করোনাকালে কেন রাজনীতির কথা?
আমার মূল্যায়নে, বাংলাদেশের গণতন্ত্রের উপর মারাত্মক আঘাত হয়েছে অনেকবার এবং প্রত্যেকবারই কোনো না কোনো নিয়মে গণতন্ত্র পুনরুজ্জীবিত হয়েছে। কিন্তু ২৯ ডিসেম্বর ২০১৮ দিবাগত রাতে, যে সর্বশেষ আঘাত গণতন্ত্রের উপর এসেছে, সেটি থেকে পরিত্রাণের কোনো উপায় এখনো চোখে পরিষ্কার ধরা দিচ্ছে না। এই প্রেক্ষাপটেই সংক্ষিপ্তভাবে রাজনৈতিক আলোচনা উপস্থাপন করব; প্রথমে বর্তমানকে নিয়ে আলোচনা করব, আজকের কলাম দিয়ে শুরু এবং আরো একাধিক কলাম ধারাবাহিকভাবে লিখব, আশা করি।
কেউ কেউ বলতে পারেন, দেশের মানুষ যেখানে করোনাভাইরাসের আক্রমণে বিপর্যস্ত, এই বিপর্যয় থেকে বাঁচার জন্য হন্যে হয়ে রাস্তা সন্ধান করছেন, সেখানে রাজনৈতিক আলোচনা করে লাভ কী? সাধারণ মানুষ, খেটেখাওয়া মানুষ, রাজনীতিতে আগ্রহী নয়; পুরো দেশের আর্থ-সামাজিক পরিবেশটাই বিরাজনীতিকরণ করা হয়ে গেছে। আমার মতে, খুবই যুক্তিসঙ্গত ও বাস্তবসম্মত স্বীকৃতি। এর উত্তরে আমার নিবেদন হলো, বর্তমান রাজনৈতিক সরকার কর্তৃক করোনাভাইরাসের আক্রমণ মোকাবেলায় চেষ্টা করে যাচ্ছে সত্য, কিন্তু সে চেষ্টা মার খাচ্ছে সরকারেরই অদূরদর্শিতা ও সমন্বয়হীনতার কারণে। এর জন্য আমাদের দেশের রাজনীতিই দায়ী। চলমান সময়ে আমরা চারটি ভাইরাসে আক্রান্ত। একটির নাম নির্বাচন লুণ্ঠনের ভাইরাস, একটির নাম নারী-পুরুষের কলঙ্কের ভাইরাস, একটির নাম দুর্নীতির ভাইরাস এবং শেষটির নাম করোনাভাইরাস। করোনাভাইরাসের আমলে জনগণের কষ্ট, মানুষের হয়রানি এত বেশি হয়েছে যে, পুরোপুরি বর্ণনা করাও কঠিন। কিন্তু বর্তমান ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক সরকারের মেধা, মনমানসিকতা এর বেশি ভালো কিছু দিতে পারবেন কি না, সেটা নিয়ে নানা জনের নানা মত আছে। করোনাভাইরাসের রেশ এবং এর নেতিবাচক প্রভাবগুলো রাজনৈতিক সরকারকে রাজনৈতিক সুবিধা দিচ্ছে। এই প্রক্রিয়া আগামী দুই-তিন বছর চলবে। তাই আমাদেরকে রাজনীতি নিয়ে আলোচনা করতে হবেই।
গণতন্ত্রের ওপর বিবিধ আঘাত
এই অনুচ্ছেদটি ও পরের অনুচ্ছেদগুলো লেখার অন্যতম উদ্দেশ্য, একান্তই ১৫ বছরের ঊর্ধ্বে ও ৩০ বছরের নিচে বয়সী রাজনৈতিক কর্মী ভাইবোনদের কাছে একটি ধারণা উপস্থাপন করা। আমরা সবাই জানি, সব রাজনৈতিক দলেরই শতকরা প্রায় ৭৫ ভাগ কর্মী তরুণ। অতএব, তরুণগণ অতীত সম্বন্ধে যৎকিঞ্চিৎ ধারণা না রাখলে, বর্তমান ও ভবিষ্যতের রূপরেখা বের করা কঠিন। গণতন্ত্রের ওপর আঘাতের কয়েকটি উদাহরণ নিম্নরূপ। প্রথমবার : ১৯৭৫ সালের জানুয়ারিতে বাকশাল সৃষ্টির মাধ্যমে। দ্বিতীয়বার : ১৯৭৫ এর আগস্ট-এ বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে। তৃতীয়বার : ১৯৮১ সালের মে মাসে প্রেসিডেন্ট জিয়াকে হত্যার মাধ্যমে। চতুর্থবার : ১৯৮২ সালের মার্চ মাসে সামরিক শাসন জারির মাধ্যমে। পঞ্চমবার : ২০০৭ সালের জানুয়ারিতে ওয়ান-ইলেভেন সরকারের আগমনে। ষষ্ঠবার : ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে ভারত সরকারের প্রত্যক্ষ ইন্টারভেনশন-এর মাধ্যমে এরশাদের সহযোগিতায় নির্বাচন। সপ্তমবার : ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে ৩০ তারিখে ভোটের আগের রাতে ভোট লুণ্ঠনের মাধ্যমে।
সংক্ষিপ্ত প্রেক্ষাপট : বিএনপি-আওয়ামী লীগ
১৯৭৮ সালে বিএনপি জন্মলাভ করে, নতুন নির্বাচনে অংশগ্রহণ এবং ক্ষমতাসীন হয়ে বহুদলীয় পার্লামেন্টের সাথে যাত্রা শুরু করেছিল। ১৯৮২ সালের মার্চ মাসে সে যাত্রা স্থগিত হয় কারণ, তৎকালীন বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সামরিক বাহিনীকে ব্যবহার করে, সংবিধান ও সাংবিধানিক রাজনীতি স্থগিত করে, সামরিক আইন জারি করেছিলেন। সামরিক আইন জারির ৪ বছরের মাথায়, জেনারেল এরশাদ বহুদলীয় নির্বাচনের আয়োজন করেছিলেন ১৯৮৬ সালে। জেনারেল এরশাদ নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেছিলেন যার নাম ছিল ‘জাতীয় পার্টি’। ১৯৭৮ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে যেমন নবগঠিত বিএনপি ক্ষমতাসীন হয়ে রাজনৈতিক যাত্রা শুরু করেছিল, তেমনই ১৯৮৬ সালে নবগঠিত জাতীয় পার্টি ক্ষমতাসীন হয়ে রাজনৈতিক যাত্রা শুরু করে। জেনে রাখা প্রয়োজন যে, ১৯৮৬ সালের নির্বাচনটি অবশ্যই বহুদলীয় ছিল। ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী প্রধান তিনটি উল্লেখযোগ্য দল ছিল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের নেতৃত্বাধীন নবগঠিত জাতীয় পার্টি, শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন পুনর্গঠিত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এবং পুনর্গঠিত জামায়াতে ইসলামী। বিএনপি ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেনি। কারণ, বিএনপি এরশাদ সরকারকে পার্লামেন্টারি বৈধতা দিতে আগ্রহী ছিল না। ১৯৮৬ সালে গঠিত পার্লামেন্টটি, বিবিধ আন্দোলনের মুখে ১৯৮৮ সালে ভেঙে দেয়া হয়েছিল। ১৯৮৮ সালের নতুন নির্বাচনে, আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জামায়াত অংশগ্রহণ করেনি; বীর মুক্তিযোদ্ধা আ.স.ম. আব্দুর রব-এর নেতৃত্বাধীন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল বা জেএসডি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিল, সরকারি সৌজন্যে জেএসডি সম্মানজনক সংখ্যক আসন পেয়ে পরবর্তী দুই বছরের কিঞ্চিৎ বেশি সময় পার্লামেন্টের ভেতরে বিরোধী দলের দায়িত্ব পালন করে। ওই সময় থেকে একটি শব্দ বাংলাদেশের রাজনীতিতে সুপরিচিত: ‘গৃহপালিত বিরোধী দল’। বিএনপির নেতৃত্বাধীন একটি রাজনৈতিক জোট, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন একটি রাজনৈতিক জোট, বামধারার রাজনৈতিক দলগুলোর সমন্বয়ে গঠিত একটি রাজনৈতিক জোট এবং জোটগুলোর বাইরে জামায়াতে ইসলামী-এই চারটি রাজনৈতিক শক্তির যুগপৎ আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে সরকারের পতন ঘটেছিল। অবশ্যই উল্লেখ রাখতে হবে যে, এরশাদ সরকার টিকে থাকার জন্য যে অপরিহার্য সেনা-সমর্থন প্রয়োজন ছিল, সে সমর্থনটি ৯০-এর ডিসেম্বরের সেনানেতৃত্ব প্রত্যাহার করে নিয়েছিল এবং ওই প্রত্যাহারের বেনিফিট আন্দোলনকারীগণ পেয়েছিলেন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সেনা-সমর্থন গত পঞ্চাশ বছর যাবৎই দৃশ্যমান। সেই আমল থেকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে চারটি বড় খেলোয়াড় চিহ্নিত হয় যথা আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী এবং জাতীয় পার্টি। বাম দলগুলো অবশ্যই রাজনৈতিক অঙ্গনের ‘গুরুত্বপূর্ণ’ খেলোয়াড় কিন্তু ‘বড়’ খেলোয়াড় হতে পারেনি।
আন্দোলনের স্মৃতিচারণ
১৯৯৪ সাল থেকে নিয়ে, সংবিধানে কেয়ারটেকার পদ্ধতির সরকার বহালের দাবিতে আওয়ামী লীগ ও জামায়াত ভিন্ন ভিন্ন মঞ্চ থেকে ঘোরতর আন্দোলন করেছিল। ১৯৯৬ সালে গঠিত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিএনপি সক্রিয় রাজনীতি করে। আওয়ামী লীগের এই আমলে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি’ স্বাক্ষর এবং বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার প্রক্রিয়া। ২০০১ সালে গঠিত বিএনপি সরকারের আমলে, আওয়ামী লীগ সক্রিয় রাজনীতি করেছে। বিএনপির এই আমলে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ২১ আগস্ট ২০০৪ সালে আওয়ামী লীগের সভায় গ্রেনেড আক্রমণ এবং চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর মোহনার অদূরে দশ ট্রাক অস্ত্র জব্দ করা। সেনাবাহিনীর তৎকালীন প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল মইন ইউ আহমেদের নেতৃত্বে ২০০৭ সালের জানুয়ারি মাসের ১১ তারিখ দীর্ঘমেয়াদি তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। জেনারেল মইন কর্তৃক প্রবর্তিত ব্যবস্থাকে আওয়ামী লীগ পরোক্ষ ভাষায় স্বাগত জানিয়েছিলেন। এই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান করা হয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংকের অন্যতম সাবেক গভর্নর ফখরুদ্দীন আহমেদকে; তাই ইতিহাসে ২০০৭-০৮ সালের সরকারটিকে ‘মইনউদ্দিন- ফখরুদ্দীনের সরকার’ও বলা হয়। এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার যেন দ্রুত চলে যায়, সে দাবি নিয়ে কোনো প্রকারের গুরুত্বপূর্ণ বা ঘোরতর রাজনৈতিক আন্দোলন করার প্রয়োজন হয়নি বা আন্দোলন গড়েও তোলা সম্ভব হয়নি, বিবিধ কারণে। পর্দার অন্তরালে দেশে-বিদেশে, ২০০৮ সালের প্রথম সাত-আট মাসব্যাপী সময়ে, যৎকিঞ্চিৎ সমঝোতার পর, একটি পার্লামেন্টারি নির্বাচনের আয়োজন করা হয়েছিল। সে নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন আছে বিগত ১২ বছর ৭ মাস ধরে। এই ১২ বছর ৭ মাসে আওয়ামী লীগ ভালো কাজ করেছে, মন্দ কাজও করেছে। বর্তমান আওয়ামী শাসনের একেবারে শুরুর দিকে একটি মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছিল ঢাকা মহানগরের পিলখানায় অবস্থিত তৎকালীন বিডিআর-এর সদর দফতরে। তখন মেজর জেনারেল থেকে নিচের দিকে ক্যাপ্টেন-এর র্যাংক পর্যন্ত ৫৭ জন চৌকস পেশাদার সেনা অফিসারকে হত্যা করেছিল বিদ্রোহীগণ বা দুষ্কৃতকারীগণ। বিশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে সুবেদার মেজর নূরুল ইসলামসহ একাধিক সৈনিক শহীদ হয়েছিলেন। কোলেটারেল ড্যামেজ বা সহযোগী ঘটনায় আরো প্রায় তেরো-চৌদ্দজন বেসামরিক কর্মকর্তা কর্মচারী শহীদ হয়েছেন।
আওয়ামী লীগের দ্বিতীয় মেয়াদ
২০১১ সালে আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিল করে দেয়। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের অধীনে ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে বিএনপি নিজে ও তার সাথে জোটবদ্ধ দলগুলোকে নিয়ে পার্লামেন্ট নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। ওই সময় (অর্থাৎ ২০১৩ সালের শেষ-অর্ধেক) আওয়ামী লীগ সরকার অস্থির ছিল; বিভিন্নভাবে কামনা করছিল যেন বিএনপি নির্বাচনে আসে। বিদেশী বা আন্তর্জাতিক আওয়ামী লীগ দলীয় সব চেষ্টা সত্ত্বেও বিএনপি নির্বাচনে আসেনি বা বিএনপিকে নির্বাচনে আনা সম্ভব হয়নি। অধিকন্তু, বিএনপি সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, ওই নির্বাচন প্রতিহত করবে। ‘প্রতিহত’ শব্দটি ব্যবহার না করে যদি বলি, ভোটারগণ যেন অংশগ্রহণ না করেন, সেই আন্দোলন বিএনপি করেছিল। কারণ, ভোটারগণ অংশগ্রহণ না করলে নির্বাচনের নৈতিক ও আইনগত ভিত্তি থাকে না। ভোটারগণকে নির্বাচন থেকে বিরত রাখার কাজে বিএনপি অত্যন্ত সফল হয়েছিল। ২০১৪ সালের জানুয়ারির ৫ তারিখে অনুষ্ঠিত নির্বাচনটি ছিল একান্তই লোকদেখানো কাগজে-কলমে এবং ভোটারবিহীন নির্বাচন। ভোটকেন্দ্রে ভোটার যে যাননি, সেরূপ ছবিতে টেলিভিশনের পর্দা ও পত্রিকার পৃষ্ঠা ভরে গিয়েছিল। ২০১৪ সালের জানুয়ারির নির্বাচনের মাধ্যমে ধারাবাহিক দ্বিতীয় মেয়াদ শুরু করে আওয়ামী লীগ। বিএনপির মূল্যায়নে, আওয়ামী লীগের সে সরকার অবৈধ ছিল অনেকগুলো কারণে। একটি কারণ ছিল, পার্লামেন্টের মোট ৩০০ আসনের মধ্যে, ১৫০টির বেশি আসনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীগণ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিলেন। এই সরকারের পতন ঘটানোর জন্য ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে বিএনপির চেয়ারপারসন, আপসহীন নেত্রী, দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া দেশব্যাপী অবরোধের ঘোষণা দিয়েছিলেন। কিন্তু সরকারের পতন ঘটানো সম্ভব হয়নি। ওই অবরোধকালে বিএনপি ও জামায়াতের হাজার হাজার বা লাখের ওপরে নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে বিবিধ প্রকারের মামলা রুজু হয়েছিল যেগুলো এখনো চলমান এবং গত ছয় বছরে এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আরো হাজার হাজার বা লক্ষাধিক মামলা। সরকার নির্বিঘ্নে দ্বিতীয় মেয়াদ শেষ করেছে।
আওয়ামী লীগের তৃতীয় মেয়াদ
দ্বিতীয় মেয়াদ শেষ করার আগে, বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার নিবিড়ভাবে চিন্তা করে, কী নিয়মে ২০১৮ সালের নির্বাচন নিজেদের আয়ত্তে রাখবে। আঠারো সালের নির্বাচনের আগের দুই-আড়াই বছর ধরেই, আওয়ামী লীগ বহুমুখী নীরব ও সরব এবং দৃশ্যমান ও অদৃশ্যমান, কৌশলগত ও লোকদেখানো, বিভিন্ন প্রশাসনিক, আইনগত ও রাজনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে থাকে। এগুলো নিয়ে আলোচনা আজ করছি না, সংক্ষিপ্তভাবে আগামীতে করব। আমার আলোচনার ফোকাস হচ্ছে, ভবিষ্যৎ নির্বাচন। কিন্তু অতীত সম্বন্ধে কিঞ্চিৎ অবহিত না থাকলে, আগামীতে আওয়ামী লীগ কী করতে পারে, সে ধারণা পাওয়া মুশকিল হবে। তাই অতীত আলোচনা করলাম। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনটিকে নিজেদের অনুকূলে নেয়ার কাজে আওয়ামী লীগ দারুণভাবে সফল হয়েছিল, এটাই বাস্তবতা।
ভালো কাজের জন্য ধন্যবাদ
বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ অত্যন্ত সুপরিচিত এবং ঘরে ঘরে ও জনে জনে উচ্চারিত নাম। এই দু’টি দল ব্যতীত বা এই দুইটির যেকোনো একটি ব্যতীতও বাংলাদেশের রাজনীতি কল্পনা করা অসম্ভব। এই বাস্তবতা মেনে নিয়েই দেশের রাজনীতি অতীতে চলেছে, বর্তমানেও চলছে। উভয় দলই বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে, সংস্কৃতির অঙ্গনে, অবকাঠামোগত উন্নয়নের অঙ্গনে, মুক্তিযুদ্ধকে মহিমান্বিত করার অঙ্গনে, প্রতিরক্ষাব্যবস্থা উন্নত করার অঙ্গনে তথা সার্বিকভাবে উন্নত বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে প্রচুর কাজ করেছে বিধায় বাংলাদেশ আজকে এতটুকু পর্যন্ত এসেছে; তার জন্য উভয় দলকেই অভিনন্দন, ধন্যবাদ।
রাজনৈতিক দলগুলোর শাসনের মেয়াদ
১৯৭২ সালের জানুয়ারি থেকে আজ অবধি সাড়ে পঞ্চাশ বছরের বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে কোন কোন রাজনৈতিক দল কতটুকু শাসন করেছে, তার একটি মোটা দাগের হিসাব উল্লেখ করছি। আওয়ামী লীগ ও বাকশাল দেশ শাসন করেছে ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ এর আগস্ট পর্যন্ত। পুনরায় আওয়ামী লীগ শাসন করেছে ১৯৯৬-২০০১, ২০০৯-২০২১ চলমান (মোট ২৫৫ মাস)। প্রেসিডেন্ট হিসেবে ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক পরিচয়ে ব্যক্তি জিয়াউর রহমান দেশ শাসন করেছেন কমবেশি ১৮ মাস। বিএনপি শাসন করেছে ১৯৭৮ এর শেষাংশ থেকে ১৯৮২ সালের মার্চ পর্যন্ত এবং ১৯৯১-১৯৯৬, ২০০১-২০০৬ পর্যন্ত (মোট ১৬৬ মাস)। প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও প্রেসিডেন্ট পরিচয়ে ব্যক্তি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ চার বছর দেশ শাসন করেছেন (১৯৮২-১৯৮৬) এবং জাতীয় পার্টি দল হিসেবে শাসন করেছে সাড়ে চার বছর (মোট ৫৪ মাস)। সাড়ে পঞ্চাশ বছরের মধ্যে দুই কিস্তিতে সামরিক আইন শাসন বা মার্শাল ’ল ছিল ৮২ মাস। বিভিন্ন প্রকারের তত্ত্বাবধায়ক সরকার দেশ শাসন করেছে ৩৩ মাস। জামায়াতে ইসলামী একা দেশ শাসন করেনি কিন্তু ২০০১-২০০৬ সালে দলটি সরকারের অংশ ছিল এবং তাদের দলীয় দুজন মন্ত্রী দক্ষতা ও সততার আঙ্গিকে সুনামের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। এই অনুচ্ছেদের উপসংহারে মোটা দাগে এতটুকু বলা যায় যে, সাড়ে পঞ্চাশ বছরের মধ্যে যে দল যে আনুপাতিক সময়ে শাসন করেছে, সে দল সে অনুপাতেই সকল কৃতিত্বের অংশীদার হবে এবং সকল ব্যর্থতার দায়ভার নিবে। কিন্তু এই বাক্যটি আমার পক্ষে যত সহজ হয়েছে, সাফল্য ও ব্যর্থতার বিবরণকে অনুপাতের সঙ্গে সমন্বয় করা কোনোমতেই সহজ নয়, অতএব সেদিকে আগাবই না।
আত্মপক্ষ সমর্থন ও ভবিষ্যতের প্রত্যয়
২০২০ সালের এপ্রিল থেকে ২০২১ সালের এই মুহূর্ত পর্যন্ত নয়া দিগন্ত পত্রিকায় খুবই কম কলাম লিখতে পেরেছি; অন্য কোনো পত্রিকায় তো আরো কম। ১৯৯৯ থেকে এ পর্যন্ত যত কলাম লিখেছি, সেগুলোকে বিষয়বস্তুভিত্তিক ভাগ করলে ৬টা ভাগে আনা যাবে (ক) বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি প্রসঙ্গে বা রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে, (খ) বাংলাদেশের রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন আনা প্রসঙ্গে, (গ) জাতীয় নিরাপত্তা, প্রতিরক্ষা ও পার্বত্য চট্টগ্রাম প্রসঙ্গে, (ঘ) ভারত-বাংলাদেশ, মিয়ানমার-বাংলাদেশ প্রসঙ্গে, (ঙ) জাতিগঠন বা ন্যাশন বিল্ডিংয়ের আঙ্গিকে, (চ), ধর্মীয় নীতিকথা বা ইতিহাস বা আচার-আচরণ প্রসঙ্গে। ২০১৪ সালের জুন পর্যন্ত যতগুলো কলাম লিখেছিলাম, তার মধ্য থেকে বেছে বেছে কলাম নিয়ে, বিভিন্ন বছরে মোট ৬টি কলাম সঙ্কলন বের হয়েছে। সর্বশেষ সঙ্কলনটি বের হয়েছে ডিসেম্বর ২০১৪ সালে। ২০১৪ সালের জুন থেকে নিয়ে ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সাম্প্রতিক মাসগুলোতে বিভিন্ন নিয়মে, দেশ-বিদেশে অবস্থিত সচেতন পাঠকসমাজ বিশেষত রাজনৈতিক পাঠকসমাজ যোগাযোগ করে, বারবার অনুরোধ করছেন যেন কলাম লেখা অব্যাহত রাখি, যেন স্থগিত বা বন্ধ না করি। পাঠক সম্প্রদায়ের যুক্তি হচ্ছে, সব লেখকের পক্ষে, সব বিষয়ে, সব সময়, সব পাঠকের বোঝার মতো করে সবকিছু লেখা সম্ভব হয় না। বিভিন্ন লেখক বিভিন্ন বিষয়ে একটা পত্রিকায় লিখলেই, সেই পত্রিকার পাঠকগণ একটি ভারসাম্যমূলক বহুমুখী জ্ঞানভাণ্ডারের সাক্ষাৎ পান। নিজে এই যুক্তিকে অস্বীকার কোনো দিনই করিনি। নয়া দিগন্ত পত্রিকা এরূপ ভারসাম্য আনয়নে সচেতন এবং আল্লাহর রহমতে সফল। সেই প্রক্রিয়া থেকে ১৮ মাস দূরে থেকেছি বিবিধ কারণে। চেষ্টা করতে হবে সম্পৃক্ততা পুনর্বহাল করতে। পাঠকদের দোয়া কামনা করি।
লেখক : মেজর জেনারেল (অব:); চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি
উৎসঃ নয়াদিগন্ত
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন