ত্রিমুখী ভূকৌশলগত সংকটে ভূস্বর্গ
25 August 2019, Sunday
কাশ্মীর এখন আর বিশেষ কোনো রাজ্য নয়। এটি এখন রাষ্ট্রপতির সরাসরি শাসনে ইউনিয়ন টেরিটরি। এখানেই শেষ নয়, কাশ্মীর পুনরায় দ্বিখণ্ডিত করে লাদাখ অঞ্চলকে আলাদা ইউনিয়ন টেরিটরি করা হয়েছে। এতে প্রায় ৪৬ শতাংশ মুসলমান এখন মূলধারার কাশ্মীরের মুসলমানদের সঙ্গে যুক্ত নেই। ৫ আগস্ট সংবিধানের ৩৭০ এবং ধারা ৩৫-এ ধারা রদ করে ভারতের বিজেপি সরকার কাশ্মীরের এই হাল করে ছেড়েছে।
এ পদক্ষেপ নেওয়ার আগে সাত দিনের মধ্যে কাশ্মীরে অতিরিক্ত প্রায় ৩৮ হাজার সেনা এবং আধা সেনা মোতায়েন করা হয়। বর্তমানে সেখানে সামরিক ও আধা সামরিক বাহিনীর প্রায় ছয় লাখ সদস্যের উপস্থিতি রয়েছে। এমনিতেই ১৯৪৭-৪৮-এর পর থেকে কাশ্মীরের ভারতীয় অংশে সামরিক উপস্থিতি রয়েছে। সময়ে সময়ে তা বাড়ানো হয়েছে।
কাশ্মীরকে ঘিরে ১৯৪৮ ও ১৯৬৫ সালে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ হয়েছে। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তান কাশ্মীর অঞ্চলের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ দখল করেছিল, যা আজ আজাদ-কাশ্মীর এবং গিলগিত-বাল্টিস্তান (নর্দান এরিয়া) নামে পরিচিত। বর্তমানে পাকিস্তানের দখলে আজাদ-কাশ্মীরসহ এই এলাকার প্রায় ৪১ হাজার ৪৭১ বর্গকিলোমিটার রয়েছে।
বস্তুত বৃহত্তর কাশ্মীর ১৯৬২ সালের চীন-ভারত যুদ্ধের পর তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে রয়েছে। চীনের দখলে রয়েছে আকসাই চীন (চীন যাকে তিব্বতের এবং নিজের জিনজিয়াং প্রদেশের অংশ মনে করে) যার আয়তন ৩৭ হাজার ৫৫৫ বর্গকিলোমিটার। চীন দাবি করে, লাদাখ এলাকায় চীন-ভারত সীমান্ত এখনো চূড়ান্ত হয়নি। চীন তিব্বত অঞ্চলে জনসন লাইন স্বীকার করে না। কাজেই সহজে বলা যায়, বর্তমানে কাশ্মীর সংকট ত্রিমুখী। ভারতের বিজেপি সরকার লাদাখকে আলাদা ইউনিয়ন টেরিটরিতে পরিণত করায় এখন চীনের সীমান্ত উত্তর-পশ্চিমে লাদাখের সঙ্গেই গণ্য করা হবে। যদিও লাদাখ অঞ্চল সব সময়ই ঐতিহাসিকভাবে কাশ্মীরের অংশ ছিল।
১৯৬২ সালের চীন-ভারত যুদ্ধ এবং ১৯৭১ সালে পাকিস্তান ভেঙে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে কাশ্মীরের ভূকৌশলগত অবস্থানে ব্যাপক পরিবর্তন হয়। এ কারণে শুধু পাকিস্তানই নয়, চীনও কাশ্মীর জটিলতায় সরাসরি যুক্ত রয়েছে। ১৯৬৩ সালে পাকিস্তান চীনকে ট্রান্স-কারাকোরাম ট্র্যাক (প্রায় ২ হাজার ৭০০ বর্গকিলোমিটার) দিয়েছিল। সীমানা সংশোধন এবং কারাকোরাম হাইওয়ে তৈরির প্রাক্কালে এই লম্বা টানা স্ট্রিপ চীনকে দেওয়া হয়েছিল। মার্কিন সামরিক সাহায্য বন্ধ হলে পাকিস্তান এবং এর সামরিক বাহিনীর সঙ্গে ভূকৌশলগত, ভূরাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ককে উচ্চপর্যায়ে নিয়ে যায় চীন।
বর্তমানে চীনের জন্য মধ্যপ্রাচ্যে এবং উত্তর আফ্রিকার জ্বালানি সঞ্চালনের প্রধান পথ হলো পাকিস্তান। অন্যদিকে নিকট বর্তমানের পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতিতে পাকিস্তানের হামাস আবদাল থেকে গিলগিত বাল্টিস্তানের খুলজেরাব গিরিপথ পর্যন্ত চীন ব্যবহার করে। কারাকোরাম মহাসড়ক চীনের জন্য ক্রমেই অর্থনৈতিক ও ভূকৌশলগত কারণে গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল হয়ে উঠেছে। এ কারণে চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডর রক্ষায় পাকিস্তান চীনের অর্থায়নে বিশেষ বাহিনী গড়ে তুলেছে। কারাকোরাম হাইওয়ে মোট ১ হাজার ৩০০ কিলোমিটার, যার ৮৮৭ কিলোমিটার পাকিস্তান অঞ্চলে এবং ৪১৩ কিলোমিটার চীনের মধ্যে রয়েছে।
কারাকোরাম হাইওয়ে আরব সাগরের বন্দর গোয়াদরকে চীনের সিংজিয়াংয়ের সঙ্গে যুক্ত করার একমাত্র পথ। এখন পাকিস্তানে অ্যাবোটাবাদ হয়ে কাশগড় পর্যন্ত রেলওয়ে লাইনের সম্প্রসারণকাজ শুরু হয়েছে বলে জানা গেছে। পাকিস্তানের এ প্রকল্প চীনের আগামী শতাব্দীর বেল্ট রোড প্রকল্পের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এবং অন্যতম প্রধান অংশ।
গিলগিত-বাল্টিস্তান অঞ্চলের কারাকোরাম হাইওয়ে শুধু যোগাযোগের ব্যবস্থাই নয়, সামরিক দিক থেকেও খুব গুরুত্বপূর্ণ। পাকিস্তানের সঙ্গে চীনের সামরিক সরঞ্জাম আনা-নেওয়ার জন্য ব্যবহৃত হয় এই পথ। এ পথেই পাকিস্তানের চীনের মধ্য এশিয়া হয়ে পূর্ব এশিয়ায় যোগাযোগের একমাত্র পথ। অন্যদিকে এ যোগাযোগ আফগানিস্তান হয়ে মধ্য এশিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত হতে যাচ্ছে। এখানেই ভারতের সামরিক ও ভূকৌশলগত দুর্বলতা, যে কারণে কারাকোরাম রেঞ্জের সলটোরা উচ্চতা, যাকে আমরা সিয়াচিন গ্লেসিয়ার বলে চিনি, ভারতীয় দখলে রয়েছে বলে চীন দাবি করছে। অন্যদিকে পাকিস্তানি সামরিক উপস্থিতিও সেখানে রয়েছে। ভারত একাই নয়, অন্যদিকে রয়েছে পাকিস্তানের বাহিনী, যারা প্রথমে এই গ্লেসিয়ারে পৌঁছেছিল। এখানে ছোটখাটো যুদ্ধ হয়েছিল। প্রতিনিয়তই সেখানে গোলাগুলি হয় বলে খবর পাওয়া যায়।
এ যুদ্ধক্ষেত্রের উচ্চতা ১৮ হাজার ৮৭৫ ফুট এবং চীনের দিকে ১১ হাজার ৮৭৫ ফুট। এর সামরিক গুরুত্ব ছাড়া অন্য কোনো গুরুত্ব না থাকলেও একটি প্রাকৃতিক কারণ হলো, সিয়াচিন গ্লেসিয়ার পাট নদীতে পানিপ্রবাহ বাড়ানোর ক্ষমতা রাখে। এই পানির প্রবাহ ভারত ও পাকিস্তান উভয়ের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অন্যদিকে কারাকোরাম হাইওয়ের এবং চীনের দখলে থাকা আকসাই চীন পর্যবেক্ষণের জন্য এই উচ্চতা গুরুত্বপূর্ণ। এই অঞ্চল দখলে রাখতে গত ২০ বছরে উভয় পক্ষের প্রায় ২০ হাজার সেনা মূলত ঠান্ডার কারণে প্রাণ হারিয়েছে। সেখানে ভারতের সামরিক উপস্থিতির জন্য প্রতিদিন ব্যয় হয় দুই কোটি রুপি। পাকিস্তানের ব্যয়ও অনুরূপ হওয়ার কথা। অথচ বিষয়টি উভয় দেশের সাধারণ মানুষের ধারণার বাইরে।
আকসাই চীন ছাড়াও কারাকোরাম রেঞ্জের সাকসাম ভ্যালি (যা এখন পাকিস্তানের উত্তরাঞ্চলের অংশ) চীনকে পাকিস্তান পুরোটাই হস্তান্তর করতে পারে, এমন সম্ভাবনা নিয়েও ভারত উদ্বিগ্ন। এরই মধ্যে ২ হাজার ৭০০ বর্গকিলোমিটার পাকিস্তান চীনকে হস্তান্তর করেছে।
কাশ্মীরের ভূকৌশলগত ও ভূরাজনীতি এখন এমন এক পর্যায়ে উঠেছে, যার মধ্যে ক্রমেই চীন জড়িয়ে পড়ছে। মোটাদাগে যার কারণ ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছি। চীন শুধু সিয়াচিনের বহুলাংশ দাবি করেই ক্ষান্ত নয়, বরং জনসন সীমান্ত লাইনকে বহুলাংশে স্বীকার করেনি এবং করছে না। ১৯৬২ সালে চীন শুধু আকসাই চীনই নয়, পূর্ব ভারতের উত্তরের তৎকালীন নর্থ-ইস্ট-ফ্রন্টিয়ার এজেন্সির (যা এখন অরুণাচল প্রদেশ) দাবিতে অনড় রয়েছে। চীন সব সময়ই মনে করে, বর্তমান অরুণাচল প্রদেশের প্রায় ৮ হাজার ফুট উচ্চ মালভূমি, থোয়াং এলাকা, তিব্বতের অংশ এবং এ কারণেই চীন ওই এলাকায় তার দাবিকে যৌক্তিক মনে করে। ১৯৬২ সালে যুদ্ধ শেষে চীন জায়গা ছেড়ে দিলেও আজ পর্যন্ত এ দাবি থেকে চীন সরে আসেনি। থোয়াং শহরের এবং ওই অঞ্চলের বহু অংশ দখল করে নিয়েছিল চীন। এ জায়গা একসময় তিব্বতের ছিল কি না, তা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও জায়গাটি যে তিব্বতের বৌদ্ধদের জন্য পবিত্র, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কারণ, যেখানে ষষ্ঠ দালাই লামা জন্মগ্রহণ করেছিলেন।
মোদি সরকার একতরফাভাবে কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিল করে ইউনিয়ন টেরিটরি যেভাবে এবং যে কারণে বানালেন, তার পেছনে অভ্যন্তরীণ কারণ যতই তুলে ধরুন না কেন, এ সিদ্ধান্তের পেছনে ভূকৌশলগত বিষয় দারুণভাবে কাজ করেছে।
এই জটিল পরিস্থিতির আগুনে বেশি ঘি ঢেলেছেন ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। তিনি পার্লামেন্টে বলেছেন, প্রাণ দিয়ে হলেও তিনি পাকিস্তানের দখল করা কাশ্মীর অংশ এবং চীনের দখলে থাকা অংশকে ভারতের কাশ্মীরের সঙ্গে পুনরায় যুক্ত করবেন। এর জবাবে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান তাঁর দেশের পার্লামেন্টে যুদ্ধ বাধলে তার পরিণতি কী হতে পারে, সে কথা বলেছেন। তাঁর বক্তব্যের জবাবে পরোক্ষভাবে পারমাণবিক অস্ত্রের কথা বলেছেন ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং। তিনিও একইভাবে পরোক্ষ হুমকি দিয়েছেন। এ ধরনের হুমকি উপমহাদেশকে অস্থির করে তুলছে। উল্লেখ্য, কাশ্মীর বিবাদে যে তিনটি দেশ জড়িত, এদের সবাই পারমাণবিক শক্তিধর প্রতিবেশী দেশ। এখানেই আমাদের মতো দেশের উদ্বেগ।
ভারতের দাবিমতে, কাশ্মীর তার অভ্যন্তরীণ বিষয়। কিন্তু তেমনটা মানেনি চীন ও পাকিস্তান। প্রায় ৫৪ বছর পর কাশ্মীর ইস্যু পুনরায় জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে উঠেছে। রুদ্ধদ্বার বৈঠক হয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে চীন শক্ত ভাষায় বলেছে, কাশ্মীরে যেন কোনো একতরফা পদক্ষেপ না নেওয়া হয়। চীন পাকিস্তানের পক্ষে শক্ত অবস্থান নিয়েছে। রাশিয়া দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করতে বলেছে। যুক্তরাষ্ট্রও একই কথা বলেছে।
যা–ই হোক, আমরা চাই, সংশ্লিষ্ট সব দেশ এবং কাশ্মীরের জনগণের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে এই সংকটের নিষ্পত্তি হোক।
ড. এম সাখাওয়াত হোসেন: সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও সাবেক সামরিক কর্মকর্তা, বর্তমানে এনএসইউর অনারারি ফেলো
উৎসঃ প্রথমআলো
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন