বাজেট পাসের এই ধরন আমাদের পরিচিত। প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভায় গৃহীত বাজেট নিয়ে জাতীয় সংসদে সাংসদেরা তুলাধোনা করেছেন অর্থমন্ত্রীকে। তাঁদের কথা শুনে মনে হয়েছে, বাজেট অর্থমন্ত্রীর একক বিষয়, সরকারের কোনো দায়িত্ব নেই। শেষে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী কয়েকটি সংশোধনের প্রস্তাব করেছেন, এরপর সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়েছে বাজেট। কিন্তু সংসদের ভেতরে ও বাইরে উত্থাপিত বেশ কিছু প্রশ্ন অমীমাংসিত থেকে গেল, থেকে যাওয়ারই কথা। কেন রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলো এত লুণ্ঠনের শিকার হলেও তার মীমাংসা না করে জনগণের টাকা থেকে সেখানে ভর্তুকি দেওয়া হয়? কেন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাধর ব্যক্তিরাই সবচেয়ে বড় ঋণখেলাপি? বাংলাদেশ ব্যাংক ফুটো করে চুরি, শেয়ারবাজার ধস নিয়ে তদন্ত কমিটির রিপোর্ট সরকার কেন জনগণের সামনে প্রকাশ করে না? কেন বাংলাদেশের নির্মাণ ব্যয় পৃথিবীতে সর্বোচ্চ, কেন ভারত-চীনের তুলনায় ১০ গুণ পর্যন্ত বেশি? (উল্লেখ্য, গত ২৫ মে ভারতে দক্ষিণ এশিয়ার দীর্ঘতম সেতু উদ্বোধন হয়েছে, যার খরচ পড়েছে সব মিলিয়ে ২ হাজার ৫৬ কোটি রুপি!) বছরে বছরে গার্মেন্টস শ্রমিক আর প্রবাসী শ্রমিকদের আয় থেকে লাখ লাখ কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়, তার খবর আন্তর্জাতিক নানা প্রতিষ্ঠান প্রকাশ করলেও আমাদের রাজস্ব বোর্ড, অর্থ মন্ত্রণালয়, দুদক—সবাই কেন গভীর নীরবতায় বসে থাকে? কেন কাণ্ডজ্ঞান, জ্ঞান ও বিজ্ঞান—সবকিছুকে অস্বীকার করে রামপাল-রূপপুরের মতো দেশধ্বংসী প্রকল্প নিতেই হবে?
একজন ব্যক্তিবিশেষকে দোষ দিয়ে লাভ কী, যিনি এরশাদ থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত ‘নীতিনিষ্ঠভাবে’ দেশি-বিদেশি কর্তাব্যক্তিদের দেওয়া দায়িত্ব পালন করে গেছেন? হাজার লাখ কোটি টাকা সরাবেন ক্ষমতাবানেরা, তা পূরণ করতে হলে মানুষের পকেটে তো হাত দিতেই হবে। আজ ব্যাংক লুট থেকে শুরু করে নানা প্রকল্পের ব্যয়ে বিশ্ব রেকর্ড নিয়ে অর্থমন্ত্রীর তাই একক কোনো ‘কৃতিত্ব’ নেই। গত তিন দশকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ক্ষমতায় স্বেচ্ছাচারিতা ও কর্তৃত্ববাদিতার বিকাশ, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির সব প্রতিষ্ঠানের ধস কিছু লোকের সামনে দ্রুত ধনী ও সুপার ধনী হওয়ার সুযোগ অবারিত করেছে। তবে এর জন্য সরকারি ক্ষমতার সঙ্গে লেনদেন ও বোঝাপড়া সব সময়ই অত্যাবশ্যকীয় শর্ত।
কেন বাংলাদেশে সেতু, সড়ক, ফ্লাইওভার বানাতে চীন, ভারত এমনকি যুক্তরাষ্ট্র থেকে বেশি খরচ পড়ছে, যেখানে শ্রমশক্তিসহ প্রায় সব নির্মাণসামগ্রীর দামই বাংলাদেশে অনেক কম? এটা পড়ে এই কারণে যে ‘ওপরের মহল’কে সন্তুষ্ট করে অবিশ্বাস্য মাত্রায় বাজেট বারবার বাড়াতে থাকলেও তা নিয়ে কোনো তদারকি, প্রশ্ন উত্থাপন বা এর সংশোধনের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়া আর দেশে অবশিষ্ট নেই। দেশ থেকে সুইস ব্যাংকসহ নানা স্থানে লাখ কোটি টাকা পাচারও তাই অনিবার্য। এত সব মেগা ব্যয় মেগা চুরি মেগা পাচারের অর্থ জোগান দেবে কে? সাধারণ মানুষ ছাড়া দাতা আর কে আছে? বড় বড় ঋণ আসবে, শোধ করবে কে? এই পাবলিকই তো।
এটা তো একটা-দুটো ঘটনা বা ব্যক্তির বিষয় নয়। মূল নকশাতেই তো গন্ডগোল। একটা উদাহরণ দিই। প্রতিদিনের ভোগান্তি আর দিনে দিনে নতুন নতুন ভোগান্তি যোগ হওয়ার কারণে কত দিন ধরে এই অবস্থা চলছে, তা মনেও করতে পারি না। মৌচাক–মগবাজারে যে ফ্লাইওভার নির্মাণকাজের জন্য আরও অনেকের মতো আমিও ভোগান্তির শিকার, তার কথা বলছি। বছর বছর ভোগান্তির পর অবিশ্বাস্য তথ্যটি জানা গেল যে অসংখ্য মানুষকে দিনরাত নরকযন্ত্রণা দিয়ে যার নির্মাণ, তার নকশাতেই ভুল ছিল। ফ্লাইওভারে যে নকশা করা হয়েছিল, তা বাঁহাতি হিসেবে। মানে ওঠানামাসহ পুরোই উল্টো নকশা!
যখন এই বিষয়টি প্রকাশ হয়ে পড়ল, তখন সরকার এই ভুল সংশোধনসহ নানা কারণ দেখিয়ে আরও কয়েক শ কোটি টাকা বরাদ্দ করল। না, এর জন্য কাউকে দায়ী করা বা কাউকে শাস্তি বা জরিমানা করার কোনো খবর পাওয়া যায়নি। ভুল নকশা, ভুল নির্মাণের কী পরিণতি হয়, তার একটি ভয়ংকর উদাহরণ রানা প্লাজা। আরও অসংখ্য ছোট-বড় দৃষ্টান্ত তৈরি হচ্ছে, সেতু, সড়ক, ভবনে। পদ্মা সেতু নিয়ে অনেক উচ্ছ্বাস শোনা গেলেও দেশের বিভিন্ন প্রান্তে শত শত সেতু যে হয় ভাঙা, না হয় অকার্যকর, না হয় অসমাপ্ত হয়ে পড়ে আছে, তা নিয়ে আলোচনা খুব কম। রেল যোগাযোগের সহজ পথের বিস্তার না ঘটলেও চার লেন, আট লেন নিয়ে মেগা প্রকল্প আসছে তো আসছেই। কিন্তু দেশের প্রায় সব প্রান্তে রাস্তা চলাচলের অযোগ্য। খোদ ঢাকা মহানগরীতে কয়টা রাস্তায় ঠিকভাবে চলা যায়? ভেতরের অলিগলি তো দশকের পর দশক একই ভাঙাচোরা অবস্থা। কোথায় কমিশনার, কোথায় মেয়র, কোথায় উন্নয়ন? হয়তো ট্রানজিট রুটই কেবল গুরুত্ব পাওয়ার যোগ্য, অন্য কোনোটিই নয়।
বাংলাদেশে যেভাবে স্বেচ্ছাচারীভাবে দুর্নীতিকে নিয়ম বানিয়ে বিভিন্ন নির্মাণকাজ হচ্ছে, তাতে শুধু ভবন-সেতু ধসই দেখব না আমরা, ভবিষ্যতে হয়তো এগুলোর অনেকগুলো ভেঙেও ফেলতে দেখব। ভুল নকশার পরিণতি তা-ই। শুধু একটি-দুটি ফ্লাইওভার, ভবন বা সেতু
নয়, মূল উন্নয়ন যাত্রাপথই যদি ভুল নকশায় মোড়ানো, বিপজ্জনক এবং দুর্নীতি-অপচয়ে ভরা থাকে, ভুল যদি দেশের পুরো উন্নয়নের নকশাকেই গ্রাস করে, তাহলে এর ভার এই দেশ কীভাবে বহন করবে?
উন্নয়ন নকশায় ভুল থাকলে শুধু বরাদ্দ দিয়ে যে প্রকৃত বিকাশ ঘটে না, তার বড় দৃষ্টান্ত শিক্ষা ও চিকিৎসা খাত। বাংলাদেশের সর্বজন বা পাবলিক শিক্ষা ও চিকিৎসাব্যবস্থার উন্নতি করতে হলে বরাদ্দ বৃদ্ধির চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো মূল নকশা পরিবর্তনের কিছু নীতিগত সিদ্ধান্ত। প্রধান বিষয় হলো, বিশ্বে যে দেশগুলো উন্নত বলে বিবেচিত, সেসব দেশে শিক্ষা ও চিকিত্সা খাতে রাষ্ট্রই দায়িত্ব গ্রহণ করে। শিশুকাল থেকে শিক্ষার বারোটা বাজিয়ে তা নিয়ে বাণিজ্যের এ রকম রমরমা চেহারা কোনো সভ্য দেশে থাকার কথা নয়। একই বিষয় চিকিৎসা খাত নিয়েও। স্বজনের জীবন-মরণ নিয়ে মানুষ যেহেতু পীড়িত থাকে সবচেয়ে বেশি, সেহেতু তার সুযোগ নিয়েই সারা দেশ ভরে গেছে চিকিৎসা বণিকে, অন্যদিকে সর্বজনের চিকিৎসাব্যবস্থার হাল দিন থেকে দিনে আরও নড়বড়ে হচ্ছে।
দেশ স্বাধীন হলো প্রায় ৪৬ বছর, দেশে কত জিডিপি, ভবন, গাড়ি, চাকচিক্য! আন্তর্জাতিক মানের বিমানবন্দর, হোটেল, শপিং মল বানানোতে উত্তেজনার শেষ নেই, কিন্তু একটা পাবলিক হাসপাতাল হয় না, যাকে দেশের কর্তাব্যক্তিরা চিকিৎসা নেওয়ার যোগ্য ভাবতে পারেন। প্রকৃতপক্ষে যখন এই নীতি নিশ্চিত হবে যে দেশের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, এমপি, আমলাদের চিকিৎসা অবশ্যই হবে দেশের সর্বজন বা পাবলিক হাসপাতালে, তখনই কেবল পরিস্থিতির বদল ঘটতে পারে। নকশা হতে হবে এমন যে দেশের মানুষের করের টাকা ব্যয় হবে দেশের চিকিৎসাব্যবস্থার উন্নতি ঘটাতে, বিদেশে বা দেশের বাণিজ্যিক হাসপাতালে ভিআইপিদের চেকআপ বা চিকিৎসায় সর্বজনের টাকার এক আনাও খরচ করা যাবে না। শিক্ষার জন্যও এ রকম নীতি থাকতে হবে যে রাষ্ট্রীয় দায়িত্বে নিয়োজিত, জনগণের টাকায় প্রতিপালিত ব্যক্তিদের সন্তানেরা অবশ্যই পাবলিক বা সর্বজন শিক্ষা গ্রহণ করবে। অর্থাৎ রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, এমপি, সামরিক-বেসামরিক আমলাসহ বিভিন্ন পেশাজীবী ব্যক্তিরা তাঁদের সন্তানদের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে সর্বজন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতে বাধ্য থাকবেন।
প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের বর্তমান ‘উন্নয়ন’–এর ধরন চোরাই পথে মূলধন সংবর্ধনের একটি মডেল। এই ধরনই ক্রমবর্ধমান হারে অর্থ পাচার এবং শিক্ষা, চিকিত্সাসহ জাতীয় ক্ষয় অনিবার্য করে তুলছে। যাঁরা সংবর্ধন ও পাচার করছেন, তাঁরা ক্ষমতাবান; যেখানে তাঁদের ভবিষ্যৎ, সেখানে তাঁরা এই চোরাই টাকা পাঠিয়ে দিচ্ছেন। এই দেশ তাঁদের টাকা বানানোর জায়গা, জীবনযাপন বা ভবিষ্যৎ অন্যত্র। অর্থনৈতিক তৎপরতায় ব্যাংক লুট (ঋণখেলাপি, জালিয়াতি) করে হাজার হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ, শেয়ারবাজারে প্রতারণা ও প্রভাব বিস্তার, জমি-বন-পাহাড়-নদী-জলাশয় দখল, রাষ্ট্রীয় বৃহৎ প্রকল্পে কমপক্ষে শতকরা ২০০ বা ৩০০ ভাগ বেশি ব্যয়, বিদেশি ঋণে ভোগবিলাসিতা, ক্ষমতা ও মুনাফার স্বার্থে দেশের জন্য রামপাল-রূপপুরসহ সর্বনাশা চুক্তি স্বাক্ষর—এগুলো সবই বর্তমান ভুল উন্নয়ন নকশার অবিচ্ছেদ্য অংশ। ঢাকঢোল পিটিয়ে, বিজ্ঞাপনী প্রচারণা দিয়ে যতই এগুলোকে উন্নয়ন হিসেবে দেখানো হোক না কেন, দীর্ঘ মেয়াদে বাংলাদেশকে তা মহাবিপদের দিকে নিয়ে যেতে পারে।
আনু মুহাম্মদ: অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
উৎসঃ প্রথমআলো
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন