কারবালার শিক্ষা ও ভাইরাসবিরোধী সংগ্রাম - প্রতীকী ছবি
ধারাবাহিক পাঠের আহ্বান
আমার লেখা গত কলামটির শিরোনাম ছিল ‘চারটি ভাইরাসের গল্প’। চারটি ভাইরাস ছিল নিম্নরূপ। একটির নাম নির্বাচন লুণ্ঠনের ভাইরাস, একটির নাম নারী-পুরুষের কলঙ্কের ভাইরাস, একটির নাম দুর্নীতির ভাইরাস এবং শেষটির নাম করোনাভাইরাস। কলামটি মূলত রাজনৈতিক ছিল। সেই কলামের ধারাবাহিকতায় আজকের কলাম। পাঠকের কাছেও আবেদন, ধারাবাহিকভাবে পড়তে। অর্থাৎ যেহেতু বাংলাদেশের রাজনীতির একটি কঠিন সময়ে কলামগুলো লিখছি, সেহেতু আবেদন করব, যারা রাজনীতিতে আগ্রহী বা রাজনীতি নিয়ে ভাবেন, তারা যেন কিঞ্চিৎ সময় ও মনোযোগ এ বিষয়টির দিকে দেন। রাজনীতির অন্যতম প্রধান অংশ দেশ শাসন; ভালো রাজনীতির সুফল হলো, দেশের সুশাসন। বাংলাদেশে সুশাসনের ঘাটতি দৃশ্যমান। তাই শুধু শাসক বদলানো একমাত্র লক্ষ্য নয় বা অপরিহার্য লক্ষ্য নয়; সুশাসন ফিরিয়ে আনাটাই হচ্ছে অপরিহার্য লক্ষ্য; দেশের জন্য জীবন-মৃত্যুসম একটি লক্ষ্য। এই লক্ষ্য অর্জনে বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বের পক্ষ থেকে যে সাহসী ভূমিকা ও যে ত্যাগ স্বীকার প্রয়োজন, সেটির শিক্ষা আমরা কারবালার ঘটনা থেকে নিতে পারি। এই উদ্দেশ্যেই কারবালার ঘটনা এবং সাম্প্রতিক বাংলাদেশের মধ্যে একটি সেতুবন্ধ রচনা করব, এই কলামের শেষাংশে।
১০ মহররমের গুরুত্ব
বাংলাদেশে অনুসৃত হিজরি ক্যালেন্ডার মোতাবেক, এ বছর ১০ মহররম হচ্ছে শুক্রবার ২০ আগস্ট তথা ৫ ভাদ্র ১৪২৮ বাংলা। মহররম মাসের ১০ তারিখ, দ্বীন ইসলামের ইতিহাসের আঙ্গিকে অনেকগুলো কারণে গুরুত্বপূর্ণ হলেও, আমাদের আবেগে, চিন্তায় চেতনায় কারবালার ময়দানের ঘটনাটি সবচেয়ে বেশি উজ্জ্বল। তাই আজকের কলামের বৃহদংশ, ৬১ হিজরি সালে সঙ্ঘটিত, কারবালার ময়দানের শোকাবহ ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত। কারবালার ময়দানের ঘটনার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেয়ার পর বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতির সাথে একটু মিলাব।
প্রেক্ষাপট : হজরত আলী এবং হজরত মুআবিয়ার মতপার্থক্য
হজরত আলী রা: ৬৫৬ সালের ২৪ জুন তথা ৩৫তম হিজরি বছরের ২৫ জিলহজ মদিনার মসজিদে উপস্থিত মুসলমানদের আনুগত্য গ্রহণকরত খলিফার দায়িত্ব পালন যখন শুরু করেছিলেন, তখন কিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি তাঁর এই দায়িত্ব গ্রহণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে গ্রহণ করেননি। উদাহরণস্বরূপ ওইরূপ তিনজন ব্যক্তির নাম- এক. মিসরের তৎকালীন শাসনকর্তা আবদুল্লাহ বিন সাদ বিন সবুর; দুই. সিরিয়ার তৎকালীন শাসনকর্তা ও বিশিষ্ট সাহাবি হজরত মুআবিয়া বিন আবু সুফিয়ান এবং তিন. তৃতীয় খলিফা হজরত উসমান রা:-এর মন্ত্রণা সচিব, হজরত মুআবিয়ার দূরের চাচাতো ভাই মারওয়ান বিন হাকাম। দায়িত্ব গ্রহণের কয়েক মাসের মধ্যেই একটি বিদ্রোহ বা যুদ্ধ মোকাবেলা করতে হয় ইতিহাসে যাকে বলা হয় ‘উটের যুদ্ধ’। অতঃপর আলী রা: চেলডিয়া ও মেসোপটেমিয়ায় বিদ্রোহ দমন করেন। এগুলো শেষ হতে না হতেই সিরিয়ার শাসনকর্তা হজরত মুআবিয়া বিদ্রোহ শুরু করেন। এরূপ প্রেক্ষাপটে তিনি প্রশাসনিক রাজধানী মদিনা থেকে বর্তমান ইরাকের কুফা নামক স্থানে স্থানান্তর করেন। মুআবিয়া কর্তৃক উসকিয়ে দেয়া যুদ্ধের একপর্যায়ে, একটি সন্ধি হয় ‘মুআবিয়া-পক্ষের সাথে’। ৬৬১ সালে তথা ৪০তম হিজরি বছরের ১৭ রমজান রাজধানী শহর কুফায় হজরত আলী রা: আততায়ীর আক্রমণে শাহাদতবরণ করেন। কুফা শহরের পাশ দিয়ে ফোরাত নদী বহমান ছিল। কুফা শহরের অদূরে, শহর রক্ষা বাঁধের পাশে নদীর তীরে হজরত আলী রা:কে সমাহিত করা হয়েছিল; সেই স্থানটি এখন সমৃদ্ধ নাজাফ শহর।
হজরত হাসান রা: এবং হুসাইন রা:
হজরত আলী রা: শাহাদতবরণের পর, তাঁর বড় ছেলে হজরত হাসান (অর্থাৎ হুসাইন রা:-এর বড় ভাই) ৩৬ বছর বয়সে ৪০ হিজরিতে ইরাক প্রদেশে খলিফা নির্বাচিত হন এবং সেখান থেকেই হিজাজ এবং খোরাসান প্রদেশও শাসন করতেন। অভিযোগ, তাঁর শাসনকালের চার মাসের মাথায়, তৎকালীন অপর শাসনকর্তা মুআবিয়া কর্তৃক পুনরায় যুদ্ধ উসকিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত উভয় পক্ষের মধ্যে সন্ধি হয়। সন্ধির অন্যতম শর্ত মোতাবেক, হজরত হাসান রা: মুআবিয়ার অনুকূলে খিলাফত ত্যাগ করে, ক্ষমতা পরিত্যাগ করে মদিনায় চলে যান। সন্ধির অপর শর্ত ছিল, মুআবিয়ার মৃত্যুর পর হজরত হাসান রা:-এর ছোট ভাই ইমাম হুসাইন রা: খলিফা নির্বাচিত হবেন। ৬৮০ সালে মুআবিয়ার মৃত্যু হলে, তাঁর পুত্র ইয়াজিদ পিতা কর্তৃক সম্পাদিত চুক্তি মান্য করতে অস্বীকৃতি জানান এবং নিজেই ক্ষমতা গ্রহণ করেন। তৎকালীন মুসলিম উম্মাহর মধ্যে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মতে, উম্মাহর ধর্মীয় নেতা ও ইসলামী রাজ্যের শাসনকর্তা তথা খলিফা হওয়ার কোনো প্রকার চারিত্রিক, নৈতিক, শিক্ষাগত যোগ্যতাই ইয়াজিদের মধ্যে ছিল না। এ কারণে হজরত আলী রা: এবং ইমাম হাসান রা:-এর ইরাকি সমর্থকরা ইয়াজিদ বেআইনি ও অনিয়মিত বা প্রথাবহির্ভূত পদ্ধতিতে ক্ষমতায় আরোহণ করায়, ইয়াজিদের প্রতি বিদ্রোহী হয়ে ওঠেন।
ইমাম হুসাইন রা:
কারবালার যুদ্ধে যিনি নিষ্ঠুর পরিস্থিতির শিকার হয়ে শাহাদতবরণ করেছিলেন, তিনি ছিলেন আমাদের প্রিয় নবী, রাহমাতাল্লিল আলামিন হজরত মুহাম্মদ সা:-এর অতি প্রিয় ও স্নেহের কনিষ্ঠ নাতি বা দৌহিত্র হজরত ইমাম হুসাইন বা হোসেন রা:। তিনি চতুর্থ হিজরির ৫ শাবান মোতাবেক ৬২৬ সালের ৫ জুন জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর বাবা ছিলেন মহানবী সা:-এর আপন চাচাতো ভাই এবং ইসলামের চতুর্থ খলিফা হজরত আলী রা:। তাঁর মা ছিলেন রাসূল সা:-এর কন্যা হজরত ফাতেমা রা:।
হুসাইন রা: দায়িত্ব নেয়ার প্রেক্ষাপট
এরূপ ঘটনাবলির সময় ইমাম হুসাইন রা: অস্থায়ীভাবে পবিত্র মক্কা নগরীতে অবস্থান করছিলেন। সঙ্কটপূর্ণ পরিবেশ ও পরিস্থিতিতে কুফাবাসীর উপর্যুপরি আমন্ত্রণ ও আনুগত্যের আশ্বাসে ইমাম হুসাইন রা: মুসলমানদের পক্ষে নেতৃত্ব গ্রহণ করতে সম্মত হন। ওই সময়, কোনো কর্মপন্থা সুনিশ্চিতভাবে অবলম্বন করার আগে ইমাম হুসাইন রা: তাঁর একজন জ্ঞাতি ভাইকে (মুসলিম ইবনে আকিল) পরিস্থিতি যাচাই করার জন্য ইরাকের কুফা নগরীতে পাঠালেন। সেখানে হাজার হাজার মুসলমান, মুসলিম ইবনে আকিলকে সাক্ষী রেখে ইমাম হুসাইন রা:-এর প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। সেই হাজার হাজার মুসলমানের দাবির পরিপ্রেক্ষিতেই, জ্ঞাতি ভাই মুসলিম ইবনে আকিল ইমাম হুসাইন রা:কে পত্র লেখেন, তিনি যেন মক্কা ত্যাগ করে ইরাক চলে আসেন। ইতোমধ্যে ইয়াজিদের খ্রিষ্টান উপদেষ্টাদের পরামর্শ মোতাবেক, ইয়াজিদ জনৈক ওবায়দুল্লাহ বিন জিয়াদকে কুফার শাসনকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেন। দায়িত্ব নিয়েই, ওবায়দুল্লাহ বিন জিয়াদ তাৎক্ষণিকভাবে মুসলিম ইবনে আকিলকে বন্দী ও হত্যা করে। এই বন্দী ও হত্যা করার বিষয়টি ইমাম হুসাইন রা: জানতে পারেননি। কুফাবাসীর আমন্ত্রণেই খলিফা হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার লক্ষ্যে, ইমাম হুসাইন রা: রাজধানী কুফা শহরের উদ্দেশে, ৬০ হিজরি সালের জিলহজ মাসের ৩ তারিখে মক্কা ত্যাগ করে রওনা হয়েছিলেন। কারণ স্বেচ্ছাচারী শাসনের অভিশাপ থেকে মুক্তি দেয়ার জন্য যেসব মুসলমান ইমাম হুসাইন রা:-এর কাছে সাহায্য চেয়েছিলেন, তাদেরকে সাহায্য করা তিনি কর্তব্য বলে মনে করেছিলেন। কুফার উদ্দেশ্যে অগ্রসরমান, ইমাম হুসাইন রা:-এর দলটি ছিল অতি ক্ষুদ্র তথা পরিবার-পরিজন এবং পরিবারের সাথে সম্পর্কিত ব্যক্তিদের সমন্বয়ে একটি ক্ষুদ্র ৭০ বা ৭১ বা ৭২ সদস্যবিশিষ্ট দল। এটা কোনো অবস্থাতেই, কোনো যুদ্ধ-দল বা যুদ্ধের কন্টিনজেন্ট নয়।
কারবালার প্রান্তরে বাধ্যতামূলক অবস্থান
কুফা আসার পথেই এই দলটি ওবায়দুল্লাহ বিন জিয়াদের অশ্বারোহী বাহিনীর নজরদারিতে পড়ে। এই অশ্বারোহী বাহিনী ইমাম হুসাইন রা:-এর দলকে অগ্রযাত্রা বন্ধ করতে আহ্বান জানায় এবং ইয়াজিদের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করতে দাবি জানায়। কিন্তু ইমাম হুসাইন রা: এই দাবি মানতে অস্বীকার করেন। কারণ এই দাবি মেনে নেয়ার অর্থই ছিল অন্যায় ও অসত্যের সাথে, স্বেচ্ছাচারিতার সাথে আপস করা তথা নতিস্বীকার করা। শেষ পর্যন্ত ফোরাত নদীর তীরে কারবালার প্রান্তরে হুসাইন রা:-এর দল অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। ফোরাত নদীর ইংরেজি নাম ইউফ্রেটিস। এই ফোরাত নদীর তীরে তখনকার আমলের কারবালা প্রান্তর ছিল ধু-ধু মরুভূমি। এখানে শত্রুপক্ষ ইমাম হুসাইন রা: এর দলকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করার নিমিত্তে, ফোরাত নদীর পানি ব্যবহার করার সব পথ বন্ধ করে দেয়। পরবর্তী কয়েকটি দিন ছিল শ্বাসরুদ্ধকর এবং একতরফা শক্তি প্রদর্শনের চরম নমুনা। অবরুদ্ধ অবস্থায় ইমাম হুসাইন রা:-এর দল, কুফা থেকে সাহায্যকারী বা সমমনা দল আশা করেছিল। কিন্তু কুফা থেকে অনুগত মুসলমান বাহিনীও বিভিন্ন কারণে তথা কুফাতে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে, ইমাম হুসাইন রা:কে সাহায্য করার জন্য কারবালার উদ্দেশে রওনা হতে পারেনি। এরূপ পরিস্থিতিতেই, ১০ মহররম ৬১ হিজরি সকালে, উমার ইবনে সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস চার হাজার উমাইয়া সৈন্যের সেনাপতি হিসেবে, ইমাম হুসাইন রা:-এর মাত্র ৭০ বা ৭২ সদস্য সংবলিত দলের বিরুদ্ধে মুখোমুখি দণ্ডায়মান হন। আত্মসমর্পণে আবারো অস্বীকৃতি জানানোর পর, উমাইয়া বাহিনী ইমাম হুসাইন রা:-এর ক্ষুদ্র দলকে আক্রমণ করে। ফলে ইমাম হুসাইন রা: বাহিনীর সবাই শাহাদতবরণ করেন।
আহলে-বাইত
মহানবী সা: এবং তাঁর কন্যা সম্পৃক্ত পরিবারকে সাধারণ ভাষায় ‘আহলে বাইত’ বলা হয়- এটা অতি সম্মানিত সম্বোধন, অতি সম্মানিত বিশেষণ, অতি সম্মানিত পরিচয়। রাসূলুল্লাহ সা:-এর আপন চাচাতো ভাই, কিশোরদের মধ্যে প্রথম ইসলাম গ্রহণকারী, রাসূলুল্লাহ সা:-এর প্রিয় কন্যার স্বামী হজরত আলী রা: এবং তাঁর স্ত্রী মহানবী সা:-এর কন্যা, যাঁকে মুসলিম বিশ্ব ‘মা ফাতিমা’ বলে চেনে, এবং তাঁদের দুই পুত্র তথা রাসূলুল্লাহ সা:-এর অতি প্রিয় নাতি, ইমাম হাসান ও ইমাম হোসাইন রা:, একটি গুচ্ছ। আসমানে ও জমিনে তাঁদের সম্মানের ব্যাখ্যা করা, তাঁদের প্রতি মহব্বতের গুরুত্ব ব্যাখ্যা করা এবং তাঁদের সম্মানে স্মৃতিচারণ করা খুবই কঠিন কাজ এবং আমি নিজে যে তার জন্য যথেষ্ট যোগ্য নই, এতে সন্দেহ নেই। তবে একটি প্রশ্ন, মহানবী সা:-এর প্রিয় দৌহিত্র তথা আহলে বাইতের সদস্য ইমাম হুসাইন রা:-এর পবিত্র রক্ত দিয়ে কেন কারবালার মাটিকে ভেজাতে হলো? সেই প্রশ্নের জাগতিক বা শরিয়তভিত্তিক উত্তর একরকম এবং আধ্যাত্মিক জগতের উত্তর আরেক রকম হওয়াটাই স্বাভাবিক।
সীমাবদ্ধতার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা
কলামের এই স্থানে পুনরায় উল্লেখ করছি যে, খুব বড় ও বিস্তৃত একটি ঐতিহাসিক ঘটনাকে মাত্র তিন-চারটি অনুচ্ছেদে, সারমর্ম করে প্রকাশ করা দুঃসাহসী ও কঠিন কাজ। অতএব আমার ভুলভ্রান্তি মার্জনীয়। ইসলামের প্রথম যুগের যুদ্ধগুলো, কারবালার বীরত্বপূর্ণ কিন্তু শোকাবহ ঘটনা এবং স্পেন বিজয়- এরূপ ১৩টি যুদ্ধ রচনা স্থান পেয়েছে, আমার লেখা একটি বইয়ে। সেই বইয়ের নাম ‘দ্য ব্যাটেলস অব ইসলাম’। এই কলামের কোনো সম্মানিত পাঠক যদি কারবালা সম্বন্ধে বিস্তারিত জানতে চান, মেহেরবানি করে পুস্তকটি পাঠ করুন (পুস্তক অনুসন্ধান : অনন্যা বা রকমারী) অনুরূপভাবে মূল্যায়নও বিস্তৃতভাবে বর্ণনা করা সম্ভব নয়, তাই অতি সংক্ষেপে করছি।
কারবালার আত্মত্যাগ ও সাম্প্রতিক বাংলাদেশ-১
কারবালার ময়দানে ইমাম হুসাইন রা:-এর শাহাদতের ঘটনার মূল্যায়ন করতে গিয়ে ইতিবাচক যে প্রসঙ্গটি সবার আগে বলতে হবে সেটি হলো, বেদনার পাশাপাশি একটি মহিমান্বিত আঙ্গিক আছে। কারণ সত্য ও ন্যায়, সাম্য ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য স্বৈরাচারী ইয়াজিদের বিরুদ্ধে ইমাম হুসাইন রা: যেভাবে বীর বিক্রমে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন, সেই ত্যাগ চিরকাল দেশে দেশে যুগে যুগে এই ধরনের সঙ্কট ও সমস্যা এবং তা উত্তরণের ব্যাপারে অনুপ্রেরণা হয়ে কাজ করবে। কারবালার ময়দানের ঘটনার পরই, ইয়াজিদের ক্ষমতার ভিত নড়ে উঠেছিল। দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া মুসলিম জাতি পুনরুজ্জীবিত হয়েছিল। মুসলমানরা আবার ঘুরে দাঁড়ায়। এই ঘটনা মুসলিম জাতিকে তাদের ভেতরের শত্রু কারা সেটি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে সাহায্য করে।
দক্ষিণ-এশিয়া তথা ভারত-বাংলাদেশ-পাকিস্তান উপমহাদেশে ব্রিটিশরা প্রায় দুই শ’ বছর শাসন করেছে। ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্তি পাওয়ার অর্থ ছিল স্বাধীন হওয়া তথা স্বাধীনতা পুনরুদ্ধার করা। সেই স্বাধীনতার জন্য ১৯০ বছরের ইতিহাসে বিবিধ প্রকারের আন্দোলন ও ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে। মুসলমানরা আন্দোলন করেছে, হিন্দুরা আন্দোলন করেছে, শিখরা আন্দোলন করেছে। এই মুহূর্তে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র; কিন্তু অদৃশ্যভাবে আমাদের স্বাধীনতার উপরে একটি বিদেশী ছায়া আমাদের স্বাধীনতাকে আচ্ছন্ন করে রাখে বলে আমার ব্যক্তিগত মূল্যায়ন। দেশপ্রেম ঈমানের অঙ্গ। তাই পাঠকদের কাছে আবেদন, কারবালার ময়দানের শিক্ষা আমরা যেন গ্রহণ করি।
কারবালার আত্মত্যাগ ও সাম্প্রতিক বাংলাদেশ-২
ইতিহাস সাক্ষী, মুসলমানরা যখনই শত্রু আর মিত্র চিনতে ভুল করেছে তখনই তারা বিপর্যয়ের শিকার হয়েছে। খেলাফতের পর, গত প্রায় চৌদ্দ শত বছরের মুসলিম উম্মাহর ভেতর, দ্বীন ইসলাম রক্ষার যে চেতনা ও শৌর্য-বীর্য আপন মহিমায় ভাস্বর রয়েছে, তার পেছনে কুরআন ও সুন্নাহর পরে ইসলামের ইতিহাসের যে ঘটনাগুলো গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে সক্রিয় হয়েছে, কারবালার ঘটনা তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি উল্লেখযোগ্য। কারবালার ঘটনায় যুদ্ধ হয়েছিল মুসলমানদের মধ্যেই। একপক্ষে তথা শক্তিশালী পক্ষে ছিল মুসলমান নামধারী মুনাফিক, স্বার্থপর, ভোগবিলাসী এবং রাজতন্ত্র অনুরাগী মানুষ। কারবালার ঘটনার মাধ্যমে শাসকরা বিজয়ী হয়েছিল; কিন্তু নন্দিত হতে পারেনি।
অন্যায় করে বিজয় অর্জন করলেও যে নন্দিত হওয়া যায় না, ধিকৃত হতে হয়, কারবালার ঘটনা তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। বর্তমান বাংলাদেশের রাজনীতির অঙ্গনের প্রতি, প্রশাসনের অঙ্গনের প্রতি নিবিড় আলোকপাত করলে আমরা দেখতে পাবো, কারা বাংলাদেশের স্বার্থপরিপন্থী কাজ করছেন, কারা বাংলাদেশের স্বার্থের অনুকূলে কাজ করছেন। পাকিস্তানের এককালীন প্রেসিডেন্ট মার্শাল আইয়ুব খান অনেক কিছু করেছিলেন; কিন্তু নন্দিত হতে পারেননি। কারণ; তিনি গণতন্ত্র হত্যা করেছিলেন, মানবাধিকার বাস্তবায়নে অস্বীকৃতি প্রদান করেছিলেন। আইয়ুব খান ক্ষমতা ছাড়ার সময়, এমন এক ব্যক্তিকে ক্ষমতাসীন করেছিলেন, যিনি ইতিহাসে আইয়ুব খান থেকেও বেশি ধিকৃত বাংলাদেশীদের গণহত্যাকারীদের নেতা হিসেবে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে গণতন্ত্র হত্যাকারী চিহ্নিত হয়েছে, মানবাধিকার লুণ্ঠনকারী চিহ্নিত হয়েছে, গণমানুষের ভোটাধিকার লুণ্ঠনকারী চিহ্নিত হয়েছে। কারবালার শোকাবহ বীরত্বপূর্ণ ঘটনা থেকে শিক্ষা নিতে হবে, অন্যায়কারীর বিরুদ্ধে দাঁড়াতে। আমার এই আহ্বানটি সব পাঠকের প্রতি, কোনো অবস্থাতেই শুধু রাজনৈতিক মহলের প্রতি নয়। আমরা মহররমের প্রথম ১০ দিনের বা অন্তত ১০ মহররমের ধর্মীয় গুরুত্ব বিবেচনা করে সওয়াব হাসিলের জন্য বিবিধ ব্যক্তিগত ইবাদত করব নিঃসন্দেহে; কিন্তু কারবালার ময়দানের মৌলিক শিক্ষাটি যেন না ভুলি, সেটিই আমার আহ্বান।
লেখক : মেজর জেনারেল (অব:); চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি
উৎসঃ নয়াদিগন্ত
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন