একের পর এক শিক্ষকরা অনশন করছেন। প্রথমে বহুবার প্রতিশ্রুতিভঙ্গের শিকার বিনা বেতনের শিক্ষকরা কয়েক বছরের আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় অনশন করেছেন। এত বছরের আন্দোলন, প্রচ- শীতে রাস্তায় রাতের পর রাত অভুক্ত কাটিয়ে অবশেষে প্রধানমন্ত্রীর আশ^াসের ভিত্তিতে ঘর ও কর্মস্থলে ফিরেছেন। এর পর ইবতেদায়ি মাদ্রাসার শিক্ষকরা প্রতিষ্ঠানের জাতীয়করণের দাবিতে প্রথমে অবস্থান ও পরে অনশন কর্মসূচিতে যোগ দিয়েছেন। এখনো প্রচ- শীতের মধ্যে নারী-পুরুষ শিক্ষকরা অনশন করছেন, সরকারের দিক থেকে কোনো সাড়াশব্দ নেই। সবশেষে যোগ দিচ্ছেন এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা। তাদেরও দাবি প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করতে হবে।
সরকারের লোকজন বলছেন, এত দাবি সরকার কী করে মানবে? না, এগুলো এত দাবি নয়। এগুলো দেশের সরকারের পর সরকারের ভুল নীতি আর প্রতিশ্রুতিভঙ্গের প্রতিক্রিয়া। শিক্ষাব্যবস্থাকে নিয়ে খেলা, বাণিজ্য আর রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করার কারণে যে নৈরাজ্য, বৈষম্য আর অসঙ্গতির সৃষ্টি হয়েছে তার ফলে শিক্ষার্থী তথা পুরো দেশই বিপদগ্রস্ত। একই কারণে বারবার আশু সমস্যা মেটাতে শিক্ষকদের আন্দোলনে নামতে হচ্ছে, নির্যাতন সহ্য করতে হচ্ছে। আবার আশ^াস পেয়ে ফিরতে হচ্ছে। কিন্তু সমস্যার স্থায়ী সমাধান হচ্ছে না।
২
ইবতেদায়ি মাদ্রাসার শিক্ষকদের অনশন দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়ে শিক্ষা গবেষক রাখাল রাহা গত ৯ জানুয়ারি লিখেছেন, ‘এবার যে প্রায় ৩০ লাখ ছেলেমেয়ে প্রাথমিক সমাপনী নামক পরীক্ষা-তামাশায় বসেছিল তার মধ্যে ইবতেদায়ি মাদ্রাসার (কওমি ধারার নয়) শিক্ষার্থী ছিল প্রায় ৩ লাখ। যেভাবে ১৯৭৪ সালে সব প্রাথমিক বিদ্যালয় (প্রায় ৩৫ হাজার) জাতীয়করণ করার পর থেকে নিবন্ধনকৃত বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় বেড়ে বেড়ে ২০১০ সালের মধ্যে প্রায় ২০ হাজার ছাড়িয়ে গিয়েছিল, সেভাবেই স্বতন্ত্র মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড প্রতিষ্ঠার পর নিবন্ধনকৃত ইবতেদায়ি মাদ্রাসার সংখ্যাও ১৯৯০ সালের পর থেকে বেড়ে চলেছিল। ইবতেদায়ি মাদ্রাসাগুলোও সরকারের প্রণীত পাঠ্যবই-ই পড়িয়ে থাকে এবং সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর মতোই পাঠদান ও পরীক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করে।
‘সরকারের শিক্ষা কর্তৃপক্ষ ও মাদ্রাসা বোর্ডের হিসাবে এ ধরনের মাদ্রাসার সংখ্যা এখন প্রায় ৭ হাজার। বলা যায়, প্রতি মাদ্রাসায় গড়ে প্রায় ৩শ জন করে শিক্ষার্থী আছে। সে হিসাবে এই ৭ হাজার মাদ্রাসায় প্রায় ২০-২১ লাখ শিক্ষার্থী আছে। এর বাইরেও নিবন্ধন না পাওয়া ইবতেদায়ি মাদ্রাসা রয়েছে কয়েক হাজার। তাই বলা যায়, প্রাথমিক স্তরের ইবতেদায়ি মাদ্রাসায় প্রায় ২৫ লাখের অধিক ছেলেমেয়ে পড়াশোনা করে।
‘জানা যাচ্ছে ১৯৯৪ সালে সরকার যে পরিপত্রে ৫০০ টাকা (!) করে নিবন্ধিত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন-ভাতা নির্ধারণ করেছিল, সেই পরিপত্রেই এসব ইবতেদায়ি মাদ্রাসার শিক্ষকদেরও বেতন-ভাতা ৫০০ টাকা করে নির্ধারণ করা হয়। এর পর এ ধরনের স্কুল ও মাদ্রাসার নিবন্ধন বেড়ে চলে এবং সরকারও শিক্ষকদের বেতন-ভাতা ৫শ টাকা থেকে বাড়াতে বাড়াতে ২০১২ সালের দিকে ২৫শ (!) টাকায় উন্নীত করে।
‘এর পর ২০১৩ সালে প্রায় ২২-২৩ হাজার নিবন্ধিত প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করা হলে সেই শিক্ষকদের বেতন এখন প্রায় ২৫ হাজার টাকায় পৌঁছে গেছে। কিন্তু মাদ্রাসাগুলোর শিক্ষকরা সেই ২৫শ টাকাতেই আছেন। তারাও সরকারের সর্বজনীন বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়ন করছেন, তারাও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মতোই শিক্ষাদানের বাইরেও সরকারের হুকুমে সব কাজ করছেন।
‘তা হলে তাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কেন জাতীয়করণ করা হবে না, এই দাবিতে গত ১ জানুয়ারি থেকে তারা প্রেসক্লাবের সামনে অবস্থান ধর্মঘট করে আসছিলেন। কিন্তু তাদের দাবি না মানায় শিক্ষকরা অনশন শুরু করেছেন।
‘অথচ এমন সংকট সৃষ্টি হওয়ার কথা ছিল না যদি আমাদের সরকারগুলো তার ঘোষিত সর্বজনীন বাধ্যতামূলক শিক্ষা আইন এবং জাতীয় শিক্ষাক্রম প্রণয়ন করার পর এটাকে সত্যিকার অর্থে গুরুত্ব দিত এবং তা বাস্তবায়নের জন্য সঠিক পরিকল্পনা ও প্রয়োজনীয় বরাদ্দ নিশ্চিত করত। ফলে সমস্যা যখন চক্রাকারে সবাইকে জড়িয়ে ফেলছে তখন আমরা এ-ওকে দোষ দিয়ে রেহাই পেতে চাচ্ছি।
‘এখন আমরা কেউ কাউকে রেহাই দেব না। যারা এই চক্রের চালক ও নিয়ন্তা ছিলেন, সেই সরকার ও প্রশাসন, তাদেরই সিদ্ধান্ত নিতে হবে এই রেকর্ড শীতের রাতে যারা সন্তান-পরিজন ফেলে রাস্তায় খোলা আকাশের নিচে রাত্রযাপন করছেন, অসুস্থ হচ্ছেন তাদের বিষয়ে তারা কী করবেন।’
৩
আপাতদৃষ্টিতে নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলা দেখা গেলেও মনোযোগ দিলে বাংলাদেশের সমাজ অর্থনীতির মতো শিক্ষা খাতেও আমরা তাই পাই শৃঙ্খলা ও ধারাবাহিকতা। এই শৃঙ্খলা ও ধারাবাহিকতার মধ্যে আমরা পাই একটি বিশেষ ধরন। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য দিকগুলো হলোÑ ১. সব পর্যায়ে শিক্ষা অর্জনের জন্য ব্যয়ের ক্রমান্বয় বৃদ্ধি। ২. সরকারি ও সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত কম ব্যয়বহুল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অবকাঠামোগত দুরবস্থা বৃদ্ধি। ৩. বহু প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের বেতন নিয়ে নৈরাজ্য। ৪. বহু প্রতিষ্ঠানে অশিক্ষক ক্ষমতাবানদের হস্তক্ষেপ বৃদ্ধি। ৫. শিক্ষকতা পেশায় নিয়োগে কমিশন বাণিজ্য বিস্তার। ৬. কম্পিউটারের সংখ্যা বাড়লেও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গ্রন্থাগার ও গবেষণাগারের ক্রমান্বয়ে প্রান্তিক অবস্থা প্রাপ্তি। ৭. প্রায় সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভেতরে ও আশপাশে কোচিং ও টিউশনির প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ। ৮. স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, মাদ্রাসা সব ক্ষেত্রেই ইংরেজি মাধ্যম উচ্চ ব্যয়বহুল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বৃদ্ধি। ৯. প্রশ্নপত্র ফাঁস, গাইডবই, কোচিং সেন্টার, শিক্ষক নিয়োগ ইত্যাদি বাণিজ্যিক তৎপরতার আধিপত্য বৃদ্ধি। ১০. স্বীকৃতি, এমপিও, জাতীয়করণ ইত্যাদিকে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা বা সুবিধার অধীন করা। লবিং, গায়ের জোর, সুবিধা অনুযায়ী সিদ্ধান্ত। ১১. শিক্ষকদের অধিকারকে দয়াদাক্ষিণ্য ও করুণা হিসেবে উপস্থাপন।
মূল সমস্যা হলো রাষ্ট্র/সরকার/নীতিনির্ধারকরা শিক্ষা খাতকে সর্বজনের জন্য সুলভ, বিকশিত, অভিন্ন মানসম্পন্ন করার কাজকে তার দায়িত্ব হিসেবে স্বীকার করে না। রাষ্ট্রীয় নীতি হলো বহু দেশে স্বীকৃত এই দায়িত্ব থেকে দূরে সরে যাওয়া। ফলে একটি অভিন্ন মানসম্পন্ন শিক্ষার প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর বদলে গড়ে উঠেছে বহু ধারা ও নৈরাজ্য। এ রকম রাষ্ট্রীয় নীতি-দর্শন অব্যাহত থাকায় তা ডালপালায় প্রস্ফুটিত হয়ে বর্তমান আকারে হাজির হয়েছে।
বাংলাদেশের শিক্ষার এই গতিমুখ লাভের ঘটনাটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে ঘটেনি। ‘সংস্কার’ ‘উন্নয়ন’ নামের নানামুখী কর্মসূচি বাস্তবায়নের সচেতন সংগঠিত উদ্যোগের ফল হিসেবে বর্তমান চেহারা তৈরি হয়েছে। এগুলো সবই হয়েছে দেশ-বিদেশের বহু অর্থ ব্যয়ে, বহু বিশেষজ্ঞ পরামর্শ নিয়ে। বিশ্বব্যাংকের দেড় হাজার কোটি টাকার পাট খাত উন্নয়ন কর্মসূচি দিয়ে বন্ধ করা হয়েছে আদমজী পাটকল। শিক্ষা খাতেও এ রকম অনেক কর্মসূচি চলছে কয়েক হাজার কোটি টাকার, বিশ্বব্যাংক আছে, আছে এডিবি।
এই উন্নয়ন দর্শনের সারকথা হলো সর্বজন প্রতিষ্ঠান, সর্বজন সম্পত্তি দ্রুত ব্যক্তিমালিকানাধীন সম্পত্তি ও বাণিজ্যিক মুনাফাকেন্দ্রিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা। এই দর্শন এটাই নিশ্চিত করতে চায় যে, সর্বজনের সম্পদে সর্বজনের অধিকার থাকবে না, তাদের কাজে লাগবে না, সেগুলো ব্যবহৃত হবে কতিপয় ব্যক্তির মুনাফার পাহাড় তৈরিতে। সর্বজন সম্পত্তি যেমন নদীনালা, খাল-বিল, জলাশয়, খোলা মাঠ ব্যক্তির দখলে যাওয়া, বনজঙ্গল, তেল-গ্যাস খনিজসম্পদ ও বিদ্যুতের ওপর বহুজাতিক পুঁজির মালিকানা, দেশি-বিদেশি মুনাফাকেন্দ্রিক প্রতিষ্ঠানের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হওয়া, পরিকল্পিতভাবে সর্বজন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও হাসপাতালের পঙ্গু অবস্থার সৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে বাণিজ্যিক খাত হিসেবে শিক্ষা ও চিকিৎসার বিস্তার ইত্যাদি ধারাবাহিক উন্নয়ন দর্শন ও রাজনীতিরই অবদান।
শিক্ষা ও চিকিৎসাকে ক্রমে বাণিজ্য ও মুনাফার উপাদানে পরিণত করার নীতি ও দর্শনের প্রভাব আরও অনেক বিষময় প্রবণতা তৈরি করেছে। বাণিজ্য, মুনাফা বা টাকার উন্মাদনা সমাজের সুবিধাভোগী অন্যান্য অংশের মতো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও ব্যাপক আকার ধারণ করেছে, টাকা কামানোর সব রকম তৎপরতা দিনে দিনে অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠছে। শিক্ষকদের বাণিজ্যিক প্রবণতা থেকে টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, নিয়োগ-বাণিজ্য, পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস পর্যন্ত এটি বিস্তৃত।
অথচ শিক্ষকদের নিয়মিত বেতন আর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্বাভাবিক বিকাশের পথ কণ্টকাকীর্ণই থাকছে। এখনো হয়তো শিক্ষকরা বিভিন্ন প্রতিশ্রুতি পেয়ে ফেরত যাবেন, আশু দাবি মাঝে মধ্যে আংশিক পূরণও হবে। কিন্তু সমস্যার গোড়া যতদিন থেকে যাবে ততদিন শিক্ষকের এই আগমন, অবস্থান, অনশন চলতেই থাকবে।
য় আনু মুহাম্মদ : অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
উৎসঃ আমাদের সময়
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন