গতকাল মঙ্গলবার, ১৭ মার্চ ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী। অতএব বঙ্গবন্ধুর আজীবন স্বপ্ন গণতন্ত্র নিয়ে বা গণতান্ত্রিক সরকার নিয়ে কয়েকটি কথা আজকের কলামে উপস্থাপন করাটাই শ্রেয়। বাংলাদেশের ইতিহাসের বিভিন্ন রাজনৈতিক পরিবর্তনের মধ্যে কোনোটি স্বাভাবিক ও সুখকর এবং কোনোটি অস্বাভাবিক ও বেদনাদায়ক। বয়সের প্রবীণত্বে এসে একান্ত কামনা করি যেন অস্বাভাবিক ও বেদনাদায়ক পরিবর্তন পরিহার করা যায়। বিভিন্ন দেশের, বিশেষত অনুন্নত দেশের বা কোনো-না-কোনো সময় ইউরোপিয়ানদের কলোনি ছিল এমন দেশের প্রশাসনে বা রাজনীতিতে পরিবর্তনগুলোকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা বা পর্যবেক্ষকরা অন্তত চারটি শিরোনামে পর্যায়ভুক্ত করে থাকেন। একটি ক্যাটাগরি হলো ব্যালটের মাধ্যমে তথা মানুষের স্বাভাবিক ভোটের মাধ্যমে। দ্বিতীয় হলো বুলেটের মাধ্যমে তথা ভায়োলেন্সে বা রক্তারক্তির মাধ্যমে। তৃতীয় ক্যাটাগরি হলো ব্যালটও নয় বুলেটও নয়, গণদাবির মুখে তথা গণজাগরণের মুখে ক্ষমতা হস্তান্তর করা। চতুর্থ ক্যাটাগরি হলো বিদ্যমান রাজনৈতিক কাঠামোর ভেতরে থেকেই দুর্বলতাগুলোকে সংস্কার করে, কাঠামো শক্তিশালী করে ব্যালট ও হস্তান্তরের যৌথ প্রক্রিয়ায়, যাকে আমরা বলতে পারি ‘সংস্কার’ ক্যাটাগরি। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ইতিহাস থেকে প্রত্যেকটি ক্যাটাগরির জন্যই উদাহরণ দিয়ে আলোচনা করা যায়। বাংলাদেশের গত ৪৯ বছরের ইতিহাস থেকেও প্রত্যেকটি ক্যাটাগরির জন্যই উদাহরণ বা ঘটনার রেফারেন্স টেনে আনা যায়।
গণতন্ত্রের পরীক্ষায় সাফল্য ও ব্যর্থতা
গণতন্ত্রের পরীক্ষায় বাংলাদেশ কোনো সময় উত্তীর্ণ হয়েছে, কোনো সময় ব্যর্থ হয়েছে। উত্তীর্ণ হওয়ার সময় বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনের বাইরে, কিন্তু দেশের অভ্যন্তরীণ শক্তি, যেমন অবদান রেখেছে, তেমনি বাংলাদেশের সীমান্তের বাইরে থেকে বন্ধুপ্রতিম শক্তিও অবদান রেখেছে। অনুরূপভাবে গণতন্ত্রের পরীক্ষায় ব্যর্থতার ক্ষেত্রগুলোতে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনের বাইরে কিন্তু দেশের অভ্যন্তরীণ শক্তি যেমন অবদান রেখেছে, তেমনি বাংলাদেশের সীমান্তের বাইরে থেকে বন্ধুপ্রতিম শক্তিও সে ব্যর্থতায় অবদান রেখেছে। ২০১৪-২০১৫ সালদ্বয় এবং ২০১৮-২০১৯ সালদ্বয় বাংলাদেশের গণতন্ত্রের জন্য কঠিন বছর। গণতন্ত্রকে যেভাবে আমরা এই দেশের মাটিতে চিনে আসছি ১৯৩৬ সাল থেকে, সেটির সাদামাটা বর্ণনা হলো : মানুষ ভোট দেবে, অনেক প্রার্থীর মধ্য থেকে একজনকে বেছে নেবে, বিজয়ী প্রার্থীরা ও তাদের দল দেশ শাসন করবে। তবে এরূপ গণতন্ত্র বাংলাদেশে হোঁচট খেয়েছে।
Ad by Valueimpression
সংক্ষিপ্ত মূল্যায়ন : প্রথম ধাপ
শুরুটা ভালোই ছিল। ১৯৭২ সালে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদেরকে দিয়েই সংবিধান রচনা করা হলো; ১৯৭২ সালেই সেই সংবিধান গৃহীত ও কার্যকর হলো। এ কাজে পাকিস্তান সৃষ্টির পর প্রায় আট বছর লেগেছিল। সেখানে এক বছরের মাথায় সংবিধান পাওয়া বঙ্গবন্ধু সরকারের একটি বড় সাফল্য ছিল। ১৯৭৩ সালের মার্চে বাংলাদেশে প্রথম পার্লামেন্ট নির্বাচন হলো। বেশ কয়েকটি আসনে দারুণ সাহসী ও ঐতিহাসিক কারচুপি হলো; যদিও তার প্রয়োজন ছিল না। কারণ, কারচুপিবিহীনভাবে যেসব আসনের ফলাফল ঘোষণা করা হয়েছিল সেগুলোতে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল। বঙ্গবন্ধু সরকার গঠন করেছিলেন। কিন্তু তার সরকারের সাফল্য ছিল সীমিত; এর পেছনে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র দায়ী, এর পেছনে তার নিজ দলের মানুষের দুর্নীতি ও অদক্ষতা দায়ী, এর পেছনে প্রকৃতি দায়ী এবং যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের পুনর্গঠনে মানুষের আশা ও প্রাপ্তির মধ্যে বিশাল পার্থক্য দায়ী। দেশ শাসনে বা দেশের মানুষের আকাক্সক্ষা মেটানোর ওই রূপ ঐতিহাসিক ব্যর্থতার ধকল কাটিয়ে ওঠার জন্য অথবা অন্য যেকোনো কারণেই হোক না কেন, বঙ্গবন্ধু নিজেই বহুদলীয় গণতন্ত্রকে নিস্তব্ধ করে দিলেন এবং একদলীয় শাসন কায়েম করলেন; গণতন্ত্রের ওপর এই প্রথম আক্রমণ হয়েছিল ২৫ জানুয়ারি ১৯৭৫। এটা ছিল প্রথম আঘাত। দ্বিতীয় আঘাত এলো ১৯৭৫ সালের আগস্ট মাসের ১৫ তারিখ, যে দিন বঙ্গবন্ধু নিহত হলেন; এই হত্যাকাণ্ড ও রক্তাক্ত পদ্ধতিতে রাজনৈতিক পরিবর্তনের প্রধান নায়ক ছিলেন বঙ্গবন্ধুর অন্যতম সহকর্মী খন্দকার মোশতাক এবং তার ঘনিষ্ঠ আওয়ামী লীগের বা বাকশালী বন্ধুরা। মোশতাক মার্শাল ল বা সামরিক আইন জারি করেছিলেন। তার সরকার বাকশাল রাখত কী রাখত না, এটা বলা মুশকিল, মোশতাকের সরকার বহুদলীয় গণতন্ত্রে ফিরে যেত কী যেত না, সেটিও বলা মুশকিল। সে সরকার আসলে কোন রাজনৈতিক সড়ক অবলম্বন করত, সেটি বলা মুশকিল। কোনো কিছু ফয়সালা বা চিহ্নিত হওয়ার আগেই এসে যায় ৩ নভেম্বরের সামরিক ক্যু-দ্য-তা; তিন দিন সরকারবিহীন থাকার পর একটি সরকার এসেছিল ৫ তারিখ সন্ধ্যায়। কিন্তু এই নতুন বা অভিনব সরকার দায়িত্ব নেয়ার ৩৬ ঘণ্টার মাথায় আসে ৭ নভেম্বর। আমি ১৯৭৫ সালের নভেম্বর মাসের ৭ তারিখের সিপাহি-জনতার বিপ্লবের কথা বলছি। অতঃপর মোশতাক কর্তৃক জারি করা সামরিক শাসন আক্ষরিক অর্থেই বাস্তবায়ন হওয়া শুরু হলো।
সংক্ষিপ্ত মূল্যায়ন : দ্বিতীয় ধাপ
মুক্তিযুদ্ধ-উত্তর স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম চার বছর মারাত্মক ঘটনাবহুল ছিল। মানুষের শরীর থেকে যেমন রক্ত বেরিয়েছে, গণতন্ত্রের শরীর থেকেও রক্ত বেরিয়ে গেছে। এই অবস্থান থেকে অর্থাৎ ১৯৭৬ সালের শুরু থেকে যদি আমরা ভিন্ন বাংলাদেশ চিন্তা করি, সেই দেশের নতুন কাণ্ডারী হলেন তৎকালীন মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান। এরূপ বাকশালবিহীন বাংলাদেশ, বঙ্গবন্ধুবিহীন বাংলাদেশ, সামরিক শাসনের অধীনস্থ বাংলাদেশ, গণতান্ত্রিক পরিবেশহীন বাংলাদেশ থেকে রাজনৈতিক উত্তরণ ছিল খুবই কঠিন কাজ। কিন্তু এ কাজটিই সম্পন্ন করেছিলেন তৎকালীন জে. জেনারেল জিয়া। যে দিন তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন, সে দিনই তিনি অবসরে গেলেন। বহুদলীয় গণতন্ত্র আবারো চালু হলো ১৯৭৮ সালে এবং চলল ১৯৮২ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত। কিন্তু এর মধ্যেই ১৯৮১ সালের মে মাসের ৩০ তারিখ তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান নিহত হলেন। এই হত্যাকাণ্ডের ও কল্পিত পরিবর্তনের নীলনকশার হোতা, প্রকাশ্যে ছিলেন মেজর জেনারেল আবুল মঞ্জুর বীর উত্তম। কিন্তু উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো, প্রেসিডেন্ট নিহত হলেও প্রেসিডেন্টের দল, অর্থাৎ বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল, স্বাভাবিক রাজনীতি বজায় রাখে এবং বাংলাদেশের জন্য একজন নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করার ব্যবস্থা করে। ১৯৮২ সালের মার্চ মাসে আসে গণতন্ত্রের ওপর আরেকটি আক্রমণ। ওই আমলের সেনাবাহিনীর প্রধান (লেফটেন্যান্ট জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ) সামরিক শক্তি ব্যবহার করে নির্বাচিত সরকারকে হটিয়ে দিলেন এবং দেশে নতুন করে সামরিক শাসন জারি করলেন। এটা ছিল গণতন্ত্রের ওপর দ্বিতীয় প্রধান আঘাত।
সংক্ষিপ্ত মূল্যায়ন : তৃতীয় ধাপ
১৯৮৬ সালে নির্বাচনের মাধ্যমে বহুদলীয় গণতন্ত্রের তৃতীয় যাত্রা শুরু হয় (প্রথম যাত্রা ১৯৭২, দ্বিতীয় যাত্রা ১৯৭৮ এবং তৃতীয় যাত্রা ১৯৮৬)। বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে রাজনীতির মেরুকরণ সুস্পষ্ট হওয়া শুরু করে ১৯৮৬ সালেই। অর্থাৎ, নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার মাধ্যমে তৎকালীন আওয়ামী লীগ, এরশাদের সামরিক শাসনকে বৈধতা দিয়ে পক্ষভুক্ত করল। তখন দেখা গেল যে, আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি এক পক্ষে, জাতীয়তাবাদী দল আরেক পক্ষে, অন্য দলগুলো তৃতীয় পক্ষে। সবার সম্মিলিত চেষ্টায় ঢাকা মহানগরের গণ-অভ্যুত্থানে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর জাতীয় পার্টি সরকারের পতন ঘটে। ওই দিন থেকে ১৯৯১ সালের ফেব্র“য়ারি মাসের ২৭ তারিখ অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনের পর, সংসদ মিলিত হওয়া পর্যন্ত সময়টি ছিল প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রত্যক্ষ শাসন। বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের শাসনকে প্রত্যক্ষভাবে এবং আন্তরিকভাবে সহায়তা করেছিল সামরিক বাহিনী ও আমলাতন্ত্র। বেগম জিয়া সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন। কিন্তু বাংলাদেশ তখনো সংবিধান মোতাবেক চলছিল রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার পদ্ধতিতে। তাই ১৯৯১ সালের সেপ্টেম্বরে, নবনির্বাচিত পার্লামেন্টের বাইরের এবং ভেতরের সব রাজনৈতিক দলের সম্মতিতে পার্লামেন্ট কর্তৃক বাংলাদেশের সংবিধান সংশোধন করা হয় এবং ওই সংশোধনীর মাধ্যমে নতুন করে বহুদলীয় গণতন্ত্রের তথা সংসদীয় গণতন্ত্রের নবযাত্রা, অর্থাৎ চতুর্থ যাত্রা শুরু হয়।
সংক্ষিপ্ত মূল্যায়ন : চতুর্থ ধাপ
১৯৯৫-৯৬ সালে অনেক আন্দোলন-সংগ্রাম হয়েছিল। ঘটনাবহুল বাংলাদেশে অনেক ঘটনার ভিড়ে ১৯৯৬ সালের মে মাসের ঘটনা আজকের পাঠকরা প্রায় ভুলে গেছেন। ঘটনা ঘটার কথা ছিল ১৯৯৬ সালের জানুয়ারি-ফেব্র“য়ারিতে, কিন্তু সেই ঘটনা ঘটল মে মাসের ২০ তারিখে। সেটি ছিল গণতন্ত্রের ওপর একটি ব্যর্থ আঘাত। আন্দোলন, প্রতি-আন্দোলন ইত্যাদির শেষে, পার্লামেন্ট ভেঙে দেয়া হয়েছিল এবং ১৫ ফেব্র“য়ারি ১৯৯৬ নতুন সংসদ নির্বাচন হয়েছিল। নবনির্বাচিত সংসদ মার্চ মাসের শেষ সপ্তাহে বাংলাদেশের সংবিধান সংশোধন করে শুধু নির্বাচনকালীন সময়ের জন্য তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতির সরকার বহাল করে। ২০০৬ সালের অক্টোবরে এই পদ্ধতির ওপর আঘাত আসে; এই আঘাত পরিপক্ব হয় ২০০৭ সালের জানুয়ারি মাসের ১১ তারিখ। এই আঘাতকে সমর্থন দিয়েই নতুন রাজনৈতিক মেরুকরণে, শক্তিশালী অবস্থান গ্রহণ করে আওয়ামী লীগ। সে দিন থেকে আওয়ামী লীগের নতুন যাত্রা শুরু; নতুন উদ্যমে, নতুন বুদ্ধিতে, নতুন বন্ধুসহ, নতুন লক্ষ্যে, নতুন উদ্দেশ্যে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন, তার আগের এক বছরের ঘটনাবলি এবং পরবর্তী তিন সপ্তাহের ঘটনা আজ আলোচনা করছি না। উপরের তিনটি অনুচ্ছেদে এবং এই অনুচ্ছেদসহ মোট চারটি অনুচ্ছেদে, বাংলাদেশে রাজনৈতিক পরিবর্তন বা ক্ষমতার পরিবর্তনের মুহূর্তগুলোকে চিহ্নিত করে উল্লেখ করেছি। এই কলামের শুরুর অনুচ্ছেদটির প্রতি যদি কোনো পাঠক খেয়াল করেন, তাহলে তিনি অবশ্যই বাংলাদেশের ইতিহাসের বিভিন্ন সময় ক্ষমতার পালাবদলের ঘটনাগুলোকে ওই চারটি প্রক্রিয়ার কোনো-না-কোনো একটির সাথে মেলাতে পারবেন।
২০১৮-২০১৯ সালে দ্বন্দ্বের স্বরূপ
২০১৮-২০১৯ সাল ‘বাংলাদেশের দু’টি প্রধান রাজনৈতিক শিবিরের মধ্যকার শুধু রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের বছর’ বললে ভুল হবে। আরো যে দ্বন্দ্বগুলোর কথা উল্লেখ করতে চাই, তার মধ্যে কয়েকটি হলো : এক. বাংলাদেশে চর্চার জন্য গণতন্ত্রের নতুন রূপ কী হবে তথা একদলীয় নাকি সীমিত বহুদলীয় নাকি উন্মুক্ত বহুদলীয়, তা নিয়ে দ্বন্দ্ব। দুই. যেহেতু বাংলাদেশের ভেতরে প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক শিবিরগুলো কর্তৃক চর্চিত রাজনৈতিক দর্শনগুলো পরস্পরের শতভাগ সম্পূরক নয়, তাই গণতন্ত্রের মূল দর্শন কী হবে তা নিয়ে দ্বন্দ্ব। তিন. বিশ্বরাজনীতির প্রেক্ষাপটে দক্ষিণ এশিয়া নামক অঞ্চলে, বৃহৎ প্রতিবেশীর আগ্রাসী ছায়ার প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের অবস্থান কী হবে, তা নিয়ে দ্বন্দ্ব। চার. মোট জনসংখ্যার মধ্যে মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ, এরূপ দেশগুলোর তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয় তথা ইন্দোনেশিয়া ও পাকিস্তানের পরই; এই প্রেক্ষাপটে মুসলিম বিশ্বের রাজনীতিতে বাংলাদেশের অবস্থান কী হবে তা নিয়ে দ্বন্দ্ব। পাঁচ. নিজেরাই যেন ক্ষমতায় থেকে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার অর্ধশতবার্ষিকী বা সুবর্ণজয়ন্তী পালন করতে পারে এরূপ স্ব-আরোপিত বাধ্যবাধকতার প্রেক্ষাপটে, আওয়ামী লীগ-শাসিত বাংলাদেশের রাজনীতির অঙ্গনে অন্য দলগুলোর অবস্থান কী হবে?
নেপাল বনাম বৃহৎ প্রতিবেশী
আমি পাঠকের সচেতন দৃষ্টি আকর্ষণ করছি দক্ষিণ এশিয়ায় অন্যতম দেশ নেপালের প্রতি। সেখানে রাজতন্ত্র দূর করার জন্য বহু বছর সশস্ত্র সংগ্রাম করেছে একটি দল। অতঃপর সাফল্য এসেছে। রাজতন্ত্রবিহীন বহুদলীয় গণতন্ত্রের সহায়ক সংবিধান রচনায় সময় নিয়েছে বহু বছর। বহু মাস ধরে টানাপড়েনের পর, একটি রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় এলেও, বারবার অদলবদল হয়। নেপাল দেশটির সংবিধানের কয়েকটি বিধান নিয়ে প্রতিবেশী ভারত বিরূপ মনোভাব প্রকাশ করেছে। এরূপ প্রেক্ষাপটে নেপালের সাথে রাজনৈতিক বিরোধ সৃষ্টি হয় ভারতের। চতুর্দিকে ভূবেষ্টিত পাহাড়ি দেশ নেপাল বিস্তৃতভাবেই নির্ভরশীল ছিল ভারতের সাথে বাণিজ্যের ওপর। সেই ভারত, নেপালের সীমান্তে অবরোধ করার কারণে চার মাসের অধিককাল নেপাল অবরুদ্ধ ছিল; শত কষ্ট সত্ত্বেও নেপালের জনগণ ও রাজনীতিবিদরা ভারতীয় এই জিম্মিনীতির কাছে আত্মসমর্পণ করেননি। সেই সময় নেপাল নামক দেশটিতে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক টানাপড়েন চলছিল চরমভাবে; কিন্তু জাতীয় স্বার্থে কোনো দলই গোপনে ভারতের সাথে আপস করেনি। নতুনভাবে নির্বাচিত এবং ক্ষমতায় যাওয়া সরকারও ভারতের সাথে আপস করেনি। প্রায় শতভাগ ভারতের সাথে বাণিজ্যের ওপর নির্ভরশীলতা কমানোর জন্য নেপাল খুব দ্রুত এবং অতি জোরালো উদ্যোগ নেয় চীনের সাথে রাস্তা খোলার; বাণিজ্যিক রাস্তা খোলার জন্য। চীনও উদারভাবে এগিয়ে আসে। নেপালের দক্ষিণের প্রতিবেশী যেমন ভারত, তেমনি নেপালের উত্তরের প্রতিবেশী চীন। নেপালের দক্ষিণের প্রতিবেশীর সাথে সীমান্ত এলাকাটি জনবহুল ও সমতল প্রকৃতির। নেপালের উত্তরের প্রতিবেশীর সাথে সীমান্ত এলাকাটি জনবহুল নয় এবং অসমতল প্রকৃতির। এই বৈচিত্র্যের মধ্যেই নেপাল নিজের অস্তিত্ব রক্ষার পন্থা বের করে নেয়। এখানে, বাংলাদেশের চিন্তাশীল মানুষের জন্য, চিন্তার খোরাক আছে বৈকি।
মিয়ানমার-চীন-বাংলাদেশ
মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও সেই রাজনীতির প্রভাব আমাদের ওপর কী হতে পারে বা হচ্ছে সেটি স্বয়ংসম্পূর্ণ দীর্ঘ আলোচনার বিষয়, অনেকবার এই পত্রিকায় তা করেছি। আজকে শুধু সারমর্ম তুলে ধরছি। কিন্তু এই কলামে অতি সংক্ষিপ্তভাবে করছি। ৮-১০ বছর আগে থেকে, মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী প্রকাশ্যে গণতন্ত্রকে স্বাগত জানালেও বাস্তবে গ্রহণ করেনি। মিয়ানমারের অনেক জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে একটি জাতিগোষ্ঠী মাত্র ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে আছে। ক্ষমতাসীন জাতিগোষ্ঠী এবং ক্ষমতার নিয়ন্ত্রক সামরিক বাহিনী উভয়ে মিলিতভাবে সিদ্ধান্ত নেয়। মিয়ানমার একাধিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। এক. তারা একগুঁয়েমির পথ বেছে নেবে, দুই. তারা সামরিকতন্ত্রের পথ বেছে নেবে, তিন. তারা একাধিক ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীকে বিতাড়িত করবে হয় থাইল্যান্ডের দিকে অথবা বাংলাদেশের দিকে ( চূড়ান্তপর্যায়ে তারা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর গণহত্যা চালিয়ে জীবিতদের বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বিতাড়িত করে); চার. তারা দেশের সম্পদকে বিদেশের হাতে উন্মুক্তভাবে ও নিঃশর্তভাবে তুলে দেবে না। পাঁচ. প্রতিবেশী চীন ও ভারতের সাথে যুগপৎ অর্থনৈতিক ও সামরিক সম্পর্ক বৃদ্ধি করবে এবং কোনো দ্বন্দ্বের আবির্ভাব হলে চীনের পক্ষ নেবে। ছয়. অর্থনৈতিক ও সামরিক সম্পর্কের প্রেক্ষাপটে তারা চীন ও ভারত উভয়কেই তাদের ভূখণ্ড এবং রাখাইন প্রদেশসংলগ্ন সমুদ্রসীমা ব্যবহারের সুযোগ দেবে। সাত. মিয়ানমার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তারা বাংলাদেশকে অবজ্ঞা করবে।
মন্তব্য : আমি নিশ্চিতভাবে জানি না যে, মিয়ানমার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল কি না বা এই মুহূর্তেও সিদ্ধান্ত নিচ্ছে কি না : বাংলাদেশের ভূখণ্ডে সামরিক অভিযান পরিচালনার জন্য। এ প্রসঙ্গে সম্মানিত পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি এই নয়া দিগন্ত পত্রিকায় ১১ অক্টোবর ২০১৭ সংখ্যায় আমারই লেখা একটি কলামের প্রতি; শিরোনাম ছিল ‘রোহিঙ্গাবিহীন রাখাইন এবং বাঙালিবিহীন পার্বত্য চট্টগ্রাম’। সম্মানিত পাঠক, এই কলামের সর্বশেষ অনুচ্ছেদের প্রতিও আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
আলোচনাটি কেন করলাম
বাংলাদেশের জন্য ২০১৮-২০১৯ সালদ্বয় একাধিক দ্বন্দ্বের বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত ছিল। কিঞ্চিৎ আলোচনা উপরের একটি অনুচ্ছেদে করা হয়েছে; বিস্তারিত করা হয়নি; আগামী দিনে করা হবে, ইনশা আল্লাহ। ওই দ্বন্দ্বগুলোর সাথে অবশ্যই আন্তর্জাতিক রাজনীতি তথা পৃথিবীর পরাশক্তিগুলোর রাজনীতিতে ছোট দেশগুলোর ভূমিকা (ইন্টারন্যাশনাল পলিটিক্স) জড়িত, আঞ্চলিক রাজনীতি তথা দক্ষিণ এশিয়া, পূর্ব এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া নামক ভূ-রাজনৈতিক অঞ্চলে, আঞ্চলিক সামরিক ও অর্থনৈতিক শক্তিগুলো (রিজিওনাল পলিটিক্স) জড়িত, আন্তর্জাতিক সংস্কৃতির দ্বন্দ্ব (কালচারাল কনফ্লিক্ট) জড়িত। সে জন্যই এখানে কয়েকটি অনুচ্ছেদে নেপাল ও মিয়ানমার নামক দু’টি দেশের নাম নিয়ে আলোচনা করলাম।
অনুপ্রাণিত করতে হবে
সাম্প্রতিক বাংলাদেশের সমাজ, রাজনীতি ও মানুষকে নিয়ে আমার চিন্তাভাবনা কিঞ্চিৎ প্রকাশ করেছি। ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ তারিখের কলাম, ৭ মার্চ ২০১৮ তারিখের কলাম এবং আজ ১৮ মার্চ ২০২০ তারিখের কলামেও এর বহিঃপ্রকাশ আছে। এটা মার্চ মাস; ১২ দিন পর শেষ হবে। ঐতিহাসিক মাস, গর্বের মাস, অনুরাগের মাস, অনুভূতি নবায়নের মাস এবং প্রত্যয় উদ্দীপ্ত করার মাস। স্বাধীনতার মাস মার্চ, এই মাস স্বাভাবিকভাবেই দাবি করে যে, আমরা বাংলাদেশের স্বাধীনতা নিয়ে, দেশের সার্বভৌমত্ব নিয়ে, বাংলাদেশের মানুষের কল্যাণ নিয়ে আলোচনা করি। নির্বাসনে প্রেরিত নির্বাচন পরিস্থিতিতে, রাজনৈতিক অঙ্গনে বিভিন্ন ইশারা-ইঙ্গিত-লক্ষণ আমাকে বাধ্য করছে স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করতে। তাই আমি লিখলাম। হঠাৎ করে, আগে-পিছে কোনো ভূমিকা বা ব্যাখ্যা ছাড়া গুরুত্বপূর্ণ কোনো কথা, কোনো স্থানে উল্লেখ করলে, সেটি অরণ্যে রোদন হয়। তাই একাধিক কলাম লিখেছি বা লিখছি বা লিখব। আগামী বুধবারের কলাম পড়ার আহ্বান রেখে আজ বিদায় নিচ্ছি।
লেখক : মেজর জেনারেল (অব:); চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি
উৎসঃ নয়াদিগন্ত
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন