জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম রচিত ‘মহররম’ কবিতা থেকে উদ্ধৃতি-
ফিরে এল আজ সেই মহরম মাহিনা //
ত্যাগ চাই, মর্সিয়া ক্রন্দন চাহিনা। //
উষ্ণীষ কোরআনের হাতে তেগ আরবীর //
দুনিয়াতে নত নয় মুসলিম কারো শির। //
তবে শোন ঐ শোন বাজে কোথা দামামা //
শমশের হাতে নাও, বাঁধ শিরে আমামা //
বেজেছে নাকাড়া, হাঁকে নকিবের তুর্য্য //
হুঁশিয়ার! ইসলাম ডুবে তব সূর্য্য ... ...।
১০ মহররমের গুরুত্ব
বাংলাদেশে অনুসৃত হিজরি ক্যালেন্ডার মোতাবেক, এ বছর ১০ মহররম হচ্ছে রোববার ৩০ আগস্ট তথা ১৫ ভাদ্র ১৪২৭ বাংলা। মহররম মাসের ১০ তারিখ দ্বীন ইসলামের ইতিহাসে অনেকগুলো কারণে গুরুত্বপূর্ণ হলেও, আমাদের আবেগে, চিন্তাচেতনায় কারবালার ময়দানের ঘটনাটি সবচেয়ে বেশি উজ্জ্বল। তাই আজকের কলামের বৃহদংশ কারবালার ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত।
কারবালা সফর
চাকরি জীবনে এবং অবসর জীবন শুরু হওয়ার পরে ২০০১ পর্যন্ত সময়ে, অনেক দেশে গিয়েছি; সরকারি কাজে, সেমিনার সিম্পোজিয়ামে অংশ নিতে অথবা বেড়াতে। কিন্তু তখন পর্যন্ত ঐতিহাসিক দেশ ইরাকে যাওয়ার সুযোগ হয়নি। ২০০২ সালেই মে মাসে একবার এবং অক্টোবর মাসে আরেকবার, আমার সুযোগ হয়েছিল তখন ইরাক সফর করার। দীর্ঘ দিন যাবত লালিত ইচ্ছা বাস্তবায়িত হয়েছিল তখন গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলো জিয়ারত করা এবং ইতিহাসের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশকে মূল্যায়ন করার। দু’বারই আমাদের দলে মোট তিনজন ছিলাম। প্রথমবার গিয়েছিলাম, ১২ রবিউল আউয়াল তথা ঈদে মিলাদুন্নবী সা: উপলক্ষে বাগদাদ নগরীতে, তৎকালীন সাদ্দাম সরকারের ধর্ম মন্ত্রণালয়ের আয়োজিত আন্তর্জাতিক সেমিনারে অংশগ্রহণ করতে। দ্বিতীয়বার গিয়েছিলাম সাদ্দাম হোসেনের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ভোটের দিন পর্যবেক্ষকের দায়িত্ব পালন করতে। মহান আল্লাহর নিকট অফুরন্ত শুকরিয়া যে, উভয়বারই হজরত ইউনুস আ:-এর সমাধি, হজরত আলী রা:-এর সমাধি, কারবালা নগরীও অন্যান্য ঐতিহাসিক স্থান পরিদর্শন করার জন্য যথেষ্ট সুযোগ পেয়েছিলাম। শুধু পাঠকের মনের ভেতরে ইতিহাসের ধারাবাহিকতা সরল ও স্মরণ রাখার জন্য মনে করিয়ে দিচ্ছি যে, আমাদের দ্বিতীয় সফরের ছয় মাস পরে, ২০০৩ সালের শুরুর দিকে আমেরিকা ইরাক আক্রমণ করেছিল।
ইমাম হুসাইন রা:
কারবালার যুদ্ধে যিনি নিষ্ঠুর পরিস্থিতির শিকার হয়ে শাহাদত বরণ করেছিলেন, তিনি ছিলেন আমাদের প্রিয়নবী, রাহমাতাল্লিল আলামিন হজরত মুহাম্মদ সা:-এর অতি প্রিয় ও স্নেহের কনিষ্ঠ নাতি হজরত ইমাম হুসাইন বা হোসেন রা:। তিনি চতুর্থ হিজরির ৫ শাবান মোতাবেক ৬২৬ সালের ৫ জুন জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর পিতা মহানবী সা:-এর আপন চাচাতো ভাই এবং ইসলামের চতুর্থ খলিফা হজরত আলী রা:। তাঁর মা রাসূল সা:-এর প্রিয় কন্যা হজরত ফাতেমা রা:।
হজরত আলী এবং হজরত মু’আবিয়া
৬৫৬ সালে ৮২ বছর বয়সে, ইসলামের তৃতীয় খলিফা উসমান রা: বিদ্রোহী আততায়ীদের হাতে শহীদ হওয়ার পর হজরত আলী রা: তৎকালীন ইসলামী রাষ্ট্রের খেলাফতের দায়িত্ব নিতে, প্রথমে বিনীতভাবে অস্বীকার করলেও, কয়েকজন বিশিষ্ট সাহাবির অনুরোধে পরে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। উল্লেখ্য এই, কিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি তাঁর এই দায়িত্ব গ্রহণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে গ্রহণ করেননি। উদাহরণস্বরূপ ঐরূপ তিনজন ব্যক্তির নাম : এক. মিসরের তৎকালীন শাসনকর্তা আবদুল্লাহ বিন সা’দ বিন সবুর, দুই. সিরিয়ার তৎকালীন শাসনকর্তা ও বিশিষ্ট সাহাবি হজরত মু’আবিয়া বিন আবু সুফিয়ান এবং তিন. তৃতীয় খলিফা হজরত উসমান রা:-এর মন্ত্রণা সচিব ও হজরত মু’আবিয়ার দূরের চাচাতো ভাই মারওয়ান বিন হাকাম। হজরত আলী রা: ৬৫৬ সালের ২৪ জুন তথা ৩৫তম হিজরি বছরের জিলহজ মাসের ২৫ তারিখে মদিনার মসজিদে উপস্থিত মুসলমানদের আনুগত্য গ্রহণকরত: খলিফার দায়িত্ব পালন শুরু করেন। দায়িত্ব গ্রহণের কয়েক মাসের মধ্যেই একটি বিদ্রোহ বা যুদ্ধ তাঁকে মোকাবেলা করতে হয় ইতিহাসে যাকে বলা হয় উটের যুদ্ধ। অতঃপর তিনি চেলদিয়া ও মেসোপটেমিয়ায় বিদ্রোহ দমন করেন। এগুলো শেষ হতে না হতেই সিরিয়ার শাসনকর্তা হজরত মু’আবিয়া বিদ্রোহ শুরু করেন। এরূপ প্রেক্ষাপটে তিনি প্রশাসনিক রাজধানী মদিনা থেকে ইরাকের কুফা নামক স্থানে স্থানান্তর করেন। মু’আবিয়া কর্তৃক উসকিয়ে দেয়া যুদ্ধের একপর্যায়ে, একটি সন্ধি হয় মু’আবিয়ার পক্ষের সাথে। ৬৬১ সাল তথা ৪০তম হিজরি বছরের ১৭ রমজান রাজধানী শহর কুফায় হজরত আলী রা: আততায়ীর আক্রমণে শাহাদত বরণ করেন। কুফা শহরের পাশ দিয়ে ফোরাত নদী বহমান ছিল। ওই নদীর প্লাবন থেকে কুফা শহরকে বাঁচানোর জন্য একটি শহর রক্ষাবাঁধ নির্মাণ করা হয়েছিল। ওই বাঁধের পাশেই হজরত আলী রা:কে দাফন করা হয়। পরবর্তী সময়ে, ক্রমান্বয়ে ওই স্থানে ‘নাজাফ’ শহর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বর্তমানে নাজাফ মুসলিম বিশ্বের একটি বড় অংশের নিকট অতি পবিত্র স্থান।
হজরত হাসান এবং হুসাইন রা:
হজরত আলী রা: শাহাদত বরণের পর, তাঁর বড় ছেলে হজরত হাসান (অর্থাৎ হুসাইন রা:-এর বড় ভাই), ৩৬ বছর বয়সে ৪০ হিজরিতে ইরাক প্রদেশে খলিফা নির্বাচিত হন এবং সেখান থেকেই হিজাজ ও খোরাসান প্রদেশও শাসন করতেন। তাঁর শাসনকালের চার মাসের মাথায়, তৎকালীন অপর শাসনকর্তা মু’আবিয়া কর্তৃক পুনরায় যুদ্ধ শুরু উসকিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত উভয়পক্ষের মধ্যে সন্ধি হলো। সন্ধির অন্যতম শর্ত মোতাবেক, হজরত হাসান রা: মু’আবিয়ার অনুকূলে খেলাফত ত্যাগ করে, ক্ষমতা পরিত্যাগ করে, মদিনায় চলে যান। সন্ধির অপর শর্ত ছিল, মু’আবিয়ার মৃত্যুর পর হজরত হাসান রা:-এর ছোট ভাই ইমাম হুসাইন রা: খলিফা নির্বাচিত হবেন। ৬৮০ সালে মু’আবিয়ার মৃত্যু হলে, তাঁর পুত্র ইয়াজিদ পিতা কর্তৃক সম্পাদিত চুক্তি মান্য করতে অস্বীকৃতি জানান এবং নিজেই ক্ষমতা গ্রহণ করেন। তৎকালীন মুসলিম উম্মাহর বিশিষ্ট ব্যক্তিগণের মতে, উম্মাহর ধর্মীয় নেতা ও ইসলামী রাজ্যের শাসনকর্তা তথা খলিফা হওয়ার কোনো প্রকার চারিত্রিক, নৈতিক, শিক্ষাগত যোগ্যতাই ইয়াজিদের ছিল না। এই কারণে, হজরত আলী রা: এবং ইমাম হাসান রা:-এর ইরাকি সমর্থকরা ইয়াজিদ বে-আইনি ও অনিয়মিত বা প্রথাবহির্ভূত পদ্ধতিতে ক্ষমতায় আরোহণ করায়, ইয়াজিদের প্রতি বিদ্রোহী হয়ে ওঠেন।
হুসাইন রা. দায়িত্ব নেয়ার প্রেক্ষাপট
এরূপ ঘটনার সময় ইমাম হুসাইন রা: অস্থায়ীভাবে পবিত্র মক্কা নগরীতে অবস্থান করছিলেন। সঙ্কটপূর্ণ পরিবেশ ও পরিস্থিতিতে কুফাবাসীর উপর্যুপরি নিমন্ত্রণ ও আনুগত্যের আশ্বাসে ইমাম হুসাইন রা: মুসলমানদের নেতৃত্ব গ্রহণ করতে সম্মত হন। ওই সময়, কোনো কর্মপন্থা সুনিশ্চিতভাবে অবলম্বন করার আগে ইমাম হুসাইন রা: তাঁর একজন জ্ঞাতি ভাইকে (মুসলিম ইবনে আকিল) পরিস্থিতি যাচাই করার জন্য কুফা নগরীতে পাঠান। সেখানে হাজার হাজার মুসলমান, মুসলিম ইবনে আকিলকে সাক্ষী রেখে ইমাম হুসাইন রা:-এর প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছিলেন। সেই হাজার হাজার মুসলমানের দাবির পরিপ্রেক্ষিতেই, জ্ঞাতি ভাই মুসলিম ইমাম হুসাইন রা:কে পত্রে লেখেন, তিনি যেন মক্কা ত্যাগ করে ইরাক চলে আসেন। ইতোমধ্যে ইয়াজিদের খ্রিষ্টান উপদেষ্টাদের পরামর্শ মোতাবেক, ইয়াজিদ জনৈক ওবায়দুল্লাহ বিন জিয়াদকে কুফার শাসনকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেন। দায়িত্ব নিয়েই, ওবায়দুল্লাহ বিন জিয়াদ মুসলিম ইবনে আকিলকে বন্দী ও হত্যা করে। এই বিষয়টি ইমাম হুসাইন রা: জানতে পারেননি। কুফাবাসীর আমন্ত্রণেই খলিফা হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার লক্ষ্যে, ইমাম হুসাইন রা: রাজধানী কুফা শহরের উদ্দেশ্যে, ৬০ হিজরি সালের জিলহজ মাসের ৩ তারিখে মক্কা ত্যাগ করে রওনা হয়ে গিয়েছিলেন। কারণ, উমাইয়াদের স্বেচ্ছাচারী শাসনের অভিশাপ থেকে মুক্তি দেয়ার জন্য যেসব মুসলমান ইমাম হুসাইন রা:-এর কাছে সাহায্য চেয়েছিলেন, তাদের সাহায্য করা তিনি কর্তব্য বলে মনে করলেন। কুফার উদ্দেশে অগ্রসরমান, ইমাম হুসাইন রা:-এর দলটি ছিল ক্ষুদ্র, তথা পরিবার-পরিজন ও পরিবারের সাথে সম্পর্কিত ব্যক্তিবর্গের সমন্বয়ে একটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র দল। কোনো অবস্থাতেই, কোনো যুদ্ধ-দল বা যুদ্ধের কন্টিনজেন্ট নয়।
কারবালার প্রান্তরে বাধ্যতামূলক অবস্থান
কুফা আসার পথেই এই দলটি ওবায়দুল্লাহ বিন জিয়াদের অশ্বারোহী বাহিনীর নজরদারিতে পড়ে। এই অশ্বারোহী বাহিনী ইমাম হুসাইন রা:-এর দলকে অগ্রযাত্রা বন্ধ করতে আহ্বান জানায়। তারা ইয়াজিদের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করতে দাবি জানায়। কিন্তু ইমাম হুসাইন রা: এই দাবি মানতে অস্বীকার করেন। কারণ, এই দাবি মেনে নেয়ার অর্থই ছিল অন্যায় ও অসত্যের সাথে, স্বেচ্ছাচারিতার সাথে আপস করা তথা নতিস্বীকার করা। শেষ পর্যন্ত ফোরাত নদীর তীরে কারবালার প্রান্তরে হুসাইন রা:-এর দল অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। ফোরাত নদীর ইংরেজি নাম ইউফ্রেটিস। এই ফোরাত নদীর তীরে তখনকার আমলের কারবালা প্রান্তর ছিল ধু-ধু মরুভূমি। এখানে শত্রুপক্ষ ইমাম হুসাইন রা:-এর দলকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করার নিমিত্তে, ফোরাত নদীর পানি ব্যবহার করার সব পথ বন্ধ করে দেয়।
পরবর্তী কয়েকটি দিন ছিল শ্বাসরুদ্ধকর এবং একতরফা শক্তি প্রদর্শনের চূড়ান্ত নমুনা। অবরুদ্ধ অবস্থায় ইমাম হুসাইন রা:-এর দল, কুফা থেকে সাহায্যকারী বা সমমনা দল আশা করেছিলেন। কিন্তু কুফা থেকে অনুগত মুসলমান বাহিনীও বিভিন্ন কারণে তথা কুফার পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে, ইমাম হুসাইন রা:কে সাহায্য করার জন্য কারবালার উদ্দেশে রওনা হতে পারেনি। এরূপ পরিস্থিতিতেই, ১০ মহররম ৬১ হিজরি সকালে, জনৈক উমার ইবনে সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস ৪০০০ উমাইয়া সৈন্যের সেনাপতি হিসেবে, ইমাম হুসাইন রা:-এর মাত্র ৭০ বা ৭২ সদস্যসংবলিত দলের বিরুদ্ধে মুখোমুখি হয়। আত্মসমর্পণে আবারো অস্বীকৃতি জানানোর পর, উমাইয়া বাহিনী ইমাম হুসাইন রা:-এর ক্ষুদ্র দলকে আক্রমণ করে। ইমাম হুসাইন রা: বাহিনীর সবাই শাহাদত বরণ করেন।
কারবালার আত্মত্যাগের মূল্যায়ন
বড় ও বিস্তৃত একটি ঐতিহাসিক ঘটনাকে মাত্র তিন-চারটি অনুচ্ছেদে, সারমর্ম করে প্রকাশ করা দুঃসাহসী ও কঠিন কাজ। অতএব আমার ভুলভ্রান্তি মার্জনীয়। অনুরূপভাবে মূল্যায়নও বিস্তৃতভাবে করতে পারছি না। কারবালার ময়দানে ইমাম হুসাইন রা:-এর শাহাদতের ঘটনার মূল্যায়ন করতে গিয়ে ইতিবাচক যেই প্রসঙ্গ সবার আগে বলতে হবে সেটি হলো, বেদনার পাশাপাশি একটি মহিমান্বিত আঙ্গিক আছে। কারণ, সত্য ও ন্যায়, সাম্য ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য স্বৈরাচারী ইয়াজিদের বিরুদ্ধে ইমাম হুসাইন রা: যেভাবে বীর বিক্রমে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন, সেই ত্যাগ চিরকাল দেশে দেশে যুগে যুগে এ ধরনের সঙ্কট ও সমস্যা উত্তরণের ব্যাপারে অনুপ্রেরণা হয়ে কাজ করবে। কারবালার ময়দানের ঘটনার পরই, ইয়াজিদের ক্ষমতার ভিত নড়ে উঠেছিল। দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া মুসলিম জাতি পুনরুজ্জীবিত হয়েছিল। মুসলমানরা আবার ঘুরে দাঁড়ায়। এ ঘটনা মুসলিম জাতিকে তাদের ভেতরের শত্রু কারা, সেটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে সাহায্য করে। পরবর্তীতেও ইতিহাস সাক্ষী, মুসলমানরা যখনই শত্রু আর মিত্র চিনতে ভুল করেছে, তখনই তারা বিপর্যয়ের শিকার হয়েছে।
কারবালার ঘটনাটির বড় প্রভাব হলো, খেলাফতের পর গত প্রায় সাড়ে তেরোশো বছরের মুসলিম উম্মাহর ভেতর, দ্বীন ইসলাম রক্ষার যে চেতনা ও শৌর্য-বীর্য আপন মহিমায় ভাস্বর রয়েছে, তার পেছনে ইসলামের ইতিহাসের যে ঘটনাগুলো গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে সক্রিয় হয়েছে, কারবালার ঘটনা তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি উল্লেখযোগ্য। কারবালার ঘটনায় যুদ্ধ হয়েছিল মুসলমানদের মধ্যেই। একপক্ষে তথা শক্তিশালী পক্ষে ছিল মুসলমান নামধারী মুনাফেক, স্বার্থপর, ভোগবিলাসী এবং রাজতন্ত্ররা অনুরাগী। কারবালার ঘটনার মাধ্যমে শাসকরা বিজয়ী হয়েছিল, কিন্তু নন্দিত হতে পারেনি। অন্যায় করে বিজয় অর্জন করলেও যে নন্দিত হওয়া যায় না, ধিকৃত হতে হয়, কারবালার ঘটনা তার জ্বলন্ত উৎকৃষ্ট উদাহরণ। কারবালা সম্বন্ধে অনেক বড় বড় পুস্তক রচিত হয়েছে, উপন্যাস রচিত হয়েছে এবং কবিতা রচিত হয়েছে। যে কবিতাটির নাম সবার আগে আমার মনে আসে সেটি হলো বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের লেখা ‘মহররম’ কবিতা। পূর্ণ কবিতাটি, ইতিহাস স্মরণ করিয়ে দেয়, রাসূল সা:-এর পরিবারের প্রতি ভালোবাসা শাণিত এবং পাঠককে ঈমানী বলে বলীয়ান করে। এই কলামে, আমি ঐ বিখ্যাত কবিতাটির দুইটি স্থান থেকে মাত্র কয়েকটি লাইন এখানে উদ্ধৃত করছি। প্রথম উদ্ধৃতি কলামের শুরুতেই আছে।
মহররম কবিতা থেকে দ্বিতীয় উদ্ধৃতি :
নীল সিয়া আসমান লালে লাল দুনিয়া //
আম্মা লাল তেরি খুন কিয়া খুনিয়া, //
কাঁদে কোন ক্রন্দসী কারবালা ফোরাতে? //
সে কাঁদনে আঁসু আনে সীমারেরও ছোরাতে। // ... ...
গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদে কচি মেয়ে ফাতিমা, //
‘আম্মা গো পানি দাও ফেটে গেল ছাতি মা!’ //
নিয়ে তৃষা সাহারার, দুনিয়ার হাহাকার, //
কারবালা-প্রান্তরে কাঁদে বাছা আহা কার ! //
দুই হাত কাটা তবু শের-নর আব্বাস, //
পানি আনে মুখে, হাঁকে দুশ্মনও ‘সাব্বাস্’ ! //
দ্রিম্ দ্রিম্ বাজে ঘন দুন্দুভি দামামা, /
/ হাঁকে বীর ‘শির দেগা, নেহি দেগা আমামা’ ! //
একটি স্পর্শকাতর বিষয়
মহানবী সা: এবং তাঁর কন্যা সম্পৃক্ত-পরিবারকে সাধারণ ভাষায় ‘আহলে বাইত’ বলা হয়। এটা অতি সম্মানিত সম্বোধন, অতি সম্মানিত বিশেষণ, অতি সম্মানিত পরিচয়। রাসূলুল্লাহ সা:-এর আপন চাচাতো ভাই, কিশোরদের মধ্যে প্রথম ইসলাম গ্রহণকারী, রাসূলুল্লাহ সা:-এর প্রিয় কন্যার স্বামী হজরত আলী রা: এবং তাঁর স্ত্রী মহানবী সা:-এর কন্যা, যাঁকে মুসলিম বিশ্ব ‘মা ফাতিমা’ বলে চেনে এবং তাঁদের দুই পুত্র তথা রাসূলুল্লাহ সা:-এর অতি প্রিয় নাতি, ইমাম হাসান ও ইমাম হোসাইন রা:, একটি গুচ্ছ। আসমানে ও জমিনে তাঁদের সম্মানের ব্যাখ্যা করা, তাঁদের প্রতি মহব্বতের গুরুত্ব ব্যাখ্যা করা এবং তাঁদের সম্মানে স্মৃতিচারণ খুবই কঠিন কাজ এবং নিজে যে তার জন্য যথেষ্ট যোগ্য নই, এতে আমার মনে সন্দেহ নেই। তবে একটি প্রশ্ন, মহানবী সা:-এর প্রিয় দৌহিত্র তথা আহলে বাইত-এর সদস্য ইমাম হুসাইন রা:-এর পবিত্র রক্ত দিয়ে কেন কারবালার মাটিকে ভেজাতে হলো, সেই প্রশ্নের জাগতিক বা শরিয়াহভিত্তিক উত্তর একরকম এবং আধ্যাত্মিক জগতের উত্তর আরেক রকম হওয়াটাই স্বাভাবিক। কোনো দিন সুযোগ হলে মহান আল্লাহর দয়ায় এ নিয়ে আলোচনা করতে চেষ্টা করব।
ইসলামের যুদ্ধগুলো প্রসঙ্গে রচনা
মহানবী সা:-এর আমলে, খোলাফায়ে রাশেদার আমলে এবং তৎপরবর্তী চল্লিশ-পঞ্চাশ বছরের ইসলামের রাজনৈতিক ও সামরিক ইতিহাস আজকের প্রজন্মের নিকট প্রায়ই অজানা। ইসলামের ইতিহাস বিষয় যদি কেউ বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পড়েন, তাহলেই মাত্র কিছুটা সংবাদ পাঠ্যপুস্তক থেকে পাবেন। সাধারণ মানুষের নিকট এই বিষয়টি একেবারেই অপরিচিত, অপরিবেশিত। এ কথা খেয়াল রেখে, ২০০৮ সালে তৎকালীন ইসলামিক টিভি (অধুনা বিলুপ্ত) কর্তৃপক্ষ আমাকে অনুরোধ করেছিল, অন্তত সামরিক ইতিহাস যেন টেলিভিশনে তুলে ধরি বাংলাভাষী টিভি দর্শকের জন্য। এই পরিপ্রেক্ষিতে, পরপর ১৩ সপ্তাহে, ১৩টি ভিন্ন পর্বে, ইসলামের ১৩টি যুদ্ধের বর্ণনা বাংলাভাষী টেলিভিশন দর্শকদের সামনে উপস্থাপন করার দুর্লভ সুযোগ আমার হয়েছিল। সময়টা ছিল মার্চ-এপ্রিল ২০০৮। আমি মনে করি, এটি মহান আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে একটি বিশেষ দয়া। কারণ, মহানবী সা:-এর আমলের যুদ্ধগুলো বর্ণনা করতে গিয়ে, আমাকে সবিশেষভাবে জানতে হয়েছে এবং আমার সেই অর্জিত ক্ষুদ্র জ্ঞান দেশবাসীর সাথে শেয়ার করতে পেরেছি। কয়জনের সৌভাগ্য হয় মহানবী সা:-এর যুদ্ধের নেতৃত্ব, অন্যের সামনে উপস্থাপন করার? শতভাগ আদবের সাথে, শতভাগ রাসূলপ্রেমের সাথে না-ও হয়ে থাকতে পারে, কিন্তু অনিচ্ছাকৃত ভুলত্রুটিসমূহের জন্য মহান আল্লাহ তায়ালার নিকট ক্ষমাপ্রার্থী; নিশ্চিতভাবেই মহান আল্লাহ তায়ালা ক্ষমা করতে পারেন।
একটি ব্যতিক্রমী বই
টেলিভিশনের সেই ১৩টি মৌখিক উপস্থাপনা, লিখিতভাবে বইয়ে প্রকাশ করার মতো করে সাজানো হয়েছিল। বইটির নাম ‘দি ব্যাটেলস অব ইসলাম’ বা ইসলামের যুদ্ধগুলো। ওই বইটি ইনশা আল্লাহ আগামী তিন মাসের মধ্যে, নতুন প্রচ্ছদে ও সজ্জায়, পুনঃপ্রকাশিত হবে। সেই বইয়ের ১২তম অধ্যায় হচ্ছে কারবালার ময়দানের যুদ্ধ। বিশদভাবে প্রেক্ষাপটসহ বইটির পরিচয় দিলাম একটি উদ্দেশ্য নিয়ে। উদ্দেশ্য হচ্ছে- সম্মানিত পাঠককুল, বিশেষ করে তরুণ সম্প্রদায়, ইসলামের অতীতের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস যেন জানতে চেষ্টা করে। যেসব ছাত্রছাত্রী স্কুলের পাঠ্যসূচিতে ইসলামের ইতিহাস পড়েন বা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামিক স্টাডিজ নামক বিষয় পড়েন বা মাদরাসায় পড়েন, শুধু তারা জানলে হবে না। ইতিহাসের উত্তরাধিকারী আমরা সবাই।
লেখক : চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি
উৎসঃ নয়াদিগন্ত
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন