বিশ্ব গণতন্ত্র দিবস উপলক্ষে বিবিসি আয়োজিত একটি অনুষ্ঠান শুনছিলাম। বিষয় ছিল, বাংলাদেশের তরুণ ভোটারদের ভাবনা। আলোচনায় অংশ নেন ২০০৮ সালের নির্বাচনে প্রথমবারের মতো ভোট দিয়েছিলেন এমন কয়েকজন ভোটার। এদের অনেকে বললেন, তারা এখন ভোটবিমুখ। আর ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার আগ্রহ পান না।
একজন গৃহিণী সালসাবিল বিবিসিকে বলেন, যদি আমি ঠিকমতো ভোটটি দিতে পারতাম তাহলে ভোট দিয়ে আমি পছন্দের সরকারকে নির্বাচন করতে পারতাম। যেহেতু আমি ভোটই দিতে পারছি না, আমার মতামতের তো কোনো গুরুত্ব নেই। শিক্ষার্থী ইশরাত জাহান ঐশী বলেন, আমি যখন নাম এন্ট্রি করলাম একজন লোক এসে বলল, আমার সামনে ভোট দিতে হবে। অবশ্যই এ ঘটনায় মর্মাহত হয়েছি। আমি চাই আমার যে গণতান্ত্রিক অধিকার সেটি চর্চা করতে; কিন্তু বিগত নির্বাচনে আমার অভিজ্ঞতার কারণে আমি দ্বিতীয়বার ভাবব, আগামীতে ভোট দিতে যাব কি না। যদি ভোট দেয়ার ব্যাপার থেকে উপসংহারে আসতে চাই, সে ক্ষেত্রে বলব, আমি গণতন্ত্র চর্চা করতে পারছি না।
শিক্ষার্থী মহিউদ্দিন মাহি বলেন, গণতন্ত্র সম্পর্কে বই পড়ে যতটা না উৎসাহিত হই, বাস্তবে বা মাঠে চর্চা দেখে ততটাই হতাশ হই। শিক্ষার্থী মরিয়ম আজিজ মৌরিন বলেন, শুধু রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ভোট দিতে পারছি না, ব্যাপারটি এমন নয়। আমরা ব্যক্তিগত জীবনেও কোনো ক্লাব বা সংগঠনে সে ভোটাধিকার চর্চাটা করতে পারছি না। কোনো প্রভাবশালী ব্যক্তি এসে সে ভোটটি দিয়ে দিচ্ছেন। ব্যক্তি হিসেবে যে মতামত প্রকাশ করব, সে জায়গাটি পাচ্ছি না। ব্যবসায়ী মাহমুদুল হাসান বলেন, গণতন্ত্রের প্রথম যে জিনিস সেটি হচ্ছে ভোটাধিকার। যেদিন সেই ব্যক্তিস্বাধীনতা পাবো, নিজের ভোট নিজে দিতে পারব, সেদিন হয়তো আমার ভোট দেয়ার ইচ্ছা তৈরি হবে। গণতন্ত্র চর্চার প্রথম যে ধাপ, সেখানেই আমি বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছি এবং আমাকে থামিয়ে দেয়া হচ্ছে। প্রতিবাদ করারও উপায় নেই। মামলা ও জেলে যাওয়ার ভয়। এটিই এখন দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থার চিত্র।
তরুণ ভোটাররা যথার্থই বলেছেন। সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান এখন দেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা। সামগ্রিক নির্বাচনী ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। নির্বাচনের নামে দেশে একের পর এক প্রহসন হচ্ছে। যেমন জাতীয় নির্বাচনে, তেমনি স্থানীয় নির্বাচনে। সিটি, মেয়র, পৌর, জেলা-উপজেলা পরিষদ এমনকি ইউপি নির্বাচনেও। শুধু তাই নয়, ব্যবসায়ী সংগঠন, ছাত্রসংগঠন, ক্লাব, ট্রেড ইউনিয়ন, পেশাজীবী সংগঠন দেশের মানুষ কোথাও ভোট দিতে পারেন না। ভোটের সুযোগ ভোটাররা পাননি স্থানীয় নির্বাচনেও। জনপ্রতিনিধি হিসেবে যারা সংসদে যাচ্ছেন বা গেছেন, তারা জনসমর্থনের ভিত্তিতে সেখানে যাননি। নির্বাচন কমিশন এখন রাষ্ট্রীয় সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান নয়, সরকারি প্রতিষ্ঠানে রূপ নিয়েছে। তাদের আনুগত্য দেখা যাচ্ছে সরকারের প্রতি, রাষ্ট্রের প্রতি নয়। এমতাবস্থায় নির্বাচনের ওপর মানুষ আস্থা হারিয়ে ফেলেছে। ভোটাররা নির্বাচনবিমুখ, ভোটকেন্দ্রে যাচ্ছেন না। কৌতুক করে মানুষকে তাই বলতে শোনা যায়, ‘ভোট দিয়েছে প্রশাসন, তাকিয়ে ছিল জনগণ, বগল বাজিয়ে সরকার বলে বাহ, কী সুন্দর হয়েছে নির্বাচন!’
এ অবস্থায় দেশের সব বিরোধী রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ এবং নানা শ্রেণী ও পেশার মানুষের পক্ষ থেকে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার দাবি উঠেছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকেও গ্রহণযোগ্য ইনক্লুসিভ নির্বাচনের ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে তারা নিরপেক্ষ গ্রহণযোগ্য নির্বাচন চায়।
প্রকৃতপক্ষে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া কারো পক্ষে এ ধরনের সুষ্ঠু নির্বাচন করা এখন সম্ভব নয়। কারণ প্রশাসন নিরপেক্ষ না থাকলে কখনো সুষ্ঠু ভোট হতে পারে না। দলীয় সরকারের সময় পুলিশ থেকে শুরু করে রিটার্নিং অফিসার, সব কিছুই রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থাকে, সেখানে কীভাবে দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন হয়? তাই প্রকৃত নির্বাচনে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিকল্প নেই। বর্তমানে দেশের যে পরিস্থিতি তাতে রাষ্ট্রের সংস্কার প্রয়োজন হয়ে দেখা দিয়েছে।
নির্বাচন কমিশন, প্রশাসনসহ সব কিছু ঢেলে সাজাতে হবে। সুষ্ঠু গ্রহণযোগ্য নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করতে হবে। সে জন্য দরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকার।
২০১৪ ও ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের অভিজ্ঞতা হলো নির্বাচন কমিশন আইন ও সংবিধানে দেয়া ক্ষমতা ব্যবহার করতে পারবে কি না তা নির্ভর করে নির্বাচনকালীন সরকার কী হবে তার ওপর। নির্বাচনের সময় এমন একটি সরকার থাকতে হবে যারা নির্বাচনের ফলের ব্যাপারে থাকবে সম্পূর্ণ নিস্পৃহ।
জাতীয় নির্বাচনের আর বেশি দিন বাকি নেই। ২০২৩ সালের শেষের দিকে কিংবা ২০২৪ সালের শুরুতে হবে নির্বাচন। দ্বাদশ সংসদের নির্বাচন যাতে একতরফা না হয় সেই আওয়াজ উঠেছে জোরেশোরে। আন্তর্জাতিক পর্যায় থেকেও বলা হচ্ছে, বাংলাদেশে কর্তৃত্বপরায়ণ শাসন চলছে। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর বর্তমান ক্ষমতাসীনরা নানা কায়দা ও ছলচাতুরীর মাধ্যমে ক্ষমতা কুক্ষিগত রেখেছেন।
বিরোধী দলগুলো সরকারের পদত্যাগ এবং সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সমস্যা ও সঙ্কট তথা জ্বালানি, বিদ্যুৎ সমস্যাসহ অর্থনৈতিক দুরবস্থা নিরসনের দাবিতে আন্দোলন করছে। আন্দোলন গতি পাচ্ছে। ইতোমধ্যে বিএনপির চারজন কর্মী আন্দোলনে নিহত হয়েছেন। তৃণমূল জেগে ওঠায় দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিএনপি ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। দলের পক্ষ থেকে খুব স্পষ্ট ঘোষণা দেয়া হয়েছে, সরকার এবং নির্বাচন কমিশন যতই তৎপরতা চালাক, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচন হবে না, হতে দেয়া হবে না।
বাংলাদেশের সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা চালু করা হয়েছিল ১৯৯৬ সালে। এর অধীনে কয়েকটি নির্বাচন হয়; কিন্তু ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে দেয়। এরপর থেকে দেশে সত্যিকার অর্থে কোনো সুষ্ঠু নির্বাচন হয়নি।
যেভাবে বাতিল হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার
জাতীয় সংসদে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান বিএনপি সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করেছিল। আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন দলের দাবি ছিল এটি। ‘ট্রায়াল অ্যান্ড এরর’-এর মধ্য দিয়ে যেকোনো পদ্ধতিই সংশোধিত হতে পারে। প্রয়োগের মধ্য দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থায় পরিলক্ষিত ত্রুটি-বিচ্যুতিও ঐকমত্যের ভিত্তিতেই সংশোধনের সুযোগ ছিল। কিন্তু শেখ হাসিনা তা না করে ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার লক্ষ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে দেন। তারা জাতীয় নির্বাচন যাতে আর নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতে না পারে, সে জন্য সংবিধান থেকে সে ব্যবস্থাটি অপকৌশলের মাধ্যমে উঠিয়ে দেয়। এ লক্ষ্যেই বহুল বিতর্কিত পঞ্চদশ সংশোধনী সংসদে পাস করা হয়। আর এটি করার জন্য এর আগে বিচারপতি খায়রুল হককে দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল-সংক্রান্ত ত্রয়োদশ সংশোধনী মামলার বিতর্কিত রায় দেয়া হয়।
বিচারপতি খায়রুল হক অবসরে যাওয়ার কিছু দিন আগে ২০১১ সালের ১০ মে ত্রয়োদশ সংশোধনী মামলার সংক্ষিপ্ত আদেশ দিয়ে যান। সেখানে তিনি সুস্পষ্টভাবে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর অধীনে আগামী দুটো সংসদ নির্বাচন করা যেতে পারে বলে অভিমত দিয়েছিলেন। বেশির ভাগ বিচারপতিরই এ অভিমত ছিল। ত্রয়োদশ সংশোধনীতে নির্বাচনের সময়ে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করার বিধান ছিল। অথচ সুদীর্ঘ ১৬ মাস পর প্রকাশিত রায়ের চূড়ান্ত লিখিত আদেশে বিচারপতি খায়রুল হক কেবল নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করা যেতে পারে বলে নির্দেশনা দেন। অবসরে গিয়ে বিচারপতি খায়রুল হক নীতি-নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে নিজের দেয়া আদেশ কোনো রকম অতিরিক্ত শুনানি ছাড়াই পাল্টে দেন যা ছিল নজিরবিহীন ও বিচারদর্শনের গুরুতর লঙ্ঘন।
সংসদে বিতর্কিত পঞ্চদশ সংশোধনী পাস করে নেয়ার মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বিধান করে। তারা নিজেদের খেয়ালখুশি ও সুবিধামতো একতরফাভাবে সংবিধান পরিবর্তন করে দেশে সাংবিধানিক সঙ্কট সৃষ্টি করে। এভাবে তারা কষ্টার্জিত গণতন্ত্রকে নির্বাসনে পাঠিয়েছে এবং কার্যত একদলীয় শাসনব্যবস্থা চাপিয়ে দিয়েছে।
এতে নির্বাচনী ব্যবস্থা প্রহসনে পরিণত হয়েছে এবং জাতীয় সংসদ কার্যত বিরোধীদল শূন্য হয়ে পড়েছে। সরকার, সংসদ, মন্ত্রিসভা, স্পিকার, বিরোধীদল, নির্বাচন কমিশনের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো জনগণের প্রতিনিধিত্বহীন হয়ে পড়েছে।
দু’টি কলঙ্কিত নির্বাচন
বাংলাদেশের নির্বাচনী ইতিহাসে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি ও ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচন দু’টি নির্লজ্জ কলঙ্কের দৃষ্টান্ত হয়ে আছে।
বিনাভোটের নির্বাচনী প্রহসন
২০১৪ সালের একতরফা নির্বাচন থেকে বিরত থাকার জন্য বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া সতর্ক করেছিলেন; কিন্তু শেখ হাসিনা আমলে নেননি। যেনতেনভাবে প্রহসনের নির্বাচনের দিকেই এগিয়ে যান। আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতার পথ রুদ্ধ হয়ে যাওয়ায় বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটসহ প্রায় সব রাজনৈতিক দল এ নির্বাচন বর্জন এবং আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করে। কিন্তু সরকার খালেদা জিয়ার বাসভবনের সামনে বালির ট্রাক বসিয়ে অবরুদ্ধ করে এবং বাসভবনে কার্যত গৃহবন্দী করে অস্ত্র ও গুলির মুখে ৫ জানুয়ারি প্রার্থীহীন, ভোটহীন, ভোটারহীন, ইতিহাসের সবচেয়ে বড় নির্বাচনী প্রহসন সম্পন্ন করে।
৫ জানুয়ারির সেই নির্বাচনটি ছিল দেশে-বিদেশে চরমভাবে প্রশ্নবিদ্ধ। এতে জনগণের ভোটের অধিকার সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করা হয়। এ নির্বাচনে ভোট ছাড়াই ১৫৪টি অর্থাৎ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে চার কোটি ৫৩ লাখ ভোটারকে বঞ্চিত করে বর্তমান ক্ষমতাসীনরা নিজেদের বিজয়ী ঘোষণা করে। বাকি ১৪৬টি আসনে গড়ে ৫ শতাংশ ভোটও পড়েনি। বৃহত্তম বিরোধী দল বিএনপিকে নির্বাচনের বাইরে রেখে ও অর্ধেকের বেশি আসন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত ঘোষণা দিয়ে এক বিচিত্র এবং অদ্ভুত সংসদ গঠন করা হয়। অর্ধেকের বেশি আসনে যেখানে প্রত্যক্ষ নির্বাচনই হয়নি, সেখানে সংসদ গঠিত হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। তারা গায়ের জোরে বিচিত্র সংসদ গঠন করে, যেখানে বিরোধী দলের সদস্যরা একই সাথে বিরোধী দলেও ছিল, আবার সরকারের মন্ত্রিসভায়ও ছিল। এভাবেই তারা পাঁচ বছর ক্ষমতা কুক্ষিগত রাখে। এরপর আসে আরেক কলঙ্কজনক অধ্যায়ের নজির।
রাতের ভোটের নির্বাচনী প্রহসন
২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনটি বাংলাদেশের ইতিহাসে আরেকটি কলঙ্কজনক অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। নির্বাচনের আগের রাতেই ভোটপ্রহসন সম্পন্ন হওয়ার এক নির্লজ্জ দৃষ্টান্ত সৃষ্টি হয়েছে। এটি নিশিরাতের ভোট বা নির্বাচন হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।
এ নির্বাচনের সময় দেশব্যাপী নির্বাচন পূর্ববর্তী সহিংসতা ও বিরোধীদলের অগণিত নেতাকর্মী সমর্থকদের গ্রেফতার ও গায়েবি মামলা দিয়ে হয়রানির মাধ্যমে নির্বাচনী প্রচার কাজ থেকে আগেই দূরে রাখা হয়েছে। নির্বাচনের আগের রাতে ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত সিলমারা ব্যালট দিয়ে ভোটের বাক্স অগ্রিম ভরে রাখা হয়। নির্বাচনের দিন ভোটকেন্দ্র দখল করে বিরোধী প্রার্থীদের ও তাদের পোলিং এজেন্টদের বিতাড়িত করা হয়। নিশিরাতের এ প্রহসনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোক দিয়েই বেশির ভাগ বাক্স সিলমারা ব্যালটে পূর্ণ করা হয় বলে অভিযোগ আছে। কোথাও কোথাও পুলিশের সাথে ক্যাডাররাও এ কাজে অংশ নেয়।
নির্বাচনের ছয় মাস পর নির্বাচন কমিশন কেন্দ্রভিত্তিক যে ফলাফল প্রকাশ করে তাতে ভোট পড়ার অস্বাভাবিক চিত্র বেরিয়ে আসে। এতে দেখা যায়, ১০৩টি আসনের ২১৩টি ভোটকেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়েছে। এক হাজার ২০৫টি কেন্দ্রে ভোট পড়েছে ৯৬ থেকে ৯৯ শতাংশ। ৯০ থেকে ৯৫ শতাংশ ভোট পড়েছে ছয় হাজার ৪৮৪টি কেন্দ্রে। আর ৮০ থেকে ৮৯ শতাংশ ভোট পড়েছে এমন কেন্দ্রের সংখ্যা ১৫ হাজার ৭১৯টি। বিদেশী পর্যবেক্ষকরা এ নির্বাচন পর্যবেক্ষণ থেকে বিরত ছিল। দেশের বেসরকারি সংস্থা ফেয়ার ইলেকশন মনিটরিং অ্যালায়েন্সের (ফেমা) প্রেসিডেন্ট মুনিরা খান বলেন, বিষয়টি উদ্বেগের। এটি একটি হাস্যকর ব্যাপার। পৃথিবীর কোথাও যা হয় না, এখানে সেটিই হয়েছে। সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন বলেছে, কেমন তামাশার নির্বাচন হয়েছে এ পরিসংখ্যান থেকেই বোঝা যায়। ২১৩ কেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়া অবিশ্বাস্য ঘটনা।
নির্বাচনের ওই পরিসংখ্যানে দেখানো হয়, অনেক আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর তুলনায় বিএনপির প্রার্থী মাত্র ১০ ভাগের এক ভাগ ভোট পেয়েছে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ-টিআইবি ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচনে ৫০টি আসন পর্যবেক্ষণ করে জানায়, ৪৭টি বুথ দখল করে, জাল ভোট প্রদান ও ভোটের আগের রাতে ব্যালটে সিল মেরে বাক্সভর্তি মারার মতো অনিয়মের প্রমাণ পেয়েছে তারা।
সাবেক নির্বাচন কমিশনার মরহুম মাহবুব তালুকদার ইসির দায়িত্ব শেষ হওয়ার আগে ডেইলি স্টারকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, একাদশ জাতীয় নির্বাচনে আগের রাতে ভোট দেয়া হয়েছে এটি প্রতিষ্ঠিত সত্য। রাতের ভোটের বিষয়টি তদন্ত করলে নিজেদের ওপরই দায় এসে পড়বে বলে ইসি তদন্তে যায়নি। এর দায় আমারও আছে। তিনি বলেন, ওই নির্বাচনে ২১৩টি কেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়েছে যা কেউই বিশ্বাস করবে না। কারণ নির্বাচনের আগের রাতে বাক্সভর্তি ব্যালটের ছবি বিবিসি তুলে ধরেছে। অন্য দিকে নির্বাচনের আগে বিরোধী নেতাকর্মীদের ওপর দমন-পীড়ন চালানো হয়েছে। তেমনি নির্বাচনের আগে গায়েবি মামলার হিড়িক পড়ে যায়। নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের কোনো অস্তিত্ব ছিল না। রাতের ভোট যে প্রতিষ্ঠিত সত্য, এর বড় উদাহরণ- ইসি এর কোনো প্রতিবাদ জানায়নি।
২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের একাদশ জাতীয় নির্বাচনের নির্বাচনী প্রহসনে মোট ২৯৯ আসনের মধ্যে ২৯১টি আসনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ জোট ও তাদের সহযোগীদের বিজয়ী ঘোষণা করা হয়। এভাবে নির্বাচনী ব্যবস্থার বিশ্বাসযোগ্যতা সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে দেয়া হয়। এটি ফিরিয়ে আনতে হলে সুষ্ঠু নির্বাচন হতে হবে এবং এটি একমাত্র নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের অধীনেই সম্ভব হতে পারে।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, সাবেক সাধারণ সম্পাদক, জাতীয় প্রেস ক্লাব
উৎসঃ নয়াদিগন্ত
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন