের চিন্তা
অন্য দিকে মাত্র জন্ম নেয়া মদিনা নামে নগর রাষ্ট্র তথা ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থার ভিত্তি ক্রমবর্ধমান হচ্ছিল। সেখানে মহানবী হজরত মুহাম্মদ সা: এবং তার সাথীরা চিন্তা করলেন, আমরা মক্কা থেকে বেরিয়ে এসেছি সত্য কিন্তু মক্কার হুমকি থেকে আমরা এখনো মুক্ত হতে পারিনি। আমরা এখনো তেমন শক্তি অর্জন করতে পারিনি। তাই আগে আমাদের শক্তি সঞ্চয় করা প্রয়োজন এবং আল্লাহর দ্বীনকে তার জমিনে প্রতিষ্ঠা করতে হলে যুদ্ধের কোনো বিকল্প নেই। মোটামুটি এ ধরনের চিন্তা ভাবনার প্রেক্ষাপটেই মক্কা এবং মদিনা এই দুই শহরকেন্দ্রিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে একটি যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে উঠেছিল। তা ছাড়া পরোক্ষভাবে আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে নির্দেশ এলো যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করার।
যুদ্ধের তাৎক্ষণিক প্রস্তুতি
অবশেষে রাসূল সা:-এর নেতৃত্বে মদিনা থেকে মুসলমানদের একটি দল বের হলেন। তাদের উদ্দেশ্য ছিল সিরিয়াগামী মক্কা নগরীর আরবদের বাণিজ্য কাফেলা যেটা সিরিয়া থেকে ধন সম্পদ নিয়ে মক্কায় ফেরত যাবে তাদের মোকাবেলা করা এবং তাদের কাছ থেকে কিছু সংগ্রহ করা। সেজন্য তারা চলাচলের রাস্তার পাশে ওঁৎ পেতেছিলেন। অন্যদিকে ধন সম্পদ নিয়ে মক্কা নগরীর ব্যবসায়ীদের কাফেলা সিরিয়া থেকে ফেরত যাওয়ার সময় সংবাদ পেল যে, এই পথ ধরে গেলে পথিমধ্যে তাদের বিপদে পড়ার সম্ভাবনা আছে। তাই তারা সবার সিদ্ধান্তক্রমে গতিপথ একটু পরিবর্তন করে মক্কায় যাওয়ার জন্য নতুন পথ আবিষ্কার করল এবং সেই পথ ব্যবহার করে তারা মক্কার কাছাকাছি চলে গেল। কিন্তু ইতোমধ্যে অন্য একটি ঘটনার উদ্ভব হলো। বাণিজ্য কাফেলার অনুরোধে, মক্কা থেকে একদল সৈন্য অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে রওনা দিয়েছিল নিরাপদে বাণিজ্য কাফেলা এগিয়ে নিতে। কিন্তু বাণিজ্য কাফেলা মদিনার মুসলমানদের দৃষ্টি এড়িয়ে চলে গেল, এমনকি মক্কা থেকে আসা সাহায্যকারী লোকদেরও দৃষ্টির অগোচরে চলে গেল। মক্কা থেকে আসা সাহায্যকারী দল যখন বদর নামক স্থানে এসে অবস্থান করছিল তখন তারা সংবাদ পেল মুসলমানরা তাদের আশপাশে আছে। আবার মুসলমানরা বদর নামক স্থানটির কাছেই অবস্থান করেছিলেন, ফলে তারাও জানতে পারলেন যে মক্কা থেকে আগত অস্ত্রেশস্ত্রে সজ্জিত একদল সৈন্য বাহিনী তাদের পাশে অবস্থান করছে।
যুদ্ধক্ষেত্রে অবস্থান গ্রহণ
যুদ্ধটি চূড়ান্তরূপে দেখা দিলো। বদর নামক স্থানে কাফেররা একদিকে অবস্থান নিলো অন্য দিকে মুসলমানরা অবস্থান নিলেন। মুসলমান বাহিনী যে স্থানটিতে অবস্থান নিলেন সেখানে একটি পানির কূপ ছিল। যেহেতু কূপটি মুসলমানদের দখলে সেহেতু কাফেররা পানির সঙ্কট অনুভব করল। কূপের পাশেই একটি পাহাড় সেখানে মুসলমানদের সদর দফতর স্থাপন করা হলো। একটি তাঁবুর বন্দোবস্তু করা হলো যেখানে রাসূলে পাক সা: অবস্থান নিলেন। এলাকাটি ছিল সমতল কিন্তু তিন দিকে ছিল পাহাড়বেষ্টিত।
উভয় পক্ষের শক্তি
বদরের যুদ্ধে মুসলমানদের সৈন্য সংখ্যা আর কাফেরদের সৈন্য সংখ্যা সম্পর্কে ছোটখাটো মতপার্থক্য আছে। তবে যে মতামতটি জোরালোভাবে গ্রহণযোগ্য সেটা এরকম : মুসলমানরা ছিলেন ৩১৩ জন, অপরপক্ষে কাফেরদের সংখ্যা ছিল এক হাজার। মুসলমানদের ৩১৩ জন সাহাবির মধ্যে ৮৫ জন ছিলেন মুহাজির সাহাবি বাকি সবাই ছিলেন মদিনার আনসার। আনসারদের মধ্যে ৬১ জন আওশ গোত্রের আর বাকিরা ছিলেন ৬৯ জন খাজরাজ গোত্রের। পুরো তিনশত তেরো জনের দলে উট ছিল ৭০টি আর ঘোড়া ছিল মাত্র দু’টি। অপরপক্ষে কাফেরদের এক হাজারের দলের ৬০০ জনের কাছে ছিল দেহ রক্ষাকারী বর্ম এবং তাদের কাছে ঘোড়া ছিল ২০০টি।
যুদ্ধক্ষেত্রের মাটি ও পরিবেশ
যুদ্ধক্ষেত্রের অবস্থান এবং পরিবেশের বর্ণনা দেয়া অবশ্যই প্রয়োজন। মুসলমানরা যে স্থানটিতে অবস্থান নিয়েছিলেন সেখানে সূর্যের তেজ সরাসরি তাদের মুখের ওপর পড়ে। কিন্তু কাফেরদের মুখে সূর্যের আলো পড়ে না। মুসলমানরা যেখানে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করবেন সেখানের মাটি একটু নরম যা যুদ্ধক্ষেত্রের জন্য উপযুক্ত নয়। অন্যদিকে কাফেররা যেখানে অবস্থান নিয়েছিল সেখানে মাটি শক্ত এবং যুদ্ধের জন্য উপযুক্ত। কিন্তু অবস্থান নেয়ার ফলে অবশেষে কী হলো? পাঠক খেয়াল করুন যে, হিজরি ক্যালেন্ডারে বা ইসলামের ধর্মীয় হিসাবে তারিখ শুরু হয় মাগরিবের নামাজ থেকে অর্থাৎ রাত আগে আসে, দিন পরে আসে। অপরপক্ষে খ্রিষ্টীয় ক্যালেন্ডারে তারিখ শুরু হয় মধ্য রাতে এবং শেষ হয় মধ্য রাতে। রমজানের ১৭ তারিখের রাত্রি আগে ছিল, ১৭ তারিখের দিন পরে ছিল।
মুসলমানদের মানসিক প্রস্তুতি
পাঠক নিজের মনে মনে অনুভব করুন, আমরা সবাই সেই ১৭ রমজানের রাত্রিতে বদরের যুদ্ধের মাঠে অবস্থান করছি! সেই রাতে উৎকণ্ঠিত মুসলমানরা এবং উৎকণ্ঠিত কাফেররা নিজ নিজ ক্যাম্পে অবস্থান করছেন। সেই রাতে মহান আল্লাহ তায়ালার কাছে সেজদায় পড়ে সাহায্য প্রার্থনা করছেন মানবতার মুক্তির দূত হজরত মুহাম্মদ সা:। কেঁদে কেঁদে বলেছিলেন অনেকটা এরকম : ‘হে দয়াময় আল্লাহ, আগামীকালের নীতিনির্ধারণী যুদ্ধে তোমার সাহায্য আমাদের অতি প্রয়োজন। এই যুদ্ধে আমরা তোমার সাহায্য ছাড়া বিজয় লাভ করতে পারব না। আর আমরা যদি পরাজিত হই হয়তো তোমাকে সেজদা করার কিংবা তোমার নাম ধরে ডাকার লোক এই পৃথিবীতে আর নাও থাকতে পারে। অতঃপর তুমি সিদ্ধান্ত গ্রহণ কর কী করবে, কারণ তুমি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার মালিক। আমরা আমাদের জীবন দিয়ে প্রাণপণ য্দ্ধু চালিয়ে যাব। আমরা আমাদের জীবন তোমার পথে উৎসর্গ করলাম। বিনিময়ে তোমার দ্বীনকে আমরা তোমার জমিনে প্রতিষ্ঠা করতে চাই। তুমি আমাদেরকে বিজয় দান করো। আমরা তোমার কাছেই সাহায্য চাই।’ রাসূল সা:-এর আন্তরিক আকুতি মিনতি মহান আল্লাহর কাছে কবুল হয়ে গেল।
ব্যতিক্রমী ঘটনার ইতিবাচক ফল
হজরত জিবরাইল আ:-এর মাধ্যমে আল্লাহর পক্ষ থেকে জবাব এলো, সাহায্য আসবে, তোমরা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হও, তোমাদের শির উঁচু কর এবং দৃঢ় পদক্ষেপে দাঁড়াও।
পবিত্র কুরআনের সূরা আনফালের ৯নং আয়াতে মহান আল্লাহ তায়ালা এই ঘোষণাটি দিয়েছেন। ওই রাতে মরুভূমিতে প্রবল বৃষ্টি হলো। যেটি একটি ব্যতিক্রমী ঘটনা। বৃষ্টি মুসলমানদের উপকারে লাগল। কারণ বৃষ্টির কারণে কাফেরদের যুদ্ধের মাঠের শক্ত মাটি কাদায় ভরে পিচ্ছিল হয়ে গেল। অন্য দিকে মুসলমানদের যুদ্ধের মাঠ শক্ত হয়ে গেল। বৃষ্টির কারণে আবহাওয়া শীতল হলো উৎকণ্ঠিত উদ্বিগ্ন মুসলমানদের চোখে তন্দ্রাচ্ছন্নভাবে প্রশান্তি এসে গেল। আরো একটি ঘটনা যেটি মহান আল্লাহ তায়ালা ঘটিয়েছেন; কাফেররা যখন মুসলমানদের ক্যাম্পের দিকে তাকাচ্ছিল ঠিক তখন কাফেরদের চোখে মুসলমানদের ক্যাম্প অনেক বড় মনে হচ্ছিল। তারা চিন্তায় পড়ে গেল এত মুসলমান কোত্থেকে এলো! আবার মুসলমানরা যখন কাফেরদের ক্যাম্পের দিকে তাকাচ্ছিল তখন কাফেরদের ক্যাম্প মুসলমানদের চোখে অনেক ছোট মনে হচ্ছিল এবং তারা ভাবতে লাগল কাফেররা তো তেমন বেশি না, আগামীকালকের যুদ্ধে এদের আমরা পরাজিত করতে পারব। অতঃপর এমন মনে হচ্ছিল যে মুসলমানদের চোখে দেখা দিয়েছিল অন্য এক স্বপ্ন যে আমরা তাদের সমান সমান। আর এ ধরনের চিন্তাচেতনা মহান আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে মুসলমানদের মনে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছিল যাতে করে মুসলমানরা তাদের মনোবল হারিয়ে না ফেলে।
১৭ রমজানের যুদ্ধ এবং আল্লাহর সাহায্য
অতঃপর দিনের বেলায় যুদ্ধ শুরু হলো। প্রথমে তিনজন করে উভয় পক্ষ থেকে এলো এবং কাফেরদের তিনজনই মৃত্যুবরণ করল। অতঃপর কথা মোতাবেক উন্মুক্ত প্রান্তরে উন্মুক্তভাবে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। সেই আমলের যুদ্ধের অস্ত্র হতো তরবারি, তীর ধনুক, বর্ম, বল্লম ইত্যাদি। মুসলমানরা প্রাণপণ যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন। মহান আল্লাহ তায়ালা তার প্রতিশ্রুতি মোতাবেক মুসলমানদের সাহায্যের জন্য ফেরেশতা পাঠিয়ে দিলেন। সাধারণত ফেরেশতারা মানুষের চোখের অদৃশ্য থাকে। কিন্তু যুদ্ধের পর সাহাবিরা সাক্ষ্য দিলেন যে, আমরা মানুষ দেখিনি তথা পরিচালনাকারী দেখিনি কিন্তু আমরা দেখিছি দীর্ঘ আকৃতির তরবারি যেগুলো শত্রুপক্ষকে ঘায়েল করছিল।
আবার আরেকটি পর্যায়ে যুদ্ধ চলাকালে জিবরাইল আ: এসে মহানবী সা:-কে জানালেন যে, হে আল্লাহর রাসূল, আপনি আপনার হাতে একমুষ্টি ধুলা নিন আর শাহাদাত আঙ্গুল ইশারা করে কাফেরদের দিকে ছুড়ে দিন। রাসূল সা: এক মুষ্টি ধুলা তার হাতে নিলেন এবং শত্রুপক্ষের দিকে নিক্ষেপ করলেন। সম্মানিত পাঠককুল বিষয়টি আসলেই আশ্চর্যের।
আমরা চাইলেই একমুষ্টি ধুলা কিংবা বালি হাতে নিয়ে এ কাজটি করতে পারি। শিশুরা খেলার মাঠে দুষ্টামি করে এ কাজ করে থাকে। কিন্তু চিন্তা করার বিষয় হলো, একমুঠ ধুলা যদি কেউ কারো দিকে ছুড়ে দেয় তাহলে তা কতদূর উড়ে যাবে? কিন্তু অসংখ্য প্রমাণে এসেছে, সেই বদরের মাঠে রাসূলের ছুড়ে দেয়া ধুলা সেদিন অনেকদূর পর্যন্ত গেছে এবং সব কাফেরের চোখে মুখে নাকে গিয়ে লেগেছে। এ ছাড়া পবিত্র কুরআনের সূরার মাধ্যমে মহান আল্লাহ তায়ালা সাক্ষ্য দিয়ে বলেছেন, হে রাসূল সেদিন সেই ধুলা আমি সবার চোখে পৌঁছে দিয়েছি। আপনি কেবল নিক্ষেপ করেছেন। এর কারণ ছিল কাফেররা যেন ভালোভাবে তাদের যুদ্ধের অবস্থান না দেখতে পারে এবং অতি দ্রুত ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যায়; এমনকি বলা হয়েছে তারা তাদের হাতের অস্ত্র ছেড়ে চোখ কচলাতে শুরু করেছিল। একটু চিন্তা করলে দেখা যায়, যদিও আমরা জাগতিক দৃষ্টিতে দেখলাম ধুলাগুলো রাসূল সা: তার হাত দিয়ে ছুড়েছেন কিন্তু এই একমুষ্টি ধুলা কীভাবে শত্রু বাহিনীর চোখে গেল? তাই বলতে হচ্ছে, এটি স্বাভাবিক দৃষ্টিতে সম্ভব নয়, এটি স্বয়ং আল্লাহ ঘটিয়েছেন। আর এটিই হলো ঐশী বা গায়েবি সাহায্য। পবিত্র কুরআনের আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন, সেই ধুলা আমি তাদের কাছে পৌঁছিয়েছি।
হাদিসের বর্ণনা ও ফেরেশতা
বোখারি শরিফের হাদিস মোতাবেক, যুদ্ধ শেষে সাহাবিদের কেউ কেউ সাক্ষ্য দিয়েছেন যে, আমরা সাদা পোশাক পরা কিছু ব্যক্তিকে আমাদের পাশে দাঁড়িয়ে য্দ্ধু করতে দেখিছি। তাদেরকে আমরা যুদ্ধের আগে কখনো দেখিনি এমনকি পরেও দেখিনি। আবার কিছু সাহাবি বলেছেন, আমরা তরবারি ব্যবহারকারীকে দেখছি না কিন্তু তরবারিটি দেখছি। তাদের তরবারিগুলো আমাদের তরবারির চেয়ে অনেক লম্বা এবং সেগুলো শত্রুপক্ষকে ঘায়েল করছিল। মূলত তারা ছিল আল্লাহর প্রেরিত ফেরেশতা। মুসলমানদের হয়ে বদরের প্রান্তরে তারা যুদ্ধ করেছিলেন। যুদ্ধ শেষে দেখা গেল, কাফেরদের মধ্যে থেকে ৭০ জন নিহত হয়েছে এবং ৭০ জন বন্দী হয়েছে। অন্যদিকে মুসলমানদের মধ্যে থেকে শহীদ হয়েছিলেন ১৪ জন। তার মধ্যে ছয়জন ছিলেন মোহাজের, আটজন আনসার সাহাবি।
পাঠক খেয়াল রাখুন, পবিত্র কুরআনের আয়াত নাজিল হয়েছিল যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই, যেখানে মহান আল্লাহ বলেছিলেন, আমি ফেরেশতা পাঠিয়ে তোমাদের সাহায্য করব। অপরপক্ষে মক্কাবাসী কাফেরদের পক্ষে যুদ্ধ করার জন্য অভিশপ্ত ইবলিশও এসেছিল সেদিন। আর ইবলিশ এসেছিল সোরাকা নামক একজন ব্যক্তির আকৃতি ধরে। কিন্তু মক্কাবাসী পৌত্তলিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের মাঠে নেমে যখন সেই ইবলিশ দেখল আল্লাহর ফেরেশতারা মুসলমানদের পক্ষ হয়ে যুদ্ধরত মাঠে বিদ্যমান, ঠিক তখন ইবলিশ পালিয়ে যেতে লাগল। কাফেরদের মধ্য থেকে কেউ একজন বলে উঠল, সোরাকা তুমি কোথায় যাচ্ছ? সোরাকা তুমি কি বলোনি যে, তুমি আমাদের সাহায্য করবে? আমাদের কাছে থেকে দূরে সরে যাবে না? সে সময় ইবলিশ (ছদ্মবেশে সোরাকা) বলল, আমি এখানে এমন কিছু দেখতে পাচ্ছি যা তোমরা দেখতে পাও না। আল্লাহকে আমার ভয় হচ্ছে, তিনি কঠোর শাস্তিদাতা। এরপর ইবলিশ আত্মগোপন করেছিল।
শিক্ষণীয় : আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল
বদরের যুদ্ধ ছিল মুসলমানদের জন্য প্রথম সমন্বিত এবং যতটুকু সম্ভব পরিকল্পিত যুদ্ধ। যুদ্ধের ময়দানে সুবিধাজনক অবস্থান নেয়া, পানির উৎস নিয়ন্ত্রণে রাখা, সূর্যের আলোর গতিবেগ লক্ষ করে সৈন্যদের দাঁড় করানো এবং যুদ্ধের আগে শত্রু দলের চার পাশ পর্যবেক্ষণে রাখা ইত্যাদি বিষয় শিক্ষণীয়। সবচেয়ে বড় শিক্ষণীয় বিষয় ছিল অজাগতিক তথা সব কিছুর জন্য আল্লাহর ওপর ভরসা বা তাওয়াক্কুল করা।
তাওয়াক্কুলের সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যায় আমরা বলতে পারি, নিজের দ্বারা সম্ভব সর্বপ্রকার প্রস্তুতি গ্রহণ করা হবে কিন্তু সাফল্যের জন্য সে প্রস্তুতির ওপর নির্ভর করা যাবে না, সাফল্যের জন্য নির্ভর করতে হবে একমাত্র আল্লাহ তায়ালার ওপর। বদরের যুদ্ধে মুসলমানরা জয়ী না হলে কী হতে পারত সেটি কল্পনা করার প্রয়োজন নেই। আল্লাহ তায়ালার অশেষ দয়া আর মেহেরবানির বদৌলতে মুসলমানদের অগ্রযাত্রার ভিত্তি সুদৃঢ় হয়েছিল এবং বদরের যুদ্ধের মাধ্যমে নতুন ইতিহাসের সৃষ্টি হয়েছিল। আজ চৌদ্দশ একচল্লিশ বছর পর বিশ্বের সর্বস্তরের মুসলমানরা সেই অকুতোভয় সৈনিকদের স্মরণ করবেন এবং নিজেরাও প্রয়োজনে বদরের যুদ্ধের যোদ্ধাদের মতো ঈমানে বলীয়ান হবেন বলে আশা করি। তবে বদরের যুদ্ধ যেমন ছিল আত্মরক্ষার্থে তেমনি মুসলমানদের সব যুদ্ধ হবে আত্মরক্ষার্থে, সত্যের অনুকূলে, নির্যাতিত-নিপীড়িতদের অনুকূলে এবং কল্যাণ কামনায়।
লেখকের পক্ষ থেকে আহ্বান
বদরের যুদ্ধ সঙ্ঘটিত হয়েছিল হিজরি দ্বিতীয় সালে রমজান মাসের ১৭ তারিখ। আজ ১৪৪৪ হিজরি সালের ১৭ রমজান আমাদের কাছে উপস্থিত- সেই বদরের কথা স্মরণ করিয়ে দিতে। আমি আশা ও প্রার্র্থনা করব মুসলিম সমাজের কাছে, ১৭ রমজান আপনারা বদরের যুদ্ধ নিয়ে আলোচনা করবেন, দোয়া করবেন এবং ওই যুদ্ধের শহীদদের রূহের মাগফিরাত কামনা করবেন, যারা দ্বীন ইসলামকে আল্লাহর জমিনে টিকিয়ে রাখার জন্য সবার আগে জীবন দিয়েছিলেন।
লেখক : মেজর জেনারেল (অব.); চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি
উৎসঃ নয়াদিগন্ত
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন