রাজনীতির চালকের আসনে বিএনপি
25 July 2023, Tuesday
অনেকেই মনে করেন রাজনৈতিক কৌশল গ্রহণের দিক থেকে আওয়ামী লীগের তুলনায় বিএনপি সবসময়ই পিছিয়ে থাকে। কথা অনেকটা সত্য। আওয়ামী লীগের কূটকৌশলের কাছে বিএনপি পেরে ওঠে না। তা ছাড়া মিথ্যাচার ও প্রতারণায়ও আওয়ামী লীগের তুলনা নেই। ফলে খোলা চোখে অনেক সময় মনে হয়, রাজনৈতিক খেলায় বিএনপি আওয়ামী লীগের তুলনায় পিছিয়ে।
তবে সাম্প্রতিক মাসগুলোতে খোলা চোখেই বিপরীত চিত্র দেখা যাচ্ছে। বিএনপির রাজনীতিকে দৃষ্টিকটুভাবে অনুসরণ ও অনুকরণ করছে আওয়ামী লীগ। গত বছরের শেষ দিকে বিএনপির বিভাগীয় সমাবেশ দেখে আওয়ামী লীগ অস্থির হয়ে পড়েছিল। এরপর বিএনপির আদলে তারা বিভিন্ন জায়গায় সমাবেশ করেছে। তাতে অবশ্য সরকারি দলের ক্ষতিই বেশি হয়েছে। মানুষ দুই দলের উপস্থিতির তুলনামূলক চিত্র দেখতে পেয়েছে। মানুষ আরো দেখেছে বিএনপির সমাবেশ ঠেকাতে রাষ্ট্রীয় এবং দলীয় সব শক্তি প্রয়োগ করা হলেও তা বিফলে গেছে। অন্যদিকে রাষ্ট্রীয় অর্থ দেদার খরচ করে সরকারি দল সমাবেশ করলেও তাতে উপস্থিতি ছিল নগণ্য। শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ রণে ভঙ্গ দেয়।
সম্প্রতি আবার সেই পথে হাঁটছে আওয়ামী লীগ। সব রাজনৈতিক শিষ্টাচার পদদলিত করে বিএনপির প্রতিটি সমাবেশের দিন তথাকথিত শান্তি সমাবেশ করছে। এসব শান্তি সমাবেশে ঢাকার বাইরে অনেক সময় কয়েক শ’ লোকও হাজির করতে ব্যর্থ হচ্ছে সরকারি দল। বিপরীতে বিএনপির প্রতিটি সমাবেশে জনতার ঢল নামছে। সম্প্রতি নয়াপল্টনে লাখ লাখ লোকের যে জনসমুদ্র হয়েছে তা অতীতে কেবল খালেদা জিয়ার উপস্থিতিতেই হয়েছে। এই জনসমুদ্র আওয়ামী মহলে কাঁপন ধরিয়েছে।
এই জনসমুদ্র থেকে বিএনপি শেখ হাসিনার সরকারের পতনের এক দফা ঘোষণা করেছে। বিএনপির এক দফার বিপরীতে হাস্যকরভাবে আওয়ামী লীগও এক দফা ঘোষণা করে। অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন, তাদের এই এক দফা দাবি কার কাছে?
বিএনপির রাজনীতি অনুকরণের সর্বশেষ ঘটনাটি ঘটিয়েছে আওয়ামী লীগ ‘ছাত্র-যুব সমাবেশ’ করার ঘোষণা দিয়ে। সবার জানা, বিএনপি সারা দেশে তারুণ্যের সমাবেশ করে তরুণ প্রজন্মের পাশাপাশি সব বয়সী মানুষের মধ্যে অভূতপূর্ব চাঞ্চল্য সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে। এর দেখাদেখি এখন আওয়ামী লীগও একই ধরনের সমাবেশ করতে বাধ্য হচ্ছে। এক দফা আদায়ে বিএনপি সারা দেশে পদযাত্রা করার ঘোষণা দেয়ার পর দিনই আওয়ামী লীগও শোভাযাত্রা করার ঘোষণা দেয়। এভাবে বিএনপির প্রতিটি রাজনৈতিক কর্মসূচি নকল করছে ক্ষমতাসীনরা, নিজেরা কোনো সৃজনশীল কর্মসূচি দিতে পারছে না।
রাজনীতি সচেতন অনেক মানুষকে বলতে শুনেছি, শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ও বেগম খালেদা জিয়ার সুযোগ্য সন্তান তারেক রহমানের রাজনৈতিক কৌশলের কাছে ধরাশায়ী হচ্ছে জনবিচ্ছিন্ন আওয়ামী লীগ। ২২ জুলাই শনিবার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে তার দেয়া তারুণ্যের সমাবেশ ছিল স্মরণকালের বৃহত্তম। এর অনুকরণে আওয়ামী লীগ তাদের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে দিয়েছিল সমাবেশ।
বিএনপির আরেকটি কৌশলের কাছেও মার খেয়েছে আওয়ামী লীগ সরকার। বিএনপি এ সরকারের অধীনে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেয়ার পর প্রতিটি নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি হচ্ছে লজ্জাজনক পর্যায়ের। স্থানীয় নির্বাচনে জাতীয় রাজনীতি সাধারণত বড় ফ্যাক্টর না হলেও বিএনপির বর্জনের কারণে বেশির ভাগ ভোটার কেন্দ্রমুখী হননি। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরকেও এমন অসত্য বক্তব্য দিতে হয়েছে যে, উন্নত দেশেও নাকি ৩০ শতাংশের নিচে ভোট পড়ে। অথচ আমরা সর্বশেষ তুরস্কের নির্বাচনে দেখেছি সেখানে ভোট পড়েছে প্রায় ৮৫ শতাংশেরও বেশি।
ভোটের করুণ চিত্র দেখা গেছে ঢাকা-১৭ আসনে। সেখানে সাড়ে ১১ শতাংশ ভোট পড়েছে বলে নির্বাচন কমিশনের দাবি। সাংবাদিকদের অনুসন্ধানে বলা হয়েছে, ৫ শতাংশের বেশি ভোট পড়েনি।
আরেকটি অঙ্গনে বিএনপির কাছে অচিন্ত্যনীয়ভাবে ধরাশায়ী হচ্ছে আওয়ামী লীগ। এতদিন মনে করা হতো, আওয়ামী লীগের কূটনৈতিক উইং খুবই শক্তিশালী। সন্ত্রাসবিরোধী লড়াইয়ের নামে তারা পশ্চিমা দুনিয়ার অকুণ্ঠ সমর্থন পেতো। বিএনপি সেই জায়গাটিতেও প্রবলভাবে আঘাত করতে সক্ষম হয়েছে। বিএনপি পশ্চিমাদের ভুল ভাঙাতে সক্ষম হয়েছে যে আওয়ামী লীগ সরকারের সন্ত্রাসবিরোধী তৎপরতা লোক দেখানো। আদতে বাংলাদেশে এই সঙ্কট প্রবল নয়। তা ছাড়া যে দলটি নিরাপত্তা বাহিনীকে অব্যাহতভাবে প্রতিপক্ষকে হত্যা, গুমের মতো ঘৃণ্য কাজে ব্যবহার করছে তারা সন্ত্রাসবিরোধী হয় কিভাবে?
বরং নিরাপত্তা বাহিনীকে বিরোধী মত দমনে অব্যাহতভাবে ব্যবহারের ফলে বাংলাদেশে গণতন্ত্র এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতার নজিরবিহীন অবনমন ঘটেছে। দু’টি ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ এখন বিশ্বে তলানিতে। পশ্চিমারা বুঝতে পেরেছে, এভাবে এরকম একটি কর্তৃত্ববাদী এবং নিষ্ঠুর সরকারের সাথে তারা কাজ করতে পারে না। ফলে পশ্চিমা দুনিয়া থেকে বর্তমান সরকার এখন আক্ষরিক অর্থেই বিচ্ছিন্ন। এমনকি ভারত চিরাচরিতভাবে আওয়ামী লীগের বন্ধু হলেও এবার এই দেশটিও মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।
অন্যদিকে সরকারের অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা এতটাই বাজে যে; স্বয়ং এফবিসিসিআই সভাপতি বলেছেন, বাংলাদেশে এমন অর্থনৈতিক সঙ্কট তিনি গত ৪০ বছরে দেখেননি। সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যে মানুষের জীবন নরক হয়ে উঠেছে। এসবের ফলে সরকারবিরোধী জনমত তুঙ্গে।
পর্যবেক্ষকদের বিবেচনায়, বর্তমান সরকার তিনটি বড় বিপর্যয়ে পড়েছে। প্রথমত, নজিরবিহীন কূটনৈতিক সঙ্কট, দ্বিতীয়ত, সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যে অর্থনৈতিক বিপর্যয় এবং এর ফলে গড়ে ওঠা সরকারবিরোধী প্রবল জনমত। ফলে আওয়ামী লীগকে এখন ২০ শতাংশের মতো জনসমর্থন নিয়ে ৭০ শতাংশের বিরুদ্ধে অসম লড়াইয়ে নামতে হয়েছে।
বিএনপি এর প্রতিটিকে কমবেশি ক্যাশআউট করেছে। একের পর এক রাজনৈতিক কর্মসূচির মাধ্যমে অজোপাড়াগাঁয়েও বিএনপি এসব বার্তা পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছে।
অন্যদিকে নির্বাসিত জীবনে তারেক রহমানের বিরামহীন রাজনৈতিক তৎপরতায় বিএনপির প্রতিটি নেতাকর্মী এখন দলীয় কর্মসূচিতে ঝাঁপিয়ে পড়ছেন।
এসবের ফল হচ্ছে, কয়েক দশকের মধ্যে এই প্রথম বিএনপি এখন রাজনীতির চালকের আসনে। সরকারি দলের নেতিবাচক পাল্টা কর্মসূচি নিয়ে মানুষের কোনো আগ্রহ নেই। সবার দৃষ্টি থাকে বিএনপি কী কর্মসূচি দিলো সে দিকে। গত কয়েক বছর বিএনপির একটি বড় ব্যর্থতা ছিল রাজধানীতে আন্দোলন কর্মসূচি সফল করতে অপারগতা। সেটি তারা ভালোভাবে কাটিয়ে উঠেছে এবং ঘুরে দাঁড়িয়েছে। এখন ঢাকার কর্মসূচি আগের তুলনায় অনেক সফল হচ্ছে। ১২ জুলাই ঢাকায় ঐতিহাসিক সমাবেশের পর টানা দু’দিন সফল পদযাত্রার মাধ্যমে রাজধানীবাসীকে আন্দোলিত করতে সক্ষম হয়েছে বিএনপি। তেমনি সোহরাওয়ার্দীর তারুণ্যের সমাবেশ অভূতপূর্ব সাড়া জাগিয়েছে।
জোটের রাজনীতিতেও বিএনপি দারুণ সাফল্য দেখিয়েছে। ক্ষমতাসীন দলের মৃতপ্রায় জোটের বিপরীতে বিএনপি এখন দেশের বৃহত্তম জোটের নেতৃত্ব দিচ্ছে। সব মিলিয়ে দেশে এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এখন আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে বিএনপি।
তবে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল মনে করেন, লক্ষ্যে পৌঁছতে হলে বিএনপি এবং বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিটি নেতাকর্মীকে অতন্দ্র প্রহরীর ভূমিকায় থাকতে হবে। সামনের কয়েকটি মাস খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সরকার পদে পদে ফাঁদ পাতবে। তাতে পা দেয়ার সুযোগ নেই। সাহস, কৌশল ও ত্যাগের মাধ্যমে সফল করতে হবে গণতান্ত্রিক আন্দোলন, বাঁচাতে হবে প্রিয় মাতৃভূমিকে।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক, সাবেক সাধারণ সম্পাদক, জাতীয় প্রেস ক্লাব
উৎসঃ নয়াদিগন্ত
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন