হায়রে সুষ্ঠু নির্বাচন
31 January 2023, Tuesday
প্রশাসনের মাঠপর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা জেলা প্রশাসকদের (ডিসি) সম্মেলন প্রতি বছর হয়ে থাকে। এবার ঢাকায় তিন দিনব্যাপী ডিসি সম্মেলন ২৪ জানুয়ারি মঙ্গলবার শুরু হয়ে ২৬ জানুয়ারি বৃহস্পতিবার রাতে নৈশভোজের মাধ্যমে শেষ হয়।
এবারের ডিসি সম্মেলনে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের দেয়া বক্তব্য রাজনৈতিক মহলে বেশ কৌত‚হলের সৃষ্টি করেছে। কৌত‚হলের কারণ তিনি ডিসিদেরকে নির্বাচনসংক্রান্ত নির্দেশনা দিয়েছেন। সম্মেলনের শেষ দিনে বৃহস্পতিবার ডিসিদের উদ্দেশে আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, ‘একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দেশবাসী চাইছেন। সারা বিশ্বও সেদিকে তাকিয়ে আছে। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য ডিসিদের ভ‚মিকা প্রাধান্য পাবে, মুখ্য হবে। সে জন্য ডিসিরা তৈরি থাকুন, যাতে আপনারা জাতিকে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন উপহার দিতে পারেন।’
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য চমৎকার। এটা প্রকৃতই দেশবাসীর মনের কথা। কারণ গত ১৪ বছর ধরে দেশের মানুষ ভোট দিতে পারছেন না সুষ্ঠু নির্বাচন না হওয়ার কারণে। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য তাই ভোটাররা উদগ্রীব। সবাই চায় দেশে একটি সুষ্ঠু গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হোক। আন্তর্জাতিক বিশ্বও সেটা চাইছে। কিন্তু কথা হলো এটি তাদের সরকার ও দলের মনের কথা কি না?
প্রথমত, নির্বাচনসংক্রান্ত নির্দেশনা দেয়ার দায়িত্বপ্রাপ্ত-সাংবিধানিক সংস্থা হলো নির্বাচন কমিশন। তারাই নির্বাচন পরিচালনা করে থাকে। নির্দেশনাও নির্বাচনী আইন অনুযায়ী তারাই দিয়ে থাকেন। সরকার কিংবা সরকারের কোনো মন্ত্রীর কাজ হলো নির্বাচনকালীন সময়ে নির্বাচন কমিশনের চাহিদা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দেয়া। যেমন যদি নির্বাচন কমিশনের পুলিশের দরকার হয়, আনসারের দরকার হয় কিংবা বিজিবির দরকার হয় তা সরবরাহ করা। কিন্তু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নির্বাচন কমিশনের এ দায়িত্বকে নিজেদের দায়িত্ব মনে করে ডিসিদের নির্দেশনা দিয়েছেন। তিনি এ-ও বলেছেন, এ ধরনের একটি নির্বাচন দেশবাসী দেখতে চায় এবং সারাবিশ্বও সেভাবে তাকিয়ে আছে।
মন্ত্রীর কথা থেকেই পরিষ্কার দেশে অতীতে যে নির্বাচনগুলো হয়েছে সেগুলো সুষ্ঠু গ্রহণযোগ্য হয়নি। সেই নির্বাচনগুলো দেশবাসীর আশা পূরণ করেনি। তাই আগামী জাতীয় নির্বাচন যাতে সুষ্ঠু গ্রহণযোগ্য হয় তা দেশবাসী এবং একই সঙ্গে বিশ্ববাসী চাচ্ছে।
ধরে নিলাম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আন্তরিকভাবে চাইছেন দেশে একটি সুষ্ঠু গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হোক, সেক্ষেত্রে তাহলে কী করণীয়? সেই সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য প্রয়োজন নির্বাচনকালীন একটি নিরপেক্ষ সরকার প্রতিষ্ঠা করা, একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন করা। তাহলে তারাই নির্বাচনের জন্য একটি লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করবেন। ডিসি-এসপি-ওসিরা নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করবেন। ফলে জনগণ যাকে ইচ্ছা তাকে ভোট দিতে পারবেন। অর্থাৎ সুষ্ঠু গ্রহণযোগ্য নির্বাচনটি হবে। সেটা না করে শুধু সুষ্ঠু নির্বাচন বললেই কি হবে? হাওয়াই কথার কি কোনো মূল্য আছে?
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান কামালের দল আওয়ামী লীগ গত ১৪ বছর ধরে ক্ষমতায়। তারা কী ধরনের নির্বাচন করেছেন দেশবাসীর অজানা নয়। বিগত দুটো জাতীয় নির্বাচনে দেশের মানুষ ভোট দিতে পারেনি। নির্বাচনের নামে দেশে দুটো জঘন্য প্রহসন সংঘটিত হয়েছে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনটি ছিল ভোট ও ভোটারবিহীন নির্বাচনী প্রহসন। আর ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনটি ছিল নিশিরাতের নির্বাচনী প্রহসন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নিয়ন্ত্রণাধীন পুলিশের লোকজনকেই দেখা গেছে সরকারি দলের ক্যাডারদের সঙ্গে একাকার হয়ে কিভাবে নির্বাচনের আগের রাতে জাল ব্যালটে বাক্স ভরেছেন সেই দৃশ্য দেশবাসী প্রত্যক্ষ করেছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান কামালের চেয়ে বিষয়টি তো আর কেউ ভালো জানেন না। শুধু ওই দুটো জাতীয় নির্বাচনই নয়, গত ১৪ বছরে দেশে সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচন, উপজেলা নির্বাচন, জেলা পরিষদ নির্বাচন, পৌর নির্বাচন এমনকি ইউপি নির্বাচনগুলো কী ন্যক্কারজনক ইতিহাস সৃষ্টি করেছে তা সবার জানা।
আগামী নির্বাচনটি যাতে সুষ্ঠু গ্রহণযোগ্য হতে পারে সে জন্য সারা দেশ থেকে আওয়াজ উঠেছে। বিশ্বের গণতন্ত্রমণা দেশগুলোও এ ধরনের নির্বাচনের জন্য চাপ সৃষ্টি করেছে। বিরোধী দলগুলো এ ধরনের নির্বাচনের দাবিতে সোচ্চার হয়েছে। আন্দোলন চলছে। ফলে রাজনৈতিক মহল মনে করেন পরিস্থিতিকে ধামাচাপা দিতেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এমন কথা বলেছেন। যারা গত ১৪ বছর ধরে নির্বাচনীব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দিয়েছেন তাদের মুখে সুষ্ঠু নির্বাচনের কথা এলে সেটা কি বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়? ডিসিদের না বলে তিনি যদি বলতেন দেশবাসী ও বিশ্ববাসী যেহেতু একটি সুষ্ঠু গ্রহণযোগ্য নির্বাচন চাচ্ছে তাই আমরাও সিদ্ধান্ত নিয়েছি এমন একটি নির্বাচন হওয়ার জন্য আমাদের সরকারে থাকার দরকার নেই। নির্বাচনকালীন সময়ে নিরপেক্ষ একটি সরকার হবে এবং তারাই একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠন করে নির্বাচন পরিচালনা করবেন। তাহলে মনে হতো স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আন্তরিকভাবেই সেটা চেয়েছেন। এটা তাদের সরকারেরই সিদ্ধান্ত। কিন্তু তার কোনো লক্ষণ কি আমরা দেখতে পাই? দেশবাসী লক্ষ্য করছেন, সরকার অতীতের নির্বাচনের মতোই আরেকটি নির্বাচন অনুষ্ঠানেরই পাঁয়তারা করছে। দুটি নির্বাচনী প্রহসন দেশবাসী দেখেছে। তৃতীয় প্রহসন কিভাবে সঙ্ঘটিত হয় সেটিই দেখার বিষয়। বর্তমানে জাতীয় পার্টিকে নিয়ে সরকার কী ধরনের খেলাধুলায় নেমেছে তা কারো চোখ এড়িয়ে যাচ্ছে না। নতুন দল গঠন করে, বিএনপির সমমনাদের ভাগিয়ে নিয়ে, বিএনপিকে ভাঙার চেষ্টা করে আগামী নির্বাচনী প্রহসন সঙ্ঘটিত করার নানা আলামতের কথাও তো বাজারে শোনা যাচ্ছে। বর্তমান ক্ষমতাসীনদের অধীনে গত নির্বাচনটি কিভাবে হয়েছে তার কিছুটা নমুনা নিম্নে বর্ণনা করছি।
নৌকার শতভাগ বনাম ধানের শীষের শূন্য ভোটের সেই নির্বাচন
২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনটি কত ভুয়া এবং নিকৃষ্ট ছিল সেটা নির্বাচন কমিশনার মরহুম মাহবুব তালুকদারই শুধু বলে যাননি, খলনায়ক সিইসি কে এম নূরুল হুদাও স্বীকার করেছেন। এ নির্বাচনে ২১৩টি ভোটকেন্দ্রে শত ভাগ ভোট পড়া সম্পর্কে নূরুল হুদার উক্তি ছিল- ‘এ ভোট স্বাভাবিক নয়। শতভাগ ভোট পড়ায় অস্বস্তিতে ছিলাম।’ নৈশভোট সম্পর্কে ২০১৯ সালের ৯ মার্চ নির্বাচন কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ কর্মশালায় তিনি বলেছিলেন, ‘ইভিএম মেশিনে যদি ভোটের ব্যবস্থা করা যায়, তাহলে আর নির্বাচনের আগের রাতে ব্যালট পেপারে সিল মেরে বাক্সভর্তি করার সুযোগ থাকবে না।’ অর্থাৎ নৈশভোট তিনি স্বীকার করে নেন। তেমনি সিইসি হিসেবে অবসর নেয়ার পর জুন ২০২২ এক বিতর্ক প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে তিনি বলেন, ‘দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করা একটি স্পর্শকাতর ও চ্যালেঞ্জিং বিষয়।’
ওই নির্বাচন সম্পর্কে মাহবুব তালুকদার বলেছিলেন, ‘নির্বাচনের আগের রাতে ভোট হয়েছে এটা প্রতিষ্ঠিত সত্য। আর ২১৩টি কেন্দ্রে যে শতভাগ ভোট পড়েছে তা কেউই বিশ্বাস করবে না। কারণ নির্বাচনের আগের রাতে বাক্সভর্তি ব্যালটের ছবি বিবিসি প্রচার করেছে।’
শুধু শতভাগ ভোটই নয়, ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল বিএনপির ধানের শীষের প্রার্থীরা অসংখ্য কেন্দ্রে শূন্য ভোট পেয়েছেন এমন অবিশ্বাস্য নজিরও স্থাপিত হয়েছে। নির্বাচনটির ছয় মাস পর নির্বাচন কমিশন কেন্দ্রভিত্তিক যে ফল প্রকাশ করে সেটা দখলেই এমন নানা জালিয়াতির ঘটনার ধরা পড়বে।
যে কেউ www.ecs.gov.bd ওয়েবসাইটে ঢুকে নির্বাচনের সারা দেশের কেন্দ্রভিত্তিক ফল দেখে নিতে পারেন। এর বাম পাশেই পাওয়া যাচ্ছে নির্বাচনীয় ফলাফল। সবাই এতে ঢুকে নিজ নিজ কেন্দ্রের ফলাফল দেখতে পারেন। তাহলে ৩০ ডিসেম্বর ওই কেন্দ্রে কেমন ভোট দেখেছেন আর এখন কেমন রেজাল্ট দেখছেন এ দুটো চিত্র মেলাতে পারবেন।
৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে (অনেকে বলেন, ২৯ ও ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচন) ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৬ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিলেন তাজুল ইসলাম। তিনি এ নির্বাচনের পর মন্ত্রী হয়েছিলেন। এর আগেও মন্ত্রী ছিলেন। টক শোতেও তাকে দেখা যেত। বেশ পরিচিত মুখ। তিনি তার এলাকায় এতটাই জনপ্রিয়(!) যে, সম্মানিত ভোটারগণ প্রতিপক্ষের প্রার্থীকে শূন্য রেখে সব উজাড় করে দেন মি. তাজুল ইসলামকে। একটা দুটো নয়, মোট ৯১টি কেন্দ্রের মধ্যে অন্তত ৫১টি কেন্দ্রে ধানের শীষ প্রার্থীর ভোট শূন্য! ৫টি সেন্টারে ১টি করে ও ৬টি সেন্টারে ২টি করে ভোট পেয়েছেন ধানের শীষ প্রার্থী। মজার ব্যাপার হচ্ছে এই যে ৯১টির মধ্যে ৬২ সেন্টারে ধানের শীষ প্রার্থী শূন্য বা দুয়েকটি করে ভোট পেয়েছেন সেই সেন্টারগুলোতে ভোট পড়ার হার অন্য কেন্দ্রের তুলনায় বেশি। এই কেন্দ্রগুলোর প্রায় সবগুলোতেই ভোট কাস্টিংয়ের হার ৯৪ থেকে ৯৯ শতাংশ। ভেবে দেখার বিষয়, কী জনপ্রিয় নেতা তিনি! ওই কেন্দ্রগুলোর এলাকায় বিএনপির কমিটিতে থাকা নেতারাও যেন কেন্দ্রে গিয়ে নৌকায় ভোট দিয়ে এসেছেন! যদি বিএনপি নেতারা নৌকায় ভোট না দেন তাহলে কি করে প্রায় শতভাগ ভোট পড়ার পরেও ধানের শীষের ভোট শূন্য হয়?
নির্বাচনে আরো তুখোড় কারিশমা দেখিয়েছেন আওয়ামী লীগের ডাকসাইটে নেতা মরহুম মোহাম্মদ নাসিম। সিরাজগঞ্জ-১ আসনে তার প্রতিপক্ষ ধানের শীষের প্রার্থী জনপ্রিয় সঙ্গীত শিল্পী কনক চাঁপাকে হাজারখানেক ভোট ধরিয়ে দিয়ে তিনি জয়ী হয়েছেন সোয়া তিন লাখ ভোটে! এ আসনে ১৬৮ কেন্দ্রের মধ্যে ৮৫টি কেন্দ্রে ধানের শীষের প্রার্থী পেয়েছেন শূন্য ভোট। ১১টি কেন্দ্রে ১ ভোট করে, ১৩ টি কেন্দ্রে ২টি করে ও ৬ টি কেন্দ্রে ৩টি করে ভোট পেয়েছেন ধানের শীষের প্রার্থী কনক চাঁপা। অথচ এসব কেন্দ্রেও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মতোই ভোট পড়ার হার ৯৬ থেকে ৯৯ শতাংশ।
আমাদের জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজা ক্রিকেটার হিসেবে যেমন জনপ্রিয় তেমনি তুমুল জনপ্রিয় রাজনীতিতেও। তা না হলে নড়াইল-২ আসনে তার প্রতিদ্ব›দ্বী ধানের শীষের প্রার্থী অন্তত ২১টি কেন্দ্রে কী করে শূন্য ভোট পেলেন! এখানেও যথারীতি ধানের শীষে শূন্য ভোট পাওয়া কেন্দ্রেগুলোর বেশির ভাগে ভোট কাস্টিংয়ের হার ৯৫ শতাংশের উপরে।
কুমিল্লা-২ আসনে বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটি সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেনও অন্তত ৩টি কেন্দ্রে শূন্য ভোট পেয়েছেন। কুমিল্লা ১০ আসনে ধানের শীষের প্রার্থী তুখোড় ও জনপ্রিয় নেতা মনিরুল হক চৌধুরীকেও অন্তত ৪টি কেন্দ্রে দেয়া হয়েছে শূন্য ভোট। এমনকি বিএনপির একচেটিয়া ঘাঁটি বলে পরিচিত বগুড়া ১ আসনেও অন্তত ২টি কেন্দ্রে ধানের শীষের প্রার্থীর ভাগ্যে জুটেছে শূন্য ভোট!
লক্ষ্মীপুর-১ আসনটি সব সময়ই বিএনপির ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত। সেই ঘাঁটিতে এবার ধানের শীষের প্রার্থী টিভি টক শো’র জনপ্রিয় মুখ এলডিপি নেতা শাহাদত হোসেন সেলিম পেয়েছেন ৪ হাজারেরও কম ভোট। আর রাজনীতির মাঠে অপরিচিত একজন নৌকার প্রার্থী পেয়েছেন ১ লাখ ৮৫ হাজারেরও বেশি ভোট। এখানে ধানের শীষের প্রার্থী অন্তত ৫টি আসনে শূন্য ভোট পেয়েছেন। তিনি একশ’র বেশি ভোট পেয়েছেন মাত্র ৪টি কেন্দ্রে! এই হলো ইলেকশনের নমুনা।
মাদারীপুর-২ আসনে শাহজাহান খানের বিপরীতে ধানের শীষের প্রার্থীও অন্তত ৩৫টি কেন্দ্রে শূন্য ভোট পেয়েছেন। মাদারীপুর-শরীয়তপুর অঞ্চলে ধানের শীষের প্রার্থীর শূন্য ভোটের আধিক্যের সঙ্গে লক্ষণীয় বিষয় হলো দু-একটি কেন্দ্র বাদে তাদের ভোট কোথাও দুই সংখ্যা অতিক্রম করতে পারেনি। বেশির ভাগ কেন্দ্রে দুই-চার ভোট দিয়েই ধন্য করেছে তাদের।
সারা দেশের চিত্র প্রায় একই রকম। তবে এ ক্ষেত্রে দেশসেরা জনপ্রিয়! নেতা গোপালগঞ্জ-১ আসনের ফারুক খান। গোপালগঞ্জ-৩ আসনে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ধানের শীষ প্রার্থী ১২৭ ভোট পেলেও ফারুক খানের আসনে পেয়েছেন মাত্র ৫৭ ভোট! এখানে ১৩৩ কেন্দ্রের মধ্যে ১২২টি কেন্দ্রে ধানের শীষের ভোট শূন্য! বাকি ১১ কেন্দ্রে ৫৭ ভোট পেয়েছে ধানের শীষ। ফারুক খান পেয়েছেন ৯৯ শতাংশ ভোট। আর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৯৯ দশমিক ৭৪ শতাংশ ভোট পেলেও তার আসনে ১০৮টি কেন্দ্রের মধ্যে ধানের শীষ শূন্য ভোট পেয়েছে ৮৯টি কেন্দ্রে। বাকি ১৯ কেন্দ্রে ধানের শীষের প্রার্থী পেয়েছেন ১২৭ ভোট। তার মানে হলো : বঙ্গবন্ধুর গোপালগঞ্জে, শেখ হাসিনার গোপালগঞ্জে শেখ হাসিনার চেয়েও বেশি জনপ্রিয় ফারুক খান!
৯৯ শতাংশ ভোট পাওয়া প্রার্থীর মধ্যে তিনি ছাড়াও আছেন সিরাজগঞ্জ-১ আসনে সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী মরহুম মোহাম্মদ নাসিম, গোপালগঞ্জ-২ আসনে শেখ ফজলুল করিম সেলিম, মাদারীপুর-১ আসনে নূর-ই-আলম চৌধুরী লিটন, শরীয়তপুর ১ আসনে ইকবাল হোসেন। এসব আসনে ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থীরা ১ শতাংশের কম ভোট পেয়েছেন।
এ নির্বাচনে বেশির ভাগ আসনে জয়ী প্রার্থীদের সাথে পরাজিতদের ভোটের ব্যবধান লাখের উপরে। সবচেয়ে বড় ব্যবধানে জয়ী হয়েছেন ঢাকা ১৯ আসনে (সাভার) আওয়ামী লীগের প্রার্থী ডা: মো: এনামুর রহমান। তার সাথে বিএনপির প্রার্থীর ব্যবধান ৪ লাখ ২০ হাজার ৬৪৮ ভোটের।
বিএনপির বড় নেতারাও এই নির্বাচনে হেরেছেন বড় ব্যবধানে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমদ নোয়াখালী-৫ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে। এই আসনে মওদুদ পেয়েছেন ১০ হাজার ৯৭০ ভোট। আর ওবায়দুল কাদের পেয়েছেন মোট ভোটের ৯৩ শতাংশ বা ২ লাখ ৫২ হাজার ৭৪৪ ভোট।
নরসিংদী-২ আসনে বিএনপির ড. আবদুল মঈন খান পেয়েছেন ৭ হাজার ১৮০ ভোট। এই আসনে আওয়ামী লীগের আনোয়ারুল আশরাফ খান ১ লাখ ৭৫ হাজার ৭১১ ভোট।
এই যে ধানের শীষের প্রার্থীর শূন্য ভোট আর আওয়ামী লীগের প্রার্থীর এত এত ভোট সেখানে নতুন মাত্রা যোগ করেছে দুই শতাধিক কেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়া। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ২১৩টি কেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়েছে।
এ নির্বাচনে ৪১ হাজারের বেশি কেন্দ্রে ভোট হয়। এতে ২১৩ কেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়েছে। ৭ হাজার ৬৮৯ কেন্দ্রে ৯০ থেকে ৯৯.৯৯ শতাংশ ভোট পড়েছে। সংসদ নির্বাচনে গড় ভোট দেখানো হয় ৭৯.৩৬ শতাংশ।
ওয়ার্ড, ইউনিয়ন, থানা ও পৌর কমিটি মিলে একটি আসনে বিএনপি এবং তার অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের শুধু কমিটিতে থাকা নেতার সংখ্যা অন্তত দশ হাজার। তাদের পরিবারের সদস্য না হয় বাদই দিলাম। সেখানে এই যে ধানের শীষের শূন্য ভোট ও একটি আসনে সর্বসাকুল্যে ৫৭ বা ১২৭ ভোট পাওয়া সেটা কি কোনো হিসেবে মিলে? ধরে নিলাম ওই এলাকায় বিএনপির নেতারাও ভোট দিতে যায়নি। তাহলে সেসব কেন্দ্রে আবার শতভাগ বা ৯৮-৯৯ শতাংশ ভোট পড়ল কী করে? আর ভোটার লিস্ট হওয়ার পর কেউ বিদেশে, কেউ অসুস্থ, কেউ নির্বাচনী কাজে অন্য এলাকায় থাকাসহ নানাবিধ কারণে শতভাগ ভোট পড়া একেবারেই অসম্ভব। অসংখ্য কেন্দ্রে বিএনপির শূন্য ভোট ও ২১৩ কেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়া ভুয়া ও নিকৃষ্ট নির্বাচনেরই প্রমাণ।
শতভাগ ভোট পড়া নিয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদাও অবাক হয়েছেন। তিনি বলেন, কেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়া স্বাভাবিক মনে হয় না। কিন্তু প্রিজাইডিং ও রিটার্নিং কর্মকর্তা যেহেতু এ বিষয়ে আগে কিছু জানাননি, তাই এখন ইসির কিছু করার নেই। মামলা হলে আদালত যদি নির্বাচন বাতিল করে ফের নির্বাচন দেন, সেটি আদালতের এখতিয়ার।
ভোট গ্রহণে নিয়োজিত কর্মকর্তারা আগে জানাননি বুঝলাম কিন্তু ছয় মাস পর তো জানলেন। তাদের বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নেয়া হলো না? আসলে এই সিইসি বাহিনী সবই করেছেন জেনে বুঝে পরিকল্পনা মাফিক। তিনি এ-ও জানেন, নির্বাচনে এই ভয়াবহ জালিয়াতি নিয়ে কেউ আদালতে গেলেও তা নিষ্পত্তি হতে হতে সংসদের মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে। ততদিনে তিনিও হয়তো আর সিইসি থাকবেন না। তাই সাংবাদিকদের কাছে ছিল তার এ কৌশলী উত্তর। এখন সেই সিইসি নূরুল হুদা নেই। নতুন সিইসি এসেছেন। সামনে আবার নির্বাচন। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্বাচনী প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন। জনসভা করছেন। নৌকায় ভোট চাচ্ছেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুষ্ঠু গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের কথা বলছেন। হায়রে সুষ্ঠু নির্বাচন! তাদের দ্বারা কী নির্বাচন হয়, সেটি সময়ই বলে দেবে।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, সাবেক সাধারণ সম্পাদক, জাতীয় প্রেস ক্লাব
উৎসঃ নয়াদিগন্ত
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন