পুলিশের গুলিবর্ষণ কিসের আলামত
26 September 2022, Monday
পুলিশের গুলিতে বিএনপির আরো একজন কর্মী হত্যার শিকার হয়েছেন। তিনি হলেন মুন্সীগঞ্জের যুবদল কর্মী শহিদুল ইসলাম শাওন। জ্বালানি তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি ও দলীয় নেতাকর্মীদের হত্যা-নির্যাতনের প্রতিবাদে গত বুধবার মুন্সীগঞ্জের মুক্তারপুরে বিএনপির বিক্ষোভ সমাবেশে পুলিশের গুলির শিকার হন শাওন। ময়নাতদন্ত ও সুরতহাল রিপোর্টে বলা হয়েছে, গুলির আঘাতে শাওনের কপালের ডান পাশে মাথায় রক্তাক্ত জখম হয় এবং সেখানে তার মগজ আড়াই থেকে তিন ইঞ্চি বেরিয়ে যায়। ঢাকা মেডিক্যালে নেয়ার পর ওইদিন রাতেই তার মৃত্যু হয়।
এ নিয়ে গত কয়েক সপ্তাহে বিএনপির চারজন কর্মী পুলিশের গুলিতে নৃশংসভাবে খুন হলেন। দু’জন ভোলায়, একজন নারায়ণগঞ্জে এবং সর্বশেষ একজন মুন্সীগঞ্জে। পুলিশ স্রেফ গুলি করে চারটি তাজা প্রাণকে মেরে ফেললেও এ নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে দুঃখ বা সমবেদনা প্রকাশ দূরে থাক উল্টো আক্রমণ করে কথা বলা হচ্ছে। কিছু দিন আগে বরগুনায় ছাত্রলীগের দু’গ্রুপের এক গ্রুপকে পুলিশ পিটিয়েছিল। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান এ ঘটনায় তাৎক্ষণিক পুলিশের ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে বলেছিলেন ‘পুলিশ বরগুনায় বাড়াবাড়ি করেছে।’ কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তাকে এজন্য বদলি এবং দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু চারজন রাজনৈতিক কর্মীকে গুলি করে মেরে ফেলা হলেও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এ নিয়ে কিছু বলার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেননি। কেন গুলিবর্ষণ হলো ন্যূনতম তদন্তের ব্যবস্থাও হয়নি। উল্টো সরকারের মন্ত্রী এবং শাসক দলের নেতারা পুলিশের পক্ষেই সাফাই গেয়ে চলেছেন। তারা বলেছেন, বিরোধী দলের নেতাকর্মীরা পুলিশকেই নাকি হামলা করছে। কোনো কোনো নেতার মুখ থেকে এও শোনা যায়, তারা বলেছেন, পুলিশকে হামলা করলে তারা কি বসে থাকবে? আত্মরক্ষায় নাকি তারা গুলি চালিয়েছে ইত্যাদি।
গত ৩১ জুলাই ভোলায় পুলিশের গুলিতে ছাত্রদল নেতা নূরে আলম এবং স্বেচ্ছাসেবক দল নেতা আবদুর রহিম মারা যান। ভোলায় বিএনপির বিক্ষোভ মিছিলের প্রাক্কালে পুলিশ অতর্কিতে হামলা ও গুলিবর্ষণ করে। ঘটনাস্থলে প্রাণ হারান স্বেচ্ছাসেবক দল নেতা নূরে আলম। অথচ গণমাধ্যমের রিপোর্ট অনুযায়ী ওইদিন গুলি করার মতো কোনো পরিস্থিতির উদ্ভব হয়নি। শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে বাধা দেয়া হবে না বলে সরকারের আশ্বাসের সাত দিনের মাথায় এ ঘটনা ঘটে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবনে তার দলের সাংগঠনিক সম্পাদকের সঙ্গে বৈঠকের পর বলেছিলেন, বিরোধী দল বিক্ষোভ করলে, সমাবেশ করলে তাদের যেন ‘ডিস্টার্ব’ করা না হয়। সেই মর্মে তিনি কী নির্দেশ দিয়েছেন তাও বলেন। শেখ হাসিনা বলেন, ‘বিরোধী দল একটা সুযোগ পাচ্ছে, তারা আন্দোলন করবে, করুক। আমি আজকেও নির্দেশ দিয়েছি, খবরদার, যারা আন্দোলন করছে, তাদের কাউকে যেন গ্রেফতার করা না হয় বা ডিস্টার্ব করা না হয়। তারা এমনকি প্রধানমন্ত্রীর অফিসও ঘেরাও করতে আসবে। আমি তাদের অফিসে বসাব, বসিয়ে চা খাওয়াব।’ (প্রথম আলো, ১৪ আগস্ট)। একই বক্তব্য প্রধানমন্ত্রী আরো আগে ২৩ জুলাই দলীয় আরেকটি সভায় দিয়েছিলেন। কিন্তু এর সাত দিন পরেই ঘটে ভোলায় পুলিশের গুলিবর্ষণের ঘটনা। গুলিতে দু’জন নিহত ছাড়াও আরো ২৪ জন গুলিবিদ্ধ হন।
প্রধানমন্ত্রীর এই নির্দেশ নিশ্চয় ছিল পুলিশ এবং সিভিল প্রশাসনের উদ্দেশে। রাষ্ট্রীয় ভবনে অনুষ্ঠিত দলীয় সভা শেষে সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে এই নির্দেশ দেয়া হলেও এ নির্দেশ কেন মানা হলো না তার কোনো ব্যাখ্যা জনগণ জানতে পারেনি। প্রধানমন্ত্রীর মুখ থেকেও এ নিয়ে কোনো বক্তব্য দেশবাসী পায়নি। বরং মানুষ লক্ষ করেছে ভোলায় ঘটনার পর নারায়ণগঞ্জে পুলিশ বিএনপির বিক্ষোভ কর্মসূচিতে গুলি চালিয়ে নারায়ণগঞ্জের যুবদলের এক কর্মীকে হত্যা করেছে। তেমনি মুন্সীগঞ্জেও আরেক যুবদল কর্মীকে একইভাবে হত্যা করা হয়েছে। নারায়ণগঞ্জে কিভাবে শাওনকে হত্যা করা হয়েছে তার ছবিও প্রকাশিত হয়েছে সংবাদপত্রে। শাসক দলের মন্ত্রী ও নেতারা ‘আত্মরক্ষার’ কথা বললেও ছবিতে দেখা যায় চায়নিজ রাইফেল দিয়ে গুলি চালানো হচ্ছে। ছবিতে যা দেখা যায় তাকে বলা যায়, ‘ বডিলাইন গুলি।’
ভোলার গুলিবর্ষণের ঘটনা সম্পর্কে সংসদে রুমিন ফারহানা এমপি তার বক্তব্যে বিষয়টি উল্লেখ করেছিলেন। তার বক্তব্যের জবাব দিতে গিয়ে শাসক দলের নেতা তোফায়েল আহমেদ সংসদে তিন ধরনের বক্তব্য দেন। প্রধানমন্ত্রীও এ সময় সংসদে উপস্থিত ছিলেন। তোফায়েল আহমেদ তার বক্তব্যে একবার বলেন, ভোলার ছেলেটি নিজের ছুড়ে মারা ইটের আঘাতে নিজেই মারা যায়। আবার সঙ্গে সঙ্গে বলেন, মিছিলে থাকা ছাত্রদলের ছেলেদের মারা ইটপাটকেলের আঘাতে মারা যায়। সেখানে-আওয়ামী লীগের বা ছাত্রলীগের মিছিল বলে কিছু ছিল না। আবার তিনি প্রশ্ন তোলেন, পুলিশইবা করবে কী? নেমেই যদি বিএনপি শুরু করে, তাহলে তো কিছু করার থাকে না। অর্থাৎ তিন ধরনের বক্তব্য- ‘নিজেই নিজেকে মেরেছে’, ‘ছাত্রদল মেরেছে’ এবং ‘পুলিশ মেরেছে’। এ অবস্থায় জনমনে প্রশ্ন উঠেছে পুলিশের এই গুলিবর্ষণ কিসের আলামত? পুলিশ কি নিজেদের সিদ্ধান্তে মিছিল-সমাবেশে গুলিবর্ষণ করছে, নাকি নেপথ্যে সরকারের নির্দেশ রয়েছে? বিরোধী দল কি তাদের প্রতিবাদ করতে পারবে না? রাজনৈতিক প্রতিবাদকে এভাবে গুলিবর্ষণ করে, নেতাকর্মীর লাশ ফেলে স্তব্ধ করে দিতে হবে? দেশে এমন অরাজকতা কি চলতেই থাকবে? দেখার কি কেউ নেই?
বিএনপির সমাবেশে কেন হামলা
জ্বালানি তেল ও নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধিসহ জনগণের মৌলিক দাবিগুলো নিয়ে রাজপথে নেমেছে দেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি। গত দু’মাস ধরেই দলটি রাজপথে সভা-সমাবেশ, বিক্ষোভ করছে। এসব প্রতিবাদ কর্মসূচিতে ২০১৪ সালের বিনা ভোটের নির্বাচনী প্রহসন এবং ২০১৮ সালের রাতের ভোটের নির্বাচনী প্রহসনের কথা তুলে ধরে সরকারের পতন চাইছে বিএনপি। দলটির পক্ষ থেকে সুস্পষ্টভাবে বলা হচ্ছে, এ সরকারের অধীনে কোনো সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। একমাত্র নির্বাচনকালীন দলনিরপেক্ষ সরকারের অধীনেই গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হতে পারে। তারা নির্বাচন কমিশনের তৎপরতার বিরুদ্ধেও বলেছেন যে, এই নির্বাচন কমিশন সরকারের তল্পিবাহক। সরকার এদের নিয়োগ দিয়েছে এবং সরকার যা ইশারা করছে সে অনুযায়ী কমিশন কাজ করছে। দেশের বেশির ভাগ মানুষ ইভিএমের বিপক্ষে।
রাজনৈতিক দলগুলো ইভিএমের বিপক্ষে। রাজনৈতিক দলগুলো ইভিএমকে কারচুপির বাক্স হিসেবে চিহ্নিত করেছে। কিন্তু নির্বাচন কমিশন ইভিএম দিয়ে নির্বাচন করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। সরকার তাদের নীলনকশা বাস্তবায়নের জন্য প্রায় আট হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ইভিএম মেশিন কেনার প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এক দিকে ভোট জালিয়াতি, অন্য দিকে টাকা লুটপাট করাই তাদের লক্ষ্য। বিএনপির নেতারা আরো বলেছেন, এই সরকার মেগা প্রকল্পে মেগা দুর্নীতি করছে। টাকা পাচার ও দুর্নীতির কারণে দেশের অর্থনীতি ধ্বংসের কিনারায় এসে গেছে। দেশ দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছে। দ্রব্যমূল্যের অবস্থা লাগামহীন। শাসক দলের লোকেরা সিন্ডিকেট করে মানুষের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। অন্য দিকে খেটে খাওয়া মানুষের হাঁড়িতে খাবার নেই। তারা মালয়েশিয়া, কানাডা ও অন্যান্য দেশে বেগমপাড়া গড়ে তুলছে।
বিএনপির এসব সভা-সমাবেশ এবং বিক্ষোভ কর্মসূচিতে প্রচুর লোকসমাগম হচ্ছে। এমনকি স্বল্প সময়ের নোটিশে বিএনপি যেসব সভা-মিছিল করছে তাতেও উপচে পড়ছে লোকজন। মানবাধিকার বিশেষ করে গুম ইস্যুতে শেখ হাসিনার সরকার যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদের চাপে রয়েছে। এর মধ্যে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিসহ নানা সংঙ্কটেও চাপে রয়েছে সরকার। প্রকৃত ভোট হলে আওয়ামী লীগের জেতার সামান্যতম আশাও নেই। এ পরিস্থিতি মূল্যায়ন করেই ক্ষমতাসীনরা বিএনপি দমনে উঠে পড়ে লেগেছে।
বিরোধী বিএনপির কর্মসূচির প্রথম দিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাধা না দেয়ার জন্য নির্দেশনা দিয়েছিলেন। তার নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও নেতাকর্মীদের বিএনপির সাথে রাজনৈতিক সংঘর্ষে না জড়ানোর নির্দেশনা দেন। কিন্তু তিনি কিছু দিনের মধ্যেই ভিন্ন বক্তব্য দিতে শুরু করেন। বলতে থাকেন, ‘মাঠ কারো কাছে ইজারা দেয়া হয়নি। আমরা মাঠ ছেড়ে যাইনি।’ প্রথম দিকে পুলিশ দিয়ে বিএনপির সভা-সমাবেশে হামলা করানো হয়। বর্তমানে পুলিশের সঙ্গে আওয়ামী লীগের মূল দল ও সহযোগী ছাত্রলীগ, যুবলীগ, কৃষক লীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ দিয়েও বিএনপির কর্মসূচির পাল্টা কর্মসূচি দেয়ানো হচ্ছে এবং বিএনপির সমাবেশে হামলা করা হচ্ছে।
সাম্প্রতিক সময়ে জেলা-উপজেলা এমনকি ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত বিএনপির কর্মসূচিতে হামলার ঘটনা ঘটেছে। কোথাও কোথাও ১৪৪ ধারা জারি করিয়ে বিএনপির সভা পণ্ড করে দেয়া হচ্ছে। এমনকি মোমবাতি কর্মসূচিতেও বাধা দেয়া হয়েছে। বিএনপির সভা-সমাবেশ করার ক্ষেত্রে পুলিশ যেমন মারমুখী, তেমনি মারমুখী আওয়ামী লীগ। তবে বাধার মুখেও বিএনপি আন্দোলনে কঠোর অবস্থান নিয়েছে। তাদের বক্তব্য হচ্ছে আন্দোলন থেকে তারা পিছপা হবে না। তাদের টার্গেট একটাই দেশকে বাঁচানো, মানুষকে বাঁচানো। এ জন্য সরকারের পতনই লক্ষ্য।
ইভিএমের পক্ষে ওকালতি!
ইভিএমে ভোট করার তৎপরতা জোরেশোরে শুরু করেছে নির্বাচন কমিশন। ইভিএমের পক্ষে দালালিতে ইসি কোন পর্যায়ে নেমেছে তার উদাহরণ দেয়া যায় রোববার নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীরের বক্তব্যে। তিনি বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর অন্তরের কথাও নাকি জেনে গেছেন! তিনি বলেন, যেসব দল ইভিএমের বিরোধিতা করে, তারাও অন্তরে বিশ্বাস করে ইভিএম ভালো। আগামী নির্বাচনে সব দল অংশ নেবে বলেও তিনি নাকি জেনে ফেলেছেন! তার মতে, দেশের ১২ কোটি মানুষের নাকি ইভিএমে আস্থা আছে।
যে নির্বাচন কমিশন সংলাপে দেয়া রাজনৈতিক দলের বক্তব্য পাল্টে দেয়, সেই নির্বাচন কমিশন ভোট পাল্টে দেয়ার জন্য ইভিএমের পক্ষে এমন সাফাই গাইবে এটা স্বাভাবিক। এজন্যই বিএনপিসহ রাজনৈতিক দল এবং দেশের মানুষ দাবি তুলেছে শুধু ইভিএম নয়, এই নির্বাচন কমিশনকেও বাতিল করতে হবে। এদের ওপর ভোটারদের বিন্দুমাত্র আস্থা নেই।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, সাবেক সাধারণ সম্পাদক, জাতীয় প্রেস ক্লাব
উৎসঃ নয়াদিগন্ত
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন