আপেক্ষিক শক্তি আর আগ্রহ যেখানে বেশি, ডেঙ্গু রোগ নিয়ে সরকারের বিভিন্ন শাখা তা-ই করছে। তা হলো ঘটনা যা-ই ঘটুক, জনদুর্ভোগ যা-ই হোক, তা অস্বীকার করা, স্ববিরোধী উদ্ভট কথাবার্তার পাশাপাশি নিজেদের কল্পিত বা অতিরঞ্জিত সাফল্যের অবিরাম প্রচার। সরকারের এই প্রবণতা নতুন নয়। সড়ক ‘দুর্ঘটনা’, সন্ত্রাস, দুর্নীতি, দুধ-খাদ্যে বিষ, নকল; বন, নদী বিনাশ, ব্যাংক লুট, ক্রসফায়ারে হত্যা, সীমান্ত হত্যা ইত্যাদি সব ক্ষেত্রে এই একই ঘটনা দেখছি। এই ধারাতেই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বেতার, টিভি এবং পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে আমাদের জানাচ্ছে যে ‘ডেঙ্গু প্রতিরোধে বাংলাদেশ একটি অনন্য দৃষ্টান্ত।’ ধারণা করা যায়, মৌসুমের কারণে ডেঙ্গু যখন কমে আসবে, তখন এই ঢোল আরও বহুগুণে বাজতে থাকবে। সরকারের নানা পর্যায়ের লোকজন জাতীয় তো বটেই আন্তর্জাতিক পুরস্কারও পেয়ে যেতে পারেন!
প্রতিদিন খবর আসছে সুস্থ সবল মানুষ ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। হাসিখুশি শিশু এক দিনের মধ্যে নাই, সন্তান পেটে নিয়ে মা মরে গেলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সব স্বপ্ন নিয়ে চলে গেলেন, আর রোগীর সংখ্যা বাড়ছেই। প্রথম থেকেই সরকারের দপ্তর থেকে বলা হচ্ছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে। রোগীর সংখ্যা, মৃতের সংখ্যা কমিয়ে বলা সরকারের অন্যতম তৎপরতা। বাস্তবতা শুধু অস্বীকার করা নয়, মানুষের কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দিতে মন্ত্রী, মেয়র আর তাঁদের সমগোত্রীয় ভিসিরা ঝাড়ু হাতে নিয়ে রাস্তা পরিষ্কার করছেন। ডেঙ্গু মশা যেখানে থাকে সেখানে পরিষ্কার করতে গেলে ক্যামেরা বসানো মুশকিল বলেই হয়তো রাস্তায় ময়লা ফেলে ঝাড়ু দেওয়ার আয়োজন।
মেয়র খোকন সাহেব এ বিষয়ে পুরোধা ব্যক্তিত্ব, তিনি হাজার মানুষ ডেকে বড় রাস্তা ঝাড়ু দিয়ে গিনেস রেকর্ড করেছেন। পরে তাঁদের খাবারের প্যাকেটে রাস্তা অলংকৃত হয়েছে। ঢাকা শহরকে আবর্জনার শহর বানানোর অন্যতম কৃতিত্ব তাঁকেই দিতে হবে। ফেসবুকে তাসলিমা মিজি ঠিকই লিখেছেন, ‘আমার কাছের বন্ধু আত্মীয় অনেকেই আক্রান্ত। জানি না এর শেষ কোথায়। যে গর্ভবতী মা জীবনের অপার আনন্দ উপভোগের কাছে এসেই পেটের সন্তান নিয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন, যে মা-বাবা ১০ বছরের পুত্রসন্তানকে কবরে শুইয়ে কন্যাকে নিয়ে হাসপাতালে পাহারা দিচ্ছেন, যে মা একাকী হাসপাতালের বারান্দায় ওড়না বিছিয়ে ডেঙ্গু আক্রান্ত সন্তানকে শুইয়ে ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে গেছেন, তাঁদের জন্য এই ঝাড়ু অভিযানের তামাশা কতটা ভার তৈরি করে, তা কি তারা জানে?’
মেয়র ঘোষণা দিলেন ১১ ওয়ার্ড ডেঙ্গুমুক্ত। আরও অনেকের সঙ্গে মিজানুর রহমান অনেক ছবি ও ভিডিও দিয়ে দেখিয়েছেন কী বিপজ্জনক পরিস্থিতি ওই সব এলাকার। বহু স্কুলের আশপাশে এডিস মশার কারখানা। না সেগুলো পরিষ্কার করা হলো, না স্কুল বন্ধ দেওয়া হলো। সবকিছু ঠিক আছে—এই দাবি নিয়ে একগুঁয়েমি করে শিশুদের আরও বিপদের মধ্যে ফেলে রাখা হলো।
ডেঙ্গু শুধু বাংলাদেশে হচ্ছে না, আরও বহু দেশেই হচ্ছে। ডেঙ্গু জ্বর হওয়া সরকারের ব্যর্থতা নয়, ব্যর্থতা বা অপরাধ হলো তার পক্ষে যা করা সম্ভব ছিল, তা না করা। গত বছরই বিভিন্ন সংস্থা থেকে এডিস মশা বৃদ্ধির ব্যাপারে সতর্কবাণী উচ্চারণ করা হয়েছিল, সরকার কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। ২০১৯ সালের মার্চ মাসে ঢাকা শহরের মশা জরিপ করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখা সিটি করপোরেশনসহ সংশ্লিষ্টদের সতর্ক করেছিল যে যথাযথ ব্যবস্থা না নিলে মশা আরও বাড়বে। কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। কার দায়িত্ব এসব মশার বংশবৃদ্ধি ঠেকানো?
এ বিষয়ে কল্লোল মোস্তফা ব্যাখ্যা দিয়েছেন, ‘এডিস মশা শুধু মানুষের ঘরের ফুলের টবে কিংবা ছাদে জমে থাকা পরিষ্কার পানিতেই হয়, তা নয়। বিভিন্ন পাবলিক প্লেস এবং বিশেষত সরকারি-বেসরকারি নির্মাণাধীন ভবন ও স্থাপনায় পড়ে থাকা বোতল, প্যাকেট, ডাবের খোসা, কনটেইনার, ড্রাম, ব্যারেল, পরিত্যক্ত টায়ার, ইটের গর্ত ইত্যাদিতে জমে থাকা পানিতে জন্মাতে পারে। এসব নিয়মিত পরিষ্কার করা একটা শহরের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অংশ, যা ঠিকঠাকমতো পালন করার দায়িত্ব সিটি করপোরেশনসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও দপ্তরের। দ্বিতীয়ত, এমনকি ব্যক্তিমালিকানাধীন হাউজিং প্রোপার্টিতে জমে থাকা পানি পরিষ্কারের জন্য সংশ্লিষ্ট কোম্পানি ও ব্যক্তিদের উদ্বুদ্ধ করা ও বাধ্য করার দায়িত্বটাও জনগণের করের টাকায় চলা সিটি করপোরেশনসহ সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের।’ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কর্মকর্তা জানাচ্ছেন পুলিশের জব্দ করা গাড়ির স্তূপ এডিস মশার অন্যতম জন্মস্থল ও বাসক্ষেত্র।
এসবের সমাধান বোঝার জন্য খুব দূরে যাওয়ার দরকার নেই, অভ্যাসবশত বিদেশি ঋণের টাকায় নানা দেশ ঘোরারও দরকার নেই। পাশের কলকাতাতেই যেসব পদক্ষেপ নিয়ে এর ভয়াবহতা মোকাবিলা করা হয়েছে, তা দেখলেও বোঝা যায় কী সম্ভব। এর কয়েকটি দৃষ্টান্ত দিয়েছে বিবিসি। এগুলো হলো: ‘কলকাতার ১৪৪টা ওয়ার্ডের প্রতিটাতেই সিটি করপোরেশনের ২০ থেকে ২৫ জন করে কর্মী আছে, যাদের মধ্যে একদল প্রচারের কাজ চালায়, আর অন্য দল জল জমছে কি না কোথাও, সেটার ওপরে নজর রাখে। ১৬টি বরোর (সিটি করপোরেশনের প্রশাসনিক অঞ্চল) প্রত্যেকটার জন্য একটা করে র্যাপিড অ্যাকশন টিম। তাতে ৮ থেকে ১০ জন লোক থাকে সব ধরনের সরঞ্জাম নিয়ে, গাড়িও থাকে তাদের কাছে। কোনো জায়গায় ডেঙ্গুর খবর পাওয়া গেলে অতি দ্রুত তারা সেখানে পৌঁছে এডিস মশার লার্ভা নিয়ন্ত্রণের কাজ করে।...যেসব জায়গায় জল জমে থাকতে দেখছে করপোরেশনের নজরদারি কর্মীরা, সেই ভবনগুলোর ওপরে এক লক্ষ টাকা পর্যন্ত জরিমানা ধার্য করার জন্য আইন পরিবর্তন করা হয়েছে।...আবার জল পরিষ্কার করে দেওয়ার খরচ বাবদ বিল, বাড়ির বার্ষিক করের বিলের সঙ্গে পাঠিয়ে দিচ্ছে করপোরেশন।’ (সূত্র: বিবিসি বাংলা, কলকাতা, ৩০ জুলাই ২০১৯)
বাংলাদেশের একটা বড় শক্তির জায়গা হলো, যেকোনো জাতীয় দুর্যোগে-বিপদে স্বেচ্ছাসেবা দেওয়ার মতো মানুষের অভাব হয় না। আমরা বিভিন্ন বড় বন্যা, ঘূর্ণিঝড় থেকে রানা প্লাজার মতো ঘটনাতেও দেখেছি মানুষের এই স্বতঃস্ফূর্ত ভূমিকা। ডেঙ্গুর উৎস নির্মূলেও এই কাজ করা সম্ভব ছিল। কিন্তু এখতিয়ারের কারণে সরকারকেই তো এতে নেতৃত্ব নিতে হবে। দরকার ছিল অস্বীকার না করে সরকার থেকে একটি বিশদ পরিকল্পনা, সিটি করপোরেশনসহ তার বাস্তবায়নের নকশা, মন্ত্রী, মেয়র, সাংসদ, ওয়ার্ড কমিশনারদের ভূমিকা যার যার অবস্থান অনুযায়ী বিন্যাস করা। উদ্যোগ নিলে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অসংখ্য ছাত্রছাত্রী এ কাজে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে অংশ নিত। সরকার প্রয়োজনে সেনাবাহিনীকে কাজে লাগাতে পারত, পারত টেন্ডার-সন্ত্রাস চাঁদাবাজিতে ব্যস্ত সরকারের নানা সংগঠনের কর্মীদের একটু ভালো কাজ করতে সুযোগ দেওয়ার।
ব্যয়বহুল কাজে সরকারের যত আগ্রহ, কম পয়সার প্রয়োজনীয় কাজে সেই উৎসাহ দেখা যায় না। স্যাটেলাইট কেনার জন্য বরাদ্দ থাকলেও সাধারণ ডেঙ্গু হোক বা আগুন নিয়ন্ত্রণ, তার জন্য প্রয়োজনীয় সাজসরঞ্জাম কেনার বরাদ্দ নেই। দেশবিনাশী রূপপুর প্রকল্পের জন্য লক্ষ কোটি টাকা আছে, সর্বজন চিকিৎসা সুলভ করার টাকা নেই। বিদেশে চিকিৎসায় যত আগ্রহ, ততটাই অনাগ্রহ দেশের হাসপাতালের প্রয়োজনীয় সম্প্রসারণ ও দক্ষ করায়। নদীকে হাতিরঝিল বানানোর নির্বোধ প্রকল্প নিয়ে যে উৎসাহ, ঢাকা শহরে পানিপ্রবাহ ঠিক করা, নদী-খালগুলোকে স্বাভাবিক জীবনদানে সেই আগ্রহ নেই। সচিব-উপসচিব পদে বাড়তি নিয়োগে টাকা খরচে কোনো কার্পণ্য নেই কিন্তু শহর পরিষ্কার করার কর্মী বা জনবল তৈরিতে কোনো আগ্রহ নেই।
দেশের মানুষের জীবন ও দুর্ভোগ নিয়ে বিন্দুমাত্র দায়িত্ববোধ বা জবাবদিহির ব্যবস্থা থাকলে পরিস্থিতি এ রকম হতো না।
আনু মুহাম্মদ: অর্থনীতিবিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক
উৎসঃ প্রথমআলো
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন