রাজনীতি উত্তপ্ত হবে, হবে না?
সাম্প্রতিক অতীতের দু’টি বছরে মারাত্মক বা ভয়াবহ বা গভীর বা ব্যাপক কোনো উত্তপ্ত রাজনৈতিক কর্মসূচি ছিল না। তবে এইবার ২০১৯ সালের ডিসেম্বরের শেষ অংশ তথা ২০২০ সালের শুরুর অংশ উত্তপ্ত কর্মসূচি দিয়ে শুরু হওয়ার সম্ভাবনা কিছুটা আছে; আবার কিছুটা নেই। বছরের শুরু বলতে শুধু পয়লা জানুয়ারি বোঝাচ্ছি না; ধরে নিন জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারির সময়টাই বোঝাচ্ছি। উত্তপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা আছে এজন্য বলব যে, দীর্ঘ দিন ধরে ২০ দলীয় জোটের শীর্ষতম নেতা ও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম জিয়াকে অযাচিতভাবেই কারাগারে আটক রাখা হয়েছে। তাকে মুক্ত করার আইনি চেষ্টা এখন শেষ পর্যায়ে আছে। অতএব, আইনি চেষ্টার ফলাফলের ওপর নির্ভর করে, বিএনপি, ২০ দলীয় জোট, জাতীয় মুক্তিমঞ্চ ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতারা রাজনৈতিক অনুষ্ঠানসূচি প্রণয়ন করবেন বলে বিশ্বাস। অপর দিকে, উত্তপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা নেই এজন্য বলছি যে, ঢাকা মহানগরের উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন মেয়র নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার সম্ভাবনা আগামী দুই-চার মাসের মধ্যে। সেই মেয়র নির্বাচনে বড় বড় সব রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ করার সম্ভাবনা আছে। অতএব বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা মহানগরের রাজনীতি মেয়র নির্বাচনকেন্দ্রিক হওয়ার সম্ভাবনাটাই বেশি।
বিভিন্ন মাসের রাজনৈতিক তাৎপর্য
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসে ভিন্ন ভিন্ন কারণে গুরুত্ব বহন করে জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি, মার্চ, মে, আগস্ট, নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাস। জানুয়ারি মাসের তাৎপর্য হলো : ১৯৭৫ সালের জানুয়ারি মাসে বাংলাদেশের সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী দিয়ে বহুদলীয় গণতন্ত্র স্থগিত করা হয়েছিল এবং একদলীয় গণতন্ত্র ও নতুন একমাত্র রাজনৈতিক দল বাকশাল চালু করা হয়েছিল। ফেব্রুয়ারি মাসের তাৎপর্য হলো : ১৯৫২ সালের এই মাসে আমরা আমাদের মাতৃভাষার অধিকার রক্তের বিনিময়ে অর্জন করে নিয়েছিলাম। মার্চ মাসের তাৎপর্য হলো : মাসব্যাপী উত্তাপের পর বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা হয়েছিল এবং মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছিল এই মাসে। এই মার্চ মাসেরই ৭ তারিখে বঙ্গবন্ধুর সেই জগৎবিখ্যাত ঐতিহাসিক ভাষণ বাংলার আকাশ ও বাতাসকে আন্দোলিত করেছিল এবং সাড়ে সাত কোটি বাঙালির হৃদয়কে উদ্বেলিত করেছিল। ২৭ মার্চ তারিখে কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত (প্রথমে নিজের নামে ও পরে বঙ্গবন্ধুর নামে) মেজর জিয়াউর রহমানের কণ্ঠের স্বাধীনতার ঘোষণা পৃথিবীর মানুষকে জানান দিয়েছিল নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশের জন্ম প্রসঙ্গে। মে মাসের তাৎপর্য হলো : শোক। বহুদলীয় গণতন্ত্রের পুনঃপ্রবক্তা রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বীর উত্তম চট্টগ্রামে একটি সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ৩০ মে নিহত হয়েছিলেন। আগস্ট মাসের তাৎপর্য হলো : ততোধিক শোক; একদল বিদ্রোহী বাকশালীয় রাজনৈতিক নেতাকর্মী ও সেনাবিদ্রোহীদের যৌথ প্রচেষ্টার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হন। নভেম্বরের তাৎপর্য সুদূরপ্রসারী। সিপাহি জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে বাংলাদেশের রাজনৈতিক গতিপথ ইতিবাচকভাবে পুনঃনির্ধারিত হয়; তৎকালীন মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান বীর উত্তম, দেশ পরিচালনার কাজের সাথে বাস্তবিক অর্থেই সম্পৃক্ত হন। ডিসেম্বর মাস মহান বিজয়ের মাস; হাজার বছরের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখার একটি মাস।
Ad by Valueimpression
এই মুহূর্তে কামনা : ইবরাহিমের অভিব্যক্তি
এই মুহূর্তে আমরা চরম অশান্তিতে আছি। এগারোটি বছর ধরে চলমান একটি দলের শাসন ক্রমান্বয়ে অপশাসনে রূপান্তরিত হয়েছে; এর থেকে মুক্তি প্রয়োজন। গত এগারোটি বছর যাবতীয় দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে; জীবনের মূল্য কমেছে। জনগণ শান্তি পায়নি। অর্থনীতির একাধিক গুরুত্বপূর্ণ সূচক গভীরভাবে নিম্নমুখী। শাসনকারী দল ও তাদের অঙ্গ সংগঠনগুলোর লুটপাটধর্মীয় অপকর্ম স্পষ্টভাবে জনগণের নিকট উদ্ভাসিত। এর থেকে মুক্তি প্রয়োজন।
অনিশ্চয়তা এখনো বিরাজমান
৯ মাসব্যাপী মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে আমরা বিভিন্ন আঙ্গিকে অনিশ্চয়তার মধ্যে ছিলাম। কিন্তু ২০১৪ থেকে নিয়ে আজ অবধি যে সময় কাটাচ্ছি, সে সময় ভিন্ন প্রকৃতির অনিশ্চয়তার সময়। মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গটি এখানে এ জন্য আনলাম যে, রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব ও সঙ্ঘাতময় পরিবেশে আজ আমরা দিন কাটাচ্ছি, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বা মুক্তিযুদ্ধ শেষে, বাংলাদেশের জন্য তেমন পরিস্থিতির কথা কখনো কল্পনা করেছিলাম কি? উত্তর হলো, আমরা কল্পনা করিনি। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০১৯ সালের ডিসেম্বর দূরত্ব হলো ৪৮টি বছর। ৪৮ বছর আগে মানুষ যা কল্পনা করেনি এখন তা হচ্ছে। ৪৮ বছর আগের কল্পনা, আশা-আকাঙ্ক্ষা সব কিছুই যে ঠিক থাকবে এটাও স্বাভাবিক নয়। পরিবর্তন হতেই পারে। তবে সেই পরিবর্তনটি যদি ইতিবাচক বা গঠনমূলক হয়, তাহলে মানুষের মনে কোনো প্রশ্ন থাকে না। ২০১৯ সালের শেষাংশে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে দু’টি পরস্পরবিরোধী রাজনৈতিক শিবিরের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব, সে দ্বন্দ্বটির বিস্তৃতি আরো ব্যাপক হয়েছে। একটি উদাহরণ দিই, তাহলে এই দ্বন্দ্বের ব্যাপকতা, গভীরতা সম্পর্কে পাঠক পরিষ্কার একটি ধারণা পাবেন।
আওয়ামী লীগ কর্তৃক সৃষ্টি করা সাংবিধানিক বিপর্যয়
স্বাধীনতার পর নয় মাসের মধ্যে যে সংবিধান রচনা করা হয়েছিল তা একটি পরিচ্ছন্ন সংবিধান ছিল এবং এত দ্রুততম সময়ে সংবিধান প্রণয়নের জন্য সংবিধান প্রণেতারা সবার পক্ষ থেকে অভিনন্দনও পেয়েছেন; আমরাও অভিনন্দন জানিয়েছিলাম, এখনো জানাই। কিন্তু মুদ্রার আরো একটি পিঠ রয়েছে। সেটি হলো : অতি দ্রুত সময়ে কাজটি করতে গিয়ে সংবিধান প্রণেতারা কি সব বিষয়ে গভীরভাবে চিন্তা করার সুযোগ পেয়েছিলেন? নাকি তারা পাকিস্তানের সংবিধান, ভারতের সংবিধান ও ব্রিটিশদের (অলিখিত) সংবিধান থেকে কিছু কিছু অংশ বেছে নিয়ে একত্র করে, সংবিধানটি রচনা করেছিলেন? এটা অস্বাভাবিক নয়। গবেষণার কাজই হচ্ছে বিভিন্ন জায়গা থেকে তত্ত্ব ও তথ্য নিয়ে সমন্বয় করা। ১৯৭২ সালে যে সংবিধানটি রচনা ও গ্রহণ করা হয়েছিল তা চারবার সংশোধন করা হয় সংবিধান প্রণয়নকারী, আওয়ামী লীগ দলীয় সরকারের আমলেই। ওই সরকারের আমলেই গৃহীত (বাকশাল সংশোধনী) চতুর্থ সংশোধনীটি ছিল মারাত্মক বিপর্যয় সৃষ্টিকারী। সেই চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে দেশে ‘বাকশাল’ এসেছিল। বাকশাল মানে ছিল একদলীয় শাসন এবং আজীবন ক্ষমতায় থাকার বন্দোবস্ত। যেই বঙ্গবন্ধু সারা জীবন গণতন্ত্রের জন্য, মানুষের বাকস্বাধীনতার জন্য, মানুষের মুক্তির জন্য সংগ্রাম করেছিলেন, তিনি কী পরিস্থিতিতে এবং কেন একদলীয় শাসনের দিকে পা বাড়িয়েছিলেন সে কথাটি বর্তমান বাংলাদেশের মানুষ উপলব্ধি করার তথা মূল্যায়ন করার তথা স্মৃতিচারণ করার প্রকাশ্য সুযোগ পাচ্ছে না। আজকের কলামে আমিও সেটাকে আলোচ্য বিষয় বানাইনি। যা হোক, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তিনি সপরিবারে নিহত হন। এর পরের ইতিহাস সবার জানা। ’৭৫-এর পর থেকে অনেক ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে ২০০৮ সালে সংবিধান একটি পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছিল। যতটুকু শুনেছি, ফখরুদ্দীন-মইনউদ্দিন সরকার সংবিধান সংশোধনের কাজে হাত দিতে চেয়েছিলেন। তারা নির্বাচিত সংসদের মাধ্যমে নতুন একটি সংবিধান প্রণয়ন করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ছয় ঘোড়ার দাপটে বা ছয় ঘোড়ার ষড়যন্ত্রে পরিস্থিতি তাদের অনুকূলে না থাকায় তারা আর এগোতে পারেননি। ১৯৯৬ সালে সংবিধানে আওয়ামী লীগ কর্তৃক পরিচালিত আন্দোলনের ফলস্বরূপ, একটি বড় সংশোধনী আনা হয়। সংশোধনী এনেছিল বিএনপি সরকার। আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকারপদ্ধতির দাবি তুলেছিল। আবার সেই একই তত্ত্বাবধায়ক সরকারপদ্ধতিকে প্রশ্নবিদ্ধও করেছে আওয়ামী লীগ এবং তাদের নেতৃত্বাধীন সরকার। আওয়ামী লীগ সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকারপদ্ধতি বাতিল করার কারণ দেখিয়েছিল যে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারপদ্ধতি বহাল থাকলে অনির্বাচিত ব্যক্তিরা দেশ শাসন করবে। তাই এটা বাতিল করতে হবে। আমার মতে, কারণটি এতই ঠুনকো যে, এটি কোনো প্রকারের যুক্তিতর্কেই টেকে না। কারণ এই মুহূর্তে আমরা বলতে বাধ্য যে, গত প্রায় ছয় বছর ধরে বাংলাদেশ শাসিত হচ্ছে অনির্বাচিত ব্যক্তিদের দিয়ে। বাংলাদেশের সংবিধান যদি অনির্বাচিত সরকারকে বৈধতা দিয়ে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব দিতে পারে, তাহলে অন্তর্র্বর্তীকালীন সময়ে কেন একজন বা এক ডজন নিরপেক্ষ অনির্বাচিত ব্যক্তি সরকার পরিচালনার দায়িত্ব নিতে পারবে না? এই প্রশ্নটির উত্তর আওয়ামী লীগ কর্তৃক কোথাও দেয়া হয়নি।
অনির্বাচিত ব্যক্তিদের দিয়ে দেশ শাসন
বর্তমানে আওয়ামী লীগ সরকার চাচ্ছে, তারা যেন ২০২৩ সালের শেষ পর্যন্ত এই সংসদ চালিয়ে নিতে পারে। তবে রাজনৈতিক চমক বলে একটি শব্দযুগল আছে। ওই রূপ একটি রাজনৈতিক চমক আমাদের জন্য অদূরভবিষ্যতে আসতেও পারে; নাও আসতে পারে। আসা বা না আসা নির্ভর করছে আওয়ামী লীগের মতিগতির ওপর এবং বিএনপিসহ বিরোধী দলের রাজপথের কর্মসূচির ওপর। বর্তমান সংসদ গঠনের সময়ই অনেক মারাত্মক ভুলত্রুটি ও সংবিধান লঙ্ঘন হয়েছে। নির্বাচন কমিশনও ভুল করেছে এবং সংবিধান লঙ্ঘন করেছে। নির্বাচন অনুষ্ঠানসংক্রান্ত গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের ব্যত্যয় ঘটানো হয়েছে মারাত্মক রকমের। আমি ওই আলোচনায় যাচ্ছি না। শুধু এটুকু বলব, বর্তমান সংসদ কার্যত অনির্বাচিত। বিগত সংসদে ১৫৪ জন ব্যক্তি বিনা ভোটে নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৫৪টি আসন অবশ্যই সংখ্যাগরিষ্ঠতা দেয়। সাংবিধানিকভাবে এ কথা বলা যাবে যে, ৩০০টি আসনেও যদি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ৩০০ জন নির্বাচিত হন, সেই সংসদও বৈধ। তাহলে আমরা অবশ্যই ধরে নিতে পারি যে, আমাদের বর্তমান সরকার ২০১৪ থেকে ২০১৮ এই পাঁচ বছর অনির্বাচিত ব্যক্তিদের দ্বারা চলেছে। শুধু তাই নয়, তাদের ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করার জন্য ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনটিকে অবর্ণনীয় অপাঙক্তেয় পঙ্কিল করেছে। বর্তমান সরকারের বক্তব্য হলো, তাদের উন্নয়নের ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য বাংলাদেশকে একটি মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করতে তারা কাজ করে যাচ্ছেন এবং (তাদের মতে) এই কাজকে এগিয়ে নিতেই তারা ক্ষমতায় অব্যাহত থাকতে চান। এটা আংশিকভাবে সত্য হলেও হতে পারে। কিন্তু এর বিপরীতে যে বড় বিষয়টি রয়েছে সেটি হচ্ছে, সরকারদলীয় ব্যক্তিদের দিয়ে ও সরকারের ছত্রছায়ায় পরিকল্পিত সর্বগ্রাসী মহাদুর্নীতি ও মহালুটপাট। সেই সাথে তারা যে গণতন্ত্রকে স্লো-পয়জনিংয়ের মাধ্যমে হত্যার প্রক্রিয়া চালু করেছে সেটাকেও তারা অব্যাহত রাখতে চায়। গত এগারো বছরে আওয়ামী লীগের প্রতি ছুড়ে দেয়া কোনো প্রশ্নের জবাব জনগণ পায়নি। কিন্তু এই প্রশ্নগুলোর জবাব এড়িয়ে যাওয়ার স্থায়ী কোনো সুযোগ নেই; কোনো না কোনো দিন, জনগণকে এই প্রশ্নের উত্তরগুলো দিতেই হবে। প্রশ্নগুলো হচ্ছে বড় বড় দুর্নীতি, বড় বড় গুম, বড় বড় হত্যা এবং ইমিডিয়েট প্রতিবেশীকে বড় বড় ছাড় দেয়া।
জনগণের চাওয়া এবং জাতীয় সংলাপ প্রসঙ্গ
এখন আমাদের দেশে আপামর জনসাধারণ চাচ্ছেন, বেগম জিয়ার মুক্তি এবং একটি নতুন নির্বাচন। কিন্তু এ ব্যাপারে সরকারি দলের উন্নাসিকতা, অহংবোধ এবং জেদ যে কোনো সমাধানের প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সর্বোপরি, সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছারও যথেষ্ট অভাব রয়েছে। একটি জাতীয় পর্যায়ের সর্বদলীয় রাজনৈতিক সংলাপ আয়োজন করা গেলে উত্তম হতো। কিন্তু সংলাপে গেলে যুক্তিতে হেরে যাওয়ার এবং সেই সঙ্গে একটি ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নেয়ার ভয় রয়েছে। অতএব সংলাপ পরিহার করাই তাদের জন্য বাঞ্ছনীয় বলে তারা মনে করছে। বিষয়টি অনেকটা দুষ্ট শিশুদের মতো। যেমন- শিশু যখন খেতে চায় না, মা তখন বলেন, তোমাকে খেতে হবে না, টেবিলে এসে বসো। তখন ওই শিশুটি টেবিলের কাছে এসে আবার দৌড়ে চলে যায়। কারণ ওই শিশু হঠাৎ করে অনুভব করে যে, টেবিলে বসলেই খেতে হবে। তাই সে টেবিলে না বসাটাকেই শ্রেয় মনে করে।
দু’টি ভোটের দিনের কাহিনী
অতি সাম্প্রতিক সময়ের কথায় আসি। ২৯ ডিসেম্বরের কথা এবং ৫ জানুয়ারির কথা। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর দিনের বেলা ভোট হওয়ার কথা ছিল; কিন্তু ২৯ তারিখ দিনের শেষে রাতে, সরকারের পরিকল্পনায় ও বাস্তবায়নে, ভোটকেন্দ্রগুলো দখল হয়ে যায়, ব্যালট পেপারে সিল মারা হয়ে যায় এবং ব্যালট বাক্স ভর্তি হয়ে যায়। ওই নির্বাচনের নাম ভোট ডাকাতির নির্বাচন। কিন্তু ১৮ দিন পরই, সরকার এই দিনটিকে পালন করবে, গণতন্ত্রের বিজয় যাত্রার মাইলফলক হিসেবে! ২০১৪ সালের জানুয়ারি মাসের ৫ তারিখের ভোটারবিহীন নির্বাচনের স্মৃতিরক্ষায় আগামী ৫ জানুয়ারি হবে, ক্ষমতাসীন সরকারের দৃষ্টিতে গণতন্ত্র রক্ষা দিবস এবং রাজপথের বিরোধী দলের দৃষ্টিতে হবে গণহত্যা দিবস। মহাশূন্য যানে, পৃথিবী থেকে ৪৫০ মাইল উপরে যখন একজন ব্যক্তি বসে থাকেন, তখন সেখান থেকে পৃথিবীটাকে কেমন দেখেন? ওই ব্যক্তি পৃথিবীটার একটি অংশ আলোকিত এবং অপর অংশকে অন্ধকার দেখেন। ২৯ ডিসেম্বর বা ৫ জানুয়ারিকেও যে দর্শক বা পর্যবেক্ষক যে রকম দেখতে চান, তিনি সে রকম দেখতে পারেন। একটি ঘটনা স্মৃতিতে আনুন। বর্তমান সরকারের একজন সম্মানিত সদস্য এখন থেকে ৯ বছর আগে পিলখানার বিডিআর গেটের ভেতরে এক বস্তা টাকাসহ মধ্যরাতে ধরা পড়েন। কেউ ওই ব্যক্তির নাম নেন না, শুধু কালো বিড়াল বলে থাকেন। কেন কালো বিড়াল বলেন? কালো বিড়াল এ জন্য বলেন যে, অন্ধকার রাতে কালো বিড়ালকে কেউ দেখতে পায় না। তদ্রুপ ৫ জানুয়ারির নাম নেয়ার প্রয়োজন নেই। ৫ জানুয়ারি কী হয়েছে সেসব দৃশ্য সে দিনকার টিভি চ্যানেলগুলো যারা দেখেছেন এবং ৬ জানুয়ারির পত্রপত্রিকাগুলো যারা পড়েছেন তাদের কাছে বেশ স্পষ্ট। আমি নিশ্চিতভাবেই বলতে পারি, সব টিভি চ্যানেলের সাংবাদিক বা কর্মকর্তারা আওয়ামী-বিরোধী ছিলেন না যে, তারা ইচ্ছাকৃতভাবে এরূপ রিপোর্ট ও প্রচার করেছে। তারা নিরপেক্ষভাবেই তাদের কাজ করে গেছেন। পত্রপত্রিকার বেলায়ও একই কথা প্রযোজ্য। সুতরাং ৫ জানুয়ারি কী হয়েছিল তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। সুতরাং, ৫ জানুয়ারি কী হয়েছি তা যেমন আর বলার অপেক্ষা রাখে নাই, তেমনি আরেকটি ৫ জানুয়ারি মার্কা নির্বাচন হোক সেটাও কেউ কামনা করেনি। কিন্তু তারা ৫ জানুয়ারি থেকেও অবমাননাকর, ৫ জানুয়ারি থেকেও অধিকতর গণতন্ত্র বিধ্বংসী নির্বাচনী প্রহসন ঘটে গিয়েছিল ২৯ ডিসেম্বর ২০১৮ সালের রাতে। বিজয়ের মাসে এই ভোট ডাকাতি ও গণতন্ত্র হত্যার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে লজ্জাবোধ করছি।
নতুন শুভ সিদ্ধান্ত নিতেই হবে
যা হোক, আমাদের একটি শুভ ও সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সিদ্ধান্তের প্রথম অংশটি হতে হবে এই যে, রাজনৈতিক অঙ্গনে ভদ্রতা, শালীনতা বজায় রাখতেই হবে। সিদ্ধান্তের দ্বিতীয় অংশটি হতে হবে এই যে, সব দলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে নতুন করে নির্বাচন করতে হবে। সিদ্ধান্তের তৃতীয় অংশটি হতে হবে এই যে, সব রাজনৈতিক কর্মে সাহস, স্বচ্ছতা ও সততা বজায় রাখতে হবে। সরকারকেও জনগণের অনুভূতির প্রতি সহানুভূতিশীল হতে হবে। আমরা যারা রাজপথের বিরোধী শিবিরে, আমাদের মূল লক্ষ্য হচ্ছে বাংলাদেশের সংবিধানকে জনবান্ধব করা এবং বর্তমান সরকার কর্তৃক আনা সাংবিধানিক সংশোধনীকে পুনর্বিবেচনার মাধ্যমে জনবান্ধব করা। সাম্প্রতিককালে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী সুযোগ পেলেই ১৯৭৫ সালের বাকশালীয় ব্যবস্থার প্রশংসা এবং উপকারিতার কথা প্রচার করেন। এটা পর্যবেক্ষণ করে এবং সরকারের অন্যান্য কর্মকাণ্ড মূল্যায়ন করার পর, আমার এবং আরো অনেকের অনভূতি হলো এই, বর্তমান শাসকদল একদলীয় শাসনব্যবস্থার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। সরকারদলীয় লোকরা বলছেন, সরকার বাংলাদেশকে উন্নয়নের চরম শিখরে নিয়ে যাচ্ছে এবং বাংলাদেশকে পৃথিবীর সামনে উন্নয়নের রোল মডেল বানিয়েছে (!!)। এখানে একটি কথা আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, অদক্ষতা, অসততা, প্রতারণা, অনিশ্চয়তা কাউকেই শান্তি দেয় না, উন্নয়নও ঘটায় না। সুতরাং দক্ষতা চাই, সততা চাই, নিশ্চয়তা চাই। আমরা সে নিশ্চয়তার অপেক্ষায় রইলাম। তবে নতুন বাংলাদেশের জন্য অপেক্ষার প্রহর যেন দীর্ঘ না হয়।
লেখক : মেজর জেনারেল (অব:); চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি
উৎসঃ নয়াদিগন্ত
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন